বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করলেন বাংলাদেশের লেখক ইমতিয়াজ মাহমুদ।
লেখককে সশ্রদ্ধ নমস্কার!
(১) বাংলাদেশে কেবল ধর্মবিশ্বাসের কারণে হিন্দুদের সাথে নানারকম অন্যায় আচরণ করা হয়। এই সত্যটা মেহেরবানী করে অস্বীকার করবেন না। এটা অন্যায়। এটা অন্যায়। এটা অন্যায়। অন্যায় করছি আমরা।
রংপুরে হিন্দুদের একটা সংগঠন মহাসমাবেশ করেছে গতকাল শুক্রবার। এর আগেও ঢাকায় ও চট্টগ্রামে এইরকম সমাবেশ করেছে ওরা। অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলিতেও একইরকম সমাবেশ করার কথা বলেছে ওরা- ঢাকা চট্টগ্রামের পর রংপুর ছাড়া দেশের অন্য কোন শহরে এইরকম সমাবেশ করেছে কিনা জানিনা, করার কথা আছে। গতকালের রংপুরের সমাবেশ নিয়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত ওদের পছন্দমত জায়গায় প্রশাসন অনুমতি দেয়নি। সাধু ধরণের কিছু নেতাকে হোটেলে থাকতে দেয়নি। সমাবেশের আসার পথেও নাকি পদে পদে বাধা দেওয়া হয়েছে। এগুলি তো ঠিক কাজ নয়।
(২)
দেখেন, একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকজন কেবল ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক একটা সংগঠন করে রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করবে এটা আমার কাছে খুব পছন্দনীয় কাজ মনে হয় না। হিন্দুদের মন্দিরে হামলা হয়, ওদের বাড়িঘরে হামলা হয়, সম্পত্তি বেদখল হয়। এগুলির প্রতিবাদ করার জন্যে শুধু হিন্দুদের নিয়ে একটা সংগঠন করতে হচ্ছে কেন? দেশের সকল মানুষ মিলেই তো প্রতিবাদ করার কথা, সকল মানুষ মিলে একত্রে লড়াই করার কথা। আজকে যে কেবল হিন্দুদের নিয়ে ওরা একটা সংগঠন করে এইসব সভা সমাবেশ করতে বাধ্য হচ্ছে, এটা হচ্ছে আমাদের সকলের ব্যর্থতার ফল- আমরা সকলে ব্যর্থ হয়েছি বলেই আজকে এইরকম ঘটছে।
কিন্তু আপনি আমি পছন্দ করি বা না করি, ওরা সমাবেশ করতে চাচ্ছে তাতে বাধা দিবেন কেন? দেশে কি সভা সমাবেশের উপর সার্বিকভাবে কোন নিষেধাজ্ঞা আছে? তাইলে সনাতনীরা একটা সভা করবে সেটাতে কেন বাধা দিবেন? হিন্দু বলে? এটা কিরকম কথা ভাই। এইটা যে অন্যায় সেই কথা কি আমাকে সংবিধান খুলে বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা দর্শনের বই খুলে বুঝাতে হবে? কিন্তু অন্যায়টা তো হচ্ছে। খবরের কাগজ ও টেলিভিশনগুলি, ওরাও তো এইসবকে খুব গুরুত্ব দিয়ে নিউজ করছে না। আজকের পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে একটা নিউজ দেখেছি, দেশ রূপান্তর নামে আরেকটা অনলাইন কাগজেও দেখেছি। ছাপা কাগজ প্রথম আলো বা ডেইলি স্টারে কি কোন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে?
(৩)
বাংলাদেশে একজন হিন্দু নাগরিককে কি পরিমাণ শঙ্কা নিয়ে জীবন ধারণ করতে হয় সেকথা কি আমরা জানিনা? বড় বড় শহরে হিন্দু হলে বাড়ী ভাড়া পাওয়া কঠিন হয়ে যায় ধর্মবিশ্বাসের কারণে। স্কুলে ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে হিন্দু বলে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে নানাপ্রকার কটু কথা বলা হয়। প্রতিটা হিন্দু মেয়ের বাবা ম্যা কন্যার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকে। প্রতিদিনের জীবনযাপনে প্রায় প্রতিটা হিন্দু নাগরিককে দুশ্চিন্তায় কাটাতে হয়- জীবনে নানা পর্যায়ে অন্যেক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না একজন হিন্দু নাগরিক- মনের মধ্যে কুণ্ঠা নিয়ে মুখ বুঝে সহ্য করে যায়, মনে মনে বলে থাক আমরা হিন্দু মানুষ। এটা তো আমার প্রিয় মাতৃভূমির জন্যে অপমানজনক।
কেউ কেউ সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন করার দাবী করেন। আমি বুঝতে পারি এই দাবীটা ওরা কেন করেন। কিন্তু আইন করে কি আপনি সেই ছোট বাচ্চাটাকে রক্ষা করতে পারবেন প্রতিদিন স্কুলে যাকে শুনতে হয়, ও, তুই হিন্দু! (ওরা সবসময় হিন্দু বলে না, ড্যাডাইয়া বলে, আরও নানারকম কুৎসিত কথা বলে)। না, পারবেন না। কিভাবে এইসব সমস্যা মোকাবেলা করতে হয় সেকথা আমাদের রাজনৈতিক নেতারা উত্তমরূপে জানেন। কেননা সাম্প্রদায়িকতা একটা রাজনৈতিক সমস্যা- একটা রাজনৈতিক প্রপঞ্চ, একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ- এর সমাধানও রাজনৈতিক। এই অধম খাকছার রাজনৈতিক নেতাদেরকে জ্ঞান দিবে তার কোন প্রয়োজন নাই।
(৪)
রাজনৈতিক দলগুলি যদি সাম্প্রদায়িকতার বিরোধ অব্যাহত রাখে তাইলেই একদিন না একদিন এই সমস্যার সমাধান হবে, নাইলে হবে না। মনে রাখবেন, রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক সংঘ, এর প্রতিটি কাজ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি পদক্ষেপ রাজনৈতিক। রাজনৈতিক দলগুলি যদি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে না দাঁড়ায় তার অর্থ কি দাঁড়ায়? তার অর্থ দাঁড়ায় যে আমাদের রাজনীতিবিদরা সাম্প্রদায়িকতা বজায় রাখতে চায়, স্মাপ্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে ফায়দা লুটতে চায়। এই অবস্থা বিরাজমান থাকলে তো সাম্প্রদায়িকতা দূর হবে না। আপনিই বলেন, আপনি কি মনে করেন যে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিতে কোন হিন্দু নাগরিক কখনো দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে?
রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের কাছে নিবেদন করি, অনুনয় করে বলি, মেহেরবানী করে স্পষ্ট কণ্ঠে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলুন। সাম্প্রদায়িকতার মত নোংরা অমানবিক জঘন্য হীনতা এই দেশে কেন থাকবে? ছিঃ!