মিজানুর রহমান কলকাতা দাঙ্গা নিয়ে লিখেছিলেন কৃষ্ণ ষোলই। বীভৎস রক্তাক্ত বর্ণনা। এই কয়েকদিনে দেশে যা হয়ে গেল তাকে কৃষ্ণ ষোলইয়ের সাথে তুলনা করতে ইচ্ছা করছে আমার। এমন ঘোরতর কৃষ্ণ সময় বাংলাদেশে আর আসছে কিনা সন্দেহ। কয়েকদিন ধরে লিখছিলাম না। ভাবছিলাম দেখতে থাকি। দেখছি আর অবাক হচ্ছিলাম। সমস্ত হিসাব নিকাশ পাল্টে যাচ্ছে। বাক স্বাধীনতা, স্বৈরাচার বিরোধী এমন কত কথা বলে শুরু হল নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পথ চলা। অথচ দুইদিন যাওয়ার পরেই বুঝলাম এরা বাক স্বাধীনতা বলতে বুঝে আমার কথা বলার অধিকার, আমার পছন্দের কথা বলার অধিকার।
মনটা ভীষণ রকমের খারাপ হয়ে আছে বেশ কয়েকদিন ধরেই। না, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন এইটা নিয়া আমার কোন মন খারাপও নাই, কোন উল্লাসও নাই। এইটা আমি আগেও বলেছি। যে পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন তিনি তাতে তার যাওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার ছিল। কীভাবে কতখানি ক্ষতি করে যাওয়া হবে এটাই ছিল আলোচনার বিষয়। কাজেই এইটা নিয়ে কোন বিকার নাই আমার। কিন্তু এরপরে দেশ জুড়ে যা চলছে আর তা ধামাচাপা দেওয়ার যে চেষ্টা উঠে পরে করা হচ্ছে তা মন খারাপের জন্য যথেষ্ট।
এক পক্ষ হিন্দুদের কিছুইই হয় নাই এইটা প্রমাণ করার জন্য যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে। যা ইচ্ছা তাইয়ের নমুনা হচ্ছে রাহুল আনন্দের বাড়ি। বলা হচ্ছে এইটা ইচ্ছা করে দেওয়া হয় নাই। অন্য আগুন এসে লেগে গেছে! এই গল্প জলের গানের অফিসিয়াল পেজ থেকে শেয়ার করা হয়েছে! অনেকেই এইটা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে। রাহুল আনন্দকে নিয়ে মজা নেওয়া শুরু করেছে। কেন তিনি এমন একটা ঘটনাকে এমন করে বলেছে! সাম্প্রদায়িক চেহারা কেন দিলেন ইত্যাদি! আমি শুধু একজনকে বললাম আচ্ছা, আগুন না হয় আরেক জায়গা থেকে আসছে, বাড়িঘর ভাঙল কে? বাজনা গুলো ভাঙল কেন? লুট হল কেন বাড়ি? উত্তর নাই! রাহুল আনন্দকে এই গল্প বলতে বাধ্য করা হয়েছে হয়ত। কে জানে।
আমাদের শেরপুরে হিন্দুরা মানব বন্ধন করবে বলে ঠিক করল। দুপুরে আমি শুনছি, সেই দুপুরেই আবার শুনলাম মানব বন্ধন করা যাবে না! কেন? জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়েকজনকে ডেকে বলেছে এগুলা করা যাবে না। শেরপুরে কী হইছে? কিছু হইছে? এরপরেও যদি কেউ নামে তাহলে তারপরে যদি কিছু হয় তাহলে সেই দায় কেউ নিবে না! এই কথা শোনার পরে কে যাবে প্রতিবাদ করতে? এমন চলছে সব জায়গায়। শাহবাগে, চট্টগ্রামে যে মানুষের ঢল নেমেছিল সব আওয়ামীলীগের চাল বলে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামীলীগ দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়! ওই যে বললাম প্রথমেই, কথা শুধু আমার পছন্দেরটাই থাকবে, ওইটাই বাক স্বাধীনতা।
আমার এক বন্ধুও এই তরিকার লোক। ও একটা পোল খুলেছে ফেসবুকে। কয়টা হিন্দুকে আক্রান্ত হতে দেখেছে এইটাই পোলের বিষয়। একটা দুইটা, একাধিক, একটাও না, এমন সব দেওয়া। ও প্রমাণ করতে চাচ্ছিল যে যা ছড়াচ্ছে সব ভুয়া, গুজব। আমাদেরই আরেক বন্ধু বলল সমানে চাঁদাবাজি হচ্ছে এইটাকে ধরবি না হিসাবে? আরেকজন নাম ধরে কে কে আক্রান্ত হয়েছে তার কথা লিখেছে। কারা চাঁদা দিচ্ছে এখনও, কাদের চালের গুদাম খালি হয়ে গেছে এগুলা লিখেছে। এর উত্তরে আমার সেই বন্ধু লিখেছে ভোট জালিয়াতির সময় কথা কস নাই কেন! হইল না কাম? দেও ওকে এর জবাব!
এই চলছে এখন। এমন একটা শ্রেণির উত্থান হয়েছে যাদের কোন যুক্তির বালাই নাই। ঢাকায় ইউনুস সাহেব সরকার গঠন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শক্ত হাতে সেই সরকারকে চালাচ্ছেন! হাস্যকর হলেও এইটাই সত্য। সমন্বয়কেরা উপদেষ্টাদের কথাবার্তা পছন্দ না হলে রীতিমত ধমক দিচ্ছেন। তাদের কথামতো না চললে নামায় দিবে বলে হুংকার দিচ্ছেন। জবাবে সেই উপদেষ্টা আবার মাফ চাচ্ছেন! ভুল বলে থাকলে ক্ষমা করে দিয়েন বলছে! ঢাকায় বিএনপি জামাত তলেতলে থাকলে প্রকাশ্যে তেমন একটা নাই। তাদের লোকই আছে সরকারে, তাই খুব বেশি উচ্চবাচ্য নাই ঢাকায়। কিন্তু ঢাকাই বাংলাদেশ না। ঢাকার বাহিরে জাস্ট ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে। সমস্ত জায়গায় বিএনপির লোকজন বসে গেছে। আমাদের প্রেস ক্লাবের কমিটি ভাঙা শেষ। আরও যত সমিতি, ক্লাব হাবিজাবি ছিল সব জায়গায় তারা বসে গেছে আমাদের শেরপুর শহর পুরো তাদের দখলে। নেতারা বিএনপি অফিসে বসে এলাকা ভাগাভাগি করছে। পুরো দমে চাঁদাবাজি চলছে। কেউ দেখার নাই, শোনার নাই। আক্ষরিক অর্থেই পুলিশ নাই। যারা কাজে যোগ দিয়েছে তারা না দিলে চাকরি থাকবে না এমন ঘোষণা দিয়েছে বলে যোগ দিয়েছে, থানায় বসার জায়গা নাই, আশেপাশের চায়ের দোকানে বসে থাকে। ইমেজের এমন ক্ষতি হইছে যে সবাই ইয়ার্কি মারছে তাদের নিয়ে। ওরা কাজ করবে কী? গতকাল দুইজন পুলিশকে দেখলাম এই ঘটনার পরে। দুইজন পোশাক সুন্দর করেই পরা কিন্তু পায়ে স্যান্ডেল! মহান বিপ্লবীরা হয়ত জুতাটাই চুরি করে নিয়ে গেছে, কে জানে!
যা বলছিলাম, বিএনপি আক্ষরিক অর্থেই দখল নিয়ে নিয়েছে দেশের। এদেরকে উৎখাত করবে এমন কোন সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। এখনও যদি সরকার থেকে বা ইউনুস সাহেব নিজে একটু দেখতেন তাহলেও হত। কিন্তু বিএনপিকে দেওয়ার জন্যই যে তারা আসছেন এইটাই যেন সত্য প্রমাণ করতে চাচ্ছেন।
মন খারাপ লিখছি। এর বড় কারণ আজকে ১৫ আগস্ট। জাতির এমন একটা কলঙ্কের দিন, যা জাতিয় শোক দিবস ছিল তিনদিন আগেও। তা বাতিল করা হয়েছে। সেটাও সমস্যা না। আমি আগেও লিখেছি যে বঙ্গবন্ধুকে কাল্ট করে রাখার কোন যুক্তি নাই। জোরে করে প্রেম করানোর কোন মানেই হয় না। আওয়ামীলীগ তাই করে গেছে। এখন যথারীতি আওয়ামীলীগ আর বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা সব গুলিয়ে ফেলে এই ছাগলেরা প্রথমে ৩২ নাম্বার ভেঙ্গেছে। এরপরে শোক দিবস বাতিল করেছে, ছুটি বাতিল করেছে। এবং এখানেই শেষ না, ১৫ আগস্ট কাওকে ৩২ নাম্বারে যেতেও দেওয়া হবে না বলে হুশিয়ারি করা হয়েছে। এখন শুধু হুশিয়ার করলে তো হবে না, কাজেও তো দেখাতে হবে। রোকেয়া প্রাচী আজকে যখন ৩২ নাম্বারে মোমবাতি নিয়ে যায় তখন তার সাথে আরও কিছু মানুষ জড়ো হয়। এরা শান্তিপূর্ণ ভাবেই কাজ করে যাচ্ছিল। এরপরেই শান্তির দূতেরা এসে লাঠি দিয়ে আক্রমণ। রোকেয়া প্রাচীকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে ওইখান থেকে।
দেশ জুড়ে কোথাও যেন কেউ শোক প্রকাশ না করতে পারে তার জন্য জোর আয়োজন। আমাদের শেরপুরেও মাইক দিয়ে বলা হচ্ছে কাওকে পাওয়া গেলেই মাইর লাগায় দিবেন, মাইরের উপরে ওষুধ নাই! রাতের শহর দখল রাখতে ডিজে পার্টির আয়োজন করেছে কোথাও কোথাও! বিকট শব্দে গান বাজছে, উদ্দাম নাচ হচ্ছে। শোক পালন করা যাবে না, আজকে আনন্দ ফুর্তি হবে শুধু!
