রুটের নির্ধারিত বাসটা ফেইল করার পর একটা রিকশা বা সিএনজির জন্য অনেকক্ষণ অধীর নয়নে তাকিয়েছিল সে। কিন্তু উপরের নীল আকাশটার মতই শহরটাও মনে হয় স্নান সারার পর গা’টা মুছে নিতে চাইছিল নিরালায়-নিভৃতে – কোথাও কেউ নেই!
উপায়ন্তর না দেখে উবার কল করতে লাগল সে; কাল থেকে লম্বা ছুটি, তাই আজ অফিসটা না ধরলেই নয়! আশ্চর্য, একটা ইয়োলো ক্যাবও খালি নেই! আর যে ক’’বারই ঢুকল সে অ্যাপটাতে, প্রতিবারই একটা মোটর বাইক এসে দাঁড়াল সামনে। ঘড়ির দিকে বার কয়েক চেয়ে শেষমেষ সে কাজটিই করে বসল লুবনা, যা আগে কখনোই করেনি।
মাঝারি আকারের ব্যাগটি যা বুকে ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, তাকেই আরো শক্ত করে চেপে ধরে যখন উঠে পড়ল বাইকটিতে, বাইকার বলে উঠল, ‘একটু ধরে বসবেন, ম্যাডাম।‘
আকাশের ভেজা তোয়ালেটা থেকে তখনো বিরতি দিয়ে দিয়ে যে জলের মুক্তো গড়িয়ে পড়ছিল, তাকে অযুত-নিযুত কণায় ভেঙে দিয়ে হাওয়ার বেগে উড়তে শুরু করল বাইকটা!
ছেলেটা হেলমেট ছাড়া ছিল। সিগারেটের গন্ধ ভুসভুস করে বেরুচ্ছিল। সঙ্গে ছিল ঘামের গন্ধ! নির্ঘাৎ গোসল করেনি কয়েকদিন! বমি পেয়ে গেল লুবনার। কি করে পারে ছেলেগুলি! সুস্থ-সভ্য কোন নিয়ম নেই এদের অভিধানে!
‘একটু সামনের দিকে চেপে বসতে হবে, ম্যাডাম!’ বাইকারের আচমকা আহবানে হুঁশ ফিরে এল লুবনার, আর দেখতে পেল, সামনের থেমে থাকা শহরটার সাথে সাথে তাকে বহনকারী যানটা হঠাৎ মেঘের ভেলার মত ধীরে বইতে শুরু করেছে! আরও অনেকগুলো বাইক ছিল তাদের সামনে-পেছনে। শরতের আকাশের মত লুকোচুরি খেলে জাম ঠেলে এগুনোর এক আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে বাইকগুলোর!
এদিকে অনেকক্ষণ ধরেই অন্য রকম গন্ধ একটু একটু করে টোকা দিচ্ছিল লুবনার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে! ছোটবেলায় বাড়ির সব কাজ সেরে মা যখন স্নান সেরে নতুন কাপড় পরে বেরুত, তখন এরকম একটা ঘ্রাণ বয়ে যেত ঘর জুড়ে! ঘ্রাণটাকে শক্তি যোগাতেই কিনা, কয়েকটা ফুলের দোকান সহসাই এসে দাঁড়াল সামনে। লুবনার খুব মন চাইল শিউলি আর বকুল ফুলের দুই জোড়া মালা বাসায় নিয়ে যেতে। কিন্তু বাইকটা আগের থেকেও বেগে পাল উড়াচ্ছিল।
অফিস থেকে অর্ধেকটা পথ দূরে লুবনারা আরেকটি ক্রসিংয়ের মুখে চলে এল। কিন্তু একটা সিএনজি এক পা বাড়িয়ে দিয়ে দিব্যি বসে ছিল বাইকের লেইনে। ফলে লুবনাদের বাইকের সাথে আটকে পড়ল পেছনের আরো অনেক বাইক। অচিরেই শুরু হয়ে গেল হাঙ্গামা, অশ্রাব্য সব খিস্তি খেউর! কিন্তু এত কিছুর মাঝেও উপরের আকাশটার মত নির্বিকার ছিল লুবনার বাইকার; মাথাটা নীচু করে এক মনে সে বাইকের ধাতব শরীরটা মুছে যাচ্ছিল একটি রুমাল জড়িয়ে। ছেলেটির নাম, কি করে, কোথায় থাকে ইত্যাদি জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল লুবনার।
কিন্তু আচমকাই সিগনালটা ছেড়ে দিল, আর পেছনে না তাকিয়েই ‘ম্যাডাম, শক্ত করে …’ বলেই ফের ছুট লাগাল বাইকটা। একটা সময় কাত হয়ে যাওয়া বাইকটার সাথে তাল মেলাতে না পেরে লুবনার শরীরটা প্রায় লেগে যেতে চাইল বাইকারের পিঠে। আর ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গেই ক্লাচ চেপে জিজ্ঞাসা করল, ‘ব্যথা পান নাই তো? রাস্তাটা বাজে!‘
লুবনার মুখখানা তখন পুরো সেলাই হয়ে আছে সংকোচে! আর এই সংকোচটা ছোট থেকেই ছিল লুবনার। যখন প্রাইমারিতে পড়ত, তখন থেকেই ছেলেদের সহ্য করতে পারত না সে! আর এজন্যই কিনা স্কুলের প্রেমের অফারের মত ফিরিয়ে দিয়েছে অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব!
বাইকটা ইতিমধ্যে একটা মসৃণ রাস্তা পেয়ে আবার বেগ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিছুই চোখে পড়ছিল না লুবনার। মনে হচ্ছিল, সে মেঘের ডানায় উড়ে চলেছে, আর এ পথের বুঝি কোন শেষ নেই! মুঁদে আসা চোখজোড়া অবশ্য এক সময় কপাট খুলতে বাধ্য হল ব্রেক কষার তীব্র নিনাদে - শেষবারের মত একটা ক্রসিংয়ের মুখোমুখি তারা। আর একটা মোটরবিহীন মানবচালিত ভ্যানের আক্রমণে বাইকটা এতটা হেলে পড়ল যে লুবনা আর একটু হলেই ছিটকে পড়ছিল ফুটপাতের ধারে!
এলোমেলো জামাকাপড় আর চুলগুলো যখন ঠিক করছিল লুবনা, বাইকটা থামিয়ে কাঁচুমাঁচু ভংগিতে হাত দুটো জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করে যাচ্ছিল ছেলেটি।
এরপর ‘আমায় অফিসে পৌঁছে দিতে পারবেন রোজ?’ বাইকারের হাতে ভাড়ার সাথে একটি ভিজিটিং কার্ড তুলে দিয়ে উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাঁটতে শুরু করেছিল লুবনা। পথ তখন সামান্যই বাকী ছিল।
শরতের সেই মাদকীয় গন্ধটা ইতিমধ্যে আরো শক্তি সঞ্চয় করে শুষে নিয়েছিল ঘাম ও নিকোটিনের সব গন্ধ, আর দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছিল বিশ্বচরাচরে!
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।