এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  আলোচনা   সমাজ

  • পুলিশ আধিকারিকের স্মৃতিতে কলকাতার দাঙ্গা 

    দীপ
    আলোচনা | সমাজ | ০৯ মে ২০২৪ | ৩৮৮ বার পঠিত
  • ...........................

    এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বড়বাজারের ব‍্যবসায়ীরা আত্মরক্ষার জন‍্য বহু মীর্জাপুরী গুন্ডা কলকাতায় আনে। প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে তাদের হাতে তখন বিপুল অর্থ। আমড়াতলা প্রভৃতি স্থানের মুসলীম ব‍্যবসায়ীরা একই উদ্দেশ‍্যে গাজীপুরী গুন্ডাদের শহরে আমদানি করে। কিন্তু দাঙ্গা উত্তরকালে কেউই ওদের ভরণপোষণ করেনি। এবার উভয় সম্প্রদায়ের গুন্ডাদের মধ‍্যে দারুণ ভাব। তারা দেশে না ফিরে পথচারীদের অর্থ ও দ্রব‍্য কেড়ে নেয় এবং নগরজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী বা ফরিয়াদী হলে নিশ্চিত মৃত্যু। ......

    জনৈক মীনা পেশোয়ারীর নামে গ্ৰেপ্তারী পরোয়ানা ও হুলিয়া  জারি হয়। ব‍্যারিস্টার সুরাওয়ার্দী সাহেব তাকে টেগার্টের ঘরে আনলেন। অভিযোগ, ইন্সপেক্টর প্রভাতনাথ মুখার্জি তাকে উৎপীড়ন করেছে। প্রভাত মুখার্জি বললেন, "এই সেই জেলাখারিজ প্রক্লেমড অফেন্ডার কুখ‍্যাত গুন্ডা।"  গ্ৰেপ্তারী এড়াতে মীনা দৌড়ে বার হল। পশ্চাৎধাবনকারীদের উদ্দেশ‍্যে মুর্হুমুর্হু  গুলিবর্ষণ করে নেমে সে অদৃশ‍্য হয়ে গেল। সুরাওয়ার্দী সাহেব ( তাকে সৎব‍্যক্তি বলার জন‍্য )  ক্ষমা চান ও তিনি তা পান। ........ 

    এই কালে জীবনের মূল্য আরও কমে গিয়েছিল। খুনের নেশায় বহু তরুণ হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। গভর্নমেন্ট বদলের পর পুলিশেরও মরাল বলে কোন বস্তু ছিল না। তারা নিজেরাই তখন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। থানায় ফোন করলে উত্তর পেয়েছিলাম : ‘স্যার, জায়গাটা বড্ড খারাপ।’ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সৈনিকদের কর্তব্য-ভীতি দেখে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছি।

     ততদিনে কলকাতা মহানগরী তিন ভাগে বিভক্ত : হিন্দু পল্লী, মুসলীম পল্লী ও মিশ্র পল্লী। প্রথমোক্ত দুটি পল্লীতে দাঙ্গা থামলেও মিশ্র পল্লীগুলিতে তা অব্যাহত ছিল। হিন্দু ও মুসলীম পল্লীর অধিবাসীরা মিলেমিশে বহিরাগতের আক্রমণ এক-সঙ্গে রুখেছে। অন্যপক্ষে, মিশ্রপল্লীতে মুসলীমরা তখনও ছুরি শানাচ্ছে আর হিন্দুরা পাইপগান ও বোমা তৈরি করছে। সারারাত্রি সেখানে পটপট আওয়াজ আর চোরাগোপ্তা আঘাত-জনিত আর্তনাদ | পুলিশ বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ইঁটের সন্ধানে ছাদ তল্লাসী করত। এজন্য বাড়ির ছাদগুলিতে ইঁট দিয়ে ঘিরে তুলসী-মঞ্চ তৈরি করা হয়। বাড়ি আক্রান্ত  হলে মেয়েরা  ওই মঞ্চ ভেঙে ইট ছুঁড়তো। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে পরিবারের সবাই তখন একটি যুদ্ধবিদ জাতিতে পরিণত। মিশ্র-পল্লীগুলিতে তখন জাতি-বর্ণ ও ধনী-নির্ধনী ভেদ নেই। বিপদ-কালে বস্তি-সুদ্ধ সবাই স্বধর্মী ধনীর গৃহে সাদরে স্থান পেয়েছে। সকলেই এক হিন্দু জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে এ বাড়ির মেয়েরা বিপদের দিনে অন্য বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এইভাবে একটি নতুন সমাজ-ব্যবস্থা তখন গড়ে উঠেছিল।

    [পুলিশ তার করণীয় কর্তব্য-কাজ না-করলেও পল্লীগুলিতে প্রাইভেট-পুলিশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাদের ভরণপোষণের জন্য চাঁদা উঠতে থাকে। পল্লীর বাতিল-তরুণেরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়। পুলিশের খাতায় তারা প্রতিরোধী দল বা রেজিসটেন্স গ্রুপ রূপে চিহ্নিত হ'ল।]

    বিঃ দ্রঃ — দাঙ্গার অবসানে স্ব- স্ব সম্প্রদায়ের গুণ্ডাদের আর প্রয়োজন থাকে নি। পূর্বের
    মত তাদের আর-কেউ আদর করে না। এই-সব লোকেদের দাঙ্গা-পরবর্তীকালে পুনর্বাসনের বাবস্থা নেই। প্রকৃতপক্ষে গুণ্ডা ও পুলিশের কোনো জাত থাকে না। কিছু পুলিশ-কর্মী স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের গুণ্ডাদের আস্কারা দিয়ে এমন  তৈরি করেছিল। কিন্তু পরে তাদের দমন করতে তারা বিব্রত হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর এরা দারুণ সমস্যা সৃষ্টি করে।

    একবার কিছু মারমুখী মুসলীম জনতাকে অগ্ৰসর হতে দেখে নিম্নপদের এক হিন্দু কর্মী উচ্চপদস্থ বেহারী মুসলীম অফিসারকে বলেছিলেন, " স‍্যার, টেরিবল্ হিন্দু গুন্ডার দল।  মুসলীম বস্তিগুলো এখুনি জ্বালিয়ে দেবে।" অফিসারটি তাই শুনে " থ‍্যাংকস্" জানিয়ে সশস্ত্র পাঠান সিপাহীদের হুকুম দিলেন, " ফায়ার !" পরে অফিসার ভদ্রলোক স্বজাতি নিধন দেখে হতবাক হয়ে যান। ....

    কোনও এক মুসলীম অফিসারকে মুসলীম জনতা " মারো শালা হিন্দু লোককো"  বললে তিনি বন্দুক নিয়ে তেড়ে গিয়ে বলেছিলেন, " আমি হিন্দু নই। আমি মুসলীম। কিন্তু একাজ করলে আমি তোমাদের জান নিয়ে নেব।" .....

     সিনেমা শিল্পী কেষ্টবাবুর এক পুত্র আমার সুমুখেই মিলিটারীর গুলিতে নিহত হন। তখনও তাঁর বাম হাতে কেরোসিনের টিন ও ডানহাতে মশাল। মশালের আলোয় সে বিরাট মুসলীম গুন্ডাবাহিনীর বিতাড়িত করে ফিরে আসছিল। .....

     গোপালবাবু ও রামবাবু তখন জনগণের রক্ষাকর্তারূপে বিবেচিত ছিলেন। পরে অভিযোগ হয় যে আমি ও সত্যেনবাবু তাদের দুজনকে তৈরি করেছি। এ অভিযোগ আমরা স্বভাবতই অস্বীকার করি। এই বিশিষ্ট ভদ্রলোকদ্বয় জনগণের স্বার্থেই
    তরুণদের সংগঠিত করেছিলেন।

     তৎকালে নিয়ম ছিল এই-যে কোনো জায়গায় বোমাবাজী বা অনুরূপ ঘটনা ঘটলে সেখানকার কিছু ব্যক্তিকে দোষী না-হলেও নির্বিচারে গ্রেপ্তার করে ওপর-মহলকে খুশি করতে হত। এই কারণে গৃহস্থরা অর্থদান না-করলে কিছু দলছুট উপগুণ্ডা বাড়ির সামনে বোমা ফাটিয়ে তাদের বিপদে ফেলতো।

    বিঃ দ্রঃ — আমি নির্বিচারে লোক-দেখানো গ্রেপ্তারের পক্ষপাতী ছিলাম না। অথচ কর্তৃপক্ষকে পরিসংখ্যান দেখাতে হয় বলে তার প্রয়োজন। তাই ঘটনার পর স্থানীয় নেতাদের বলতাম কিছু তরুণকে নিজেরাই বাছাই করে গ্রেপ্তারের জন্য পাঠিয়ে  দেবার জন‍্য। ……

     ( পরবর্তী কালে এইসব তথাকথিত গুন্ডাদের জীবনধারনের কোন ব‍্যবস্থা ছিল না, 
     তাঁদের কারোর জন্য সরকারী পেনসনের ব্যবস্থা নেই। অথচ ওরাই একদিন মা-বোনেদের ইজ্জত রক্ষা করেছিল। ) 

     জনৈক উচ্চপদস্থ ইংরাজ-সেক্রেটারি সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন : ‘সৌভাগ্য এই-যে এখনও পুলিশ দেখে ওরা পালায়। ওরা পুলিশকে এখনও পর্যস্ত আক্রমণের চিন্তাও করে নি।’ এই বিবৃতির ফলে সেদিন থেকেই এক সম্প্রদায়ের অফিসারদের উপর অন্য সম্প্রদায়ের আক্রমণ শুরু হ'ল। প্রথমে একজন হিন্দু অফিসার ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারালেন। আমার উপরেও চারবার আক্রমণ করে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। মধ্যে মধ্যে শহরে আমার মৃত্যু-সংবাদ ছড়িয়ে পড়তো। জনৈক ব‍্যক্তি আমাকেই ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিল : ‘হ্যাঁ মশাই, একথা সত্যি মি: ঘোষাল নাকি মারা গেছেন?' ওই সময়ে আমাকে রক্ষাকর্তা বুঝে পল্লীতে গেলে শাঁখ বাজানো হত।

     আমার জুনিয়র হক সাহেব গাড়ির মধ্যে স্টেনগানের গুলিতে প্রাণ হারালেন। অথচ এ ব্যক্তিটি অসাম্প্রদায়িক তো  ছিলেনই এমন কি মসজিদের আপত্তি সত্ত্বেও নিজের বাড়িতে রেডিও-র গান বন্ধ করেননি। তাঁরই শবদেহ বহন করে মুসলীমরা নতুন করে হত্যাকাণ্ড শুরু করলে।। প্রতিবাদে একদল জীপ-আরোহী হিন্দু কিছু পাঠান-কনস্টেবলকে স্টেনগান স্প্রে করে রাজপথে হত্যা করে শোধ নিল। পরবর্তীকালে মন্ত্রী হয়েছেন এমন কজন ব‍্যক্তি আমাকে বলেছিলেন, 'পঞ্চাননবাবু দেখবেন, আমাদের ওপর যেন হামলা না হয়।’ প্রকৃতপক্ষে আমরাই তখন হিন্দুদের একমাত্র ভরসাস্থল।

    [স্বাধীনতার পর মন্ত্রী হেমচন্দ্র নস্কর ও মন্ত্রী কালীপদ মুখোপাধায় নবীন ডেপুটিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোমরা নবাগত ও বয়সে তরুণ । তোমরা জানো না যে সেদিন সত্যেন মুখার্জি ও পঞ্চানন ঘোষাল জীবন ও চাকুরি বিপন্ন করে কিভাবে নাগরিকদের রক্ষা করেছিলেন।’

     দৈনিক বসুমতী-সম্পাদক বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন মন্ত্রী কিরণশংকরবাবুও অন্য বহুজনকে বলেছিলেন, ‘ওহে, এই একটি লোকের কর্মতৎপরতার জন্য সেবার আমরা বেঁচে গিয়েছিলাম। আজকের কলকাতা সেদিনকার কলকাতাকে ভুলে গিয়েছে। তাই আজ আমরাও শহরবাসীর স্মৃতিপথে সহজে আসি না।] 

     একদিন কিছু মুসলীম-অফিসার হিন্দু আসামীদের গ্রেপ্তার করে থানায় আনছিলেন। পথে কজন হিন্দু-ছোকরা বোমা ফাটালে তারা বিহ্বল হয়ে গুলি ছুঁড়ে আসামীদের একজনের মাথাই উড়িয়ে দিলেন।

     আর-একদিন অ্যাংলো-সার্জেণ্টরা বোমা ও পিস্তল সমেত এক গাড়ি লোককে গ্রেপ্তার করলেন। হঠাৎ জীপে করে কজন য়ুনিফর্ম-পরা বাঙালী ইনস্পেক্টর এসে সার্জেন্টদের ডিউটিতে থাকতে বলে আসামী-সমেত ওই গাড়ি নিয়ে থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। কিছু পরে সার্জেন্টরা থানায় এসে বুঝলো যে ওরা অলীক তথা ভুয়া-পুলিশ। অত্যন্ত আপত্তিজনক বিষয় এই-যে আমাকে ও অন্য কয়েকজন অফিসারকে সন্দেহ করে সনাক্তির জন্য লালবাজারে আসতে বলা হয়। কিন্ত সার্জেন্টরা কেউই আমাদের সনাক্ত করতে পারে নি।

     উভয়-সম্প্রদায়ের নেতাদের মধ্যে কিন্তু সৌর্হাদ্য ও খানাপিনা এবং আলোচনায় তখনও ছেদ পড়ে নি। এবার ইংরাজ-প্রভুরা বুঝলেন যে তাদের নিজেদের ঘরেই আগুন লেগেছে । তাঁরা পূর্ব প্রশাসন-ব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তন করতে বদ্ধপরিকর হলেন। লীগ-মন্ত্রীরা পথেই রায়বাহাদুর সত্যেন্দ্র মুখার্জিকে নর্থ-ডিসট্রিক্ট ত্যাগ করে এনফোর্সমেন্ট-এর ডেপুটি পদে ফিরে যেতে হুকুম দিলেন। ইংরাজ পুলিশ-কমিশনার ফোনে গভর্নরকে তা জানালে তিনি বলেন, ‘এ হুকুম আমি বাতিল করে দিলাম।’

    হীরেন্দ্র সরকার এবং সত্যেন্দ্র মুখার্জির নেতৃত্বে এবার আমরা সন্দেহজনক গুণ্ডাদের বস্তিগুলি খানা-তল্লাসী শুরু করে দিলাম। বস্তির লোক তাতে অবাক হয়ে বলে-ছিল, ‘আরে এ ক্যা বাত? ইয়ে তো হুকুম নেহী থে।’ দশ কোটির উপর মূল্যের অপহৃত দ্রব্য সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল।

     বড় বড় সিন্দুক ও আলমারী ভর্তি হীরা জহরত ও সোনা। পরিত‍্যক্ত বাড়ির বহু দরজা ও জানলা। সেই সাথে উঠান খুঁড়ে পাওয়া গেল মানুষের হাড়গোড় ও মাথার খুলি । সনাক্তির সুবিধার জন্য সেগুলি ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ামে সাজানো হয়েছিল। গুণ্ডাদের মূল ঘাঁটি কলাবাগান তখনও বিভীষিকা স্বরূপ । জনৈক চিত্রশিল্পী অন্যমনস্কতাবশতঃ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট হতে  কলাবাগানের মধ্যে দিয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ-তে এসেছিলেন। গুণ্ডারা তার লম্বা চুল ও ঝলমলে পাজামা দেখে জাতি-নির্ণয়ের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এবারে এলে তাঁকে দেখে আমি বলেছিলাম, 'আরে করেছো কি? তুমি কলাবাগানের মধ্য দিয়ে দিব্যি চলে এলে!’ চিত্র-শিল্পীটি ওটা কলাবাগান শুনে আঁতকে উঠে অজ্ঞান হয়ে যান আর-কি।

     এই কলাবাগানের মোড়ে সত্যেন্দ্র মুখার্জির গাড়ি দুই শতাধিক ব্যক্তি আক্রমণ করে তার মাথা ফাটায়। সৌভাগ্যক্রমে সেই সময় আমি টহলে এসে পড়ায় ও প্রতি-আক্রমণ করায় তারা পালিয়ে যায়। রায়বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ অপারেশনের পর বহুদিন ভুগে আরোগ্যলাভ করেন।

     মুসলীম-সম্প্রদায় হতে সদ্য-ধর্মান্তরিত দুজন হিন্দুর দৌরাত্ম্যে চিৎপুরের মুসলীম-সমাজ বিপন্ন হয়। শুধু হিন্দু নয় হিন্দু-ব্রাহ্মণ হয়েও এরা অতি নিষ্ঠুরভাবে হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিদাহ ঘটাতো। ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা কিরূপ পরধর্মবিদ্বেষী হয় তা এদের ব্যবহারে বুঝতে পেরেছিলাম। আমি বাধ্য হয়ে এদের গুলি করে জখম করি দুষ্কর্মের সময়।

     কোনও এক উগ্র হিন্দু উদর-স্ফীতিরোগে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বিকারগ্রস্ত হয়ে বলেছিল, ‘আমি দশটি মুসলীম ভক্ষণ করেছি। ডাক্তারবাবুকে চারটে বার করে দিতে বল।'

    সাম্প্রদায়িকতা যে কিরূপ ভীষণ মনোরোগ সৃষ্টি করতে পারে আমি তার ওই কথা থেকে বুঝতে পেরেছিলাম।

    মহাদাঙ্গার কারণ নিরূপণের জন্য ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট এনকোয়ারি-কমিশন বসালেন। আমি ওখানে আমার বক্তব্যে প্রমাণ করেছিলাম ষে দাঙ্গার প্রথম দিনে ধর্মতলা স্ট্রীটের মুসলীম দোকানগুলিতে এক বিশেষ চিহ্ন-আঁকা থাকাতে দুয়ার ভেঙে লুণ্ঠন করা হয়নি। প্রতিরোধের জন্য কিছু তদারকি-ব্যবস্থা ওই রাস্তায় মোতায়েন করা হয়। সাক্ষ্যদান কালে জনৈক ব্রিটিশ অফিসারও দেবজ্যোতি বর্মনের জেরায় ওই চিহ্ন দেখেছেন বলে স্বীকার করেন।

     আমার উপর গভর্নমেন্টের অভিযোগ : অযথা  ট্রানস্ফারেন্স অফ পপুলেশন এবং দেবজ্যোতি বর্মনকে জেরার জন্য তথ্য সরবরাহ। অন্যদিকে ওঁরা হীরেন্দ্র সরকার এবং সত্যেন্দ্র মুখার্জির উপরও বিরক্ত। এনকোয়ারি-কমিশনের সাক্ষ্যে সত্যেনবাবু বলেছিলেন যে অ্যাংলো-কর্মীরা দাঙ্গা-কালে ইন্ধন যুগিয়েছে। সরকার-সাহেবের কিছু অপ্রিয় সাক্ষ্যও তাদের মনোমত
    হয়নি। সরকার-সাহেব দীর্ঘ ছুটিতে ইংল‍্যান্ড চলে গেলেন। সত্যেন্দ্র মুখার্জি আঠারো মাস ছুটির জন্য আবেদন পাঠালেন। আমাকে ময়ূরভঞ্জ রাজপ্রাসাদে মিলিটারীদের লিয়াঁসো অফিসার রূপে সেখানে আটকানো হ'ল । ময়ূরভঞ্জে গুর্খা-রেজিমেন্টের কর্তা ইংরাজ-কর্নেল আমাকে বলেছিলেন যে  একমাত্র গুর্খা সৈন্যদের বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু সেখান থেকে হঠাৎ আমাকে ডেকে কাশীপুরের ও চিৎপুরের যুগ্ম ইনচার্জ করায় আমি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠি।

     দেশ-বিভাগ ও স্বাধীনতা দুটি ঘটনাই যে অত্যাসন্ন তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। হঠাৎ কড়েয়ার য়ুরোপীয় ব্রথেলগুলির নারীদের জাহাজ ভর্তি করে বিলাতে পাঠাচ্ছে দেখে আমি বুঝেছিলাম যে ওদের কোনও কালিমা ওরা এদেশে রেখে যেতে চায় না। 

    ওদিকে ওয়াকিবহাল মুসলীম সিভিলিয়ান ও রাজনীতিবিদরা  পরিবারবর্গকে ঢাকায় পাঠাতে শুরু করেছেন। ব্রিটিশ রাজত্বের কলকাতায় পুলিশের শেষ প্যারেড ট্রেনিং ইস্কুলের বদলে লালবাজারে অনুষ্ঠিত হয় গভর্নরের উপস্থিতিতে।

     কিন্তু ওই প্যারেড কম্যাণ্ড করার জন্য কোনও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না । তাদের অবর্তমানে ওই প্যারেড আমি কম্যান্ড করি।

     হীরেন্দ্র সরকারের স্থলে প্রণব সেন গোয়েন্দা-বিভাগের ডেপুটি হয়ে আসেন | দোহা সাহেবের স্থলে হরিসাধন ঘোষচৌধুরীকে হেড-কোয়ার্টারের ডেপুটি-কমিশনার করা হয়েছিল।

    [ হরিসাধন ঘোষচৌধুরী পরবর্তীকালে পুলিশ-কমিশনার হয়েছিলেন। ইনি অধীনস্থ কর্মীদের এলাকায় বসবাসকারী রিটায়ার্ড অফিসারদের খোঁজ-খবর নিতে বলতেন, যাতে তারা ভাবেন যে তখনও তাঁরা পুলিশেরই একজন। তাদের পরামর্শ ও অভিজ্ঞতা কার্যে প্রযুক্ত করতে বলতেন। তিনি পুলিশ মেডিকেল ইউনিট ও সংযোগ-ব্যবস্থা প্রভৃতি চালু করা সত্ত্বেও সেগুলি দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। প্রণব কুমার সেনও পরবর্তী কালে পুলিশ-কমিশনার হয়েছিলেন। রাজপথের বর্তমান ট্রাফিক-লাইটগুলির তিনিই প্রবর্তক। লালবাজার কন্ট্রোল-রুম ও ওয়ারলেসেরও তিনি উন্নতি-বিধান করেন। বর্তমান স্পেশাল কনস্টেবল-প্রথা তিনিই তৈরি করে গেছেন। কিছু সুন্দর ইংরাজি ফ্রেজ তার সৃষ্টি, যথা :  লাইফ অফ ভাল্গারিটি, সেক্স অফ ইনসিকিউরিটি ইতাদি।] 

     চিৎপুর থানার যিনি ইনচার্জ তিনি ছটি বস্তি পুড়িয়ে এবং বহুজনকে হত্যা করে পূর্ববঙ্গে পলাতক। আমি ওখানে ঘাঁটি করে যুগ্ম-ইনচার্জ হলাম। সমগ্র থানা-এলাকা গরম। থানায় আমি একা হিন্দু অফিসার। প্রত্যেক জুনিয়র-অফিসার ও শতকরা আশিজন কনস্টেবল মুসলীম। আ্যাসিসটেন্ট ও ডেপুটি-কমিশনারও মুসলীম, তারা ছুটিতে পূর্ববঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তত হচ্ছেন। তখনও বাংলার মুখ‍্যমন্ত্রী জনাব সুরাওয়ার্দি
    সাহেব। 

     মিশ্রপল্লী হতে কোনও হিন্দু ভয়ে অন্যত্র চলে গেলে অন্য হিন্দুদ্বারা ওই বাড়িটি দখল হত। এমনি একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে এক উপনেতা সপরিবারে অধিষ্ঠান করেন। তার দুই পুত্র প্রতিরোধ-দলের শ্রেষ্ঠ ওয়ার্কার ছিল।

     পুরুষদের অনুপস্থিতিতে ওদের বাড়ি চড়াও হয়ে গুন্ডাদল এক চতুর্দশী বালিকাকে টেনে রাস্তায় আনে। সংবাদ পাওয়ামাত্র আমি সেখানে উপস্থিত হই এবং একজনকে পদাঘাতে ও অন্যজনকে ঘুষি মেরে মেয়েটিকে বুকের মধ্যে টেনে নিই। গুন্ডারা আমাকে দেখে পলায়নোদ্যত হলেও শিকার-ত্যাগের বাসনাও ছাড়তে পারে না। আমি অস্ত্র বার করে ফাঁকা-আওয়াজ করায় ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। মেয়েটি স্বভাবতই কৃতজ্ঞতাবশত পরবর্তীকালে রাত্রে ও-অঞ্চলে রাউণ্ডে গেলে চা তৈরি করে খেতে অনুরোধ করত ।
     এটা লক্ষ্য করে গুন্ডাদের কেউ বা অন্য কেউ আমার নামে বেনামী পোস্টকার্ড পাঠায় । তাতে লেখা: ‘মৃত্যুর জন্য প্রস্তত হও’ এইরূপ একাধিক চিঠি আসল । আমি সেগুলি লালবাজারে পাঠিয়ে দিলে কমিশনার নর্টন জন মন্তব্য লেখেন : 'হু ইজ দিজ ফ্রেণ্ড?' একরাত্রে পাবলিক প্রসিকউটর রায়বাহাদুর রমণী ব্যানার্জির সংবাদে ছুটে গিয়ে দেখি, ওদের টিনের বাড়িটি জ্বলছে আর দুই ব্যক্তি সাংঘাতিকভাবে আহত । কিন্তু ওই মেয়েটিকে জীবিত বা মৃত বহু বস্তি তল্লাসী করেও খুঁজে পাই নি। এখনও বক্ষে তার সেই দিনের নিশ্চিন্ত -নির্ভর কোমল স্পর্শটুকু আমি অনুভব করি।

    [ঠিক ও-রকম আমি একদা একটি মুসলীম-বালিকাকে মেছুয়া-এলাকার হিন্দু গুণ্ডাদের কবল হতে রক্ষা করি। তাকে কিন্তু নিরাপদে তার আত্মীয়দের বাড়ি পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম।]

     দুষ্টলোক রটাতে থাকে যে উক্ত ঘটনাবলীর জন্য প্রতিশোধ নিতে অসম্প্রদায়িক হয়েও কিছু গুলিবর্ষণ করি। কিন্ত, তার মধ্যে এতটুকু সত্য ছিল না। অন্যায় প্রতিশোধ বা উৎপীড়নের আমি আদৌ পক্ষপাতী নই।

     কিছু লীগ-নেতার মুসলীম-প্রধান পূর্ব-কলিকাতাকে একটি নগর-রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিলাষ। মহাদাঙ্গার সময় পূর্ব-কলিকাতার বহুস্থান হতে হিন্দুরা অন্যত্র চলে গিয়েছে। গঙ্গাকুলবর্তী ফ্রেঞ্চ-চন্দননগরের মতো একটা আউটলেট পেতে ওদের চিৎপুর-এলাকাটি প্রয়োজন। এজন্য পরে একটি প্লেবিসাইট করলে সুবিধা হবে। কিন্তু ওদের এই ষড়যন্ত্র আমি ব্যর্থ করে দিই।

     আমি সংবাদ পেলাম একটি বিশেষ তারিখে রাত্রি দুটোর সময় ওরা পাইকপাড়া ও রানী রোড অঞ্চল আক্রমণ করে হিন্দু বাসিন্দাদের বিতাড়িত করবে। রানী রোডের ওপারে বস্তি-এলাকায় লীগের গাড়ি করে বহু বহিরাগত গুন্ডাদের আমদানি করা হয়েছে। অস্ত্র হিসাবে স্টেনগান ও ব্রেনগান তুলে দেওয়া হয়েছে ওদের হাতে।  এ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পাঠানো সত্ত্বেও তার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি। আমি স্থানীয় হিন্দু ও কিছু মুসলীমদের সাহায্যে প্রতিরোধে প্রস্তুত হয়েছিলাম।

