একদা একটি নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে গ্রামের বাড়ি যেতে হয়েছিল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, সমস্ত গ্রাম মানুষে গিজ গিজ করছে। অনুসন্ধানে জানা গেল, দোকানের ঝাঁপি বন্ধ করে অথবা চাকুরি থেকে ছুটি নিয়ে দলে দলে মানুষ আসছেন শহর থেকে - ইলিশের অমোঘ আকর্ষনে।
দেশে তখন চলছে ইলিশের নিষিদ্ধ কাল, ১৪ অক্টোবর থেকে ৪ঠা নভেম্বর - এই ২২ দিন ইলিশ ধরা, বিক্রি ও মজুদের উপর রয়েছে সরকারী নিষেধাজ্ঞা। অথচ এই নিষিদ্ধ প্রহরই হয়ে উঠেছে ইলিশ শিকারের জমজমাট মৌসুম, আমাদের গ্রামের চারদিকে লেগেছে ইলিশ শিকারের ধুম, আশ্চর্য হল, ইলিশের শিকারের এই বিপুল আয়োজন মঞ্চস্থ হচ্ছে আইনপ্রয়োগকারীদের চোখের সামনেই। নিষিদ্ধ মৌসুমে খলুই ভর্তি করে ইলিশ সংগ্রহ ও মজুদ এবং মৌসুম অন্তে তা বিক্রি করে কাচা সোনা আহরণ – ইলিশের মৌসুমি ব্যবসার এই হচ্ছে মূলমন্ত্র! তবে আমাদের দেশে খাদ্যসামগ্রী হতে শুরু করে ইট-বালু সব ব্যবসার মধ্যেই পরিলক্ষিত হয় মৌসুমি ব্যবসার এই আদিম ঝোঁক।
কোন এক শীতকালে আমার কাছে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী একটি ঋণ আবেদন নিয়ে এসেছিল। সে ইলিক্ট্রিক পন্যের ট্রেডিং ব্যবসায় নিয়োজিত। ঋনের টাকা দিয়ে সে যত বেশী সম্ভব ইলেকট্রিক ফ্যান স্টক করে রাখতে চাইছিল। ভরা মৌসুমে যখন পাখার চাহিদা পাখা মেলতে শুরু করবে, তখন মোটা লাভে সে তার মজুদ পন্যগুলো বিক্রি করে দেবে। মৌসুমি ব্যবসার মন্ত্র ভাল করে বুঝে উঠতে পারিনি বলে আমি তার ব্যাপারে আর আগ্রহ বোধ করিনি। সেই মৌসুমি ব্যবসায়ী অবশ্য অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল ভাল ব্যবসায়িক লেনদেন থাকার কারণে, যদিও সেই ঋণ তার জন্য শুধু দুর্ভাগ্যই ডেকে এনেছিল। ভরা মৌসুমে পাখার দাম কাংখিত হারে না বাড়ায় সে পন্য গুদামজাত করেই রাখল, মৌসুমি ব্যবসার নেশায় চুর হয়ে সে শুধু ‘মোটা দাম, মোটা মুনাফা’কে অন্বেষন করছিল বাজারের গতি-প্রকৃতিকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করে। অবশেষে তাকে হার মানতেই হল, দীর্ঘ মজুদের পর কেনা দামের প্রায় অর্ধেকে বিক্রি করতে হয় সেই মৌসুমি মজুদ। মৌসুমি ব্যবসার ধান্দা মৌসুমি ঋণের দিকে নিয়ে যেয়ে তাকে মৌসুমি মন্দার পানে ধাবিত করেছিল।
আমাদের দেশে বহু মানুষ আছেন যাদের কি ব্যবসা করেন জিজ্ঞাসা করলে একটু ঝেড়ে কেশে নিয়ে স্টক লট ব্যবসার নাম করবেন, যা চরিত্রের দিক থেকে মৌসুমি ব্যবসার সমতূল্য। আমার পরিচিত এক গার্মেন্টস ব্যবসায়ী একবার সস্তায় একটি বড়সড় স্যুয়েটার লটের সন্ধান পায়, সে বড় অংকের ব্যাংক ঋণ করে ঘরে নিয়ে এল সেই ‘সোনার হরিন’, কিন্তু মনমতো ক্রেতা খুঁজে পেল না। প্রায় তিন বছর ধরে রাখার পর এক তৃতীয়াংশ দামে বিক্রি করে দিতে হয়েছিল সেই অতিকায় স্টক। ব্যাংকের দেনা ঘুচাতে সেই মৌসুমি ব্যবসায়ীকে শেষমেষ বন্ধক রাখা বাড়ি-ঘরও বেচে দিতে হয়েছিল।
বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইন্সটিটিউট সাম্প্রতিক চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেখানে বেরিয়ে এসেছে, রেকর্ড ফলন হওয়া বোরো ধানের প্রায় ৮৪ শতাংশ মজুদ নিয়ে ঠায় বসেছিলেন রাইস মিল মালিকেরা। ফলে ২ থেকে ৫ টাকা করে বেড়ে যায় চালের দাম কেজি প্রতি। বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী, কৃষকদের নিকট থেকে ৩৭.৩২ টাকা কেজি দরে ক্রয় করা চাল মিল গেটে ৪৫-৪৬ টাকার বেশী হওয়া উচিৎ নয়, কিন্তু বিক্রি হচ্ছিল ৪৯ টাকায়। এখানে কাজ করছে মৌসুমি ব্যবসার আদিম আকাঙ্ক্ষা ও কলা-কৌশল। পন্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে চলতি মৌসুমের জন্য পকেট ভর্তি মুনাফা করে নেয়া।
এক কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের সর্বসাকুল্যে ৮.৩২ টাকা ব্যয় হলেও তা বাজারে বিক্রি হয় ৫০ টাকায়। অথচ কৃষক হিমাগার মালিকদের কাছে মূল্য পায় মাত্র ৯ টাকা। ওদিকে গুদাম ভাড়া, কালেকশান চার্জ ও ওজন হ্রাসজনিত কারণে হিমাগার মালিকের খরচ পড়ে আরো ৯ টাকা, সাথে ২ টাকা মুনাফা ধরে সে পাইকারি বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে ২৫ টাকায়। অবশেষে, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতার লভ্যাংশ যোগ হয়ে তা কখনোই ৩০ টাকার বেশী হওয়া উচিৎ নয় ভোক্তা পর্যায়ে। অথচ এখানেও সেই মৌসুমি ব্যবসার পুরনো উপসর্গ, মজুদকরণ ও বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে মুনাফার আঁশ মেটানো। বিগত বছরের পেয়াজ ও লবনকান্ডেও মৌসুমি ব্যবসার অদম্য পিপাসা দেখা গিয়েছে।
আমাদের ব্যবসায়িদের মৌসুমি রোগের তীব্রতা টের পাওয়া যায় রমজানে। ছোলা ও ডাল জাতীয় পন্যের ৭০ শতাংশ চাহিদা তৈরী হয় রমজান মাসে, তাই প্রায় আট সপ্তাহ আগে থেকেই মজুদ শুরু হয়ে যায়। ঈদে ঘরমুখো মানুষের বিশাল স্রোত টিকিট কাউন্টারে প্রবল বেগে আছড়ে পড়লে জেগে উঠে মৌসুমি ব্যবসার লিপ্সা।
করোনাকালে নীতিনির্ধারকরা যখন ব্যবসা বাণিজ্যের স্থবিরতা নিয়ে হায় হুতাশ করেছেন দিবারাত্র, তখন আমরা মৌসুমি ব্যবসার মনোহর সব ছায়াছবি দেখতে পেয়েছি। দুর্ভিক্ষ ও মারিকে নিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার ইতিহাস অবশ্য অনেক পুরনো। অমর্ত্য সেন তো সেই কবেই অভেদ্য প্রমান উপস্থাপন করেছেন যে, আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষগুলি খাদ্যের অভাবের জন্য হয়নি, মৌসুমি ব্যবসার পসার ছিল নেপথ্য কারিগর।
বিগত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ১২ টি জাঙ্ক স্টককে উপরের গ্রেডে উন্নীত করেছিলেন তাদের ব্যবসায়িক অগ্রগতির প্রেক্ষিতে । একই সাথে, জাঙ্ক শ্রেণীতে অবস্থান করা অন্য ২২ টি কোম্পানিকে তাদের বিজনেস প্লান নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির সাথে শেয়ার করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এই সংবাদে, মুহুর্তেই জাঙ্ক স্টক জীবন্ত হয়ে উঠল, জোয়ারের পানির মত তারা ঢুকে পড়ল বিনিয়োগকারীদের পকেটে। অল্পদিনের মধ্যেই ৪২ টি জাঙ্ক স্টকের মধ্যে ৩৭ টির দাম বেড়ে গেল। পুজিবাজারে ৯ টি জেড ক্যাটিগোরির শেয়ার রয়েছে যারা এক দশকেরও বেশী সময় ধরে লভ্যাংশ বিতরনে বিরত রয়েছে, তবু তারা উঠে এল মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে থাকা কোম্পানিগুলোর তালিকায়। এখানে মৌসুমি মুনাফার মনোরোগ ব্যতীত কোন সুস্থ ব্যবসায়িক কৌশল, বা পরিকল্পণার হদিস কেউ বের করতে সক্ষম হবে?
আমরা মৌসুমি ব্যবসার সবচেয়ে সাধারণ ও সার্বজনীন রূপটি দেখতে পাই জমির ব্যবসায়। জমির দাম কমে গেলে বা কোথাও উত্তম কোন জমি সস্তায় পাওয়ার সুযোগ তৈরী হলে ঘরে ঘরে তৈরী হয়ে যায় মৌসুমি ব্যবসায়ি।
এই সিজনাল ব্যবসা কি সত্যিকারের ব্যবসা? ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’ বইতে শুমেখার দেখিয়েছেন সত্যকারের ব্যবসায় মাথা ও হাতের শ্রম দরকার হয়। অথচ মৌসুমি ব্যবসায় কোন মূল্য সংযোজন নেই, অনেকটা আকাশ থেকে পড়া লাভের উপর ভর করে এই ব্যবসা টিকে থাকতে চায়, কখনো কখনো বরাত জোরে পার পেলেও বেশিরভাগ সময় খাদের কিনারায় নিয়ে যায় এই ব্যবসা। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৬০% মৌসুমি ব্যবসা তার প্রথম বছরেই ঝরে পড়ে!
অ্যাডাম স্মীথ ১৭৭২ সালে লিখিত তার সুবিখ্যাত ‘দ্য ওয়েলথ অব ন্যাশান্স’ গ্রন্থে ‘ওভারট্রেডিং’ বা ‘অতিব্যবসা’ নামক এক শব্দের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। যখন কোন পন্যের দাম নিয়ে স্পেকুলেশান বা অবাস্তব জল্পনা শুরু হয়, যখন কোন বিনিয়োগ অতিরিক্ত ঋনের ভারে নিমজ্জিত হয়, যখন বিনিয়োগ থেকে স্বাভাবিক মুনাফার প্রত্যাশা পরিত্যাগ করা হয়, তখনই অতিব্যবসার জন্ম হয়। আমাদের দেশে প্রচলিত মৌসুমি ব্যবসার মধ্যে এই অতি-ব্যবসার লক্ষনগুলি অবিকল ফুটে উঠে।
বিনিয়োগ গুরু বলে কথিত বেঞ্জামিন গ্রাহাম তার সুবিখ্যাত ‘ইন্টিলিজেন্ট ইনভেস্টর’ বইতে একজন প্রকৃত বিনিয়োগকারী ও ফটকা কারবারীর পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে বলেনঃ একটি সার্থক বিনিয়োগ কৌশল হল এমন কিছু যা পুংখানুপুঙ্খ বিশ্লেষনের পর পুজির নিরাপত্তা এবং একই সঙ্গে পর্যাপ্ত ও পরিমিত মুনাফার প্রতিশ্রুতি দেয়। যে সকল কর্মকৌশল এই পূর্বশর্তসমূহ ধারণে ব্যর্থ হয়, সেগুলোই ফটকা কারবারে পর্যবসিত হয়। যারা প্রকৃত অর্থেই বিনিয়োগকারী, তারা নিজেদের জন্যই উপার্জন করে, অন্যদিকে ফটকা কারবারীদের ভুল বিনিয়োগ ও তৎপরবর্তী লোকসান অন্যদের উপার্জনের সুযোগ করে দেয়।
মৌসুমি ব্যবসা এক নিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানিতে জন্মলাভ করে। অথচ ইতিহাসের সব থেকে যন্ত্রণাদায়ক সত্যগুলোর একটি হল, ভবিষ্যৎ সবসময়ই আমাদের বিষ্মিত করবে, সবসময় অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে। বাজার সব থেকে নিষ্ঠুরভাবে তাদেরকেই চমকে দেয়, যারা সব থেকে বেশী নিশ্চিত থাকে যে, তাদের ভবিষ্যৎ অনুমানটি সঠিক হবে। ব্রিটিশ প্রাবন্ধিক জি কে চেস্টারটন একদা বলেছিলেন, "সেই লোকই আশির্বাদপুষ্ট যে কোন কিছুই প্রত্যাশা করে না, কারণ সে তাহলে আর হতাশ হবে না।"
সিজনাল ফিভার বা মৌসুমি জ্বর আমাদের দেশের মানুষের বহুল পরিচিত একটি অসুখ। মৌসুম পরিবর্তনের সময় শরীরে অস্বাভাবিক উত্তাপ নিয়ে আসে এক প্রকার ভাইরাস। সেই রোগে মৃত্যু না হলেও বেশ ভুগতে হয়, শরীরের স্বাভাবিক শক্তি হারিয়ে যায় অনেকখানি। মৌসুমি জ্বরের মতই মৌসুমি ব্যবসার রোগে ভুগতে দেখা যায় আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষকে, ভাইরাসের মতই এক অযৌক্তিক বিশ্বাস তাদের মস্তিষ্ককে উত্তপ্ত করে তোলে অতিমুনাফার নেশায়, স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি বিসর্জন দিয়ে তারা নেমে পড়ে পন্য মজুদে, এজন্য তারা ঋণ করতেও কসুর করে না, ফলাফল হয়, মৌসুমী জ্বরের থেকেও মারাত্মক, ব্যবসা শুধু রুগ্নই হয় না, অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুও ঘটে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।