স্যারের চেম্বারটা থেকে আঙুলের কানায় চোখ মুছতে মুছতে যখন বের হয় মিতু, তখন কারো কারো চোখে পড়ে ব্যাপারটা; তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার জিজ্ঞেস করেই ফেলে। কিন্তু মিতু মুখের ভাঁজগুলোতে একটার পর একটা নকশা কেটে যখন ‘কিছুই না’ বোঝানোর চেষ্টা করে, তখন মুখচ্ছবিটা আগের থেকেও দুর্বোধ্য আকার ধারণ করে!
প্রশ্নকারীদের সন্দেহ মিথ্যে নয়, ব্যাপার তো কিছু একটা হয়েছেই! কিন্তু তা কি এত সহজ যে, চাইলেই বলা যায়! আর নার্গিস তো পুরো অফিসকেই তাক্তুক করে রেখেছে! ওর ঐ সরল হাসির স্রোতে যে কী গরল বয়ে যায়, তা শুধু ওর পাশে বসে যারা কাজ করে, তারাই জানে!
‘রাশিডাই খারাপ আমার! না হইলে ক্যান্ ভাউচারগুলি ওর হাতে দিয়া বাইর হইয়া গেছিলাম! দাওয়াতটায় একটু পরে গেলে কী এমন কেয়ামত নাইম্যা আইত!’ কথাগুলি মনের মধ্যে পাঁক খেতে খেতে মিতুর চোখের নরম পাড়টাকে ক্রমেই তস্নস্ করতে থাকে। একটা সময় পাড় ভেঙে পড়ে অশ্রুটা পতনোন্মুখ হলে, হাতের ফাইলটা কোনমতে পেপারওয়েটে চাপা দিয়ে মিতু বাথরুমে দৌঁড়ায়!
যদিও কিছুতেই স্বীকার করবে না নার্গিস, কিন্তু এ তো এখন দিবালোকের মতই সত্য যে, ভাউচারগুলি আসলে সে চেক-ই করেনি! যেমন ছিল, তেমনি ফেলে রেখেছে; আর পরদিন সেগুলোই পরম বিশ্বাসে স্যারের রুমে নিয়ে গেছে মিতু! আর সেখানেই আবিষ্কার হয়েছে যে, একই বিল দুবার পোস্টিংই হয়নি শুধু, পরিমাণেও গরমিল আছে! হ্যাঁ, ভুলটা মিতুরই, কিন্তু চেক করলে যে কারোই চোখে পড়বে! আর নার্গিস তো একটা প্রফেসর – সব বিষয়ে যে তার অগাধ জ্ঞান, তা ক্ষণে ক্ষণেই ফিরতে থাকে লোকমুখে!
হঠাৎ মনে পড়ে যায় মিতুর, এ বছর তাদের দুজনেরই প্রমোশানের শিডিউল আছে! আর আবার হাহাকার ভাপ দিয়ে উঠতে থাকে তার ভিতর থেকে! তাকে অদক্ষ প্রমাণ করে ‘এ’ গ্রেডটা নিজের কাঁধে ঝোলানোর এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র তাহলে! কিন্তু এই ষড়যন্ত্রের জাল সে ছাড়াবে কী করে! নার্গিস তার কাজগুলি করে যেতেই থাকবে, অথচ কোন প্রমাণ থাকবে না! নাগিনটার পাতা ছকে পা ফেলে ওকে ওর কাংখিত জায়গায় পৌঁছে দেয়াই মনে হয় এখন তার একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে অফিসটিতে! ভীষণ বিপন্ন বোধ করতে থাকে মিতু! আর বাষ্পে ছেঁয়ে যেতে থাকে সামনের আয়নাটার ঘর-দুয়ার!
কতক্ষণ এভাবে পড়েছিল মনে পড়ে না। হঠাৎ ক্ষুদে জানালাটা দিয়ে ভেসে আসে আযানের সুর, আর সঙ্গে সঙ্গেই তার হুঁশ ফেরে। বাথরুমটা থেকে বেরিয়ে মিতু সোজা নামাযে বসে পড়ে আর দু'হাত তুলে খোদাকে ডাকতে থাকে, ‘হে পরওয়ারদিগার, এই বিপদ থেকে আমায় পরিত্রাণ দাও! ষড়যন্ত্রকারীদের ধ্বংস করে দাও! আমি তোমার অসহায় বান্দী! তুমি ছাড়া আমাকে বাঁচানোর আর কেউ নাই!’
মোনাজাত শেষে জায়নামাযটা রাখতে রাখতে হঠাৎ বিদ্যুত চমকের মত করে মনে পড়ে যায় তার কথাটা, আর মুহূর্তেই ঝলসানো লালিমায় আলোকিত করে তোলে তার চারপাশটা! হ্যাঁ, আর তো বেশিদিন নেই; সামনেই তাদের কোম্পানির অ্যানুয়াল বুক ক্লোজিং, আর এত বড় একটা কাজ স্যার্ এবার নার্গিসের হাতে তুলে দিয়েছেন! নাগিনটাও হাসিমুখে আশ্বস্ত করেছে স্যারকে – দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র অবহেলা করবে না সে। কিন্তু এবারই কাজটা প্রথমবারের মত করছে ও। বলা যায় না, বড়সড় একটা গুবলেট পাকিয়ে বসতে কতক্ষণ! সারা বছরের সমস্ত হিসাব-নিকাশের জের একদিনেই টানতে হবে! নাহ্, মনে হয় এবার নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই পড়তে যাচ্ছে শয়তানটা! এরপর ভাবনাটা যতই পাখা মেলতে থাকে, ততই একটা ঘন নিঃশ্বাস দ্রুতগতিতে লুটোপুটি খেতে থাকে মিতুর মধ্যে, আর বুকটা হাঁপরের মত উঠানামা করতে থাকে কেন কে জানে!
নামাযঘর থেকে হাঁটতে হাঁটতে যখন মিতু আবার নিজের ডেস্কের দিকে এগুতে থাকে, তখন সেই আগের মত সবাই লক্ষ্য না করলেও কারো কারো চোখে পড়ে যায় ব্যাপারটা! স্বাভাবিকের তুলনায়ও শান্ত দেখাচ্ছিল তার চোখের মণিটা, একটা স্নিগ্ধ ছায়ায় ঢেকেছিল পাতাগুলি; একটু আগের গনগনে আভা যেন হারিয়ে গেছে গগনের অন্য কোন উনুনে! দর্শকদের মধ্যে সবাই না হলেও কেউ কেউ যখন জিজ্ঞাসা করে, ‘ঘটনাটা কী’, তখন মিতু সেই আগের মতই নীরব থাকে!
‘সবার উপর একজন রক্ষাকর্তা আছেন, এ কথা সবাই ভুলে যায়!’ নিজের মনকে কথাটা বলতে বলতে এরপর ডেস্কের কিবোর্ডটায় আঙ্গুলের তুবড়ি ছোটাতে থাকে মিতু!
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।