সেদিন আলমারিতে ঘরে পরার জামাকাপড়ের তাকে হাঁটকাতে গিয়ে চোখে পড়লো একটি তুঁতে রঙের টি-শার্ট। সেটা ১৯৯৪ সালে সুন্দরগড়ে সরকারি বাসস্ট্যান্ডের কাছে সুজাতা স্টোর্স থেকে কেনা। এটুকুই এই স্মৃতিচারণার সাবান। সেটাই স্মৃতির জলে পড়ে, রোমন্থনের হাতে ঘুলে, নস্টালজিয়ার শ্বাসে ফুলে হয়ে দাঁড়ালো নিম্নোক্ত শব্দ-ফেনা।
অক্টোবর ১৯৯২ থেকে মার্চ ১৯৯৭ কর্মসূত্রে ছিলাম সুন্দরগড়ে। ওটি ওড়িশার দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা। ছোট্ট সুন্দরগড় শহর জেলা সদর হলেও তখন তা ছিল এক শান্ত জনপদ। বহিরাগতের রাত্রিবাসের একমাত্র জায়গা দেবাশীষ হোটেল। ভোজনের একমাত্র ভদ্রস্থ ঠিকানা উৎসব হোটেল। একমাত্র সিনেমা হল বিজয়া টকিজ, যেখানে চার বছরে মাত্র একবার, একা গিয়ে দেখেছিলাম একটিমাত্র সিনেমা - মূখ্য ভূমিকায় সানি দেওল, পূজা ভাটের 'অঙ্গরক্ষক'।
ব্রিটিশ আমলের সদর হাসপাতালটি টালির চালের। বাইক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তাতে একবার ভর্তিও ছিলাম একরাত। ছিল হেড পোষ্ট অফিস, ও দুটি ব্রাঞ্চ পোষ্ট অফিস। একটি মাত্র ব্যাঙ্ক - স্টেট ব্যাঙ্কের একটি বড় শাখা, একটি পেট্রল পাম্প, সার্কিট হাউস, সেশন কোর্ট, কালেক্টর অফিস, এস.পি বাংলো, জেল, কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় ইত্যাদি। অর্থাৎ একটি জেলা সদরের ন্যূন্যতম যেটুকু প্রশাসনিক পরিকাঠামোর প্রয়োজন হয়, সেটুকুই। এইসব নিয়ে তখন সুন্দরগড় যা ছিল তাকে শহর বলতে এখনকার প্রজন্ম হয়তো নাক সিঁটকোবে। আমাদের পুঁচকে ১৪” BPL কালার টিভিতে তখন কেবলে আসতো দুটি মাত্র চ্যানেল - DD ও Zee.
তবু, দীর্ঘ তিরিশ বছর পরেও, সেদিন এই টি-শার্টটি দেখে মনে পড়ে গেল সদ্যবিবাহিত জীবনের চারটি বছর কী সুন্দরই না কেটেছিল সুন্দরগড়ে!
তখন L&T ওখানে ১৬৩ কিমি দীর্ঘ সম্বলপুর - রৌরকেলা (SH-10) হাইওয়ে পূনঃনির্মাণ প্রকল্পের কাজ করছিল। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক ফান্ডেভ সেই প্রোজেক্ট তিনটে প্যাকেজে বিভক্ত ছিল। S2= সম্বলপুর থেকে ঝাড়সুগুদা। S3= ঝাড়সুগুদা থেকে বারগাঁও। S4= বারগাঁও থেকে রৌরকেলা। আমার পোষ্টিং ছিল মাঝে ৫৭ কিমি দীর্ঘ S3 প্যাকেজে। পেশাগত জীবনে ছিল নানান বৈচিত্র্যময় চ্যালেঞ্জ। নিরিবিলি জনপদে আটপৌরে জীবনযাত্রাও কিছু আকর্ষণীয় মানুষের সাহচর্যে কেটেছিল বেশ আনন্দে। চিরকাল স্বল্পে সন্তুষ্ট বলে ঘরে বাইরে বস্তুগত উপকরণের অভাবে বিশেষ কোনো মনোকষ্ট তখন টের পাইনি। আজও পাইনা।
সুন্দরগড়ে কোনো রেল স্টেশন নেই। কারণ সুন্দরগড়ের তৎকালীন রাজা তা চাননি। তাঁর মনে হয়েছিল রেল যোগাযোগ হলে যেসব অনুষঙ্গের আমদানি হবে - বহুল জনসমাগম, তুমুল কোলাহল, চুরি-ছ্যাঁচরামি - তা উৎপাত বিশেষ। ফলে ১৮৯৯ সালে খড়্গপুর স্টেশন তৈরি হবার পর ১৯০০ সালে বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ের বোম্বে হাওড়া রেললাইন ঝাড়সুগুদা থেকে ডাইনে বেঁকে বামরা, রাজগঞ্জপুর ছুঁয়ে রৌরকেলা, জামশেদপুর হয়ে চলে গেল হাওড়া। সুন্দরগড় বাঁদিকে, একান্তে পড়ে রইলো অচ্ছুত কন্যার মতো। আমরাও হাওড়া আসতে ট্রেন ধরতাম তিরিশ কিমি দুরে ঝাড়সুগুদা স্টেশন থেকে।
তবে সেখানে তখন ছিল না একটিও কারখানার চিমনি। ছিল শহরের মধ্যেই একটি বড় আয়তকার লেক ও সংলগ্ন উদ্যান। পাশেই একটি অনুচ্চ টিলা। অদুরে সর্পিল পথে প্রবাহিত ইব নদী। তার তীরে প্রাচীন সম্বলেশ্বরী, মহাদেব, জগন্নাথ ও আরো কয়েকটি মন্দির। নদীর কাছেই অতীতের রাজবাড়ী। অদুরে রাজার আমলে তৈরি রিজেন্ট মার্কেট। ছিল একটা বড় খেলার মাঠ ও স্টেডিয়াম।
জনপদে রাস্তার দু পাশে ছিল অনেক গাছ, কারণ অতীতে সুন্দরগড়ের রাজা ছিলেন বৃক্ষপ্রেমী। তার অনেকগুলি ছিল শতাব্দী প্রাচীন মহীরুহ। প্রখর গ্ৰীষ্মের দুপুরেও সেইসব গাছের ঘন ছায়াময় পথ ধরে হাঁটতে বেশ লাগতো। এইসব সামান্য আয়োজন নিয়ে সাকুল্যে দুই বাই দুই কিমি এলাকায় বিস্তৃত ছিল ওড়িশার দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলার সদর শহর সুন্দরগড়। সে তুলনায় স্টীল প্ল্যান্ট, রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এসবের দৌলতে ঐ জেলারই অন্তর্গত শ খানেক কিমি দুরে রৌরকেলা তখনই ছিল বেশ জমজমাট।
দেশে বা সমাজজীবনে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও অনেক কিছুই বিশেষ বদলায় না। তা যেন শালগ্ৰাম শিলার মতোই অনড়, অক্ষয়। তাই স্বাধীনতার প্রায় ৭৭ বছর পরেও দেশের অধিকাংশ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে থাকে মুষ্টিমেয় ধনীদের কাছে। এখনও প্রতি বছর বহু কৃষক নিদারুণ অভাবে আত্মহত্যা করেন। এই লজ্জায় যাঁদের মাথা নত হওয়ায় কথা তাঁরা কথার ফুলঝুরিতে নির্বাচনী জনসভায় প্রতিশ্রুতির ফানুস ওড়ান।
ব্যক্তির জীবনে তিন দশক বড় কম সময় নয়। এই দীর্ঘ সময়ে ঘরে বাইরে তার নিজস্ব পরিসরে অনেক কিছু বদলায়। পুরানো গাড়ি বাতিল হয়, নতুন গৃহে প্রবেশ হয়, পুরানো সম্পর্কে শ্যাওলা ধরে, নতুন অহং পুষ্ট হয়, পুরানো স্মৃতি ধূসর হয়, নতুন মানে খুঁজতে হয়। এমন নানা পরিবর্তনের প্রভাবে কখনো জীবনের কিছু সরল সমীকরণ ক্রমশ বিবর্তিত হয় জটিল অসমীকরণে।
এসবের মাঝে তিন দশক ধরে একটি সামান্য টি-শার্ট নীরবে সার্ভিস দিয়ে যায়! ভেবে অবাক লাগে। এখনো তা কোথাও এতটুকু ছেঁড়েনি, সেলাই খোলেনি। তবে তার উজ্বল রঙ বহু ব্যবহারে কিঞ্চিৎ বিবর্ণ হয়ে গেছে। তবে পুরোনো হলেও ব্যবহারের উপযোগী পোশাক বা অন্য কোনো বস্তুও প্রাণে ধরে বাতিল করতে পারি না আমি। এই টি-টা বহু কাচাকাচিতে হয়ে গেছে কিছুটা ঢিলেঢালা, মোলায়েম। তাই পরলে খুব আরাম হয়, যেন গায়ে বোলানো মা, ঠাকুমার স্নেহময় হাত। তাই ওটা দেখে উথলে উঠলো কিছু প্রাচীন স্মৃতির ঢেউ! অলস ভাবনা ভাজলো কিছু পেঁজা কথার খই!
অনেকেরই সঙ্গত কারণে নামী, বিদেশী brandএর প্রতি দূর্বলতা আছে। এটি লুধিয়ানার একটি দেশী brand - Duke. এহেন সার্ভিস দেওয়ার জন্য আমি এই দেশী পণ্যটির গুণমানের প্রশংসা না করে পারলাম না।
খুব ইচ্ছে করে সুন্দরগড়ের নানা সুন্দর স্মৃতি শব্দের মোড়কে ধরি। সময়ের সাথে স্মৃতি ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছে। জানি না সেসব কখনো লিখে উঠতে পারবো কিনা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।