এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য – ( পর্ব - ৯ ) 

    Goutam Dutt লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ১৬ এপ্রিল ২০২২ | ১৮৭৫ বার পঠিত
  •  
    সালটা ১৯৭৯।

    আমার ডান পা-এর তলায় একটা ফুস্কুড়ি’র মতো হয়। বাঙালির স্বভাব সবকিছুকেই খুঁচিয়ে পর্যালোচনা করা, সে নিজের জ্ঞান বা বিষয়ের বাইরে হলেও। যথারীতি নিজেই সেই ফুস্কুড়ি’র মতো বস্তুটাকে খোঁচানোর ফলে ক্রমশ সেটা ঘা-এর আকার নিতে থাকে। ওই অবস্থায় চাকরি- বাকরি সবই চলতে থাকে। কিন্তু ভবি কি ভোলার ? নিজের নিয়মেই মাঝে মাঝে শুকোয় আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে চায়। চরক-সংহিতা’র সেই শ্লোক মনে আছে তো ?  এক্কেরে শুরুতে তা লিখেছিলাম। তবুও বলি আরেকবার – “অবোধ বালকবুদ্ধি লোক মোহ বা প্রমাদবশতঃ প্রথম প্রথম উৎপন্ন রোগকে শত্রু বলিয়া বুঝিতে না পারিয়া অগ্রাহ্য করে। পরন্তু রোগ সকল প্রথমে অণুর ন্যায় উৎপন্ন হইয়া ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতে থাকে। পরে বদ্ধমূল হইয়া পরিশেষে সেই নির্বোধের বল ও পরমায়ু অপহরণ করে। পীড়া যে পর্য্যন্ত না কঠিন হইয়া উঠে, সে পর্যন্ত মূর্খ লোকের চৈতন্য হয় না। রোগ কঠিন হইয়া দাঁড়াইলে, তখন সে রোগ প্রতীকারের চেষ্টা করে। তখন সে, স্ত্রী, পুত্র ও জ্ঞাতিদিগকে ডাকাইয়া কহে, যে আমায় যাহা কিছু আছে, সর্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়াও কোন চিকিৎসককে আনাও। পরে তাহার সেই ব্যাধিপীড়িত, দুর্ব্বল, ক্ষীণেন্দ্রিয়, দীন ও গতায়ুপ্রায় অবস্থায় এমন কোন্ বৈদ্য আছে, যে তাহাকে পরিত্রাণ করিতে সক্ষম হয় ? গোসাপ স্বীয় লাঙ্গুলে আবদ্ধ হইলে বলবান্‌ কর্ত্তৃক কি আকৃষ্যমাণ ইয় যেরূপ প্রাণত্যাগ করে, দ্রুতপ সেই পীড়িত মুর্খব্যাক্তিকেও ত্রাতার অভাবে প্রাণত্যাগ করিতে হয়”। যদিও সেই যৌবনে চরক-সংহিতা’র নাম শুধু শোনা ছিল। অনেক পরে এসে ওই বইটার সম্পর্কে জানার চেষ্টা শুরু হয়। কী নিদারুণ সত্য কথা ভাবুন দিকি !!

    পা-এর তলার ঘা বেশ ঝামেলায় ফেলতে থাকে – ফেলতেই থাকে। তখনো বিয়ে-থা হয়নি। একটা ঘর পেয়ে গেছি। আমি আর আমার ঠাকুমা ছিলাম সে ঘরের বাসিন্দে। ঠাকুমার বয়স হয়েছে, এক চোখে ছানি কাটানোর ফলে অত নজর দিতেই পারতো না সব কিছুতেই। আর বিশেষ কারো’র সামনে তো আর জুতোমোজা খুলে পা দেখানো যায় না। তাই আমার পা-এর দিকে আর কেই বা নজর দেবে ? 

    থমকে গেলাম অল্প। সম্ভবত পাড়ার ডাক্তারবাবুকে আমার ডান পা দেখাতেই হলো। তিনি একটা কপিন রঙের তরল বস্তুসমেত একটা ছোট্ট শিশি দিয়ে বলে দিলেন যে একটা ছোট কাঠির মাথায় একটু তুলো আটকে ওই শিশির ওষুধ তুলোয় লাগিয়ে – ওই পায়ের তলাটায় লাগাতে। আর সাথে দিলেন ইরিথ্রোমাইসিনের বড়ি।

    এই সব ওষুধ চলার পরে পরেই সেই ‘পিড়ক’ এর পীড়া নির্বাপিত হ’ল বটে, কিন্তু পায়ের ওই অঞ্চলের আশেপাশেই শুরু হ’ল, চামড়ার তলায় লাল লাল দাগ। শুরুতে ওই দাগগুলো ছোট্ট থাকলেও ক্রমশ বিক্রম বাড়ায় শুধু নয়, আশপাশের জায়গাগুলো দখল করতে শুরু করে। যদিও সেই প্রকাশ পা-এর নিচের দিকেই সীমাবদ্ধ ছিল।

    এর কিছু মাস পরে পরেই আরেক রকমের উৎপাত শুরু হ’ল ওই ডান পা-এর গোড়ালির ওপর দিকে। প্রথমে একটা ক্ষুদ্র কড়া দিয়ে শুরু করে বেশ খানিকটা ডেলা মতন উঁচিয়ে রইল। মাঝে মধ্যে ওই অংশে কণ্ডূয়ন (An irritation on the skin) ছাড়া আর কোনো রকম বিব্রত করেনি যদিও। শ্রীযুক্ত প্রণব বর্দ্ধনের লেখা “স্মৃতি কণ্ডূয়ন” বইটা কিনে এই ‘কণ্ডূয়ন’ শব্দটাকে বেশ তামিল-তেলেগু ভেবে মনে রেখে দিয়েছিলাম কোনো লেখায় ব্যবহার করবো বলে।
    এখন বেশ অবলীলায় ব্যবহার করা গেল। সাদা বাংলায় যাকে চুলকুনি বলা হয় আর কি !

    এবারে শুরু হ’ল চামড়া বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের খোঁজ। কলকাতা শহরে প্রচুর এমন চামড়া বা ত্বক বিশেষজ্ঞ। এখন হয়তো এই চামড়া বা ত্বকের আরো অনেক প্রকার শাখা-উপশাখার বিশেষজ্ঞ প্রাকটিস করছেন মহারাণীর কলকাতা শহরে।

    আমার বাচ্চুদা খোঁজ দিলেন এক এশিয়া বিখ্যাত ডাক্তার মহোদয়ের। এই আরেক সমস্যা। আমরা কলকাতার বাঙালিরা নিজের পছন্দের ডাক্তারবাবুদের এই ‘গুড’, ‘বেটার’, ‘বেস্ট’ ইত্যাদি তকমা লাগিয়েই থাকি। তার সাথে আরো যেটা বলে থাকি সেটা হ’ল ভারতের বেস্ট বিশেষজ্ঞ অথবা এশিয়ার। বুঝতেই পারিনা যে ডাক্তারবাবুদের এই ক্রমিকতার উৎস ! অথচ লোকমুখে এমন শুনেই থাকি হরবখৎ। উনি কোনো হাসপাতালের সেই বিভাগের মুখ্য বা প্রধান ডাক্তারবাবু হতে পারেন কিন্তু তাই বলে…। ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় বা ডাঃ নীলরতন সরকারের সময়েও কী এমন বলা হত ? খুব জানতে ইছে করে।

    তো, সেই দাদার কথামতো গেলাম এক বিখ্যাত ডাক্তারের চেম্বারে। বিখ্যাত তিনি। এখনো প্রাক্টিস করেন কিনা জানিনা। তবে বয়স হয়েছে অনেক নিশ্চয়ই। যাই হোক তিনি প্রথম দিনেই সব কিছু বুঝে শুনে নিয়ে একটা-মাত্তরই প্যাথোলজিক্যাল টেস্ট দিলেন। হাগু-পরীক্ষার। তারপরে একটা তামার পুরোনো পয়সা নিয়ে আমার রিস্টের ওপরে পয়সাটা ঘষলেন। কি যে হ'ল খোদায় মালুম, জিজ্ঞেস করলেন বাড়ির কারোর এ্যাজ্‌মা (হাঁপানি) আছে কি না !  বললাম, ছিলো ঠাকুর্দার। উনি বেঁচে নেই আর। উনি প্রেস্ক্রাইব করলেন একটা এ্যালার্জির ওষুধ, কি একটা হাইড্রোকুইনান লিক্যুইড চার শতাংশ সাথে সুরাসার, আরেকটা ত্বকের ক্রিম আর সবশেষে খুব প্রচলিত সে-সময়ের ইউনিএঞ্জাইম বড়ি।

    এতো রকম কিছু মেখে ঘষে খেয়ে মাস দুয়েক কাটলো। সেই আঁচিলের মতো কড়া, বেশ খানিকটা বড় হয়ে রয়েই গেল। নো চেঞ্জ সেই বস্তুটির। তারপরে রিপোর্ট, আবার কন্সালটেশন ইত্যাদি করে করেই পেরিয়ে গেল বছর দুয়েক। কিন্তু সেই ডেলা মার্কা কড়া তখন স্থিতধী একেবারে সাধকদের মতো।

    বাধ্য হয়ে আবার নতুন কোনো ডাক্তারের খোঁজ করতে হ’ল। এবারেও ত্রাণকর্তা আমার এক কলিগ দাদা। তার কাছে যে কোনো সমস্যাই ছিল জলভাত। কানে অল্প খাটো ছিলেন সেই দাদা। মজা করার জন্যে দাদার কানের কাছে মুখটা বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলতাম – দাদা আমার বাচ্চা হচ্ছে না (তখনো আমি অবিবাহিত)। এক্কেরে অবজেক্টিভ উত্তর রেডি তার মুখে। নিচের ঠোঁটের এক কোনা’কে ওপরের ঠোঁটখানি দিয়ে কামড়ে বলে উঠতেন – ‘হয়ে যাবে – করে দেবো !’ বেশ ছিল ড্যালহাউসি পাড়ার সেই সব দিনগুলি !

    ……চলবে……পরের পর্বে…
    #
    ©গৌতমদত্ত
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৬ এপ্রিল ২০২২ | ১৮৭৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন