রসা রোডের শান্তনু সেনের বাড়ীতে সেদিন আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছিল । এবাড়ীতে এমন আড্ডা প্রায়ই হয় । শান্তনু সেন দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন । অনেকদিন হল অবসর নিয়েছেন । বহুদিন থেকেই এবাড়ীতে আড্ডার রেওয়াজ ছিল কিন্তু পৌনঃপুনিকতার হার এত বেশি ছিল না । অবসরের পর এখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই হয় । শান্তনু সেনের পুরানো বন্ধুরা দূরে দূরে ছড়িয়ে গেছে ; সুতরাং তাদের উপস্থিতি বিরল হয়ে উঠেছে আজকাল । অধুনা নতুন বন্ধু ও আগন্তুকরা আসে এবাড়ীতে । শান্তনু সেন স্বল্পভাষী , বন্ধু বৎসল ও জনপ্রিয় । স্ত্রী সোমা সেন প্রিয়ভাষিনী , অথিতি আপ্যায়নে পারদর্শিনী । সেন দম্পতির আবাসের পরিবেশ মনোরম, বন্ধু হোক বা নবাগত হোক এখানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে । অবশ্য এমন কথা শপথ করে বলা যাবে না যে, এই জনপ্রিয়তার জন্য অপরিমিত চা,কফি ও মুখরোচক জলযোগের কোনো অবদান আছে কিনা ।
কবে কোন আড্ডা যে কেমন হবে তা বলা যায় না । কোন দিন শুধু গান বাজনা , শান্ত শিস্ট সুন্দর খুশী-খুশী আবহাওয়া ; কোন দিন তুমুল তর্ক বিতর্ক , একই বিষয়ে নিজ নিজ মতবাদ জানাতে উৎসুক সকলে । তারস্বরে ভরে যায় ঘর বাড়ী ।
সন্ধ্যায় একে একে নীরেন, কান্তি , বোস দম্পতি মানব ও অদিতি এসে আসর জমিয়ে বসেছে । সকলে সেদিন তাদের জীবনে ভয় ও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার গল্প করছিল । হঠাত ডাঃ তরুণ তরফদারের আবির্ভাব । বলল ‘কাছাকাছি এসেছিলাম, ভাবলাম সোমাদির হাতে এক কাপ চা খেয়ে যাই একবার ।‘ ঘরে অপ্রত্যাশিত এত মানুষ দেখে একটু অবাক হল । শাতনু সকলের সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিলেন । সোফায় আরাম করে বসল ডাঃ তরুণ তরফদার । সোমা চা আর গরম কচুরি ও ভেজিটেবল চপ এনে সামনে রাখল ।
ডাঃ তরুন তরফদার অত্যন্ত মিশুকে মানুষ । শহরে বন্ধু সংখ্যার সীমা নেই । সকলেই ওর বন্ধু । Dr Tarun Tarafdar ওর বন্ধুদের কাছে টি টি । ওই নামেই ও পরিচিত ; অনেকে ওর আসল নামই জানে না । টি টি ডাক্তারি পেশা থেকে অবসর নিয়েছে । এখন ভ্রমণ , পরোপকার আর চিত্তবিনোদন করেই সময় কাটে । আড্ডা দিতে ভালবাসে , ভাল আড্ডা হলে সময় জ্ঞান থাকে না । কথা বলতে ভালবাসে , হয়তো একটু বেশীই ভালবাসে । একবার কথা শুরু করলে অন্যকারো সুযোগ হয় না আর । টি টি ভেবেছিল চা শেষ করে একটু বসেই উঠে পড়বে। শান্তনু বলল , ‘ আরে আরে উঠছ কি ? আড্ডাটা জমেছে ভাল । বসে যাও ।‘ টি টি সোফা থেকে উঠেই আবার বসে পড়ল । মনে হল ও শান্তনুদার অনুরোধের অপেক্ষায় ছিল । শান্তনুদাকে ও ভালভাবে চেনে ; জানত শান্তনুদা ওকে কিছুতেই যেতে দেবে না ।
টি টি আসার আগে মানব একটা গল্প বলছিল । টি টি-র আগমনে সে গল্পে ছেদ পড়েছিল । কান্তি বলল , ‘মানব, এবার তোমার গল্পটা শেষ করো ।‘ মানব গল্পের সূত্র ধরল আবার । ‘শেষই হয়ে গেছে প্রায় । … তখন আর আমার কিছু করার ছিল না । দেহটা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে , বিভৎস । মহিলা স্বামীর দেহের উপর আছাড় খেয়ে পড়ল ।‘ মানব গল্প শেষ করল । সকলে চুপ , কারো মুখে কথা নেই । নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে শান্তনু টি টি -কে লক্ষ্য করে বললেন , এবার তুমি একটা গল্প বল । ‘ সোমাদি , আর এক কাপ চা হবে কি?’ টি টি-র গলায় আব্দারের সুর ।
চায়ে চুমুক দিয়ে টি টি পাইপ বার করল । তাতে তামাক ভরে অগ্নি সংযোগ করল টি টি । সকলে ফিস ফাস কথা থামিয়ে চুপ হয়ে বসল । এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে টি টি শুরু করল ।
‘’ আমি তখন মেডিকাল কলেজ থেকে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে বেরিয়েছি । সে কালের বিখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সত্য মহাপাত্র পি জি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ডাঃ মহাপাত্রর অধীনে কাজ করার , তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করা । পি জি হাস্পাতালে কাজ করার একটা সুযোগ যখন এল তখন সেটা লুফে নিলাম । ডাঃ মহাপাত্রর বিভাগে জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে কাজ শুরু করলাম। তখন আমার বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ । আমার আশা, শিশুরোগের পীঠস্থান লন্ডনের গ্রেট অরমন্ড স্টীট হাসপাতালে কিছুদিন কাজ করে আরো অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশে ফিরে আসা । প্রায় বছর ঘুরে গেল । খুব মন দিয়ে কাজ করে ডাঃ মহাপাত্রর আস্থাভাজন হয়েছি । আস্তে আস্তে তিনি অনেক সঙ্কটজনক রোগীর ভার আমাকে দিতে আরম্ভ করলেন । একদিন আমাকে ডেকে বললেন , ‘টি টি , ৬ নম্বর বেডে একটি শিশু এসেছে । কেসটা খুব জটিল মনে হচ্চে । তুমি দেখ । আমি তো আছিই ।‘ আমি দেখাশুনা করতে শুরু করলাম । এক বছরের একটি বাচ্চা । বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে আর মাঝে মাঝে চীৎকার করে কেঁদে উঠছে । পাশে এক মহিলা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে । মহিলার বয়সবোধ হয় একুশ-বাইশ হবে । মুখটা বেশ মিস্টি, স্নিগ্ধ । মনে হল স্বাভাবিক উৎকন্ঠা ছাড়াও মনের মধ্যে যেন একটা ব্যাথা চেপে বসে আছে । সেই বেদনা ওর মুখেও ছড়িয়ে পড়েছে , ওকে মলিন করে রেখেছে । শিশুটি ওর প্রথম সন্তান । আমাকে দেখে মহিলা ব্যাকুল হয়ে বলল , ‘ ডাক্তারবাবু , আমার ছেলের কি হয়েছে ? ও বাঁচবে তো ? ওকে আপনি ভাল করে তুলুন ।‘ আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম , ‘ আপনি চিন্তা করবেন না । আমরা যথাসাধ্য করব ।‘ মহিলা তাড়াতাড়ি বলল , ‘ ডাক্তারবাবু, আপনি আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না । আমি আপনার থেকে অনেক ছোট । আমি জিগ্যেস করলাম , ‘তোমার নাম কি “ । উত্তর এল, ‘ আমার নাম উর্মিলা ।‘
ডাঃ মহাপাত্র প্রতিদিন শিশুটিকে দেখতে আসতেন । সবসময় সঙ্গে থাকতাম আমি । কোনো কোনোদিন একা একাই আসতাম । দেখতাম উর্মিলা ছেলের পাশে বসে আছে । সপ্তাহ দুই পরে শিশুটি বিপ্তজ্জনক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আরোগ্যলাভের দিকে যেতে লাগল । উর্মিলার মুখ থেকে উদ্বেগের ভাব অনেক কমে গেল । স্থির হল পরের সপ্তাহে শিশুটিকে বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে । খবরটা আমি উর্মিলাকে দিলাম । শুনে ও খুশী হয়েছে মনে হল । তারপর হঠাৎ ঢিপ করে প্রনাম করল আমাকে । আমি অপ্রস্তুত হয়ে এক পা পেছিয়ে এলাম । বললাম ,’ আরে, আরে , কর কি ?’ ওর চোখে মুখে কৃতজ্ঞতার ছাপ । বলল , ‘ডাক্তারবাবু আপনি আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছেন । আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব ।‘ আমি নির্বাক , কোনরকমে উচ্চারণ করলাম , ‘ না না ওসব বোলো না । আমরা শুধু আমাদের কর্তব্য করেছি ।‘ ও বলল , ‘ কথাটা বলতে আমার সঙ্কোচ হচ্ছে । আমার খুব ইচ্ছা আপনাকে আমি রান্না করে খাওয়াই । আপনি আসবেন আমার বাড়ীতে ?’ এমন অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব আমি আশা করিনি । একটু থেমে আমি বললাম ,’ হ্যাঁ , যাব । নিশ্চয় যাব । সামনের বুধবার সন্ধ্যেয় আমার কোন কাজ নেই । আমি সন্ধ্যেবালা আসব ।‘ ও বলল, ‘না, সন্ধ্যেবেলা না । রাত্রে আমি কাজ করি ।‘ আমি বললাম ,’ তাহলে সামনের রবিবার দুপুরে যাব ।‘ ও মাথা নেড়ে বলল ,’আচ্ছা, ঠিক আছে । রবিবার দুপুরে আপনাকে আশা করবো ।‘
রবিবার সকালে স্নান-টান করে জামা-কাপড় পরে আমি প্রস্তুত হলাম । দিনটা ভাল ছিল , আমার মেজাজটাও । একটা ভাল আদ্দির পাঞ্জাবী পরলাম , পরনে কালো পাড়ের তাঁতের ধুতি , পায়ে নতুন জুতো । গ্লোব নার্সারি থেকে এক তোড়া ফুল নিলাম । একটু এগিয়ে পুঁটিরাম থকে মিস্টি কিনলাম । আস্তে আস্তে উর্মিলার বাড়ীর দিকে হাঁটতে শুরু করলাম । উর্মিলার ঠিকানাটা দেখলাম । এ গলিটা আমি চিনি না । রাস্তার ধারে এক পান বিড়ির দোকানীকে জিগ্যেস করলাম ঠিকানাটা কোথায় । দোকানী আমাকে আপাদমস্তক দেখল , তারপর একটু মুচকি হেসে বলল , ‘ সামনের বাঁদিকের রাস্তা দিয়ে পাঁচ মিনিট হেঁটে ডান দিকে বেঁকলেই পাবেন আপনার গলি ।‘
আমি ওর কথা অনুযায়ী চলতে শুরু করলাম । ডান দিকের রাস্তার নাম দেখলাম , ‘ রাইচাঁদ বড়াল স্ট্রিট’ । আমি এ পাড়ার নাম শুনেছি । একটু এগিয়ে গেলেই ‘রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট’ ‘ লাল বাতি পাড়া’ । হঠাৎ আমার সব ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে উঠল । আমি কলকাতার উত্তর দক্ষিণ সব অঞ্চলেই ঘুরে বেড়াই , সর্বত্রই আমার বন্ধুবান্ধব, চেনাশোনা মানুষ চারিদিকে । কেমন যেন এক অজানা ভয় আঁকড়ে ধরল । যদি কোন বন্ধু বা চেনা জানা কেউ আমাকে এমন অবস্থায়, সৌখিন ধুতি-পাঞ্জাবী পরা, হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে , দেখে ফেলে । কি ভাববে তারা ? এখন বুঝছি কেন দোকানিটা মুচকি হেসেছিল ।
আমি কোন চিন্তা করলাম না । তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে উল্টোদিকে বড়্ররাস্তায় এসে উঠলাম । রাস্তার ধারে একটা ছোট ময়লার স্তুপের উপর ফুলের তোড়াটা ছুঁড়ে দিলাম । একটু এগিয়ে এক বৃ্দ্ধা ফুটপাথে চাদর পেতে বসে আছে । আমি মিস্টির বাক্সটা চাদরের উপর রেখে দিলাম । সভয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছি ; আদ্দির পাঞ্জাবী ঘামে ভিজে গেছে , দ্রুতবেগে নিশ্বাস পড়ছে । বাড়ী ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম ।
পরের দিন শরীর খারাপের অজুহাতে হাসপাতালে গেলাম না । শুধু মনে হচ্ছে উর্মিলার কাছে মুখ দেখাব কি করে ? দেখা হলে কি বলব ?
হাসপাতালে গিয়ে যথারীতি উর্মিলার ছেলেকে দেখতে গেলাম । উর্মিলা ছেলের বিছানার পাশে বসে আছে। আমাকে দেখে বলল,’ কই , সেদিন তো আমার বাড়ীতে এলেন না । আমি যত্ন করে কত রান্না-বান্না করলাম। ‘
একটু থামল । আমি কিছু বলার আগেই ও বলল ,’আমি জানতাম আপনি আসবেন না।‘
আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না । যেন এক প্রাগৈতিহাসিক দানব আমার গলা দুহাত দিয়ে চেপে ধরেছে। ‘’
টি টি থামলো । নিস্তব্ধ ঘর । পাইপটা নিভে গিয়েছিল। টি টি পাইপে অগ্নি সংযোগ করলো ।