     নির্ধারিত দিন ক্ষণে প্রায় চার হাজার বহিরাগত গুন্ডাদের আক্রমণ শুরু হ'ল। আমার দেহরক্ষীর উদর ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল গুলি। তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম । উভয় মহল্লার মধ্যস্থলে রানী রোড। আমি সকলকে সীমানা হতে পিছিয়ে আনলাম। এই উদ্দেশ্যে যে আমদের কেউ যাতে আক্রমণকারী বলতে না পারে। উপরন্তু দ্রুতগতিতে ইট গেঁথে একটা রক্ষা-পাঁচিলও তৈরি করা হ'ল। প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে এই যুদ্ধ চলে। প্রথমে দুজন স্থানীয় তরুণ আহত হয়, একজনের পুরো ডানহাত উড়ে গিয়েছিল। দুইজনকেই হাসপাতালে পাঠালাম ততক্ষণাৎ। ওদের মধ্যে একজন বর্তমানে এ্যাডভোকেট মদন চক্রবর্তী। একজন গুর্খা সিপাই ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। শুরু হ'ল আমাদের প্রতিআক্রমণ। ওরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ওরা হত বা আহত সঙ্গীদের ঘটনাস্থলে ফেলে রেখেই পলায়ন শুরু করলে। ওদের পশ্চাদ্ধাবন করে আমি আর মৃতের সংখ্যা বাড়াইনি।

     কিন্তু কিছু বহিরাগত তরুণ মানা সত্বেও সীমানা পেরিয়ে বস্তিতে অগ্রিসংযোগ করেছিল। আমি গুলিবর্ষণ করে ওরে বিতাড়িত করে ফায়ার-ব্রিগেড ডেকে আগুন নেবাই । আমি ডানপায়ে আঘাত পাওয়ায় ওদের রুখতে পারিনি। উভয় সম্প্রদায়ের কিছু লোককে গ্রেপ্তারও করা হয়। ওই এক রাত্রির ব্যবস্থায় কলকাতার দাঙ্গা সম্পুর্ণ থেমে গেল।

     থানায় ফিরে দেখি সেখানে ইংরাজ পুলিশ-কমিশনার ও ইংরাজ গভর্নর স্বয়ং উপস্থিত। কলিকাতা-পুলিশের কোনও থানার সেই প্রথম ও সেই শেষ বাংলার লাটসাহেবের আগমন। ওঁরা ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেছিলেন। স্থানীয় মুসলীম-অধিবাসীরা   তাঁদের   বলেছিলেন যে আমিই তাদের রক্ষা করেছি। তবু তারা আমাকে ওই স্থানেই সাসপেন্ড করেছিলেন। আমিই একমাত্র অফিসার যে ওই মহাদাঙ্গার সময় ওঁদের শিকার হয়েছিলাম। আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের আদেশ হয়। হিন্দু-মুসলীম উভয়-সম্প্রদায় এবং অ্যাংলো দমকল-কর্মীরা আমার পক্ষে সাক্ষী দেয়।
    আমি অনারেবব্লি  রি-ইনস্টেটেড ( সম্মানের সঙ্গে পুনর্বহাল)  হয়েছিলাম। প্রণব সেন  সক্রিয়ভাবে আমার পক্ষ না-নিলে আমার খুব অসুবিধা হ'ত।

     তাছাড়া বসুমতী, আনন্দবাজার, অমৃতবাজার প্রভৃতি বহু পত্র-পত্রিকায় আমার পক্ষে সম্পাদকীয় লেখা হয়। নাগরিকগণ ও মান্যগণ্য ব্যক্তিগণ ইংরাজ-সরকারকে বারবার গণ-দরখাস্তও পাঠিয়েছিলেন। আমার পক্ষে শ্লোগান-সহ কয়েকটি মিছিল ও ডেপুটেশনের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে আমার অব্যাহতি-লাভ ত্বরান্বিত হয়।

    এই সময়ে বহুবাজারের নিকট সেন্ট্রাল এভেনিউ-এ এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। একটি
    জীপ-গাড়ির মধ্যে দুটি স্টেনগান ও বহু বোমা-সহ দুই ব্যক্তিকে কজন অ্যাংলো সার্জেন্ট ধরে ফেলে। কিন্তু পথেই দুজন য়ুনিফর্ম-পরা ব্যক্তি থানার ইনচার্জ-অফিসার ও সেকেণ্ড অফিসার-রূপে পরিচয় দেয় এবং বামাল-সমেত আসামীদ্বয়কে 
    নিজেদের হেফাজতে নিয়ে তাদের ডিউটিতে ফিরে যেতে বলে। 

    ওই সার্জেন্টরা পরে থানায় এসে জানতে পারে যে ও-রকম কোনো আসামী বা অস্ত্রশস্ত্র কেউ থানায় আনে নি। পরদিন ইংরাজ-কর্তৃপক্ষ কজন হিন্দু অফিসারকে লালবাজারে ডেকে পাঠান। আমাকে বিশেষ করে সেখানে আসতে বলা হয়। আমাদের সকলকে সনাক্ত করণের জন্য একে-একে ওই সার্জেন্টদের সম্মুখে আনা হ'ল | কিন্তু ওরা আমাদের কাউকেই সনাক্ত করতে পারে নি। এই অপমানজনক ব্যবহারে আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম।

    মহাত্মা গান্ধী
    .......................

     গান্ধীজী বেলেঘাটায় এক মুসলীমের বাগান-বাড়িতে এলেন। তার উপস্থিতির ফলে শহরের পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। গতকাল যারা হানাহানি করেছে আজ তারা গলাগলি করে শান্তি-মিছিলে সামিল। হিন্দু-মুসলীম আবার ভাই-ভাই হয়ে যায়। (তাহলে বাংলা দেশ-বিভাগের প্রয়োজন কী ছিল?) [বিঃ দ্রঃ — গান্ধীজী শীতের রাত্রে এক বারান্দায় নগ্নগাত্রে বসেছিলেন। এক পুলিশকর্মী, যার সর্বাঙ্গ মোটা বনাতের ওভারকোট দ্বারা আবৃত, সলজ্জভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বাপুজি, আপনার শীত করছে না ?' 

     গান্ধীজী তার মুখের দিকে তাকিরে দেখলেন, তারপর মৃদু হেসে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা তোমার নাকটা তে৷ ঢাকা নেই, ওখানে ঠাণ্ডা লাগে না ? '  পুলিশ-অফিসার উত্তরে ‘অভ্যাস’ বলায় তিনিও জানান যে খালি-গায়ে থাকা তাঁর অভ্যাস।]

     আমাকে গান্ধীজীর নিকট উপস্থিত করা হয়েছিল। জনাব সুরাওয়ার্দি সাহেব তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি গান্ধীজীকে বলেন যে আমার চিৎপুরের এপিসোডে খুব একটা দোষ নেই । গান্ধীজী আমাকে মুসলীমদের সেবা করার উপদেশ  দিয়েছিলেন।

    [ গান্ধীজীর নিহত হওয়ার সংবাদে মুসলীম দোকানীরা  কাঁদতে- কাঁদতে আমাকে বলেছিল, ‘বাবুজি, আপলোক-কো তো  বহুত নেতা আছে ; লেকেন হামলোককো ওহী এক-ই নেতা হ্যায়।‘ ]

     আমি এই সময় কংগ্রেসী-বন্ধুদের ডিপ্লোম্যাটিক হতে বলি। পাকিস্তান হিন্দুস্থান-বহির্ভূত স্বাধীন পশ্চিমবাংলা চাইলে স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য বাংলার অর্ধেকের উপর পাওয়া যেতো।  তারপর ভারত-রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যরূপে যুক্ত হ'ত। তাহলে বাস্তুহারা-রূপ কোনো সমস্যা বাঙালীদের থাকতো না। কিন্তু ওরা কেউই বাঙালী-রূপে ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন না।
     সৌভাগ্য এই-যে ঠিক সময়ে গান্ধীজী কলকাতায় এসেছিলেন। নইলে, পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গ হয়তো উভয়-পাঞ্জাবের মতো যথাক্রমে মুসলীম ও হিন্দুশূন্য হত । এতে বাস্তুহারা সমস্যা পাঞ্জাবের মতো অতি সহজে মীমাংসা করা যেত। বাঙালীদের
    ভিটামাটির প্রতি অনন্য মমতা, তবু তারা অন্য বাঙালীদের মতো স্বাধীন বাংলা দেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত কোনরূপে টিকে থাকলে ভালো হত।

     প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ অফিসারদের অদল-বদল ব্যবস্থা গ্রহণ না-করলে বাংলার হিন্দু মুসলীমরা স্ব-স্ব স্থানে
    হয়তো টিকে থাকতেন । হঠাৎ পশ্চিম বাংলা হতে মুসলীম-পুলিশ এবং পূর্ববাংলা হতে হিন্দু-পুলিশ চলে আসার ফলে জনগণের মনোবল ভেঙে পড়ে | নচেৎ বাঙালী মুসলীম ও হিন্দু ভিটা ত্যাগের এতটুকু চিন্তা করতো না। তা না-হওয়ায় পশ্চিম বাংলায় একমুখী বাস্তুহারার আগমনে মহাসমস্যার স্থষ্টি হয়। ব্রিটিশরা দেশ-বিভাগের পরও কিছুকাল থাকলে ভালো হত। তাড়াহুড়া করে জীবদ্দশাতেই স্বাধীনতা ও ক্ষমতা-ভোগে লিপ্সু নেতারা এ বিষয়ে এতটুকু দেরি করতে রাজী নন। তাঁরা সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার বিষয় একটুও চিন্তা করলেন না।

     দেশবিভাগজনিত পাঞ্জাবের রক্তক্ষয়ী হাঙ্গামার পর দ্বিমুখী বাস্তুত্যাগ ও নির্বিচারে গণহত্যা এবং বাংলার একমুখী উৎপীড়িত বাস্তুহারাদের সম্পর্কে কলকাতার এক জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লেখা হয় : ‘ঈশ্বর ওদেরকে ক্ষমা করো। ওরা জানে না ওরা কি করেছে।‘

     [ আশ্চর্য এই-যে মুসলীম-নেতারা পাকিস্তানে পাড়ি দেবার কালে মুসলীম-জনগণের দিকে তাকিয়েও দেখলেন না। বাস্তুত্যাগে অক্ষম মুসলীম-সমাজ নেতাদের ধোঁকাবাজি বুঝে অবাক হয়ে ভাবে যে এ-সবের প্রয়োজন কি ছিল। নিরাপত্তার অভাব না-থাকায় তারা বাস্তুত্যাগ করে নি।

     কিন্তু বিহারী নিম্নপদস্থ মুসলীম-সিপাহী পূর্ব-পাকিস্তানে চলে গিয়ে পরে মোহভঙ্গ হওয়ায় আবার ফিরে আসে। আমাদের চেষ্টায় তারা কলিকাতা-পুলিশে পুনর্বহাল হয়।

     অন্যদিকে যে-সব সিডিউল কাস্ট মেম্বাররা লীগ-গভর্নমেন্টের বিশিষ্ট সহায়ক-রূপে পার্টিশনের বিকল্প-ব্যবস্থার পরিপন্থী হন তারাও শেষ অবধি পাকিস্তান হতে বিতাড়িত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।]

     ওই সময় কলিকাতা-পুলিশের এক মহা-দুঃখবহ দিবস। বহুদিনের বহু মুসলীম সহকর্মীরা পূর্ব-পাকিস্তানে চলে গেলেন। সহকর্মীদের নিকট হতে বিদায় নেবার সময়টুকুও তারা পান না। য়ুরোপীয় ও মুসলীম উর্ধতন অফিসররা তখন পোটলা বেঁধে তৈরি। লালবাজারে আমার কম্যান্ডে শেষ পুলিশ-প্যারেড অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় লীগ-মন্ত্রীরা শেষবারের মতো বিষোদ্গার করলেন। গভর্নর কয়েকজন কর্মীকে পদক দিলেন এবং বিগত দিনের স্মৃতি ভুলে যেতে বললেন। পুলিশ-কমিশনার হার্ডিক-সাহেব নর্টন জনকে চার্জ বুঝিয়ে য়ুরোপে পাড়ি দিলেন। নর্টন জনই কলিকাতা-পুলিশের শেষ কমিশনার। প্রথম ভারতীয় পুলিশ-কমিশনার সুরেন্দ্র চ্যাটার্জিকে চার্জ বুঝিয়ে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানে প্রস্থান করেন। তখনও পশ্চিম বাংলায় ছায়ামন্ত্রী তথা আন্ডার-ট্রেনিং মন্ত্রী ও প্রকৃত মন্ত্রীর দ্বৈত-শাসন অব্যাহত।

     লালবাজারে ড্রিলের দিন পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ বক্তৃতা দিতে আসেন। সেইদিনই ভারত পূর্ণ স্বাধীনতা-লাভ করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী সেদিন উপস্থিত অফিসারদের বলেন যে পুলিশ হ'ল দৌবারিক,  তারা যেন কারো কাছে হাতজোড় না করে। দুয়ার রক্ষার্থে তাকে উচিত-মত কঠোর হতেই হবে। তাঁর এই বৃক্ততা আমাদের সকলেরই ভালো লাগে। তিনি আরও বলেন যে অনুগত্যহীন অফিসারদের সহ্য করা হবে না।

     সদ্য স্বাধীন দেশের মুখ্যমন্ত্রী অতঃপর ড্রিল হল-এ প্রবেশ করলে অফিসররা তাকে সম্মান দিতে দাঁড়াবে কি-দাঁড়াবে না তা ঠিক করতে পারেন না।

     তারা উঠি-উঠি করেও বসে পড়েন। বহুদিনের পুরানো অভ্যাস ত্যাগ করা কঠিন। ইংরাজ পুলিশ-কমিশনার নর্টন জন তখনও সুরেন্দ্র চ্যাটার্জিকে চার্জ বুঝিয়ে দেন নি। মিঃ নর্টন জন অফিসারদের দোদুল-মনোভাব দেখে নিজেই হাতের ইশারায় মৃদুস্বরে বলে উঠলেন, ‘আপ(up)।’ পরাধীনতা ও স্বাধীনতার সন্ধি-সীমায় দাঁড়িয়ে অফিসাররা কিংকর্তব্য বিমূঢ়, তাই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

     [সুরেন্দ্র চ্যাটার্জি কলিকাতা -পুলিশের প্রথম ভারতীয় কমিশনার। তিনি পল্লীতে-পল্লীতে হিন্দু-মুসলীমের যুক্ত মিটিং করে প্রতি জায়গায় নিজে বক্তৃতা দিতেন।

    আমি এরূপ বহু সভা, সংগঠন করে তার কাজে সাহায্য করেছিলাম। সুবক্তা কমিশনার-সাহেব এভাবে হিন্দু-মুসলীম সম্প্রীতি ফিরিয়ে এনেছিলেন। এই তেজস্বী ভদ্রলোক ব‍্যাক্তিত্বে ও কর্মদক্ষতায় অনন্য ছিলেন।]

     বাংলার প্রশাসন ও পুলিশের ইতিহাস এক ও অবিভাজ্য ছিল। এবার তা দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এপার বাংলা এপারের এবং ওপার বাংলা ওপারের ইতিহাস পড়বে। তবু পিছন ফিরে তাকালে দেখতে পাবে মূল-ইতিহাস একটাই।

     আমার মাত্র পনেরো বছরের চাকুরি-জীবনের মধ্যে এক মহা-অঘটন ঘটে গেল সেদিন। সেই কলকাতাকে আজও আমি স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পাই।

    পঞ্চানন ঘোষাল, ডেপুটি কমিশনার, 
    কলকাতা পুলিশ

    পুলিশ কাহিনী (  দ্বিতীয় খন্ড ) বইয়ের অংশ
     প্রকাশক ; মন্ডল বুক হাউস, ১৩৬৪
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দীপ | 2402:3a80:196c:30f8:778:5634:1232:***:*** | ০৯ মে ২০২৪ ২২:৪০742953
  • সৎসাহস থাকলে লেখা না মুছে তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা করুন।
  • হে হে | 2a03:e600:100::***:*** | ০৯ মে ২০২৪ ২৩:০৮742954
  • আবার লাথ খেতে এসছে চাড্ডিচো। একটা কিছু পড়ে তার সম্পর্কে নিজে দুচারকথা লেখার মুরোদ নেই অন্যের লেখা চিটিয়ে যাচ্ছে।  তোদের  স্কুলে সারসংক্ষেপ লেখা শেখায় নি?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন