এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • নিউনর্মাল করোনাকালীন পর্ব বাহান্ন

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০২ আগস্ট ২০২৩ | ৫৯১ বার পঠিত
  • পর্ব আটষট্টি

    অনিল টমাস তাঁর বেডরুমসংলগ্ন বারান্দায় বসে।
    আবছা আলোতে কৃষ্ণ কিরীডম গাছটিকে মুকুট পরিহিত কোনো ঐশ্বরিক মূর্তির মতো দেখায়। পাশে ঝাউগাছগুলি প্রজা যেন।
    অনিলের মন ভালো নেই। তিনি এবং তাঁর পরিবার এখনো পর্যন্ত শারীরিক ভাবে সুস্থ আছেন, কিন্ত এই সেকেন্ড ওয়েভের ধাক্কা, অনবরত গৃহবন্দিত্ব, আতংক এবং আইসোলেশনে তিনি বিধ্বস্ত।
    কেরলে ট্রিপল লকডাউন রেস্ট্রিকশন চলছে। থিরুভানন্তপুরম, থ্রিশূর, এর্নাকুলমে এবং মোল্লাদের বিশেষত। এগুলো হাই রিস্ক এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
    অনিলকে খুব সাবধানে থাকতে হচ্ছে তাঁর ফুসফুসজনিত কারণে। আগে সবার ধারণা ছিল কোভিড একবার আক্রমণ করলে আর ফিরে আসে না। এখন দেখা যাচ্ছে একবার পজিটিভ রোগীও দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হতে পারেন। ভ্যাকসিনেটেড হলেও মানুষ করোনা আক্রান্ত হতে পারে। পলি এবং অনিল একেবারেই গৃহবন্দিত্ব নিয়েছেন বাচ্চাদের নিয়ে। পলির মা এবং বোনও এখন এই বাড়িতে।
    পিনায়রি ভিজয়ন প্রেস কনফারেন্স ডেকে চারটি জেলার কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করেছেন ।এই জেলাগুলি ভয়ানকভাবে সেকেন্ড ওয়েভে অ্যাফেক্টেড। এই ভয়াবহতা ভীষণভাবে আশাতীত ছিল। ফার্স্ট ওয়েভে প্রথমদিকে কেরল যতটাই সফল ছিল, শেষের দিকে ততটাই ব্যর্থ। কেস ফেটালিটি রেট বলেছে, আরো অনেক আই সি ইউ দরকার। আসলে করোনার এই ডাবল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়ান্ট সম্পর্কে সাধারণ মানুষ একেবারেই অবহিত ছিলেন না। কোনো রাজ্যেই নয়। কেরলে কাজের কাজ যেটা হল, সেটা হল প্রত্যেকটি কোভিডের মৃত্যুর ডিটেইলড অডিট রিপোর্ট।
    তাতে নথিভুক্ত থাকল রোগীর নাম, বয়েস, মৃত্যুর কারণ, সম্পর্কিত ফ্যাক্টরগুলি, বাড়িতে মৃত্যু না হাসপাতালে, কতদিন রোগী ভুগেছেন, আই সি ইউ না অক্সিজেন বেড, ভ্যাক্সিনেশনের স্লট।
    কেরালা সোশ্যাল সিকিউরিটি মিশনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড.মহম্মদ আশিল বললেন, ডেথ উইল কাম ডাউন ইন দ্য নেক্সট টু অর ফোর উইকস  ডিউ টু ডেথ ল্যাগ। তাঁর বক্তব্য, সরকারী অফিশিয়াল মৃত্যুর চেয়ে বাস্তবে মৃত্যুর ঘটনা তিন থেকে পাঁচগুণ।
    এটা যে ভীষণ সত্যি সেটা অনিল হাড়ে হাড়ে জানেন। এই ছোট্ট জায়গা চেঙ্গালাতে তাঁর অতি প্রিয় বন্ধু চক্ষু চিকিৎসক  জনাথন অতি অকালে করোনাতে চলে গেছেন। জনাথন ডিসুজা একেবারে শক্তসমর্থ মানুষ ছিলেন। কখনো তাকে গাড়ি ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।
    একহয় পদব্রজে নয়তো সাইকেলে তিনি চার্চ সংলগ্ন হাসপাতালে এবং রোগী দেখতে যেতেন। এই হাই রেস্ট্রিকটিভ ট্রিপল লকডাউন মোড চালু হবার আগেই অনিলের জীবনে তিনটি বেদনাবৃত্তান্ত ঘটে গেছে। অদিতির মৃত্যু। জনাথন চলে গেছেন। মারা গেছেন ফাদার ম্যাথ্যু। যিনি সুখে দুঃখে এই পরিবারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।অনিলের সুস্থতা উপলক্ষ্যে, হোম কোয়ারানটাইন থেকে মুক্তি উপলক্ষ্যে যে ছোট্ট গ্যাদারিং হয়েছিল, ফাদার ম্যাথ্যু সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অনিলের এখন সেইসব দিনের কথা মনে পড়লেই  হাত পা কাঁপতে থাকে। দুবাই থেকে সোজা ডিটেকশন সেন্টার। তারপর আউটহাউসে সেই অসহায়দিনগুলো। ঐ আউটহাউস তখন জেলখানা ।পলি কী সাংঘাতিক শক্তিতে সামলেছিলেন সবকিছু।
    অনিল বলে উঠতে পারেননি, শুধু পজিটিভ নয় পলি। আমার লাংগসে একটা স্পট আছে। দ্যাট মাইট বি ক্যানসেরাস। দ্যাখো, আমি এই আতঙ্কে ভুগছি!
    শুধু এই বাগান সঙ্গী ছিল। আর দূর থেকে পলির নিরবিচ্ছিন্ন যত্ন। দেবরূপের ফোনের অপেক্ষা । দেবরূপের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে জড়িয়ে যায় আরেকটা নাম। অনিল ভুলতে চান।
    ছোট ছোট ফার্ণগুলো নিবিড় সবুজ। চাঁপাগাছে এখন প্রচুর ফুল। কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল। শুধু এই কাঁঠাল যে নামাতো, অনিলের অসুখের সময় যে নিয়মিত হোম ডেলিভারি দিয়ে গেছে নিত্য প্রয়োজনের জিনিস পত্র, সেই মুরুগণ নেই। চকচকে বার্ণিশ করা মুখটি। সদাহাস্যময়। তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা গেছে। মুরুগণ ছাড়া যে তাঁদের জীবন চলবে, এটাই একসময় ভাবা যেত না। সমস্ত পরিবার থম মেরে গেছিল। সময় এত দ্রুত চলে যায় অথচ অভাববোধ যায়না।
    পলি আর এমিলি তাঁদের প্রিয় নালুকেতু সংলগ্ন হলে বসে বহু পুরোনো একটি ছবি দেখছেন। তাতে তেমন নাচগান নেই। নায়িকা মূক ও বধির। তিনি আঙুলের মুদ্রায় নায়ককে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। ফিল্ম দেখা যত না উদ্দেশ্য তার থেকে বড় উদ্দেশ্য হল সময়টা পার করা। পলির মা কে বিশেষ যত্নে রাখতে হয় বয়সজনিত কারণে। নেহাত তাঁদের বাড়িটি বড়। বাগান সমৃদ্ধ। এখানে বেশির ভাগ বাড়িই খোলামেলা। গাছ আছে। অনিল ভাবেন বড় শহরগুলিতে ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা কেমনভাবে জীবন কাটাচ্ছেন!
    আবার মুম্বাই যাওয়া বন্ধ। চেক আপ হচ্ছে না। আপাতত অনিল টেলিমেডিসিনে আছেন। ত্রিদিবের জন্য বড় চিন্তা হয়। হি শুড সারভাইভ। পুওর দেবরূপ। কী ঝড় যাচ্ছে ওর ওপর দিয়ে !
    নালুকেতুর ডানদিকে একটি ক্ষুদ্রায়তন শৌখিন বাঁশঝাড়। তার ওপর দিয়ে মৃদু বাতাস বয়ে এলো। কিন্ত এখন হাওয়া বাতাসও আর শান্তি দেয় না।
    করোনা ভাইরাস আর শুধুমাত্র ড্রপলেট নয়। বায়ুবাহিতও বটে। এত টেনশন নিয়ে বাঁচা যায়।
    অনিলের কন্যাটি গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করে ক্রিয়েটিভ রাইটিং ক্লাস করছে। রাস্কিন বন্ড বলছেন। পুত্রটি জাপানি ভাষা শিখছে ল্যাপটপে। এদের শৈশবের অমূল্য দুটি বছর চলে গেল। সারাদিন প্রায় ল্যাপটপে বসে থাকে। অনিলের খুব কষ্ট হয় দেখে। তাও বাগান আছে বলে এরা দু দন্ড খেলে। অন্যরা কী করে ! চেঙ্গালাতেই কোভিডে আনপ্রিপেয়ার্ড আনঅফিশিয়াল মৃত্যুসংখ্যা অফিশিয়াল সংখ্যা অধিক তিন শতাংশ বেশি! সারা ভারতবর্ষে কত হবে কে জানে!
    অনিলের ছেলেটি লম্বা হয়েছে একবছরে। সে হঠাৎই দৌড়ে এসে বলল, গেংকি দেস কা?
    তার মুখে মিটমিটে হাসি। সে মাঝেমাঝেই সবাইকে জাপানি ভাষায় প্রশ্ন করে। ভাগ্যিস শৈশব এমন করে হাসতে পারে !
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০২ আগস্ট ২০২৩ | ৫৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন