

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘আমরা বাঙালি’ কবিতায় তাঁর সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “বিষম ধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙালি দিয়াছে বিয়া...”, আবার একই বছরে জন্ম হওয়াতে তাঁর সত্তর বছরের জন্মদিনে বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশস্তিপাঠে বলেন, “কালের যাত্রাপথে আমরা একই তরণীর যাত্রী...”। তাঁকে বাঙালি চেনে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, দেশপ্রেমী, ছাত্রদরদী, দানবীর, ব্যাবসায়ে উদ্যোগী পুরুষ হিসেবে। এ লেখায় তাঁর জীবনের এমন কিছু অংশের কথা বলবো, যার কিছু অন্যান্য বইয়ে পাওয়া গেলেও, বাকি আমি জেনেছি পারিবারিক গল্প হিসেবে।
আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্ম—অবিভক্ত বাংলার (ব্রিটিশ ভারত) খুলনা জেলার কপোতাক্ষ নদীর তীরে রাড়ুলি কাটিপাড়া গ্রামে এক প্রাচীন জমিদারবাড়ির অন্দরমহলে। সাল ১৮৬১, তারিখ ২রা আগস্ট। বংশের পুর্বপুরুষ দেওয়ান মানিকলাল রায়চৌধুরী বাংলার নবাবের থেকে দক্ষিণদেশে অনেকগুলো তালুক পত্তনি পেয়ে কপোতাক্ষ-তীরে এই অঞ্চলে, গাছপালা কেটে, জঙ্গল পরিষ্কার করে, জমিদারি স্থাপনা করেন। রায়ের আল বা আলি থেকে গ্রামের নাম হয় রাড়ুলি আর গাছপালা কেটে স্তুপ করে রাখা পাশের গ্রামের নাম কাটিপাড়া। মানিকলাল যথেষ্ট অর্থশালী ছিলেন। ভারী লোহার কড়িকাঠের বরগা, চুন-সুরকি দিয়ে তিনি অন্দরমহলে মহিলাদের জন্য একটি দ্বিতল বাড়ি তৈরি করেন। এই অন্দররমহলেরই একতলার একটি ঘরে, মানিকলালের বংশধর হরিশ্চন্দ্র রায়চৌধুরীর স্ত্রী ভুবনমোহিনী দেবী জন্ম দেন প্রফুল্লকে।

মানিকলাল—জমিদারি পরিচালনার জন্য—সামনের বহির্বাটিতে পশ্চিম ভিটায় একটি উঁচু দ্বিতল বাড়ি, পুবে একতলার সারি দেওয়া কাছারি ঘরগুলি, উত্তরের ভিটায় বিশাল চণ্ডীমণ্ডপ ও দক্ষিণে বিশাল পাল্লার লোহার বেড় দেওয়া কাঠের সিংহদরজা সমেত এক চকমিলানো বাড়ি তৈরি করেন। দোতলার হলঘরে প্রজাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বড় ফরাশ পাতা থাকত। সে ঘরে থাকত ঝাড়লন্ঠন, টানা পাখা, বড় আবলুস কাঠের কালো গোলটেবিল চেয়ার, ইত্যাদি। চণ্ডীমণ্ডপে প্রতিবছর ধুমধাম করে দুর্গাপূজা হত। জনশ্রুতি ছিল, যে মানিকলাল কয়েক ঘড়া মোহর মাটির নীচে পুঁতে রেখেছিলেন; সেজন্য কয়েক পুরুষ পরেও গ্রামবাসীরা রাত্রে লুকিয়ে বাড়ির কাছাকাছি শাবল দিয়ে খোঁড়াখুড়ি করত—যদিও কোনো মোহরের ঘড়া পাওয়া যায়নি। এ সমস্ত কথা প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর ‘Autobiography of an Indian Chemist’ বইতে লিখেছেন। তৎকালীন চক্রবর্তী-চ্যাটার্জী পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত বইটির প্রথমেই অন্দরমহল ও বহির্মহলের দুটি সুন্দর আলোকচিত্র আছে।
মানিকলালের ছেলে আনন্দলাল বাড়িগুলি রক্ষণাবেক্ষণ ও জমিদারি মজবুত করেন। তাঁর ছেলে হরিশ্চন্দ্র ছিলেন বিদ্যানুরাগী এবং নিজেও যথেষ্ট পড়াশুনা করতেন। বলা হয়, তিনি সাতটা ভাষা জানতেন। বাড়ির একতলায়, পূর্বদিকের কাছারির ঘরগুলির পাশের একটি ঘরে বড় বড় কাঠের আলমারিতে প্রচুর বই সংগ্রহ করে তিনি একটি পারিবারিক লাইব্রেরি তৈরি করেছিলেন। জমিদারি এবং অন্যান্য বৈষয়িক ব্যাপারে তাঁর অতটা আগ্রহ ছিল না। গ্রামে ইংরেজি স্কুল না থাকায় তিনি জমিদারি পরিচালনার ভার নায়েবের হাতে তুলে দিয়ে, নিজের চার ছেলে – জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র, নলিনীকান্ত, প্রফুল্লচন্দ্র ও পুর্ণচন্দ্রকে নিয়ে কোলকাতার আর্মহার্স্ট স্ট্রিটে একটি দোতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানকার অ্যলবার্ট স্কুল, হেয়ার স্কুল এসব জায়গায় ছেলেদের ভর্তি করে পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। সেখানে ঠাকুর-চাকর দিয়ে তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হত। হরিশ্চন্দ্র এতটাই বিদ্যানুরাগী ছিলেন, যে তিনি স্ত্রী ভুবনমোহিনীকেও কিছুদিন এখানে এনে রেখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে বাংলা শেখানোর জন্যে। বহুকাল এই বাড়িটিই ছিল রায়চৌধুরীদের কলকাতার ঠিকানা। তখন কপোতাক্ষর ঘাট থেকে স্টিমার সরাসরি কোলকাতার আউটরাম ঘাটে ভিড়ত। ওদিকে রাড়ুলিতে, নায়েব, সরকারের ঘরে খাজনা না দিয়ে বেশ কয়েকটি তালুক বেনামে নিজেই কিনে নেন। হরিশ্চন্দ্র বেশ অর্থসংকটে পড়েন। ছেলেদের পড়াশুনার খরচ চালাতে তিনি অভিধান রচনা করেন। সে বই বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এমনকি মা ভুবনমোহিনী তাঁর কিছু গয়নাও খুলে দেন ছেলেদের উচ্চশিক্ষার জন্য। এ সব কথাও আছে প্রফুল্লচন্দ্রের অটোবায়োগ্রাফি-তে।
এই বইটির বারবার উল্লেখ করার কারণ—এতে রাড়ুলির বাড়ি, তাঁর মা-বাবার অবদান—এই সব বিষয়ের কথা লেখা আছে। অনেকেই জানেন, যে প্রফুল্লচন্দ্র বহু পড়াশুনা করে হিষ্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি – পার্ট ওয়ান ও পার্ট টু বইদুটি রচনা করেছিলেন। এ ছাড়া বাঙালিকে স্বনির্ভর করতে ও ব্যবসায় আগ্রহ বাড়াতে তিনি বাংলায় লিখেছিলেন, ‘বাঙালির অন্নসমস্যা ও তার প্রতিকার’ বইটি। বাঙালি যাতে ব্যবসায়ে উৎসাহ পায়, সেজন্য তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়ে তৈরি করেন, ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিটিউক্যালস লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠানটি এবং সেটি সফলভাবে পরিচালনা করে দেখিয়েছিলেন। আমাশয়ে ভোগা শীর্ণদেহ প্রফুল্লচন্দ্র এন্ট্রান্সে সাধারণ ফল করেছিলেন। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় যখন তিনি নামী ‘গিলক্রাইষ্ট স্কলারশিপ’-এর জন্য পড়াশুনা করছিলেন, তখন সহপাঠীরা অনেকেই তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে থাকেন, কিন্তু ভারতবর্ষ থেকে যে দু-জন স্কলারশিপ পেয়েছিলেন—তার একজন প্রফুল্লচন্দ্র। এই বৃত্তি নিয়ে তিনি এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে পরপর বিএসসি ও ডিএসসি (Doctor of science) ডিগ্রি অর্জন করেন। ফিরে এসে 1889 সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে মাত্র আড়াইশো টাকায় রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ঐ সময় ঐ কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসুকে সঙ্গে নিয়ে ইংরেজ অধ্যাপকদের সমান বেতন পাওয়ার জন্য আন্দোলন করেন। কয়েক মাস কাজ করে তিনি মায়ের সোনার গয়না আবার গড়িয়ে দেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পরের দিকে তাঁর হাজার টাকা (তৎকালীন) মাইনে হয়েছিল, কিন্তু নিজের জন্য দশভাগ রেখে বাকি নব্বই ভাগই দুঃস্থ ছাত্র, বিধবা, সহায়সম্বলহীনা – এদের দান করে দিতেন। সে সময় সায়েন্স কলেজের দোতলার একটি ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল; পাশের ঘরে একটি ছোট রসায়নাগার। তাঁর ছাত্র, ছোটভাই পূর্ণচন্দ্রের ছেলে চারুচন্দ্র এখানে তাঁর সঙ্গেই থাকতেন ও একসাথে প্রেসিডেন্সি কলেজে যেতেন— যথাক্রমে শিক্ষক ও ছাত্র হিসেবে। অবশ্য প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যবরেটরির একটা অংশেও তিনি তাঁর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতেন। এই সময় তিনি মারকিউরাস নাইট্রেট এবং কিছু জৈব যৌগ আবিষ্কার করেন। মারকিউরাস নাইট্রেট ছিল দুটি বিষম ধাতুর যৌগ। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধি দেন, যেটিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আচার্য্য’ নামে তর্জমা করেন।

প্রফুল্লচন্দ্র মনেপ্রাণে স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করতেন। খাদির ধুতি ও খাদির কালো কোট পরতেন। কলকাতা সন্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির হয়ে তিনিই গান্ধীজিকে ট্রেন থেকে নিয়ে আসেন। নিজে হাতে চরকায় সুতো কাটতেন। তাহলে তিনি কেন নাইট উপাধি ত্যাগ করেননি? এর উত্তরে তিনি বলতেন, “আমি রোগাসোগা মানুষ, সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধিতা করলে ওদের মোটা লাঠির বাড়ি সহ্য করতে পারব না, আমার প্রাণটাই চলে যাবে।”
১৯২১ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত এমিরিটাস অধ্যাপক হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে, সর্বমোট যে একলক্ষ আশি হাজার টাকা (তখনকার হিসেবে) পেয়েছিলেন, বিদায় নেওয়ার সময় পুরো টাকাটাই বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে যান। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সায়েন্স কলেজের ঘর তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়। তিনি তখন তার বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠানের মানিকতলার একটি ঘরে বা কখনও পানিহাটি শাখার একটা ঘরে থাকতেন। কলকাতায় একটি বাড়ি কি তিনি করতে পারতেন না? বেঙ্গল কেমিক্যাল তখন কানপুর ব্রাঞ্চ সহ সারা ভারতবর্ষে ভাল ব্যাবসা করছে, তাঁর বইগুলিরও ভাল চাহিদা ছিল। অথচ, বিলাসিতা বলতে শুধু একটি ফিটন গাড়ি কিনেছিলেন, সেটায় চড়ে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যেতেন।
প্রফুল্লচন্দ্র সবসময় ছাত্র পরিবৃত থাকতেন। সায়েন্স কলেজে তাঁর ছাত্ররা – মেঘনাদ সাহা, জ্ঞান ঘোষ, ফজলুল হক তাঁর ঘরে বহু সময় কাটাতেন। আবার বেঙ্গল কেমিক্যাল গড়ে তোলার সময় তাঁর অনেক মেধাবী ছাত্র, যেমন রাজশেখর বসু—যিনি পরে সাহিত্যিক পরশুরাম হবেন—যোগ দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময়, গ্রীষ্মাবকাশে বা পুজোর ছুটিতে ছাত্রদের নিয়ে দেশের বাড়ি রাড়ুলিতে যেতেন। বাইরের বাড়ির দোতলার হলঘরে ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করা হত। প্রফুল্লচন্দ্র থাকতেন তাঁর নিজস্ব দক্ষিণের কোণার ঘরটিতে। বাবা হরিশচন্দ্র ততদিনে প্রয়াত হয়েছেন। প্রফুল্লচন্দ্র পৈত্রিক পদবীর শুধু ‘রায়’ লিখতেন, ‘চৌধুরী’ আর লিখতেন না। বড়দা জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র কোলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট ছিলেন। তিনি শেষ জীবনে ডায়মন্ড হারবারের কাছে সরিষাতে বাড়ি তৈরি করে থাকতেন। মেজদা নলিনীকান্ত রাড়ুলির বিষয়সম্পত্তি দেখাশুনো করতেন। ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্র ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্রের একান্ত অনুগত। কেমিস্ট হিসেবে বেঙ্গল কেমিক্যালে কাজে সহায়তা করতেন। অনেকেই জানেন না, যে, বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠানের অর্ধেক মালিকানা প্রফুল্ল ছোটভাই পূর্ণচন্দ্রকে দিয়েছিলেন।
বাড়িতে দুপুরে খাওয়ার পরে মা ভুবনমোহিনীর কাছে বসতেন। তখন তিনি তার স্নেহের ‘ফনু’-র সাথে অনেক সুখ-দুঃখের কথা বলতেন। বিকেলে ছাত্রদের জন্য বাড়ির গাছের মিষ্টি আম কেটে দেওয়া হত, সঙ্গে কাঁচাগোল্লার সন্দেশ। সকাল ছ-টা থেকে ন-টা তিনি নিজের ঘরে দরজা দিয়ে পড়াশুনা করতেন। সেই সময় তাঁকে ডাকা চলতো না। গ্রামবাসীরা তাঁর সঙ্গে দোতলার লম্বা টানা বারান্দায় দেখা করতে এলে তিনি নানা জৈব যৌগ দিয়ে নিজের হাতে লিচু, লেবু – এইরকম নানা স্বাদের সরবত খাইয়ে তাদের চমৎকৃত করে দিতেন। পুজোর সময় ছাত্ররা এলে খুব আনন্দ পেত, কারণ বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে ধুমধাম করে দুর্গাপূজা হত, রাত্রে উঠোনে যাত্রাপালা। গ্রামের একমাত্র পুজো—গ্রামবাসীরা হৈ হৈ করে অংশগ্রহণ করতেন। সকালে ছাত্রদের জন্য আসত ঘিয়ে ভাজা লুচি, নারকোল দিয়ে ছোলার ডাল, মিষ্টি। দুপুরে বাড়ির সদর পুকুর থেকে বড় কাতলা মাছ ধরে উঠোনে ফেলা হত। কুটে-বেছে ছাত্রদের জন্য হত মাছ ভাজা, মাছের ঝোল।

এক গ্রীষ্মের বিকেলে প্রফুল্লচন্দ্র ভাইপো চারু-সহ অন্যান্য ছাত্রদের নিয়ে কপোতাক্ষ নদীতে নৌকাভ্রমণে যান। হঠাৎ কালবৈশাখীর তুমুল ঝড়ে সে নৌকা ডুবে যায়। সবাই ভাল সাঁতার জানায় সাঁতরে কাটিপাড়ার ঘাটে ওঠেন। ভিজে কাপড়ে এক মাইল হেঁটে রাড়ুলির বাড়িতে কাছারি দিয়ে ঢুকতে যাবেন, মেজদা নলিনীকান্ত বললেন, ‘তুমি ঐ মাঝির নতুন নৌকো তৈরির টাকা দিয়ে দেবে’। সেজ ভাই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানান। মজার কথা—মাঝির পুরোনো নৌকোও পরে ভেসে উঠেছিল।
এ সমস্ত পারিবারিক গল্প আমি আমার বাবা চারুচন্দ্র রায়চৌধুরী ও ঠাকুরমা, যিনি ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্রের স্ত্রী—তাঁদের কাছে শুনেছি। আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর জন্মভূমিকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। এলাকায় স্কুল না থাকাতে বাড়ির নীচের ঘরগুলিতে পিতা হরিশ্চন্দ্র প্রতিষ্ঠিত যে মাইনর স্কুল ছিল, তাকে সরিয়ে কপোতাক্ষ তীরে অনেকটা জায়গা, বিশাল খেলার মাঠ, অর্জুন, মেহগিনি ইত্যাদি গাছ বসিয়ে বড় ইমারতের হাইস্কুল তৈরি করে দেন। ছাত্র, ভাইপো চারুচন্দ্রকে এ স্কুলের শিক্ষকতার দায়িত্ব দেন। তখনকার অবিভক্ত বাংলা থেকে আরও অনেক ভাল শিক্ষক এনে এই স্কুলের সাথে যুক্ত করেন এবং প্রচুর বই এনে স্কুলের নিজস্ব বড় লাইব্রেরি গড়ে তোলেন। রাড়ুলি কাটিপাড়া ছাড়া পাশের গ্রাম বাঁকা ও খেশরার নামের আদ্যাক্ষরের সাথে পিতার নাম জুড়ে সে স্কুলের নাম হয় ‘আর কে বি কে হরিশ্চন্দ্র ইনস্টিটিউশন’। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরে অন্য শরিকেরা চলে গেলেও চারুস্যার তাঁর শিক্ষক সেজ জ্যাঠামশায়ের দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। প্রফুল্লচন্দ্র গ্রামের মেয়েদের শিক্ষার জন্য রাড়ুলিতে তাঁর মায়ের নামে ভুবনমোহিনী বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। গ্রামের মানুষ ও চাষীদের সুবিধার্থে রাড়ুলিতে একটি কো-অপরেটিভ ব্যাঙ্কও প্রতিষ্ঠা করেন, সেটি বাংলাদেশের সরকারি কো-অপরেটিভ ব্যাঙ্ক হিসেবে এখনও কাজ করে যাচ্ছে। কাছেই বাগেরহাটে একটি কলেজ স্থাপন করেন; ছাত্র ফজলুল হকের জোরাজুরিতে সে কলেজের নাম হয়—বাগেরহাট আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ বা সংক্ষেপে ‘এ পি সি কলেজ’। সেটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সরকারি কলেজ। রাড়ুলি গ্রামের হাইস্কুলটির সাথে এখন সরকারি কলেজ হয়েছে। ষাটের দশকে—আমার ছোটবেলায়—আমি আমাদের ঐ পৈত্রিক বাড়িতে থাকতাম। বাবা ঐ হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন এবং বিনা পয়সায় অনেক গরীব মেধাবী ছাত্রও পড়াতেন। আমাদের বাড়িতে আমি বহু বাঁধানো মাসিকপত্র, যেমন প্রবাসী, ভারতবর্ষ পত্রিকা, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা দেখেছি। খাদির চরকা ছাপ দেওয়া তেরঙ্গা পতাকা ছিল, চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুর বাঁধানো ফটো ছিল। নীচে একতলায় হরিশ্চন্দ্র-প্রতিষ্ঠিত বাড়ির নিজস্ব লাইব্রেরিতে আমরা বই পড়তাম। সে লাইব্রেরি এখন গ্রামের সাধারণ পাঠাগার। আমার ছোটবেলায় ঐ ভুবনমোহিনী স্কুলে পড়েছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতায় আমরা এ-পার বাংলায় চলে আসি। তিরাশি সালে আমার বাবার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি বারবার একা ঐ বাড়িতে গিয়ে থাকতেন এবং বাড়িটা যাতে সরকার নেন সেজন্য ঢাকায় লেখালেখি করতেন।

বিজ্ঞানীর বাড়ি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার এখন আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্রের জন্মভিটা বাড়ির অন্দরমহল ও বাইরের মহল সবটাই অধিগ্রহণ করেছেন। গ্রামের লোক এখনও চণ্ডীমণ্ডপে দুর্গাপূজা করেন বলে সরকার চণ্ডীমণ্ডপটি সুন্দর সংস্কার করেছেন, কিন্তু এই প্রাচীন বাড়ির অন্য অংশ ভেঙে পড়ছে। প্রতি বছর ২রা আগস্ট এই বাড়ি ও সামনের মাঠে বড় করে আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মদিন পালন করা হয়।
&/ | 151.14.***.*** | ০৩ আগস্ট ২০২৩ ০০:৫৬522026
পার্থ সারথী দত্ত | 27.13.***.*** | ০৩ আগস্ট ২০২৩ ১৮:৪৩522065
&/ | 151.14.***.*** | ০৩ আগস্ট ২০২৩ ২২:৩৪522073