মঙ্গল শোভা যাত্রা আপনার পছন্দ না তাতে কোন সমস্যা নাই, আপনি যোগ দিয়েন না। মঙ্গল শোভা যাত্রা তো আর নববর্ষ পালন না।আপনার মনে হতেই পারে চারুকলার পুলাপান মুখোস বানাবে, কাগজের ভাস্কর্য বানাবে আর তা নিয়ে ঘুরবে এইটা আমাদের সংস্কৃতির কী হইল? কোন সমস্যা নাই, আপনার মতবাদ থাকতেই পারে মঙ্গল শোভা যাত্রা নিয়ে। তাছাড়া সবার সব জিনিস ভাল লাগবে না, এইটাই স্বাভাবিক। কিংবা আপনে নববর্ষই পালন করবেন না। ছুটি পেয়ে লম্বা ঘুম দিবেন, সিনেমা দেখবেন, গান শুনবেন। এতেও কোন সমস্যা নাই। আপনের এই গরমে, রোজার মধ্যে অত তেল নাই ঘুরে বেড়ানোর, এটাও বুঝা গেল, মানা যায়। মুশকিল হচ্ছে আপনি যখন নিজের এই মতবাদ অন্যের উপরে চাপায় দিতে চাইবেন তখন। যখন আপনি হুকুম জারি করে বসবেন নববর্ষ পালন করা যাবে না, করলেই সরাসরি জাহান্নামে! এক হুজুরকে দেখলাম এই উপলক্ষে পাঞ্জাবি কিনলেই সেই জাহান্নামে যাবে চিল্লায় বলতেছে, মাইক্রোফোন ভেঙে ফেলছে! এই অধিকার তাকে কে দিল? আল্লার কাছ থেকে ডিলার শিপ নিয়া আসছে? কে জান্নাতে যাবে আর কে জাহান্নামে যাবে সে এখানে গলা ফাটায় বলে দিবে?
আমার বাবাকে শেরপুরের মানুষ ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলে মনে করতেন। সাধারণ মানুষ আব্বাকে চিনত এমন না, কিন্তু যারা এই ধারায় আছে তারা সবাই এক নামেই চিনত। শহরের বড় বড় মসজিদের ইমাম, ইসলাম বুঝে জানে এমন লোকজন আব্বাকে মান্য করত। আব্বার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছি অনেকেই। কোন মসজিদ বা মাদ্রাসায় আব্বার নাম বললে উনার নাম শুনা মাত্র নড়েচড়ে বসত সকলেই। আব্বা আমাদের এলাকার মসজিদে নামাজ পড়তেন না, কারণ এখানে যে নামাজ পড়ায় তিনি অল্প বয়সই, আব্বা তৃপ্তি পেতেন না তার পিছনে নামাজ পড়ে। হেঁটে দূরের এক মসজিদে যেতেন শুধু মাত্র সেই ইমাম সাহেবকে আব্বার মনে হত উনার মাপের, যার সাথে কথা বলা যায়, আলাপ করা যায়। সেই ইমাম সাহেব আমাকে অনেকবার আমার কাছে আব্বার প্রাণ খোলা প্রশংসা করেছেন। এক বাক্যে স্বীকৃতি দিছেন যে আব্বার মত ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানী মানুষ তিনি খুব কমই দেখেছেন। তিনি পরে শেরপুরের সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা ও মসজিদের ইমাম হয়ে ছিলেন, এবং তখনও উনার আব্বার প্রতি মুগ্ধতা কাটেনি। আব্বা যখন অসুস্থ, বিছানায় পড়ে গেছেন। তখনও আমি দেখতাম কোথা থেকে কোথা থেকে মানুষ আসত, উদ্দেশ্য আব্বার সাথে দেখা করা আর একটু আলোচনা, ইসলামের নানা বিষয় নিয়ে গল্প।
আমি আব্বার এই দিকের কথা কেন বলছি? কারণ আমি আব্বাকে কোনদিন নববর্ষের বিরোধিতা করতে দেখি নাই। আব্বা নিশ্চয়ই মঙ্গল শোভা যাত্রায় অংশ নেয় নাই। কিন্তু মেজোপা যখন নববর্ষ উপলক্ষে একটা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া এনে দিত তখন তিনি আগ্রহ নিয়েই পরতেন, খুশিতে চোখ নেচে উঠত উনার। বাব্বাহ! আমার জন্য আনছ, বলে হাতে নিতেন, হাসতেন। আমি যখন ঢাকায় ছিলাম তখন ফোন দিয়ে বলতাম, আব্বা, শুভ নববর্ষ, তিনিও সাথে সাথেই শুভেচ্ছা জানাতেন নববর্ষের। নববর্ষ উপলক্ষে ভাল মন্দ রান্না হয়েছে কি না তার খোঁজ নিতেন, আগ্রহ নিয়ে খেতেনও। আমি আমার জ্ঞান বাজি রেখে আপনাদের বলতে পারি যে কাঠ মোল্লা জাহান্নাম যাওয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছেন গলা ফাটাইয়া, আমার বাবা তার চেয়ে বেশি জানতেন, ধর্ম, ইসলাম, সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র সম্পর্কে।
বাংলা নববর্ষ আমাদের সংস্কৃতি। একদিনের জন্য বাঙালী হয়ে কী হবে বলা লোকজন এখন আর দেখা যায় না, তারাই সম্ভবত বাঙালিই হওয়া যাবে না বলে চিল্লায়। এরা প্রতিবারই চিল্লায়, চিল্লানোয় খুব একটা পার্থক্য হয়েছে এমন বলা যাবে না। অত হুঙ্কারের পরেও মানুষ রাস্তায় এত মানুষ দেখে হতাশ হয়ে যায়, সবাই টিএসসিতে কী করতে আসে? দুনিয়ায় আর কোথাও জায়গা নাই বলে মাইলের পর মাইল হাঁটে, গরমে সিদ্ধ হয়, অস্বাভাবিক দামে কেনা তেহারি খায়, খিচুড়ি খায়, দিগুণ দামে কোক খায়, চরম বিরক্ত নিয়ে এবারই শেষ বলে, আর কোনদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে পহেলা বৈশাখ আসবে না বলে কসম কাটে এবং পরের বছর একই ভুল করে। এই ভুল করতে করতে যে ছাত্র ছিল সে প্রেমিক থেকে স্ত্রীকে নিয়ে আসা শুরু করে, কিছুদিন পরে বাচ্চাকাচ্চা নিয়েও একই ভুল করে! ভুল করে কিন্তু নববর্ষ পালনে ভুল হয় না। চারুকলার ছাত্রদের বাহিরে যে বিশাল জনসমুদ্র তৈরি হয় শাহবাগ সহ ঢাকার আনাচেকানাচে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই জনসমুদ্রই হচ্ছে আমাদের শক্তি, বাঙালির শক্তি। নব্বই শতাংশ বলে হুঙ্কার দেওয়ারা কোনদিন এরা কত শতাংশ তার খোঁজ নিয়ে দেখেনি। আপনারা জানেন না যে পিতা নিজের শিশু কন্যাকে সাজিয়ে ঘাড়ে নিয়ে কালকে রাজপথে হাঁটবে তার শক্তি কতখানি। বাবার আঙুল ধরে যে শিশু পুত্র কালকে গালে নকশা এঁকে হাঁটবে আর বড় বড় চোখ করে দেখবে মানুষের ফুর্তি, সেই আঙুল ধরা মুষ্ঠির শক্তি অমন অসুস্থ হুজুরের চেয়ে লক্ষ গুণ। যতদিন নববর্ষের দিন রাস্তায় মানুষের ঢল থাকবে, যতদিন মানুষ দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে দেখতে আসবে বাংলাদেশে, দেখতে আসবে বাঙালির নববর্ষ উদযাপন, অবাক হয়ে দেখবে মানুষ শুধু হেঁটেই যাচ্ছে, চক্কর খাচ্ছে, গান শুনছে, খাচ্ছে আবার ঘুরছে, আড্ডা দিচ্ছে! ফার্মগেট থেকে হেঁটে হেঁটে দোয়েল চত্বর চলে যাচ্ছে কখন হয়ত বুঝতেই পারছে না কেউ। শহীদ মিনারে বসে যখন আবার আগাবে টিএসসির দিকে, কিংবা এখন একটু মানুষ কম হতে পারে বলে রউনা হল রমনার দিকে আর গিয়েই বুঝতে পারবে শহীদ মিনারে বসে থাকাই বেশি ভাল ছিল! তখন অবাক হয়ে হিসাব করবে এমন বর্ণিল উৎসব পৃথিবীতে কয়টা আছে? যতদিন এমন চালু থাকবে ততদিন বাঙালি, বাংলা সংস্কৃতির ভয় নাই। আমরা পথ হারাব না। আমাদের বুঝতে হবে পথ একটাই, নিজ সংস্কৃতিতে বাঁচা। আমাদের শিকড় মজবুত থাকলে কোন ঝড়েই আমাদের উপড়ে ফেলতে পারবে না। এই একটা পরিচয়েই আপনি নব্বই শতাংশ বলে হুঙ্কার দেওয়াদের থেকেও জোরে হুঙ্কার দিতে পারবেন। তাহলে কেন আপনি বাঙালি বলে পরিচয় দিবেন না?
সবাইকে ১৪২৯ সনের শুভেচ্ছা। নতুন বছর শুভ হোক, সমস্ত অমঙ্গল দূরে সরে নতুন করে মঙ্গলময় হোক সবার। মঙ্গল হোক, মঙ্গল হোক, মঙ্গল হোক সকলের। মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।