এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য – ( পর্ব – ৩ ) 

    Goutam Dutt লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২০ মার্চ ২০২২ | ১৫২০ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)
  •                                      

    আমাদের পৈত্রিক পার্টিশনড হয়ে যাওয়া বাড়ির - দুদিকেই রাস্তা। একদিকে ৩বি, ভৈরব বিশ্বাস লেন, আর অপরদিকে ১/১এ, দীননাথ মিত্র লেন। আমার ঠাকুর্দার অংশখানার দরজা ছিল দীননাথ মিত্র লেনে। অপরদিকে আমার ছোটঠাকুর্দার বাড়ির এন্ট্রি পয়েন্ট ছিল ওই ভৈরব বিশ্বাস লেন। আমার জীবনের বেশিরভাগ যাওয়া আসার দরোজা ছিল ওই ভৈরব বিশ্বাস লেনের প্রাচীন বড়ো দরোজাখানা। উলটো দিকেই ‘পল্লী সঙ্ঘ’। আমাদের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। ভৈরব বিশ্বাস লেন এর আরেকটা নাম ছিল ছানাপট্টি। এ গলির একদিকে ছিল রামদুলাল সরকার স্ট্রিট। আর অন্যদিক গিয়ে মিশেছিল ডাব্লু সি ব্যানার্জি স্ট্রিটে। সোজা বেরিয়েই জীবন মিলন লাইব্রেরি।

    আমাদের বাড়ি থেকে ওই ডাব্লু সি ব্যানার্জি (উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি) স্ট্রিটের দিকে যেতে এক বাড়িতে থাকতেন  ডাক্তার বিষ্ণুপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছোট থেকে এমডি করা অব্দি এ পাড়াতেই কেটেছে তাঁর ছেলেবেলা, যৌবন। উনি ছিলেন আমাদের প্রাণ। ওনার এমডি ছিল ফার্মাকোলজিতে। উনি ছিলেন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট শুধু নয়, গোল্ড মেডালিস্ট ও।  আমরা বরানগরে চলে আসার পরে উনিও বাঙ্গুরে বাড়ি করে উঠে যান কিন্তু আমার ঠাকুর্দা, বাবা, আমি এবং আমার ছেলে এই চার-চারটে জেনারেশনের ভগবান বলতে ছিলেন উনি। ওই পুরোনো পাড়ার মানুষজনের কাছে “বিষ্টুদা” আর আমার মা কাকিমাদের কাছে “বিষ্টুবাবু”।  উনি আমার বাবার চেয়ে বয়সে ছোটো ছিলেন। চেহারায় ছোটোখাটো মানুষটির পার্সোনালিটি ছিল দুরন্ত। চেম্বার ছিল নিজের বাড়ি বাঙ্গুরে (সকালে) আর মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে (সন্ধ্যেবেলা)।

    উনি পড়াতেন পি জি মেডিক্যাল কলেজে স্নাতোকোত্তর ছাত্রদের। তাই নামের আগে প্রোফেসর লিখতেন। আজীবন বামপন্থী মানুষটি একবার কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলরও হয়েছিলেন। আর ডাক্তার নারায়ন চন্দ্র রায়ের তিন শিষ্যের একজন হওয়াতে গরীব মানুষদের চিকিৎসা দিতেন মাগ্‌নাতেই প্রায়। ওনার মতো ডাক্তারের ফি-ও ছিল যৎসামান্য। কেউ ওনাকে দেখিয়ে ফি না দিয়ে চলে গেলেও - চাইতেও পারতেন না।

    এমন একজন ভগবান ডাক্তার কোনোক্রমে একটা দোতলা বাড়ি করেছিলেন মাত্র। শেষ বয়সে স্ট্রোক হয়ে পঙ্গুত্ব গ্রাস করেছিল কিন্তু এমন কিছু সঞ্চয় ছিল না যাতে উন্নত চিকিৎসা বা আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর খুব কাছের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমি অন্তত এই মানুষটির কোনো দ্বিচারিতা বা সুযোগ নেওয়ার কিচ্ছু দেখিনি কোনোদিনই।

    আমি দেখিনি ডাঃ নর্মান বেথুনকে, দেখিনি ডাঃ নারায়ণ রায়কেও। কিন্তু বিষ্টুবাবুকে দেখেছি আমি। একটা কালো রঙের এ্যামবাসাডারের জীবনভোর সেই একই ড্রাইভার মানুষটাকেও দেখেছি আজন্ম। দেখেছি বা অনুভব করেছি ডাক্তারের আদর্শকে।

    মিনিমাম আধঘন্টার আগে কোনো রুগীকে চেম্বার থেকে বেরোতেই দেখিনি কখনো। ডাক দিলে সময় করে আমাদের বরানগরের বাড়িতেও এসে দেখে গেছেন কাউকে না কাউকে।

    আজ মনে পড়ে আমার ছেলের ছোটো বেলায় বাড়াবাড়ি হলেই বিষ্টুদা ছিলেন ভরসা। আমার ছেলের জন্ম ১৯৯২তে। সেই সময় যখন আধুনিক ডাক্তারগণ ‘ঊডওয়ার্থস্‌ গ্রাইপ ওয়াটার’কে অচ্ছ্যুৎ মনে করছেন, তখন বিষ্টুদা অবলীলায় খাওয়াতে বলতেন ওই সিরাপ। ছেলেকে দেখাতে নিয়ে গেলেই প্রেসক্রিপশন লেখার আগের সহকারী মহিলাকে বলতেন ব্যাগ থেকে একটা সন্দেশ বার করে ওকে দিতে। আর সে সন্দেশ ছিল অবশ্যই গিরিশ চন্দ্র ঘোষ আর নকুড় নন্দীর দোকানের। একটা দিনও ব্যত্যয় হয়নি এই মিষ্টি খাওয়ানোর।

    ডাক্তারি ছাড়াও সংস্কৃতি জগতেও আনাগোনা ছিল পুরোমাত্রায়। ওনার একটা দল ছিল নৃত্যনাট্যের। শো হ’লে সেখানে পাঠ করতেন নিয়মিত। ভাবলে অবাক হতে হয় এই মানুষটাকে আমি প্রচণ্ড রেগে যেতেও দেখেছি কিন্তু কখনোই দেখিনি বিরক্ত হতে। পেটের যে কোনো রোগের অনায়াস চিকিৎসায় - বলে বলে সারিয়ে তুলতেন। প্রেসক্রিপশন লেখার সময় আমার দাবী থাকতো সস্তা দামের ওষুধ লেখার জন্য। বলতেন – তোর জন্যে আমায় আবার ভাবতে হয় !

    ওনার লেখা আমার ছেলের শেষ প্রেসক্রিপশনের তারিখ ৯ জুলাই ২০০২। আর দেখাতে পারিনি এরপরে।  

    ১৯৭৮। চাকরি পাওয়ার পরে পরেই এক অদ্ভুত রোগে কাবু হয়ে পড়তাম রোজ। সন্ধ্যে হলেই সারা শরীর চাকা চাকা হয়ে ফুলে উঠতো আর অসম্ভব চুলকোতো। গোদা বাংলায় একেই বলে ‘আমবাত’। বেশ কিছুদিন চিকিৎসা চালালেন উনি। এটা ছিল এক প্রকারের এ্যালার্জি সম্ভবত। জানিনা সে সময় এই এ্যালার্জি’র টেস্ট হ’ত কি না !  অন্তত আমার ক্ষেত্রে তা করতে হয় নি। বিভিন্ন এ্যান্টি-এ্যালার্জিক ওষুধেও যখন কমছে না আমায় বললেন একটা ইঞ্জেকশন দিচ্ছি, এতে আশা করি কমবেই। প্রেশক্রিপশনের তারিখ দেখছি জুন ১৯৭৮। প্রেসক্রাইব করলেন ‘Sandosten-Calsium’ 5 ml Inj daily for 3 days, then on alt days 3 such

    অদ্ভুতভাবেই কমে গেল ওই সন্ধ্যের চুলকুনি রোগ। স্বাভাবিক হয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। অনেক পরে এই ইঞ্জেকশনের কথা বলেছিলাম আমাদের টবিন রোডের এক অভিজ্ঞ কম্পাউণ্ডারবাবুকে। তিনি বললেন যে এই ইঞ্জেকশন এখন আর কেউ দেন না। এটাকে নাকি ওদের পরিভাষায় বলা হ’ত কোল্ড ট্রিটমেন্ট বা এমন কিছু। ঠিক মনে নেই পুরোটা তবে ‘কোল্ড’ শব্দটা মনে আছে আমার স্মৃতির কোনো এক বিক্ষিপ্ত কোষে।

    যদিও আমি ওয়েব সাইটে দেখতে পাচ্ছি যে এখনো পাওয়া যাচ্ছে এ ইঞ্জেকশন।

    (…………………চলবে……)

    #
    ©গৌতমদত্ত
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২০ মার্চ ২০২২ | ১৫২০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন