এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য – ( পর্ব - ১৫ ) 

    Goutam Dutt লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ০৩ জুন ২০২২ | ১২৮৬ বার পঠিত

  •  
    ২০০২।

    অফিস থেকে বাড়ি আসছি। ব্রেক জার্নি শ্যামবাজার পাঁচমাথায়। দাঁড়িয়ে আছি বি টি রোডের বাস ধরবো বলে। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। হাতের ক্যারি ব্যাগেও শখের সামগ্রী। প্রৌঢ়ত্বের শরীরে হঠাৎ যৌবনের দোলা। অথচ নিয়মিত ব্যায়াম বা হাত-পা চালনা ঘুমে অচেতন। হঠাৎ ছটফটানি ! এগিয়ে আসছে দুশ’এক নাম্বারের প্রাইভেট বাস। আর পায় কে আমায় ! বাস চলছে তবে গতি কম।

    তিড়িং করে সে বাসের ফার্স্ট গেটে এক লাফ !  কি যে হলো অচিরেই !  ডান পা’খানা নীচের সিঁড়িতে লাগলই না আমার। হড়কে যেতে যেতে বুঝলাম রড ডান হাতে ধরা থাকলেও পা স্লিপ খেয়ে ঘষ্‌টাচ্ছে রাস্তায়। বাস থামল না। কণ্ডাক্‌টর দেখলো। গতি বাড়াল বাস। আমার হাত ছেড়ে গেল বাসের রড। চিৎ হয়ে সটান রাস্তায়। বাসের পেছনের চাকা অবলীলায় ঘষ্‌টে দিল আমার ডান উরু। একটা বিকট যন্ত্রণার মধ্যেই দেখলাম বাস চলে যাচ্ছে দূরে।

    “লালবাতির নিষেধ ছিল না,
    তবুও ঝড়ের বেগে ধাবমান কলকাতা শহর
    অতর্কিতে থেমে গেল;
    ভয়ঙ্করভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
    ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেমপো, বাঘমার্কা ডবল-ডেকার।
    ‘গেল গেল’ আর্তনাদে রাস্তার দুদিক থেকে যারা
    ছুটে এসেছিল—
    ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার—
    এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
    লগ্ন হয়ে আছে।
    স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,…………………”  ॥ - ( কলকাতার যীশু – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।)  
     
    পাঁচমাথার মোড়ে ঠিক ‘ইয়ং বেঙ্গল স্টোর্স’ এর অপর পারে – যন্ত্রণায় খাবি খাচ্ছে এক প্রৌঢ়।
    একটা অপরিচিত ছেলেকে বললাম – ভাই, একটু বরফ আনবেন ? আরেক ভদ্রলোক তাঁর গিন্নিকে দাঁড় করিয়ে রেখে থামাচ্ছিলেন পেছনের যানবাহন – যাতে আমি আবার রান ওভার না হয়ে যাই। যন্ত্রণা তখন সহ্যের শেষ সীমানায়।

    ছেলেটি এক চাঙড় বরফ এনে পায়ে ছোঁয়াতেই তারস্বরে আর্তনাদ আমার। সে যে কি ভয়ানক যন্ত্রণা তা লেখার সাধ্য আমার নেই। পাঁঠা বা মুরগীদের গলা কাটা হলে বোধহয় এমন যন্ত্রণা পায়। ওদিকে সেই ভদ্রলোকের হাতে কলকাতায় সদ্য আসা সেই নোকিয়া ঢাউস মোবাইল। আমি কিছুতেই বাড়ির ফোনের নাম্বার বলবো না। এক অফিস কলিগের ফোন নাম্বার পাওয়া গেল না অগত্যা বাড়ির নাম্বার বলতেই হলো – আমি দিশেহারা তখন।

    এলো পুলিশ। একটা ট্যাক্সি ডেকে আমায় তোলা হল পেছনের সিটে। বাঁ দিকের দরজা খোলাই রইল। সেই ছেলেটি আমার পা কোলে নিয়ে বসলো পেছনে। সামনে সেই পুলিশ কন্সটেবল মহোদয়। হৈ হৈ করে এক দরজা-খোলা ট্যাক্সি রওনা হলো বেলগাছিয়ার দিকে।

    সোজা ডাক্তার রাধা গোবিন্দ কর হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে এমার্জেনসির সামনে থামলো ট্যাক্সি। সেই ছেলেটিই কোত্থেকে যেন টেনে নিয়ে এলো একটা স্ট্রেচার। চ্যাংদোলা আমি জনগণেশের হাতে পড়ে স্ট্রেচারে শুয়েই পৌঁছে গেলাম ভেতরের ঘরে। নিমেষের মধ্যে একঝাঁক তরুন-তরুণী কাঁধে স্টেথো নিয়ে আমার চারধারে ঝুঁকে। আমি বলছি শিগ্‌গির একটা যন্ত্রণার ইঞ্জেকশন দিন না।

    এক্স-রে টা হোক আগে। আবার সেই ছেলে। স্ট্রেচার ঠেলে নিয়ে গেল এক্স-রে’র ঘরে। সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জন-রশ্মি আমার পা-এ। এক হাতে সেই ভেজা এক্স-রে প্লেট নিয়ে সেই ছেলেটি আবার পৌঁছে দিল ওই ডাক্তারদের বৃত্তে। ইতিমধ্যে দেখতে পেলাম অদূরেই বাড়ির দু-তিনজনের উদ্‌ভ্রান্ত মুখ। আবার কাতর প্রার্থনা – একটা ইঞ্জেকশন দিন না !!

    প্রেসক্রিপশন পৌঁছে গেল আমার কাকার হাতে। ইঞ্জেকশনখানা কিনে আনতে হবে। অল্প পরেই কাকার হাতে ইঞ্জেকশনের এ্যাম্পুল। এক তরুণী ফুঁড়ে দিলেন আমার শরীর। ক্রমশ অবসাদ চোখের তারায়। হয়তো জ্ঞান হারালাম। দুপুর বিকেল হলো।

    তাকিয়ে দেখি আমার কলীগেরা দুজন। অফিসে অফিসে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। আর জি কর হাসপাতালের ডাক্তারেরা ঠিক করছেন অপারেশনের খুঁটিনাটি আর ওদিকে সহৃদয় এক কলীগ ততক্ষণে আমার জন্য ঠিক করে ফেলেছেন দক্ষিণ কলকাতার এক নামজাদা নার্সিং হোম।

    অগত্যা বণ্ড দিয়েই আমার আবার চ্যাংদোলা—স্ট্রেচার—শয়ন যান (এ্যাম্বুলেন্স) ইত্যাদি। অল্প ঝাঁকুনি মানেই তীব্র যন্ত্রণার অনুভব। সেই সব কাটিয়ে পৌঁছনো গেল নির্দিষ্ট নার্সিং হোমে।

    হাই-ফাই সে ব্যবস্থা। এ্যাম্বুলেন্স পৌঁছোনো মাত্তর স্ট্রেচার নিয়ে নির্দিষ্ট সাজের একদল কর্মী ছুটে এলো। আবার চ্যাংদোলা হয়ে স্ট্রেচারে শুয়ে লিফট চেপে পৌঁছে গেলাম একটা দারুণ টুইন শেয়ারিং-এর বিশালাকার ঘরে। ছুটে এল নাইটিঙ্গেলের দল। আমাকে একটা সুসজ্জিত ধব্‌ধবে বিছানায় ভাসিয়ে দিলো সবাই মিলে। তারপরে প্রেশার মাপা থেকে শুরু করে টেম্পারেচার ইত্যাদি নানাকিছু সম্পন্ন করে সিস্টারেরা চলে যাওয়ার পরে আমার কাছে দেখা করে বিদায় নিলেন বাড়ির লোকজন, কলীগেরা।

    এই অবসরে এক সুদর্শন ডাক্তারসাহেব এসে দেখেশুনে জানালেন পরের দিন বিকেলে অপারেশন। বেশিক্ষণ নয় মাত্র চার ঘন্টার আয়ু সেই কাটা-ছেঁড়ার। ডান পায়ের ফিমার অর্থাৎ থাই বলি যাকে, তার ভেতরে অবস্থিত লম্বা হাড়খানি একটা থেকে ভেঙে দুখান হয়েছে শুধু। তাই সেই হাড়দুটো আবার সেট করে হাড়ের ভেতরের ছিদ্র দিয়ে একটা মেটাল রড ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। তারপরে সেলাইফোঁড়াই। বিজ্ঞানের কি দারুণ সাফল্য !

    মনে পড়লো ডাক্তার শ্রী শৈলেন ভট্টাচার্যের কথা। বিখ্যাত অর্থোপেডিক সার্জন। উনি অপারেশন করতেন তখনকার হ্যারিংটন স্ট্রিটের ‘হ্যারিংটন নারসিং হোমে’। কি সুন্দর সে নার্সিং হোম। আমার এক বয়স্ক নিকটাত্মীয় বাড়িতে মই থেকে পপাত ধরণী হওয়ায় তাঁকে অপারেশন করার পরে পুরো প্ল্যাস্টারে মুড়ে বিছানায় শুইয়ে রেখেছিলেন প্রায় দিন পনেরো। সেই সময় ওনার অপারেশন ফি দিতে গিয়ে মুখ ফস্‌কে বলে ফেলেছিলাম, স্যার একটু কম করা যায় না ? মিষ্টি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন – না ভাই, আমি তো রিসিট দিয়ে দিচ্ছি। সত্যিই রেভেনিউ স্ট্যাম্প লাগানো সেই রিসিট হাতে নিয়ে আর কিছু বলার ছিল না আমার। সেই দিনেই উনি গল্প করতে করতে বলেছিলেন, ভাই আমরা হলাম হাড়-গোড়ের ছুতোর মিস্ত্রি। ছুতোর মিস্ত্রি যেমন কাঠ কেটে-চেঁছে-ঘষে ফার্নিচার বানায় তেমন করেই ওনারা মানে অর্থোপেডিক সার্জেনরা আমাদের ভাঙা হাড় জোড়া দেন। এই কারণে শারীরিক পরিশ্রম ওনাদের অনেক বেশি।

    ……চলবে……পরের পর্বে…
    #
    ©গৌতমদত্ত

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৩ জুন ২০২২ | ১২৮৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Critic | 103.24.***.*** | ০৩ জুন ২০২২ ১১:৫৩508426
  • "তিড়িং করে সে বাসের ফার্স্ট গেটে এক লাফ"
    He is an indisciplined person, without self-control.
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন