আর থেকে যায় ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত একটি অসামান্য করের চুক্তি - মাশুল বিহীন আয়ের সনদ ।
দুই নাম না জানা অর্থের ভাঁড়ার জুরিখ জেনিভা নয়ের দশকে আমার কর্ম জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। লন্ডন আমস্টারডাম হামবুর্গ প্যারিস গোটেবর্গের খ্যাতনামা কোম্পানিদের কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে উন্নয়নশীল বাজারের ব্যাঙ্ক, কর্পোরেট এবং সরকারের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টায় পথে নামি। সেনেগালের বাদাম, কেনিয়ার চা বিক্রেতা , কলকাতার ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি , পোল্যান্ডের জাহাজ নির্মাতাকে আমাদের ব্যাঙ্ক সবে দু পয়সা ধার দিচ্ছে । আমাদের নিজেদের মুরোদ অত্যন্ত সীমিত । তবু খদ্দেরকে হাম হ্যাঁয় না বলে বাড়তি ঋণ কিংবা বন্ডের টাকা যোগাড়ের ধান্দায় নানান পথ সভা করে বেড়াচ্ছি । আই এন জি ব্যাঙ্কের দে লাঙ্গে বলেছিল ওটাকে শোক সভাও বলতে পারো! টাকা জুটবে কিনা, পেলে কত সুদে , কতদিনের জন্য সেটা কেউ জানে না । শেয়ার বাজার, বিদেশি মুদ্রা বিনিময়, সুদের হার ইত্যাদি জানা এবং জানানোর জন্য রয়টার ব্লুমবেরগ ছিল, আছে – কোন দামে ইন্দোনেশিয়ান কোম্পানি পাঁচ বছরের জন্য টাকা ধার করতে পারে সেটা জানতে সিধু জ্যাঠা কেন গুগল বা ইয়াহুর দ্বারস্থ হয়েও জ্ঞান সঞ্চয়ের আশা বিরল।
আমার বাঁধা বুলি ছিল চাকরি ছাড়া আমার হারানোর আর কিছুই নেই।
একদিন আমার অফিসে বসে বিশ্বের যাবতীয় সমস্যা , আর্সেনাল এবং মোহনবাগানের ধারাবাহিক ব্যর্থতা ও তার সঙ্গে একটি ভারতীয় টেলিকম কোম্পানির জন্য কিভাবে সাত কোটি ডলার বাজার থেকে তোলা যায় সেই চিন্তা করছি এমন সময়ে ববের আবির্ভাব হল। বব তখন মুম্বাইতে বসেন , আমাদের ভারতীয় বাজারের প্রধান ক্রেডিট গুরু , তার অনুমোদন ছাড়া কাউকে এক পয়সা ধার দেওয়া যায় না। আমার হাতে যে টেলিকম ডিলটি আছে তাতে এক কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ব্যপারে সম্মতি তিনি দিয়েছেন। আমার সঙ্কট হল বাকি ছ কোটির জন্য কার দুয়োরে হত্যে দেব ? লন্ডনে এসেছেন দু দিনের জন্যে। দর্শন দিতে এলেন। কফি পান করবার সময় ববকে আমার হৃদয় বেদনার কথা জানালাম – আমার ধনের মানুষ যে, কোথায় পাবো তারে ?
- আমি যেমন ভারতীয় দেনদারদের চিনি বা চেনার চেষ্টা তুমি নিশ্চয় তোমার বাজার চেনো। তোমার
কাছ থেকে ভারতীয় ঋণে যোগদানের আমন্ত্রণের অপেক্ষায় তাইওয়ানের কোন প্রতিষ্ঠান বা আপার অস্ট্রিয়ার কোন বন্ধকি ব্যাঙ্ক টাকার পোঁটলা নিয়ে হাঁ করে বসে আছে!
- বাজে কথা ছাড়ো । সময় কঠিন বব । ভবি ভুলছে না। এই ভারতীয় টেলিকম সংস্থাটি আহামরি কিছু নয়, আগে কখনো বিদেশের মাঠে খেলে নি যে নিবেশকরা তাদের বটুয়ার বাঁধন আলগা করবে !
- কোথায় কোথায় তুমি বা তোমার দল হানা দিয়েছে জানি না তবে যদি নিতান্ত ঠেকায় পড়ো , সুইস ব্যাঙ্কগুলোর কথা মনে রেখো , বিশেষ করে ইউলিউস বেয়ার ।
- ঠাট্টা হচ্ছে বব ? বাঙ্কহাউস ইউলিউস বেয়ার একেবারে মার্কা মারা প্রাইভেট ব্যাংক- দুনিয়ার ধনী মানুষের বেহিসাবি টাকা জমা রাখে আর তা দিয়ে নানান দুষ্কর্মের ইন্ধন সরবরাহ করে । তাদের গোপনতা সর্বজন বিদিত - আজ অবধি কোন কর্পোরেট সিনডিকেশন বা বন্ডের লিগ টেবিলে তাদের নাম দেখি নি । তারা কেন একটা মাঝারি সাইজের ভারতীয় টেলিকম কোম্পানির তিন বছরের লোনে টাকা ঢালবে ?
- আমার প্রিয় বালক , যতদূর জানি এই টেলিকম প্রতিষ্ঠানের মালিক, মনোজের বহু বেনামি টাকা ইউলিউস বেয়ারে জমা আছে । সেটা কোম্পানির নয়, মনোজের আপন ধন তবে বিভিন্ন কোম্পানির নামে , যার সঙ্গে মনোজের যোগসূত্র খুঁজে বের করতে শারলক হোমসকে আহ্বান করতে হবে । নিতান্ত প্রয়োজন হলে এই রকম কোন অজানা অচেনা ফাণ্ড অকস্মাৎ মনোজের দু নম্বরি টাকা মনোজের কোম্পানিকেই ধার দেবে । মাঝখানে ইউলিউস বেয়ার পরের ধনে পোদ্দারি করে দু পয়সা কামিয়ে নেবে । বাজারে রটে যাবে ভারতীয় টেলিকম প্রতিষ্ঠানকে সুইস ব্যাঙ্ক ধার দিচ্ছে । সেটা এমন হাওয়া তুলে দেবে যে অন্যান্য ব্যাঙ্ক উৎসাহী হয়ে বাকি ধারের যোগাড় করে দেবে।
শেষ অবধি ইউলিউস বেয়ারের অর্থ সম্পদ অথবা মালিক মনোজের লুকোনো টাকা দিয়ে আমাদের আন্তর্জাতিক ঋণের তহবিল ভর্তি করতে হয় নি। আমাদের ছেলে মেয়েরা প্রভূত পরিশ্রমে অনেক অচেনা নিবেশকের নাম পরিচিত জনতার সরণিতে এনে সে কাজটি সম্পন্ন করে। ববের পরামর্শটি বাকি দিনগুলিতে মনে রেখেছি। ধনী ভারতীয়দের বিদেশে বে আইনি ভাবে গচ্ছিত ধনের উপযোগ নানাবিধ- কখনো তা দিয়ে কেনা হয় আপন কোম্পানির বন্ড , কখনও বা সেটির অংশ নিবেশিত হয় ভারতে গঠিত কোন প্রতিষ্ঠানের বিদেশি শেয়ার নিবেশকের ছদ্মবেশে।
দেশ ছেড়েছি অনেক দিন । এই উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্যে অর্থ সংগ্রহ করার কারণে আপন দেশের বাণিজ্য ব্যবস্থার সঙ্গে নতুন করে পরিচয় হল নয়ের দশকে । ব্যাংকিং ব্যবসায় ধোয়া তুলসী পাতা অথবা জর্ডান নদীর জলে আদ্যোপান্ত চোবানো কোন দলিল দস্তাবেজের অস্তিত্ব কেউ কোন দিন দেখে নি। কিন্তু আধোয়া তুলসী পাতার চেহারাটা চিনতে সময় লেগেছিলো
কফি এবং আমার সময়ের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে অফিস থেকে বেরুনোর সময়ে বব বললেন
- তুমি ১৯৮৫ সালে সিটিব্যাঙ্ক লন্ডনে যোগ দিয়েছিলে, তাই না ? তখন তোমার কর্পোরেট জীবনের সঙ্গে ভারতবর্ষ কতটা জড়িয়ে ছিল আমি জানি না। কিন্তু ১৯৮৫/৮৬ সাল নাগাদ একজন ভারতীয় উদ্যোক্তা লন্ডনে কিছু পথসভা করেন- জানান তিনি এক মহতী প্রতিষ্ঠান গড়তে যাচ্ছেন । তাঁর কোম্পানির নাম কেউ জানতো না , বিদেশি ব্যাঙ্কগুলি ধার দেওয়ার জন্যে হামলে পড়ে নি, পড়ার কথাও নয় । তিনি আবেদন জানান প্রবাসী ভারতীয়দের যাদের মধ্যে অনেকে সেই প্রতিষ্ঠানকে ঋণ অথবা বন্ডের মাধ্যমে ধার দেন।
- বব আমার মনে হয় আমি তেমন একটি পথসভায় গিয়েছি ,সিটির উলটো দিকে ওয়ালডরফ হোটেলে । তুমি ধীরুভাই আম্বানির কথা বলছ , রিলায়েন্স কোম্পানির জন্য টাকা তুলছিলেন।
- ঠিক । সেই সঙ্গে এটাও মনে রেখো শুধু প্রবাসী ভারতীয় নয়, বিদেশে রক্ষিত ভারতীয়দের কালো টাকাকে সাদা করার একটি প্রকৃষ্ট পন্থার উদ্ভাবক ছিলেন প্রয়াত ধীরুভাই আম্বানি । এখন সেটা অনেক পরিমার্জিত স্তরে উঠে এসেছে।
আমাকে প্রায় বাকশুন্য দেখে বব প্রস্থান করলেন ।
পুঃ আমাকে পছন্দ করতেন বব । তাঁর অবসর ঘোষণার দিন জানিয়ে আমাকে আমন্ত্রণ করেন- বলেছিলেন দু দশক কাজ করেছি , আসতে বলেছি তোমাকে নিয়ে মাত্র বারোজনকে।
ক্রমশঃ