আর আমার বন্ধুরা অনেকেই স্বপ্ন দেখেছে এরপরে সব ঠিক হয়ে যাবে। মহান বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে, এখন সব সুন্দর হবে! আমরা প্রায় ইউটোপিয়ান দুনিয়ায় ঢুকে যাচ্ছে। খালি সুখ আর সুখ!
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এই অপমান হারিয়ে যাবে না। এই দুনিয়ায় কিছুই হারায় না। শেখ হাসিনা যদি তার প্রাপ্য কর্মফল পেয়ে থাকেন তাহলে এইটা বলা খুব ভুল হবে না যে এগুলারও প্রাপ্য কর্মফল আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
আমি ছোটবেলায় বিএনপি আমল পার করেছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের ইতিহাস বিকৃতি ফাইজলামি পর্যায় ছিল। এরা রামায়ণ লেখার চেষ্টা করেছে রামকে বাদ দিয়েই! মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অথচ বঙ্গবন্ধুর নাম নাই বললেই চলে। আমাদের সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে চার পাঁচ লাইনে ছিল বুদ্ধিজীবী দিবসের কথা। বঙ্গবন্ধু সাত মার্চের ভাষণ দিয়েছেন, এই টুকু, এরপরেই ২৬ মার্চ জিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন! এমন হাস্যকর ইতিহাস ছিল পাঠ্য বইয়ে। আবার সেই দিন আসছে। এবার আরও ভয়ংকর হয়ে আসবে এই সব। বলা চলে অন্ধকার সময়ের শুরু হয়ে গেছে। ঘোর অন্ধকার চারদিকে। যারা চাইলে আলো জ্বালাতে পারে তারা জীবন বাঁচাতে ব্যাস্ত।
বড় একটা প্রজন্ম বড় হয়েছে বই পড়া ছাড়া। এখন এদেরকে ইতিহাস জানাবে কে? অনেকেই বইয়ের নাম জানতে চাচ্ছে। ইতিহাসের চরম বিকৃতি করা বই গুলাই সাজেস্ট করছে এদেরকে। এগুলাই পড়বে, পরে এঁড়ে তর্ক করতে আসবে। পিচ্চি একজন আমাকে বলছে ঘরে গোষ্ঠী সবাইকে এমন করে মেরে ফেলল, কত বড় আকাম করছিল একবার ভাবেন! আমিও তাই ভাবছি, কত ঠেকা পড়ছিল এমন অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীন করতে গেছিল লোকটা। মরার এত বছর পরেও এমন অপমান সহ্য করতে হচ্ছে তাকে। এরা বই পড়ে না, যা পড়ে তা নিজের পছন্দের টুকু। কমফোর্ট জোনের বাহিরে যাইতে রাজি না।
এগুলা দমন করতে পারতেন ইউনুস সাহেব। কিন্তু সম্ভবত ইচ্ছা করেই এই ব্যাপারে নিশ্চুপ আছেন। তিনিও আওয়ামীলীগ আর বঙ্গবন্ধুকে এক করে ফেলছেন। তিনিও হয়ত আমার সুশীল বন্ধুদের মতো বলছেন এর জন্য শেখ হাসিনা নিজেই দায়ী! এরপরেও যা হবে তার জন্যও শেখ হাসিনাই দায়ী থাকবেন। দেশের সংখ্যালঘুর উপরে নির্যাতন হয় ওইটাও আওয়ামীলীগ দায়ী! সামনে যত গণ্ডগোল হবে তার দায়ও তাদেরই! এইটা ভালো কল চালু হল না? এমন হলে দেশ চালানো এমন আর কী কঠিন!
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালের সকল শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।