সমস্যাটা আগেও ছিল, কিন্তু কোভিড-অতিমারীর পর তা বহুগুণ বেড়ে গেছে। যেকোনো সরকারী স্কুলে সচরাচর দু-ধরনের ছাত্র পাওয়া যায়। একদল পড়াশুনায় আগ্রহী, তারা নিয়মিত স্কুলে আসে, ক্লাসে রেসপন্সিভ থাকে। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো তত ভাল রেজাল্ট করে না, কিন্তু প্রথাগত পড়াশুনার বাইরে নানা রকম অ্যাক্টিভিটিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। কেউ খেলাধুলায়, কেউ সাংস্কৃতিক কাজকর্মে, কেউ বা নেতৃত্বদানের প্রশ্নে তার স্বভাবগত দক্ষতার পরিচয় দেয়। আর দ্বিতীয় দলটি পড়তে, বুঝতে অথবা অন্য কোনো রকম কাজেকর্মে নিতান্তই অনিচ্ছুক। এরা স্কুলে ভীষণই অনিয়মিত উপস্থিত থাকে। এই অনিচ্ছার পিছনে নিশ্চই কিছু আর্থ-সামাজিক কারণ অবশ্যই আছে, কিন্তু সেই কারণগুলো এতই বৃহৎ এবং জটিল যে তা নিয়ে তা নিয়ে ভাববার বা সেই সমস্যাগুলোর সমাধান করা শিক্ষক-শিক্ষিকার কর্ম নয়, তাদের তাই ওই প্রথম শ্রেণির ছাত্রদলকে নিয়েই কাজে-কর্মে বৃত থাকতে হয়।
মুশকিল হল, অতিমারী-জনিত যে পরিবর্তনগুলো আমাদের চারপাশের সমাজে ঘটে গেছে, তার থেকে স্কুলও রেহাই পায়নি। নগর পুড়িলে দেবালয় এড়ায় না। ঠিক যেমন কর্পোরেট সেক্টরে অফিসের বদলে গুরুত্ব বেড়েছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর, অথবা অর্থনীতির জগতে নগদের বদলে অনলাইন লেনদেনের ওপর ভরসা বেড়েছে অনেকখানি, অথবা সিনেমা হলের জায়গা নিয়েছে মোবাইল নির্ভর ওটিটি প্লাটফর্ম, ঠিক তেমনি স্কুলের প্রথাগত শিক্ষাদান বা গ্রহণের পরিসর অনেকখানি দখল করে নিয়েছে অনলাইন এডুকেশন। এসে গেছে অসংখ্য অনলাইন টিচিং অ্যাপ। দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় আমাদের ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট টিউশনের ওপর নির্ভরতা বরাবরই বেশি, অতিমারী এসে সেই নির্ভরশীলতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে ছাত্রছাত্রীরা স্কুল শুরুর আগে, সকালে অথবা স্কুলের পর সন্ধ্যায় টিউশন পড়তে যেত, ইদানীং দেখছি প্রাইভেট কোচিং সেন্টারগুলো আর স্কুলের সময়টাকে বাদ দেবার সৌজন্যও দেখাচ্ছে না। দুপুর বারোটা, দুটো অথবা বিকেল তিনটের সময়ও ‘ব্যাচ’ বসানো হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরাও আজকাল স্কুলে অনুপস্থিতির জন্য জ্বর বা পেটখারাপের মত মত প্রচলিত অজুহাতগুলো দেখানোর বদলে পরিষ্কার বলে দিচ্ছে – ‘প্রাইভেট পড়া আছে স্যর’। শিক্ষার প্রশ্নে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি অস্বীকার করার এই স্পর্ধা কিন্তু অতিমারীরই অবদান। আজকাল তাই পড়াশুনায় ইচ্ছুক বা অনিচ্ছুক কোনো রকম ছাত্রছাত্রীকেই নিয়মিত স্কুলে পাওয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু দোষটা কি শুধুমাত্র অতিমারীই? অতিমারীর কাঁধে বন্দুক রেখে কোনো বৃহত্তর শক্তি তাঁর স্বার্থসিদ্ধির জন্য ময়দানে নেমে পড়েনি তো? প্রশ্নটা গুরুতর। এবং পাপী মনে প্রশ্নটা আসছে এই কারণেই যে, অতিমারী আগে-পরে বিগত পাঁচ বছরের রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাবে, কমবেশী প্রতিবছরই গড়ে প্রায় দু-মাস করে গরমের ছুটি দেওয়া হয়েছে স্কুলগুলোতে। এর পাশাপাশি রয়েছে গড়ে প্রতি বছর একটি করে ভোট-উৎসব, যার জন্য কমবেশি পনেরো দিন থেকে এক মাস স্কুল-বাড়িগুলো অধিগ্রহণ করা হয়। যেদিন এই নিবন্ধটি লিখছি, সেদিনকার সংবাদপত্রেই এই মর্মে প্রতিবেদন রয়েছে যে, দুমাস গরমের ছুটি এবং একমাস পঞ্চায়েত জনিত ছুটির পর দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার একটি স্কুলে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি দশ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে, ফলে ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধান শিক্ষককেই মাইক হাতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচারে নামতে হয়েছে।
একটি শিশু বা কিশোরের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের প্রশ্নে স্কুলের ভূমিকা অসীম। অধিকাংশ অভিভাবক এবং জননেতাদের একাংশ যেমন মনে করেন স্কুল হল সিলেবাস শেষ করা এবং পরীক্ষা নিয়ে মার্কশীট আর সার্টিফিকেট বিলি করার জায়গা, তা আদৌ নয়। সিলেবাস শেষ করা বা একটা ভাল রেজাল্ট করার জন্য কিন্তু সত্যিই ইদানীং আর স্কুলের খুব একটা দরকার নেই। অজস্র অনলাইন কোচিং বা প্রাইভেট টিউটর বাজারে সুলভ, তারাই কাজটা সেরে দিতে পারেন। আর ‘ভাল রেজাল্ট’ তৈরির প্রয়োজনীয় সস্তা মালমশলা স্কুলের বাইরের বাজারে সুলভ বলেই হয়তো আজকাল আর স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা বলার বা গান গাইবার মত ছাত্রছাত্রী পাওয়া যায় না, স্পোর্টসে বা ফুটবল ম্যাচে অংশগ্রহণ করার আগ্রহ নেই ওদের, সরস্বতী পুজোয় মণ্ডপ সাজানোর বা ফল কাটার লোক পাওয়া যায় না। এইভাবেই এই ‘নিউ নর্মাল’ শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের এক আত্মমগ্ন, স্বার্থপর এবং অবধারিতভাবে এক সমাজ-বিচ্ছিন্ন একক-যাপনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এর পাশাপাশি আর্থিক বা সামাজিকভাবে তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া একদল ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষার অঙ্গন থেকে বার করে দেবার একটা গভীরতর চক্রান্ত তো রয়েইছে। যাদের মোটা দক্ষিণা দিয়ে প্রাইভেট পড়ার বা অনলাইন এডুকেশন গ্রহণ করার সামর্থ্য নেই, তারা এখন অবধারিতভাবেই পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের জন্য তাই অপেক্ষায় রয়েছে তামিলনাড়ু, মুম্বই, গুজরাটের পরিযায়ী শ্রমিক-মহল্লাগুলো।
মোটের ওপর ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াল এই যে, যাদের সামাজিক সচেতনতা এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক সামর্থ্য আছে, তাদের আর স্কুলের দরকার নেই। আর যাদের স্কুল ছাড়া শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই, স্কুল তাদের ভুলে বসে থাকছে। আর এক মাঝখানে আছেন শিক্ষক নামধারী এক তৃতীয় পক্ষ, যাদের অধিকাংশই শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোকে দেখতে পাবার মত দূরদৃষ্টি-সম্পন্ন নন, তাঁদের যাবতীয় দাবি-দাওয়া তাই ডি এ-কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে, এখনও।
পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বললে কম বলা হবে, বরং এরকমই বলাই বোধহয় ঠিকঠাক হবে যে, আমাদের সরকারী শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। মুশকিল হল, এই পরিস্থিতিকে বদলানোর প্রশ্নে সরকার বা বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলকেই আর ভরসা করা যায় না। ইদানীং কিন্তু সরকার, বিরোধীপক্ষ এবং তাদের কারো-না-কারো তাঁবেদারী করা প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যমের বাইরে ফেসবুক-ট্যুইটার-হোয়াটসঅ্যাপ-আদি সমাজমাধ্যমকে অবলম্বন করে একটি স্বতন্ত্র এবং ভিন্ন স্বর উঠে আসছে । অনেক সময়ই সেই সমবেত ভিন্ন-স্বর বিভিন্ন স্পর্শকাতর ‘ইস্যু’-তে সরকারকে নড়েচড়ে বসতেও বাধ্য করছে। শিক্ষার প্রশ্নেও এমনই একটা তৃতীয় নিরপেক্ষ কণ্ঠ তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল বিগত কিছুদিন ধরে।
সেই লক্ষেই এই সেদিন এক বৈঠক হল একটি অনলাইন প্লাটফর্মে। বৈঠকের ডাক দিয়েছিলেন অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী, অধ্যাপক অচিন চক্রবর্তী, অনিতা অগ্নিহোত্রী, কুমার রানা, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কয়েকজন শিক্ষাবিদ, চিন্তাশীল মানুষ এবং সমাজকর্মী। হাজির ছিল শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত প্রায় একশো জন মানুষ, যারা সকলেই সেই বিপন্নতায় সামিল।
প্রায় তিন ঘন্টার সেই ম্যারাথন বৈঠক শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, সত্যিই, এখন বোধহয় শিক্ষার গুণমান, পেডাগজি, সিলেবাস, কারিকুলাম ইত্যাদি গৌণ হয়ে পড়েছে। তার থেকে অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে কিছু মোটা দাগের সংস্কার। যেমন,
১. পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে,
২. শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন কিনা, নিলেও ব্ল্যাকবোর্ড, লেসন প্ল্যান ইত্যাদি যথাযথভাবে ব্যবহার করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পড়াচ্ছেন কিনা যা নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য ঘনঘন পরিদর্শনের ব্যবস্থা চাই,
৩. যেন-তেন-প্রকারেণ ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে হাজিরা নিশ্চিত করত হবে,
৪. প্রাইভেট টিউশনের রমরমা বন্ধ করার জন্য স্কুল স্তরে উন্নত মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে,
৫. ছাত্রছাত্রীদের মত শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও কর্মদক্ষতার নিয়মিত মূল্যায়ন চালু করতে হবে এবং তার ভিত্তিতে তার চাকরির স্থায়িত্ব নির্ধারণের ব্যবস্থা করতে হবে,
৬. মিড ডে মিলের বরাদ্দ বাড়িয়ে তার গুণগত মানের উন্নয়ণের পাশাপাশি তাকে সুস্বাদু করে তুলতে হবে,
৭. স্কুলগুলোর পরিকাঠামোয় পর্যাপ্ত সংস্কার করে এবং পর্যাপ্ত অশিক্ষক কর্মী, মেথর-ঝাড়ুদার ইত্যাদি নিয়োগ করতে হবে। এবং রক্ষণাবেক্ষনের খরচের জন্য কম্পোজিট গ্রান্টের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
৮. নানাবিধ ‘ডোল’ বিলির জন্য হয় বিদ্যালয়ের বাইরে স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে স্কুলের তার জন্য পৃথক দপ্তর এবং কর্মী নিয়োগ করতে হবে।
৯. ল্যবরেটারি ইত্যাদি পর্যাপ্ত পরিকাঠামো এবং শিক্ষকের অভাবে গ্রামের দিকে বিজ্ঞান-শিক্ষার হাল অত্যন্ত খারাপ। তাই বিজ্ঞান-শিক্ষার প্রসারে আলাদা অর্থ-বরাদ্দ জরুরি,
১০. সর্বোপরি, কারণে-অকারণে দীর্ঘ ছুটি দেবার প্রবণতা কমাতে হবে এবং নির্বাচন ইত্যাদি প্রয়োজনে স্কুলবাড়ি অধিগ্রহণের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে।
জনজীবনে শিক্ষার গুরুত্ব যিনি বোঝেন, তার কাছে এই দশ দফা দাবি খুব একটা গুরুতর বা বিরাট ব্যয়বহুল কিছু নয়। প্রশ্নটা কেবলমাত্র সদিচ্ছার। দেখা যাক, শিক্ষা-নিয়ামকদের মনে সেই সদিচ্ছা জাগরিত করা যায় কি না।