এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য – ( পর্ব – ৫) 

    Goutam Dutt লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২৬ মার্চ ২০২২ | ১৭২৩ বার পঠিত
  •                          
     
    এর পরে বছর আট-নয় বাবা আবার কাজে বেরোচ্ছিল। টবিন রোড থেকে নিমতলা ঘাট স্ট্রিট নিত্যই যাতায়াত চলছিল। এর মধ্যে যেটা হ’ল, তা হ’ল, হয়তো বাসের মধ্যেই বাথরুম পেলে তা ধরে রাখতে পারছিল না। নেমে পড়তেই হ’ত বাথরুম করতে। এই অবস্থার মধ্যেই আমার এক আত্মীয়ের ইউরোলজিস্ট বন্ধুর চেম্বারে দেখিয়ে এল। কলকাতার দক্ষিণে ওনার বাড়ির চেম্বার। আমি চাইছিলাম আর অপারেশনের ঝক্কিতে না যেতে। তার প্রধান কারণ হ’ল ডাক্তার চন্দ বারবার বলে দিয়ে ছিলেন আমায়, যে আর যেন খোঁচাখুঁচি না করা হয়। পরে বুঝেছিলাম যে ওষুধটা ডাক্তার চন্দ দীর্ঘদিন ধরে খাইয়ে চলেছেন সেটা একটা প্রস্টেট ম্যালিগন্যান্সির ট্যাবলেট (এই মুহূর্তে আমার ওষুধটার নাম ঠিক স্মরণে আসছে না)।

    সেই আত্মীয়ের বন্ধুর কথায় বাবাকে ভর্তি করলাম দক্ষিণ কলকাতার এক নামকরা হাসপাতালে ১৯৮৮ সালের গোড়ার দিকেই। ইউরোলজিস্ট ডাক্তারবাবু ওখানেই বাবাকে আবার অপারেশন করবেন বলে স্থির হ’ল। আগের অপারেশন হয়েছিল ওপেন প্রসেসে (মানে পেট কেটে স্বাভাবিক সিস্টেমে)। এবারে নাকি ল্যাপ্রোস্কপিক প্রসেসে অপারেশন হবে।

    খুব ভাল কথা। সে সময় বাবাকে প্রচুর রক্ত দিতে হ’ত। বাবার ছিল ‘ও’ নেগেটিভ। সে সময়েও নেগেটিভ রক্তের আকাল ছিল ভালই। ভবানীপুরের ‘পিপল্‌স ব্লাড ব্যাঙ্ক’ আমায় ফেরায়নি কোনোদিনই।

    পরের ঘটনা দুঃসাহসিক বললেও কম বলা যায়। আমার এখন মনে হয় ওই তথাকথিত ইউরোলজিস্ট আমার বাবাকে গিনিপিগ হিসেবে ট্রিট করেছিলেন। আমি না জানলেও ডাক্তার চন্দ তো জানতেনই এই প্রস্টেট ম্যালিগন্যান্সি শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। জানিনা, সমস্ত রিপোর্ট দেখে ডাক্তারবাবু কি বুঝতে পারেননি বাবার ম্যালিগন্যন্সির কথা। নাকি, এমন একটা মামুলি সাধারণ (আমার তখন তো কোনো দাদা ছিল না ! এখনো নেই।) রুগী পেয়ে হাত পাকিয়ে নিতে চেয়েছিলেন এই ল্যাপ্রোস্কপিক পদ্ধতির। যেমন করে আমরা কম্প্যুটার শিখেছিলাম কর্মক্ষেত্রে কম্প্যুটার আসার পর। পরিষ্কার টিপে-টাপে!  আমাদের ছেলেরা কিন্তু তা শিখেছে স্কুল জীবন থেকেই।

    অপারেশন শুরু হ’ল। বোতল চারেক রক্ত আগেই জমা করে দিয়েছিলাম হাসপাতালে। দুপুরের দিকে অপারেশন ছিল। সে সময় লোডশেডিং ছিল বহাল তবিয়তেই। ‘এতো বিদ্যুৎ দিয়ে কি হবে ? বিদ্যুৎ কি খাবে ?’ এই ছিল তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীর সদম্ভ উক্তি।

    হঠাৎ ডাক পড়লো তিন তলায় মানে ওটি’র সামনে। গিয়ে যা শুনলাম তাতে তো চক্ষু আমাদের ছানাবড়া। অপারেশন চলাকালীন নাকি কারেন্ট চলে যায় (জানিনা সেই মেশিন বিগড়ে ছিল কি না ?) আর তাতেই ল্যাপ্রোস্কপিক মেশিন সেই যে দেহ রাখে, তাকে আর সচল করা যায় নি ওটি’তে। স্বাভাবিক ভাবেই ডাক্তার আর ঝুঁকি না নিয়ে ওই অবস্থায় সেই মেশিনকে বা মেশিনের যে অংশ বাবার শরীরে ঢুকিয়ে অপারেশন করা হচ্ছিল সেই অংশকে বার করে (নিশ্চই টানাহ্যাঁচড়া করে – যা আমাকে বলাই হয়নি ! ) নেওয়া হয়েছে। তাই আবার আরেকদিন বাকি অপারেশন করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

    ভাবুন একবার ! যে পেশেন্টের অলরেডি প্রস্টেট ম্যালিগন্যান্সি শুরু হয়ে গেছে তার সেই প্রস্টেটে ছুরি-কাঁচি তো চালালেনই এবং একটা বন্ধ হয়ে থাকা অটোমেটেড ল্যাপ্রোস্কপিক মেশিনের অংশকে নাকি স্বাভাবিক উপায়ে বার করে নিলেন ডাক্তারবাবু। সে সময় এত বুঝিই না।

    যাই হোক, সেই রাত কাটল হাসপাতাল করিডোরে’র মেঝেয় শুয়ে। সে রাতে আর যমরাজার ডাক এল না। ভোর হতেই একবার বাবাকে দেখে আমরা দুজনে এল—নাইনে চেপে বসলাম বাড়ি যাব বলে।

    বাড়ি ফিরে কিছু খেয়ে দেয়ে আবার রওনা দিলাম দক্ষিণ কলকাতার ওই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

    হঠাৎ দুপুরে আমার যম-ডাক।

    ছুটে গেলাম। আর এম ও বললেন যে এখুনি রক্ত লাগবে। দু-বোতল। আমি তখন একা। মা কাকারা আসবেন পরে। কি করা যায় ! ছুটলাম পিপল্‌স ব্লাড ব্যাঙ্কে। আশুতোষ কলেজের পাশে। এর আগের রক্ত ওখান থেকেই কিনেছিলাম।

    গিয়ে শুনলাম রক্ত নেই ! উপায় ?  ওখানকারই একজন বললেন যে এসেম্বলী অফ গড চার্চ হাসপাতালে চলে যান, পেলেও পেয়ে যেতে পারেন। হাতে রক্তের স্যাম্পেল আর হাসপাতালের কাগজ। চিনিই না ওই হাসপাতাল। কে যেন বলে দিল পার্ক স্ট্রীটে। আর কিছু জানি না।

    পার্ক স্ট্রীট চৌরঙ্গী ক্রশিং থেকে খুঁজতে খুঁজতে কি করে চলে গেছিলাম বরদান মার্কেট-এর সামনে তা আর মনে নেই। গরম কাল। রাস্তায় পীচ গলছে। ক্লান্ত অবসন্ন এক যুবক অসহায় হয়ে শেষমেশ এক পাঞ্জাবী ড্রাইভারকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল যে এসেম্বলী অফ গড চার্চ হাসপাতালটা কোথায় ? এক হাতে রক্তের স্যাম্পেল আর এক কাঁধে আমার চিরসঙ্গী সেই ঝোলা ব্যাগ।

    ‘ট্যাক্সি মে আইয়ে’ বলে সেই ড্রাইভার বাঁ-হাত বাড়িয়ে খুলে দিলেন পেছনের দরজা। আমি ইতস্ততঃ করছি কারণ তখন অত পয়সা ছিল না ট্যাক্সি চাপার। বেশ ধমকেই ওই লম্বা চওড়া পাঞ্জাবী ড্রাইভার আমাকে ট্যাক্সিতে তুলে নিলেন। ট্যাক্সি চলতে লাগল।

    বরদান মার্কেট থেকে ওই হাসপাতাল এমন কিছুই দূরে নয় ! কিন্তু তখন চিনতামই না। গরম কালের জন্যে রাস্তায়ও লোকজন কম।

    এ-রাস্তা সে-রাস্তা ঘুরে ট্যাক্সি দাঁড়াল হাসপাতালের সামনে। ‘ইয়ে হ্যায় হসপিটাল, জলদি উতরিয়ে আউর যাইয়ে...’ । আমি নেমে হতবাক হয়ে ওনার মুখের দিকে চাইছি যে ভাড়া কত দিতে হবে ?  বলেও ফেললাম অপারগ হয়ে। কিতনা দেনা হোগা।

    ট্যাক্সিতে আসতে আসতেই শুনে নিয়েছেন আমার বৃত্তান্ত। আবার ধমক্‌।

    আপ জলদি যাইয়ে। আপকা পিতাজী ভী মেরা পিতাজী হ্যায়। জলদি যাইয়ে অন্দর মেঁ নেহি তো উয়ো খুন থক্কে যায়গা।

    বড়দাদা’র এমন কড়া ধমক কি অগ্রাহ্য করা যায় !

    **
    ……চলবে……পরের পর্বে…
    #
    ©গৌতমদত্ত

     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৬ মার্চ ২০২২ | ১৭২৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন