‘মেয়েটা আমাকে একদম বোকা বানিয়ে চলে গেল’ -- প্রবল ছাত্রদরদী হেডমাস্টারমশাইয়ের কণ্ঠস্বরে গাঢ় অভিমান। বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বলে ক্লাস ইলেভেনের একটা মেয়ে এসে কেঁদে পড়েছিল তাঁর কাছে। বলেছিল, ‘আমাকে বাঁচান স্যর, আমি পড়াশুনা করতে চাই’। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেদিন মেয়েটির বিয়ে আটকে ছিলেন তিনি। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তিনি টের পাননি, মেয়েটি ইতিমধ্যেই ‘বাগদত্তা’। ওই ঘটনার কয়েকদিন পরেই সেই প্রেমিকের সঙ্গে সে উধাও হয়ে যায়।
এমন ঘটনা ইদানীং অনেক ঘটছে। বস্তত এত বেশি পরিমাণে ঘটছে যে আঠারোর কাছাকাছি নাবালিকাদের বিয়ের খবর পেলে আজকাল চাইল্ড লাইন বা প্রশাসনের তরফে সেই বিয়ে বন্ধ করার খুব একটা সদিচ্ছা দেখা যায় না। দিন পনেরো আগের ঘটনা। সতেরো বছর পাঁচ মাস বয়সী একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে থানায় ফোন করেছিলেন হুগলী জেলার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ‘থানা থেকে তো পরিষ্কার বলে দিল, কী লাভ মাস্টারমশাই এই বিয়ে আটকে? আর তো মাত্র ক’মাস, একবার আঠারো বছর হতে দিন, দেখবেন ও মেয়ে নিজেই পালিয়ে যাবে বয়ফ্রেন্ডের সাথে।’ – দুঃখ করছিলেন তিনি।
মজার ব্যাপার হল, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মেয়েদের বাবা-মা থেকে শুরু করে সমাজ বা প্রশাসন পর্যন্ত কেউ-ই একটি মেয়ের নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করাটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। আঠারো বছর পার হবার পর যদি একইভাবে জোর করে পরিবার থেকে ‘অপছন্দের পাত্রের’ সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়, তখন তো স্কুলের দরজা তখন তার জন্য বন্ধ, চাইল্ড লাইন তাকে আর ‘এন্টারটেইন’ করবে না। তাহলে তখন সে কার কাছে যাবে? সোজাসুজি থানায় গিয়ে দাঁড়াবার সাহস বা উপায় কটা মেয়ের থাকে? পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর উপায় কী!
এ তো মোটামুটি আমাদের সকলেরই জানা যে, নাবালিকা বিবাহে দেশের সব রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম। কিন্তু তাদের মধ্যে ক’জন স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়ছে আর ক’জন পরিবারের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে -- তার কোনো পরিসংখ্যান এ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই। যদি নেওয়া যেত, নিশ্চিতভাবেই দেখা যেত, স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়া (বা পছন্দের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া) মেয়ের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। কিন্তু সত্যিই কি তারা ‘স্বেচ্ছায়’ ঘর ছাড়ে, নাকি পরিবেশ-পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করে?
কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু হবার পর প্রথম দু’এক বছর এই প্রবণতা অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কন্যাশ্রী-ক্লাবের মত সংগঠনগুলো বাল্য-বিবাহ রুখতে খুব বড় ভূমিকা নিয়েছিল। পাশাপাশি ‘কন্যাশ্রী’ নিয়ে সদর্থক প্রচারের একটা ঢেউ উঠেছিল গ্রামে-গঞ্জে, মেয়েরা একাধারে সতর্ক ও সচেতন হয়ে উঠছিল। মনে করে দেখুন, ২০১৪-১৫ সাল নাগাদ কন্যাশ্রীদের সদলবলে হানা দিয়ে সহপাঠিনীর বিয়ে রুখে দেবার ঘটনা প্রায়শই সংবাদপত্রে চোখে পড়ত। পাশাপাশি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবার স্বপ্ন দেখছিল মেয়েরা, ফলে প্রেম করলেও নাবালিকা অবস্থায় পালিয়ে যাবার হঠকারিতা খুব একটা দেখা যাচ্ছিল না চারপাশে।
কিন্তু দু-বছরের অতিমারী-জনিত ছুটি আরও অনেক সামাজিক সংগঠনের মত স্কুলে-স্কুলে কন্যাশ্রী-ক্লাবগুলিকেও শীতঘুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে নবান্ন-র পাশের গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। বিপুল দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জমান শিক্ষা-দপ্তর তথা রাজ্য সরকারের এখন আর নাবালিকা-বিবাহ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। ফলে একদা ইউনেস্কো থেকে পুরস্কৃত যে ‘কন্যাশ্রী প্রকল্প’ ছিল নাবালিকা বিবাহ রোধ করার অন্যতম হাতিয়ার, যা নিয়ে রাজ্য সরকারের গর্বের অন্ত ছিল না, এখন তা-ই হয়ে উঠেছে সেই অপর্কমেরই পরোক্ষ সহায়ক। একটু ভিতরের দিকের গ্রামগুলিতে খোঁজ নিলেই জানা যাবে, দিব্য বহু নাবালিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, অথচ আঠারো পেরুলে তাদের ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্টে নগদ পঁচিশ হাজার টাকা ঢুকেও যাচ্ছে সময়মত। স্থানীয় রাজনৈতিক মাতব্বরদের চাপে প্রধান শিক্ষক তাকে নাবালিকা হিসেবে ‘সার্টিফাই’ করতে বাধ্য হচ্ছেন আর মেয়েটির প্রাপ্য নগদ পঁচিশ হাজার টাকা ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে মেয়েটির শ্বশুরবাড়ি আর উক্ত নেতাদের মধ্যে।
মুশকিল হল, এতটা প্রবঞ্চনা মেয়েরা মেনে নেবে কেন? একে তো অতিমারী তাদের ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি গৃহবন্দী করে দিয়েছে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ফলাফল জানাচ্ছে পনেরো থেকে চব্বিশ বছরের বাঙালী মেয়েদের ৪৯.৫ শতাংশই ঘরকন্নার কাজে নিযুক্ত। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে গত দু-তিন বছরে দারিদ্র বেড়েছে অনেক গুণ, ফলে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই কাজের খোঁজে বেরুতে হয়েছে। বাড়ি কিশোর ছেলেটি সারাদিন মোবাইলে মুখ গুঁজে বসে থাকে, কিন্তু রান্নাবান্না-আদি যাবতীয় গৃহকর্মের দায় সে পড়েছে ষোল-সতেরো বছরের মেয়েটির ঘাড়ে। ফলে স্কুলে তার অনুপস্থিতির হার বেড়েছে, প্রাইভেট কোচিং-এর পাট চুকেছে, পড়াশুনার সময় আর ইচ্ছা দুটোই শূন্যে এসে ঠেকেছে। সে খুব ভাল করে জানে যে কন্যাশ্রীর টাকাগুলোর ভরসাতেই তার বাবা-মা বসে আছে। এমনকি যদি আঠারোর আগেও তার বিয়ে দেওয়া হয় তবে হবু শ্বশুরবাড়িকে ওই টাকার লোভ দেখিয়েই পনের খরচ কমিয়ে ফেলা হবে। এইভাবে তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র – তার সঙ্গে প্রতারণা করছে সব্বাই। তার শিক্ষার অধিকার তো কেড়ে নিয়েছেই, শিক্ষান্তে পাওয়া রাষ্ট্রীয় অনুদানটুকুও ছল করে হাতিয়ে নিচ্ছে। ফলে তার একমাত্র অবশিষ্ট স্বপ্ন, নিজের পছন্দের ছেলেটিকে বিয়ে করে স্বাধীনভাবে সংসার করার ইচ্ছেটাকে সফল করতে যদি মরিয়া হয়ে ওঠে, তাতে তার দোষ কোথায়?
আবার উলটো জ্বালাও কম নেই। ‘মেয়েটি সত্যিই পড়াশুনা করতে চায় জানেন, সেই কারণেই বিয়ের আগের দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে সোজা থানায় চলে গিয়েছিল।’ বলছিলেন সুন্দরবন অঞ্চলের একজন শিক্ষক, ‘বিয়েটা তো আটকানো গেল, কিন্তু মেয়েটার অবস্থা এখন চক্রব্যূহে সপ্তরথী পরিবেষ্টিত অভিমন্যুর মত। বাড়িতে বাবা-মা থেকে শুরু করে গ্রামের লোকজন, সবাই এখন ওর বিরুদ্ধে। লগ্নভ্রষ্ট মেয়ের নাকি আর বিয়ে হবে না – এই আশঙ্কায় তার বাবা-মা ওর সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। পাত্রপক্ষ সামাজিক সম্মান নষ্ট হওয়ার জন্য ক্ষতিপূরণ চাইছে। ওর জন্য গ্রামে পুলিস ঢুকেছে, গ্রামের বদনাম হয়েছে – তাই এলাকাসুদ্ধ লোক ওর ওপর খাপ্পা। ওদিকে সাদা পোশাকের পুলিস দুবেলা বাড়িতে এসে মেয়েটাকে অভিযোগ তুলে নেবার জন্য চাপ দিচ্ছে। ভয় দেখাচ্ছে, নইলে হোমে গিয়ে থাকতে হবে। সবারই চোখে-মুখে যেন একটাই তিরস্কার – কী দরকার ছিল বাপু এত বাড়াবাড়ি করার? বিয়ের পর কি পড়াশুনা করা যায় না?’
‘বলতে পারেন, কী করলে একটু স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে আমাদের মেয়েগুলো?’ – হতাশ গলায় প্রশ্ন করলেন সেই মাস্টারমশাই। কারো কি জানা আছে উত্তরটা?