এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য – ( পর্ব - ১৬ ) 

    Goutam Dutt লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ০৯ জুন ২০২২ | ৭৩৯ বার পঠিত

  •  
    বড় বড় নার্সিং হোমের বড় বড় ঘরানা। ডাক্তার জানিয়ে দিলেন দু-শিশি রক্ত লাগবে। খুব ভাল কথা। আমার অফিসের দুজন পরের দিন সকালেই ফ্রেশ ব্লাড ডোনেট করে দিলেন। আমার কলিগ ওই ফ্রেশ ব্লাডই আমাকে দিতে বললে, ওনারা জানালেন যে ওদের ল্যাবোরেটরির পরীক্ষায় পাশ করা রক্তই আমায় দেওয়া হবে। আর আমার দেওয়া দু-শিশি ব্লাড ওদের হিমঘরে ঢুকে যাবে।

    এ এক চরম সিস্টেম এই রক্তের পরীক্ষা। যে কোনো ডোনেট করা ফ্রেশ ব্লাড দিলে আমি বা আমরা তো তক্ষুনি জানতেই পারি যে ওই রক্তে অন্য কোনো কিছু ঘাপটি মেরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিনা ! কিন্তু কলকাতার সিস্টেমে তা হবার নয়। সরাসরি ফ্রেশ ব্লাড সম্ভবত হৃদয়ের বাইপাশ সার্জারি ছাড়া আর কিছুতেই দেওয়া হয় না। অন্তত কলকাতা শহরে। এবারে মজাটা হলো আপনি যে স্টকে থাকা রক্ত পাচ্ছেন তার মধ্যে সাপ আছে না ব্যাঙ আছে তার দায়িত্ব কে নেবে ? ওই রক্তের থেকে অন্য উপসর্গ দেখা দিলে আপনি কিছুতেই প্রমাণ করতে পারবেন না যে সেই উপসর্গ ওই রক্তের  মধ্যে থেকেই এলো কি না ? এ এক চক্রবৎ বাজে বৃত্ত।

    এমনিতেই যে কোনো এমার্জেন্সিতে আমরা যে রক্ত নিয়ে আসি তার কোনো কাগজপত্তর পেশেন্ট পার্টির হাতে দেওয়াই হয় না। একমাত্র বর্তমানে ওই রক্তের পাউচের ওপরে যে কাগজ বা লেবেলটি সাঁটা থাকে সেটা যদি কেটে রেখে দিতে পারেন, তাহলে অন্তত ভবিষ্যতের আইন আদালতে কাজে লাগলেও লাগতে পারে। তবে সে সম্ভাবনা খুব কম।

    এই প্রসঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম কলকাতার এক প্রাইভেট ব্লাড ব্যাঙ্কের এক বন্ধুর সাথে। সে অনেকদিন ধরেই জড়িয়ে আছে এই ব্লাড ব্যাঙ্কের সাথে। আমার প্রশ্ন ছিল যে ওদের থেকে নেওয়া রক্ত থেকে আমার যদি হেপাটাইটিস বি হয় তাহলে প্রমাণ করবো কি উপায়ে ?

    ও যা জানায় তা আপনাদের সংক্ষেপে বলি। ‘হেপাটাইটিস বি’ কারোর শরীরে আসে একমাত্র রক্ত নিলে আর যে যে মাধ্যমে রক্ত শরীরে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ নিডল ইত্যাদি (মানে যে মাধ্যমের সাথে শরীরের রক্তের বন্ধুত্ব হয়েছে) যদি না পরিশুদ্ধ থাকে। এছাড়া এমনও তো হতে পারে যে রোগীর কোনো অস্ত্রোপচার হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে ওই ওটিতেই আগের কোনো অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি ঠিকমতো পরিশুদ্ধ করা হয়নি এবং হয়তো সেই আগের রোগীটির শরীরে বাসা বেঁধেছিল হেপাটাইটিস বি’র জীবাণু।

    এমন হলে অন্তত আমাদের দেশে প্রথমেই যেটা করতে হবে যে যেখান থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে সেই প্রতিষ্টানে একটা চিঠি দিয়ে জানা যে রক্তটি দেওয়া হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ। কোনো দাতার শরীর থেকে রক্ত নেওয়া হবার পরে সেই রক্ত পরীক্ষা করা হয় আধুনিক মেশিনে এবং সেই মেশিন অটোমেটিক্যালি প্রিন্ট করে দেয় রক্ত পরীক্ষার ফলাফল। স্বাভাবিকভাবে সেই রিপোর্টে হেরাফেরি করার স্কোপ কম যদিও এ দেশে না আঁচালে কিছুই বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর সরকারি ব্লাড ব্যাংকে এমন সুন্দর সুচারু ব্যবস্থা যথাযথ মেনটেন হবে বলে অন্তত মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়।

    এছাড়া হেপাটাইটিস বি কোন ছিদ্র দিয়ে আমার-আপনার শরীরে এসে বাসা বাঁধলো তা জানা অসম্ভব। অন্তত আমি তো আমার ক্ষেত্রে পারিই নি কোনো প্রমাণ করতে। 

    আরো একটা প্রয়োজনীয় কথা আপনাদের গোচরে আনি।

    যে কোনো বস্তু যা আমাদের শরীরে লাগানো হয় চিকিৎসার কারণে এবার থেকে সেটির যথাযথ ক্যাশ মেমো বা বিল নিতে ভুলবেনই না। সে চোখের ছানি অপারেশনের আইওএল লেন্সই হোক বা কোনো মেটাল বা প্লেট ইত্যাদি জাতীয় যে কোনো বস্তু যা আপনি দাম দিয়ে কিনতেন হাসপাতালে থাকাকালীন, তার উপযুক্ত বিল, ক্যাশ মেমো বিশেষ করে ওয়ার‍্যান্টি অবশ্যই দেখে নেবেন। কেন ? তা পরে জানাচ্ছি।

    আমার ফিমারের হাড়ের মধ্যে যে রডখানি প্রবেশ করানো হয়েছিল সেটা সেই সময়ে দাম ছিল ছাব্বিশ হাজার টাকা। এবং বলা হয়েছিল যে এটা শরীরের মধ্যে থাকলেও এমআরআই করতে কোনো সমস্যা হবে না এবং ওই মেটালটির দাম বেশ বেশী বলে তার নাকি লয়-ক্ষয় খুবই কম। প্রসঙ্গত বলে রাখি আমার বিলে এই মেটাল রডটার দাম ঢোকানোই ছিল অথচ সে বস্তুর সাপোর্টিং বিল বা ক্যাশ মেমো কিছুই ছিল না। ওই ভাবেই আমার মেডিক্লেমও পেতেও অসুবিধে হয় নি যেহেতু দক্ষিণ কলকাতার এই নার্সিং হোমের বেজায় নাম-ডাক।

    যথাবিধি আমার অপারেশন হয়ে গেল এবং শুয়ে শুয়ে আমি বুঝতেও পারলাম না যে কি চলছে আমার সেই ভাঙা পা’কে নিয়ে। অপারেশন শুরুর আগেই আমি অজ্ঞান-শিল্পী ডাক্তারবাবুকে বলেছিলাম যে স্থানীয় এ্যানাস্থেটিয়া না করে পুরোপুরি অজ্ঞান করে দিতে। লোকমুখে শুনেছিলাম যে ওই শিরদাঁড়ায় ছুঁচ ফুটিয়ে অজ্ঞান করলে নাকি পরে অনেকরকম জটিল ব্যবস্থা জন্ম নেয়। উনি শুনলেন আমার এ কথা। কথাপ্রসঙ্গে সেই অজ্ঞান-শিল্পী ডাক্তারবাবুর সাথে আমার একটা ঈথার তরঙ্গ মিলে গেল। উনি আর আমি রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র। আমার জোর ফলানোর অধিকারটা নিমেষেই ইতি হয়ে গেল।

    ‘আমি আপনাকে পিঠের শিরদাঁড়াতেই ছুঁচ ফোটাবো তবে একটা কথা !  যদি বিন্দুমাত্র আপনার কষ্টের অনুভূতি বোধ হয় তখনই আমায় বলবেন। আমি তারপরে পুরো অজ্ঞান করে দেবো’। আর কি বলি ! তবে সত্যিই এত অসাধারণ ছিল আমার সাথে গল্প করতে করতে সেই ছুঁচ ফোটানোর পর্ব, হতবাক হতে হতেই বুঝলাম ভারি হয়ে আসছে আমার পা দুটো। সত্যিই তুলনাহীন ছিলেন সেই ডাক্তারবাবু।   

    বললে বিশ্বাস করবেন না অত লম্বা সময়ের একটা অপারেশন নির্দ্ধিধায় সমাপ্ত হলো। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম, শুয়ে শুয়ে শুনলাম সব শব্দ, কথাবার্তা।

    তারপরে ছুটি হবার আগে এক্স-রে প্লেটেতে দেখলাম একটা তলোয়ারের মতো বস্তু বহাল তবিয়তে অবস্থান করছে আমার থাই-এর মধ্যে। তফাৎ শুধু এই যে তলোয়ারের ছুঁচোলো দিকটা একটু বেঁকে যায়, আর আমার ওই বস্তুটি সোজা।

    পাক্কা দুমাস চিৎপাৎ হয়ে বিছানায় লেপ্টে থেকে ক্রমশ স্বাভাবিক হলাম ক্রাচ, লাঠি ইত্যাদির সমারোহে। অফিস যেতেও শুরু করলাম লাঠি হাতে। অকালেই বৃদ্ধ বনলাম। তবে বাসে উঠেই প্রতিবন্ধী সিটটা অবলীলায় পেয়ে যাচ্ছিলাম। সাফল্য বলতে এইটুকুই।

    ……চলবে……পরের পর্বে…
    #
    ©গৌতমদত্ত

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৯ জুন ২০২২ | ৭৩৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন