এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য – ( পর্ব - ২২ ) 

    Goutam Dutt লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ১৮ জুলাই ২০২২ | ১৫৯৪ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)

  • অনেক তো বাজে বকলাম। এবারে আস্তে আস্তে নটে গাছটা মুড়োবার জন্যে তৈরি হই বরং। সাথে থাক কিছু শোনা কিছু জানা মিষ্টিমধুর গল্প। আশাকরি আপনাদের তা ভালই লাগবে।

    ডাক্তার শীতল ঘোষ। নাম অনেকেই শুনে থাকবেন। আবার পাগলা ডাক্তার বলেও অনেকেই জেনে থাকবেন। তাঁর বিভিন্ন কীর্তিকাহিনী ঘোরাফেরা করে অনেকেরই লেখায়। অনেক সময় আবার দেখি একই ঘটনা একটু অন্য অনুষঙ্গে। মোটকথা এই যুগে একজন জেনারেল ফিজিশিয়নের এক চূড়ান্ত উদাহরণ। যাঁর বিভিন্ন অলৌকিক চিকিৎসা প্রদানে না ছিল হাজার হাজার টাকার প্যাথোলজিক্যাল টেস্ট বা অন্য কিছু। ক্লিনিক্যাল অবজারভেশনেই বুঝে নিতেন রুগীর অসুখ। আর খুব সাধারণ সামান্য দামের ওষুধেই সারিয়ে তুলতেন বিভিন্ন রকমের দীর্ঘমেয়াদী রোগ।

    মানুষটি ছিলেন হাওড়ার বাসিন্দা। দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজ ধরে হাওড়ার দিকে গেলে ওনার বাড়ি পড়বে ডান দিকে। শোনা যায়, দ্বিতীয় হুগলি সেতু তৈরি হবার আগেই উনি জানতে পারেন যে ওনার সাধের বাড়িখানা ভাঙা পড়বে। সে সময় বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। গল্প ভেসে বেড়ায় এখনো যে উনি সরাসরি জ্যোতি বসুকে কালো টেলিফোনে ডায়াল করেই বলেন – হাওড়া থেকে আমি ডাক্তার শেতল ঘোষ বলছি। আপনি কি চান আমি আমার এখানকার বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চিরকালের জন্যে বিলেত চলে যাই ?  জ্যোতি বসুর প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান যে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর যে নকশা তৈরি করা হয়েছে তাতে ওনার বাড়ি সম্পূর্ণ ভাঙা পড়ছে। অবশেষে সেই রাস্তাকে একটু তেরছা করে বেঁকিয়ে সে যাত্রা ডাক্তারবাবুর বিলেত যাওয়া আটকানো হয়েছিল।     

    আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর বাড়ি হাওড়ার বেতড় অঞ্চলে। ২০০১ সালের কথা। ওর গিন্নির কিছুদিন ধরে কথা বলতে একটা অস্বস্তি। গলার একটা অংশ ফুলে যেত। কষ্ট হ’ত কথা বলতে গিয়ে। নানান ডাক্তার দেখিয়ে জানা গেল যে সেটা থাইরয়েড গ্ল্যাণ্ডের রান্নাঘর থেকে উৎপত্তি। শেষ চেষ্টা ডাক্তার শীতল ঘোষ। পাশের পাড়াতেই যে ওনার বাড়ি।

    রুনা মানে আমার বন্ধুর বউ খোঁজখবর করে জানতে পারে যে রোজ সকালে নিজের বাড়িতে মাত্র দশজন পেশেন্ট উনি দেখেন। আর সেই জন্যে রাত তিনটে থেকে লাইন পড়ে ডাক্তার বাবুর বাড়ির সামনে। দূর দূরান্ত থেকেই রোগীরা আসেন এই মানুষটিকে দেখাতে।

    রাত থাকতে উঠে কর্তা গিন্নি দুচাকায় চেপে হাজির হন ডাক্তার বাবুর বাড়ির সামনে। তখন রাত তিনটে। লাইনে দাঁড়াতেই হয়।

    আস্তে আস্তে রাতের আকাশ ফর্সা হয়ে ওঠে। সকাল ছটা নাগাদ বাড়ির দরজা খুলে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে বলেন – এত রাত থেকে এসে লাইন দেবার কি হয়েছে ? সকাল সকাল এলেই তো হয়। আর আজ ডাক্তার বাবু রোগী দেখবেন না। ভাবুন !

    পরে জানা যায় ওই ভদ্রলোকটি ডাক্তারবাবু নিজেই। বাড়িতে ওনার কোনো হেল্পার বা এ্যাটেন্ডেন্ট ছিলই না কোনোদিন।

    আবার দিনকয়েক পরে আমার বন্ধু আর তার স্ত্রী আবার মাঝ রাতে উঠে লাইন লাগায়। সেদিন আট নম্বরে নাম রেকর্ড হয় রুনার।

    সাতটা নাগাদ ডাক্তারবাবু এসে দরজা খোলেন চেম্বারের। এরপরে চলে একটা বিরাট এ্যাকোরিয়ামে রাখা রঙিন মাছেদের খাওয়ানোর পর্ব। সেটা শেষ হলে আট নম্বরে থাকা রুনাকে ডাক্তারবাবু ডেকে নেন নিজের চেম্বারে। কারোর কিছু বলার নেই। বসার ঘরে পিন পতনের শব্দ যাতে না হয় এমনই নৈঃশব্দ।

    বিরাট এক ঢাউস কাঠের টেবিলের এক প্রান্তে ডাক্তার শীতল ঘোষ। অন্য প্রান্তে রুনা একা। রোগী ভিন্ন অন্য কারো প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত। রুনার কিছু বলার আগে ডাক্তারবাবুই বলতে শুরু করেন।

    —আমি কবিতা লিখি জানো। তোমায় আমি আমার লেখা কিছু কবিতা শোনাই।

    রুনা তো হতভম্ব। কিছু বলতেও পারছে না ভয়ে। আবার বেরিয়েও আসতে পারছে না ডাক্তারের সামনে থেকে। বাইরে অপেক্ষারত আমার বন্ধুবর।  

    পাক্কা পৌনে এক ঘন্টা। দরাজ গলায় একের পর এক কবিতা শুনিয়ে গেলেন ডাক্তার ঘোষ এক অপরিচিত রোগিণীকে। রোগিণীর তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া। অথচ কিচ্ছু করারও নেই। কবিতা পাঠ শেষ হবার পর ডাক্তারবাবু রুনাকে প্রশ করলেন – তোমার কি হয়েছে ?  ধড়ে প্রাণ এ’ল রুনার।

    ওর সমস্যা শুনলেন চুপ করে। তারপরে রুনাকে হাত সোজা রাখতে বললেন। রুনা ডান হাত সোজা করে বসে আছে। খচাৎ করে একটা প্রেশক্রিপশনের পাতা আদ্ধেক ছিঁড়ে রুনার হাতের ওপরে রেখে তাকিয়ে রইলেন।

    রুনা বলে ডাক্তারবাবু এটা কি দেখছেন ?  বললেন ওই সাদা পাতাটা কাঁপলে বুঝতে হবে তোমার থাইরয়েড হয়েছে। না কাঁপলে হয়নি। তারপরে বললেন ও কিছু নয়। কিচ্ছু হয়নি তোমার। থাইরয়েড বলে গলায় একটা গ্ল্যাণ্ড আছে সেটা একটু ফুলেছে আর তার থেকেই হচ্ছে এটা।

    রুনা বলে ডাক্তার বাবু এটা যদি আরো বেশি কিছু হয় !  ডাক্তার ঘোষ বললেন কিচ্ছু হবে না। আর হলে আমার কাছে চলে আসবে। আমি বলে দেব কার কাছে কোথায় অপারেশন করাতে হবে।

    নো প্রেশক্রিপশন ! নাথিং !  সেই সময় কড়কড়ে দেড়টি হাজার টাকা পকেটে পুরলেন।

    রুনা বললে ডাক্তারবাবু কোনো প্রেশক্রিপশন-টন কিছুই তো দিলেন না আমায়। কোনো ওষুধ খাবো না ?

    —কিচ্ছু খেতে লাগবে না। ওতে ওষুধ দিয়ে কিচ্ছু হবে না।  বাড়াবাড়ি হলে তো আমি আছিই।

    চেম্বার থেকে বেরোতেই অপেক্ষারত রোগীর দল নিঃশব্দে ঘিরে ধরলো রুনাকে। কি দেখলেন ডাক্তারবাবু এতক্ষণ ধরে ?  রুনা উত্তর দিলে – আমায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে আগে কবিতা শোনালেন তারপরে চিকিৎসা।

    এরপরে এক নম্বরে নাম লেখানো রোগী ঢুকলেন চেম্বারে। তখনো রুনা ওই অপেক্কার জায়গাতেই। মিনিট পাঁচেক পরে ডাক্তার শীতল ঘোষ বেরিয়ে বললেন যে, শোনো ভাই আজ আর রোগী দেখতে পারবো না। বাকি রোগীরা কাল আসবেন। এই বলে হন হন করে বেরিয়ে নিজের গাড়ি চেপে নিস্ক্রান্ত হলেন বাড়ির থেকে।

    পরবর্তী কালে রুনা চেন্নাই এ্যাপেলোতে যখন বুকের একটা অপারেশন করাতে যায় সেই সময় ওই থাইরয়েড গ্ল্যাণ্ড টাও দেখায়। ওরা ওখান থেকে রস টেনে নিয়ে বায়াপ্সিও করে। কিন্তু সে রেজাল্ট নেগেটিভ-ই ছিল।

    ……চলবে……পরের পর্বে…
    #
    ©গৌতমদত্ত
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৮ জুলাই ২০২২ | ১৫৯৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন