গোয়েন্দা গল্প বা অপরাধ-রোমাঞ্চের গল্পের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। গল্পগুলিকে অবলম্বন করে তৈরি চলচ্চিত্র বা স্বাধীনভাবে লেখা স্ক্রিপ্ট থেকে তৈরি এ জাতীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। গোয়েন্দা গল্পের হরেক রীতি। 'হু ডান ইট' এক ধারা। এই ধারায় চলচ্চিত্রও পৃথিবীতে কম নেই। কিন্তু সাহিত্য ও চলচ্চিত্র প্রকরণগত ভাবে আলাদা। সত্যজিৎ রায় মনে করতেন গপ্পের শেষে অপরাধীকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে সনাক্ত করার দীর্ঘ চেম্বার ড্রামার মধ্যে একটা একঘেয়েমি আছে, এটা আরও প্রকট হয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে। তাই সত্যজিৎ এর পরিবর্তে এডভেঞ্চার ধর্মী গোয়েন্দা চলচ্চিত্রের পক্ষপাতী ছিলেন। আসামীকে আগেই চিনিয়ে দেওয়া হবে, দর্শক বরং বেশি আগ্রহী হবে গোয়েন্দা কিভাবে আসামীকে ধরল সেই এডভেঞ্চারে সামিল হতে। সত্যজিৎ মনে করতেন এর একটা পুনরাবৃত্তিমূলক মূল্য আছে! গোয়েন্দা গল্প বা অপরাধ-রোমাঞ্চের গল্প থেকে নিছক বিনোদনের আকাঙ্ক্ষা যতটা থাকে সমাজ বা ব্যক্তি-মানসের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানের দাবী ততটা থাকে না। কিন্তু সাহিত্যিকের সহজাত প্রতিভার বলে সে ব্যাপারটাও ঘটে যায় কখনও কখনও উপরি পাওনা হিসেবে। গোয়েন্দা গল্পের পথিকৃৎ এডগার এলানপোই (১৮০৯-১৮৪৯) যেমন। আমাদের দেশের শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭০) কিংবা ওদেশের জি কে চেস্টারটন (১৮৭৪-১৯৩৬) কিংবা রেমন্ড চ্যান্ডলার (১৮৮৮-১৯৫৯) যেমন। এদের অনেক কাহিনীতেই নিছক অপরাধ বা হত্যার অন্তরালে পাওয়া যায় চিন্তা উদ্রেককারী বিভিন্ন সামাজিক প্রক্ষেপ। সুতরাং, এগুলি একইসাথে বিনোদনে পরিপূর্ণ এবং গুরুগম্ভীর গল্প-উপন্যাসের রীতি মেনে ব্যক্তি ও সমাজ-মানসের সত্যের প্রতিফলক। প্রকৃতপ্রস্তাবে যেকোনো সার্থক সাহিত্য এক্ষেত্রে গল্প উপন্যাসের কথাই বলা হচ্ছে, আসলে গোয়েন্দা গল্প – এরকম বলেছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়(১৯৩৩-২০০৫)! খাঁটি সত্য কথা। আসলে সাহিত্যিকের কাজ ব্যক্তি ও সমাজকে সার্জারির টেবিলে তুলে কাটা-ছেঁড়া করে দেখা , তাই সে আসলে গোয়েন্দাই এবং অবশ্যই বৃহৎ অর্থে সত্যান্বেষী। সত্যানুসন্ধানটাই আসল, অপরাধ-অনুসন্ধান নয়। সত্য সবসময় অপরাধমূলক হবে এও সবসময় ঠিক নয়। ফলত আলাদা করে গোয়েন্দা গল্প অপরাধমূলক রোমাঞ্চের গল্প নাম দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়েই ভেবেছিলেন সন্দীপন। নিজে যদিও গোয়েন্দা কাহিনী নাম দিয়ে 'এসো নীপবনে' লিখেছিলেন, কিন্তু যারা উপন্যাসটি পড়েছেন তারা জানেন গোয়েন্দা কাহিনী বলাটা আসলে উপহাস মাত্র।
এরকম মনোভাব নিয়ে যখন শুনলাম চলচ্চিত্রটির বিষয় পুলিশি তদারকি, তখন ক্ষণিক দমে গিয়েছিলাম। সাল - ২০১১, উৎসব - কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। কিন্তু এরপরই মাথায় এলো পরিচালকের নামটি, মনে হল ব্যাপারটা অন্যরকম কিছু হওয়ারই সম্ভাবনা। কারণ এই পরিচালকের কাজের সঙ্গে বেশ কিছু বছর ধরে আমরা পরিচিত। সম্ভবত ২০০৪-৫ সাল হবে, 'ডিসট্যান্ট' (২০০২) বলে একটি ছবি দেখানো হয়েছিল গোর্কি সদনে, আইজেনস্টাইন সিনে ক্লাবের উদ্যোগে। কিছু ছবি থাকে যার শৈল্পিক সিদ্ধির ভরকেন্দ্রটি যতটা থাকে ছবির শরীরে তার থেকে অনেক বেশি থাকে ছবির সঙ্গে ধাবমান দর্শকের কল্পনার মনোভূমিতে। এ ছবিও তাই। ছবিতে যা বলা হয় নি বা বলা ভাল যা বলা যেতো কিন্তু সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানেই রয়েছে চলচ্চিত্রটির সৌন্দর্য। ফ্যাক্টরিতে কাজ হারিয়ে ইউসুফ গ্রাম ছেড়ে শহরে আত্মীয় মেহমুদের কাছে আসে। মেহমুদের সংসার জীবন অনুল্লেখিত, বোঝা যায় তার সচ্ছলতা আছে কিন্তু চিত্তে শান্তি নেই। রাতের একটি দৃশ্যে দেখানো হয় – ইউসুফ ও মেহমুদ দুজনেই দেখছে রান্নাঘরে ইঁদুর-কলে একটা ইঁদুর আটকে পড়েছে। ব্যাস, আর কিছু বলা হয় না। ঘর গৃহস্থালিতে এ খুবই সাধারণ ঘটনা, ফলে দৃশ্যটিকে মূল গল্পে আরোপিত বলে মনে হয় না। অথচ বহুবিধ অর্থের ব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ দৃশ্যটি। এই সৌন্দর্য-ব্যঞ্জনা কিন্তু শুধুমাত্র বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে তৈরি হয়নি, বরং নির্মাণ রীতিই অনেকাংশে একে দিয়েছে মহার্ঘ্যতা। পরিচালকের নাম ‘নুরি বিলজ সেলান’ (Nuri Bilge Ceylan) (১৯৫৯-)।
এর দু-তিন বছর পরের ‘কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব’-এ দেখানো হয় ‘নুরি বিলজ সেলান’-এর রেট্রোস্পেক্টিভ। একটা ছবিকে কারো প্রতি বা কোনো কিছুর প্রতি ডেডিকেট করার রীতি বহুকালের, কিন্তু একটা ডেডিকেশন কতটা যথার্থ হতে পারে তার উজ্জ্বল প্রমাণ সেলানের 'ক্লাউডস অফ মে' (১৯৯৯)। পূর্বে উল্লেখিত সেলানের না বলা কথার নান্দনিকতার সঙ্গে এখানে এসে মিশেছে চেখভীয় সৌন্দর্য! ছবিটি চেখভের প্রতিই নিবেদিত। কিন্তু এ ছবির পূর্বাভাষ আছে ১৯৯৭ সালে নির্মিত ‘দি স্মল টাউন’ (কাসাবা) ছবিটির মধ্যে। ব্যক্তিগত পরিসরে এযাবৎ দেখা ছবি গুলির মধ্যে ‘দি স্মল টাউন’ একটা অভিজ্ঞতা! 'ক্লাউডস অফ মে' ও ‘দি স্মল টাউন’ বিষয়বস্তুর দিক থেকে আলাদা কিন্তু মিলের জায়গাটা হল দুটি ছবির মধ্যেকার ইনডোর-আউটডোর, চরিত্রচিত্রণ ও নির্মাণকৌশল! গ্রাম-তুরস্ক দুটি ছবিরই ইনডোর-আউটডোর।‘দি স্মল টাউন’-এর ছোট্ট আলিকেই আমাদের মনে হয় 'ক্লাউডস অফ মে’-এর যুবক মুজাফফর। ‘দি স্মল টাউন’-এর দাদু-ঠাকুমাই যেন 'ক্লাউডস অফ মে’-এর বাবা-মা। ছবি দুটিতে দাদু-ঠাকুমা ও বাবা-মার চরিত্রে অভিনয় করেছেন সেলানের নিজের বাবা মা যথাক্রমে এমিন সেলান (১৯২২-২০১২) ও ফাতমা সেলান (১৯৩৪-)! মুজাফফরকে 'ক্লাউডস অফ মে’-তে দেখানো হয়েছে একজন চিত্রনির্মাতা হিসেবে। সব মিলিয়ে ‘দি স্মল টাউন’ ও 'ক্লাউডস অফ মে’ সেলানের আত্মজৈবনিক কাহিনীর সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ!
কিন্তু দুটি ছবিরই অন্যতম প্রধান দুটি চরিত্র হল গ্রাম-তুরস্কের ভূপ্রকৃতি এবং পৃথকভাবে প্রতিভাত বিভিন্ন ঋতু! সেলান তাঁর নির্মাণশৈলীর মধ্যে নিয়ে এসেছেন এমন এক স্বাভাবিকতা যাতে করে অন্যতম প্রধান এই চরিত্র দুটি তাদের রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে আমাদের পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ে ধরা দিয়েছে চূড়ান্ত বাস্তবরূপে! প্রথম ছবিটিতে ছোট্ট আলি ও তার দিদি আশিয়া (আমাদের অপু-দুর্গার কথা মনে পড়ে যায়) এবং পরের ছবিটিতে রূপকার্থে মুজাফফরের ক্যামেরা, অপরূপা প্রকৃতির দিকে চেয়ে আমাদের মতই বিহ্বল। ‘দি স্মল টাউন’-এর শুরুর দিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষের দৃশ্যাবলী আছে। প্রবল শীতে ঘুমন্ত একটি গ্রামের ভোরবেলার বিদ্যালয়ের অন্দরমহল। আশিয়া সেখানে পড়াশুনা করে। শ্রেণীকক্ষে যে মাস্টারমশাইকে আমরা দেখতে পাই এরকম সংবেদনশীল মুখ ও এত স্নেহ-প্রবণ চিত্ত খুব কম দেখা যায়। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা শ্রেণীকক্ষের জানালা দিয়ে বাইরে চলে যায়। ডিসেম্বর-জানুয়ারির তুষারে ঢাকা প্রায় জনমানব শূন্য গ্রাম-তুরস্ক, তুষারপাত জানালায় এসে ধাক্কা মারছে। বাইরের শৈত্যের দৃশ্যগুলিকে শ্রেণীকক্ষের অন্দরের দৃশ্যগুলির ফাঁকে ফাঁকে এমনভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন পরিচালক যে, শ্রেণীকক্ষের অন্দরের ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যেকার সম্পর্কের উষ্ণতা তাতে আরও বেশি করে আদ্র করেছে আমাদের হৃদয়। ‘দি স্মল টাউন’-এ এক বছরের ঋতুকে ধরা হয়েছে উল্টো দিক থেকে, অর্থাৎ শীতে শুরু করে শরতে শেষ হয়েছে। আলি ও আশিয়ার চোখ দিয়ে গ্রাম-তুরস্কের প্রেক্ষাপটে প্রশান্ত প্রকৃতির মধ্যে তিনটি প্রজন্মের সম্পর্কের উষ্ণতা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এর মেজাজ পুরাদস্তুর প্রাচীয়। আদব-কায়দা আচার-ব্যবহারে এশিয়ার দেশে দেশে কি আশ্চর্য সাযুজ্য!
'ক্লাউডস অফ মে’-তে মুজাফফর তার বাবা মাকে কেন্দ্রে রেখে যে চিত্রনাট্যটি চলচ্চিত্রায়িত করে সেটা যেন মনে হয় পূর্বের ছবি ‘দি স্মল টাউন’! আমরা দেখি কারা যেন রাতের অন্ধকারে মুজাফফরের বাবার মালিকানার অধীনে থাকা গাছগুলির গায়ে লাল দাগ দিয়ে গেছে। মুজাফফরের বাবা কর্তৃপক্ষের ডি-ফরেস্টেশানের সিধান্তের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে লিপ্ত! পরিবেশ সংরক্ষণ এ ছবির প্রধান বিষয় নয়, বরং আকাশে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা মে মাসের মেঘে-রোদে স্নাত এ ছবির শরীর। বাইজেনটাইন সভ্যতার উত্তরাধিকার বহনকারী প্রাচীন একটি জনজাতির আবহমান জীবনের ধীর ছন্দে সেলান বেঁধে নিয়েছেন এই ছবির চলন-বলন।
অন্যদিকে পূর্বে উল্লেখিত ‘ডিসট্যান্ট’ যেন 'ক্লাউডস অফ মে’-র উত্তরভাষ। ‘ডিসট্যান্ট’-এ মেহমুদ (মুজাফফর ওজদেমির (১৯৫৭-) অভিনীত, 'ক্লাউডস অফ মে’-র মুজাফফরের চরিত্রেও ইনিই অভিনয় করেছিলেন) একজন পুরাদস্তুর চিত্রগ্রাহক। শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন ও তাঁর শিল্প-বিশ্বাসের সঙ্গে এখানে অনুধাবন করে দেখা হয়েছে পরিবারের প্রতি ও বৃহৎ অর্থে সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার পরিসরটি। মোটামুটি ভাবে শীতের শুরু থেকে শীত চলে যাওয়া, এই কালখণ্ডে বিধৃত কাহিনী। এ ছবিতে প্রকৃতিকে পরিচালক ব্যবহার করেছেন অন্যভাবে, প্রকৃতি এখানে বিস্ময় উদ্দীপক যতটা তার চাইতে অনেক বেশি করে মানুষের মানসিক অবস্থার তার মেজাজের অনুসারী! ‘দি স্মল টাউন’ 'ক্লাউডস অফ মে’ হয়ে ‘ডিসট্যান্ট’ যেন একই সঙ্গে সেলানের সত্ত্বার কবোষ্ণ অনুপস্থিতি এবং আরেকভাবে ভূগোল ও প্রকৃতির ব্যবহারে তুরস্কের সমকালীন উপন্যাসিক ওরহান পামুকের (১৯৫২-) সমগোত্রীয়।
অভিনেতা হিসেবে সেলানের আবির্ভাব ছিল অবধারিত। নুরি সেলান ও তাঁর স্ত্রী এব্রু সেলান (১৯৭৬-), পরের ছবি ‘ক্লাইমেটস’ (২০০৬)-র প্রধান দুই অভিনেতা। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে মানব-মানবীর সম্পর্কের পরিসরটিকে পরিচালক এখানে দেখেছেন প্রেম-কাম-ঈর্ষার আলো-আধারিতে। অর্থাৎ, প্রকৃতি এখানে শুধুমাত্র মানুষের মেজাজের অনুসারী নয়, প্রকৃতি এখানে যেন মানুষের মেজাজের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকও! প্রেমের ও কামের, হৃদয় প্রেমের শীর্ষে ও উদ্ধত লিঙ্গের উদযাপনে, গ্রীষ্ম ও বর্ষা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এক গ্রীষ্মে ইসা-ব্যহেরের (নুরি সেলান-এব্রু সেলান) সম্পর্কের ইতি ঘটে, সেই বর্ষায় মিলন পিপাষু ব্যাঙের মত ইসা পুরানো প্রেমিকা সেরাপের কাছে যায়, আবার সেই শীতেই ইসা ব্যহেরকে পুনরায় পায় ও পরিশেষে হারায়! এক অগ্নিদগ্ধ গ্রীষ্মে আপাত সুখী জুটির ভ্রান্তি নিয়ে ব্যহেরের ক্রন্দনরত মুখের ক্লোজআপে ছবি শুরু হয়। সে বছরের শীতেই প্রবল তুষার পাতের মধ্যে ব্যহেরের ক্রন্দনরত মুখের ক্লোজআপ, ছবি শেষ হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি একটা বছরের শেষে ক্ষণভঙ্গুর সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেছে। শুরুর গ্রীষ্ম যদি সম্পর্কের উত্তাপের সামান্যতম ব্যঞ্জনাও বহন করে, শেষের শৈত্য সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া সম্পর্কের ইঙ্গিতে পরিপূর্ণ! সম্পর্কের আপাত আবেশের অন্তরালে এখানে রয়েছে সেক্সুয়াল-অ্যাংজাইটি ও সেক্সুয়াল-অবসেশানের চোরা স্রোত। বস্তুত এ ব্যাপারে তথাকথিত নিম্নশ্রেণী উচ্চশ্রেণীতে খুব একটা তফাত নেই। দক্ষিণ কোরিয়ার পরিচালক কিম কিদুকের(১৯৬০-২০২০) ছবিতে আমরা দেখেছি তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর মানুষের আদি-প্রবৃত্তির স্বরূপ। কিম ঐ দেশের ও ঐ শ্রেণীর মানুষের স্বভাব অনুযায়ী অনেক উচ্চকিত। কিন্তু সেলান তা নয়। উচ্চ-মধ্যবিত্ত কলেজের অধ্যাপক ইসা ধীরে সুস্থে কাম-চরিতার্থের তুঙ্গে উপনীত হয়। নির্দিষ্ট দূরত্বে সোফায় বসে থাকা ইসা ও সেরাপের বাদাম খাওয়ার দৃশ্যটির ভিতর দিয়ে ‘লালসা’ ও ‘প্রলোভন’ ব্যাপারটা সেক্সুয়াল-ফোরপ্লেয়ের ব্যঞ্জনা নিয়ে যে ভাবে চিত্রিত হয়েছে তা এককথায় অভিনব! নির্মাণকৌশলের মধ্যে এমন একটা হিমশীতল ধূর্ততা আছে যা ছবিটির মধ্যে এনে দিয়েছে রহস্য রোমাঞ্চের বাতাবরণ! চেখভীয় বীক্ষার মধ্যে নীরবে রহস্যের আবহ নিয়ে আসা, এ ছবির বৈশিষ্ট্য! অথচ প্রচলিত রহস্য রোমাঞ্চ-ধর্মী ছবির ধারে কাছে নেই ছবিটি! এই ক্যারিশমার পরবর্তী রূপ পরের বছর নির্মিত 'থ্রি মাংকিস' (২০০৮) ছবিটি।
অনিচ্ছাকৃত গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা ও তাকে ধামা চাপা দেওয়া নিয়ে 'থ্রি মাংকিস' –এর পটভূমি। দুর্ঘটনাটি ছবির শুরুতেই দেখানো হয়, অতঃপর ঘটনাটির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হয় অসম্পর্কিত কিছু চরিত্রকে, ছবি শেষ হয় একটি হত্যার পরে। হত্যাকারী কে তা আমাদের অনুমানের স্তরে থেকে যায়। রহস্য রোমাঞ্চ-ধর্মী ছবি, এ কথা মাথাতে আসবে না ছবিটি দেখার সময়। অথচ বিচ্ছিন্ন সূত্র গুলিকে দর্শক ছবি দেখতে দেখতে নিজের মাথায় জুড়ে নেবে ও নিতে নিতে রোমাঞ্চিত হবে! কিছু কিছু পরিচালক থাকেন যাদের ছবি দেখলে মনে হয় ‘আদ্যন্ত চলচ্চিত্র’! সাহিত্য বা অন্য কোনো শিল্প মাধ্যমে এই ব্যাপারটা যেন হতেই পারে না। সেলানের ছবিও তাই। ট্রু সিনেমা! কিন্তু পোয়েটিক নয়। আমাদের অভ্যাস আছে কোনো কিছু খুব ভাল লাগলেই বা তার মধ্যে একটা বহমানতা বা একটা ছন্দ থাকলেই তাকে পোয়েটিক বা কাব্যিক বলা। সেলানের ছবির বহমানতা বা তাল-লয়-ছন্দ ঈর্ষণীয়। কিন্তু তাকে পোয়েটিক বা কাব্যিক বলা যাবে না। একে বরং বলা উচিৎ দৃশ্য-শ্রাব্যের বা অডিও-ভিজুয়ালের চূড়ান্ত! এই বহমানতা এই ছন্দ সিনেমার নিজস্ব প্রকরণ, কবিতার নয়। সেলান যা করতে চেয়েছেন ও সার্থক ভাবে ছবির পর ছবিতে করে গেছেন তার চূড়ান্ত পরিণতি ২০১১-য় নির্মিত 'ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন আনাতলিয়া'।
২০১১-র উৎসবের কোনো এক সকালে নন্দন এক-এ 'ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন আনাতলিয়া'র প্রদর্শনীতে জানতে পারি নুরি বিলজ সেলান স্বয়ং এসেছেন! স্পষ্ট মনে আছে, দীর্ঘকায় ভদ্রলোক নন্দন এক-এর সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠে অপরিচিত কলকাতার দর্শকদের প্রতি যুগপৎ উদ্বেগ নিয়ে ও উপদেশ দেওয়ার অভিপ্রায় জানিয়েছিলেন - "দিস ফিল্ম ইস কোয়াইট লেন্দি এন্ড স্লো, নট লাইক ইউসুয়াল একশানপ্যাক থ্রিলার, সো ইউ পিপল মে বেকাম বোর! বাট আই থিংক ফিল্ম সুড বি লাইক দিস!"। শেষের বাক্যটিতে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়। আনাতলিয়া হল তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার সেই অঞ্চল যাকে আনাতলি স্টেপি বলা হয়, এখানে এসে এশিয়া ইউরোপের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ছবিটি দু ঘণ্টা সাইত্রিশ মিনিটের। শুরুতে তিনজন মানুষকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে দেখা যায়। টাইটেল ক্রেডিট শেষ হলে তাদের মধ্যে দু'জনকে আমরা দেখতে পাই পুলিশের হাতে বন্দী! ছবি আরেকটু এগোলে বোঝা যায় তৃতীয় ঐ আরেকজনের হত্যাকারী হিসেবে বাকি দুজনের দিকে রয়েছে সন্দেহের তীর! অর্থাৎ, এর পূর্ববর্তী ছবি ‘থ্রি মাংকিস’-এর মত এখানেও শুরুতে রয়েছে একটি মৃতদেহ। আগেরটি তে অনিচ্ছাকৃত হত্যা , এটি খুন! সারাদিনের কাজের শেষে রাত্রি নামার একটু আগে শুরু হয় পুলিশি তদারকির প্রক্রিয়াটি। প্রত্যাশা ছিল মৃতদেহটি খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না, হত্যাকারীরা একইরকম ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য জায়গাটি সহজে সনাক্ত করতে পারে না!
‘সিনেইউরোপা’ নামক ফিল্ম জার্নালে ২০১১ সালে দেওয়া সেলানের ইন্টারভিউ থেকে আমরা জানতে পারি এ ছবির কাহিনী কল্পনা-প্রসূত নয়। সেলানের সহকারী চিত্রনাট্যকারের (এরকান কেসাল, যিনি এই ছবিতে মেয়র মুখতারের চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন) জীবনে এই কাহিনীর অনুরূপ একটা ঘটনা ঘটেছিল। "তিনি একজন ডাক্তার এবং তুরস্কে লাইসেন্স পেতে হলে আপনাকে আনাতোলিয়ার প্রত্যন্ত স্থানে কমপক্ষে দুই বছর কাজ করতে হবে। চলচ্চিত্রে চিত্রিত শহরেই ইনি কাজ করেছিলেন এবং আমাদের গল্পের মতোই একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল: একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল এবং লাশের সন্ধানে তাঁরা সারা রাত ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।" – সেলান জানিয়েছেন। দুই অপরাধী, একজন পুলিশ অফিসার, একজন প্রসিকিউটর, একজন কমিশনার, একজন ডাক্তার, গাড়ির ড্রাইভার ও একটি লাশ এরাই ছবির মূল চরিত্র। সারারাত তারা মৃতদেহটিকে খুঁজে বেড়ায় আনাতলি স্টেপি জুড়ে। সেলান এই অনুসন্ধানকে সাজিয়েছেন নিগূঢ় রাজকীয়তায়। আনাতলি স্টেপির নৈসর্গিক ভূপ্রকৃতিকে সন্ধ্যার শেষ আলোয় এক-ঝলক দেখতে পাই আমরা, তারপর থেকে অন্ধকারে গাড়ির আলোয় দেখতে পাওয়া আনাতলিতে লেগে থাকে ঐ এক-ঝলক দেখতে পাওয়া মোহময়ী আনাতলির কল্পনা। এরপর আলো-অন্ধকারে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে চরিত্রগুলোর অন্তর্লোক। চরিত্রগুলির অবস্থান তুরস্কের বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীতে। পুলিশি তদারকির মত সাধারণ ঘটনাকে প্রেক্ষাপটে রেখে পরিচালক সূক্ষ্মভাবে ছুঁয়েছেন সে দেশের জটিল সামাজিক বিন্যাসকে। প্রাকৃতিক শব্দ, দূরে চলে যাওয়া ট্রেনের শব্দ, ঝড়ের শব্দ, আনাতলির ভূপ্রকৃতি ও ভূপ্রকৃতির শব্দকে সেলান ব্যবহার করেছেন চরম দক্ষতায়। ওয়াইল্ড এঙ্গেল ফটোগ্রাফির অভাবনীয় প্রয়োগে দেখতে পাই ছবিটিতে। সেলুলয়েডে নয় ডিজিটালে তোলা হয়েছে ছবিটি, চিত্রগ্রাহকের নাম গোখান তির্যাকি (১৯৭২-) । নাতিদীর্ঘ সংলাপ, অথচ গভীর অর্থবহ। গোটা পরিকল্পনাটি এত সনির্বন্ধ ও একাগ্র যে আমাদের স্থান-কাল চেতনা লুপ্ত হয়ে যায়, আমরা ঐ দলটির একজন হয়ে উঠি! ছবিটির প্রথম দেড় ঘণ্টা ডুবে আছে রাতের অন্ধকারে।
ভীষণ রকম পুরুষ-কেন্দ্রিক ছবি। অনুসন্ধানে অকৃতকার্য দলটি খিদেতে বিধ্বস্ত ক্লান্ত হয়ে মধ্যরাতে ঐ অঞ্চলের মেয়র ‘মুখতার’-এর বাড়িতে গিয়ে ওঠে। কথিত আছে, মধ্যরাতে মানুষের নৈতিকতা জেগে ওঠে, মধ্যরাতে মানুষ সৎ ভাবে নিজের মুখোমুখি হতে চায়। ল্যাম্পের আলোয় দেখতে পাওয়া মুখতারের অপরূপ সুন্দরী মেয়ে চেমিলির মুখ চরিত্রগুলির হ্রদয়কে সিক্ত করে। সুন্দরী আনাতলির ভূমি-কন্যা যেন এই মোহময়ী চেমিলি। আরেকভাবে বললে সুন্দরী আনাতলি ও মোহময়ী চেমিলি যেন একে অপরের প্রতীক! চেমিলি মোহময়ী, কিন্তু চেমিলি সহজ (সরল কথাটা এক্ষেত্রে যথোপযুক্ত হবে না)! চেমিলির সহজ মুখের দিকে তাকিয়ে প্রত্যেকের জটিল মনের সত্যিকারের অবস্থা ফুটে ওঠে তাদের মুখের অভিব্যক্তিতে! চেমিলির মুখাবয়ব সন্দেহভাজন কিনানের চোখে জল এনে দেয়। এই অশ্রুর মধ্যে মিশে আছে পরিত্রাণ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও একইসঙ্গে অপরাধ বোধ। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরা কিনান খুন হওয়া ইয়াসারের ভূতকে হঠাৎ দেখতে পায়, ইয়াসার বসে চা খাচ্ছে! সীমিত সংলাপ ব্যবহার করে শুধু মাত্র শব্দ ও দৃশ্য দিয়ে স্ট্রিম অফ কনসাসনেশ বা চেতনা প্রবাহের এত নিগূঢ় দৃশ্য-সংযোজনা খুবই বিরল। পরে এক জায়গায় দেখানো হয়েছে গ্রামবাসীরা ইয়াসারের প্রেতাত্মার ঘুরে বেড়ানোর কথা বলাবলি করছে। ছোট শহরগুলিতে বা গ্রামে কোনো খুনের ঘটনা ঘটলে এই ধরণের রহস্যময় আইডিয়া সেই অঞ্চলের মানুষের খুব প্রিয় ! কুহকী রহস্যময় পরিবেশের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেকটি চরিত্রের অসম্ভব বাস্তব-ধর্মী অভিনয়, পূর্ব পরিচিত 'না বলা কথা'-র নান্দনিকতা ও চেখভীয় সৌন্দর্যের নান্দনিকতার সঙ্গে এখানে যুক্ত হয়েছে লিরিসিজাম বা গীতিময়তা।
শেষ পর্যন্ত ভোরবেলা মৃতদেহটিকে খুঁজে পাওয়া যায়! অতঃপর বাকি এক ঘণ্টার রীল-টাইম দিনের আলোতে। মৃতদেহের পিছনের রহস্য উন্মোচনের বাতাবরণের সঙ্গে দিনের আলোর প্রতীকী সংযোগ আছে। তথাপি জীবনের রহস্য সম্বন্ধে সচেতন শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের মতই সেলান আমাদের সবটা জানান না। সামান্য কিছু দৃশ্য-শব্দগত ইঙ্গিত বা কিছু অসমাপ্ত সংলাপ, ব্যাস, বাকিটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে দর্শকের নিজস্ব বোধের উপর। যে যার মত করে বুঝে নেবে। হত্যার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে সেলানের বক্তব্য – “আমার কাছে এর অন্তত পাঁচটি কারণ আছে, কিন্তু আমি আপনাকে বলতে পারব না। আমি সতর্কতার সঙ্গে এই পাঁচটি কারণ সেখানে[সিনেমাটিতে] রেখেছি, তবে সেগুলি অনুধাবন করতে গেলে আপনাকে আপনার নিজের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করতে হবে। এভাবেই জীবন চলে, আমরা তথ্য পাই, আমরা বিশদ সংগ্রহ করি এবং সঠিক উপসংহার অনুমান করার জন্য আমাদের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করতে হয়“ (সিনেইউরোপা, ২০১১)। ছবির শেষ দশ পনের মিনিটে অটোপসি বা ময়নাতদন্তের দৃশ্য আছে। দেহটাকে মাঝখান দিয়ে উলম্ব ভাবে চিড়ে ফেলে অঙ্গব্যবচ্ছেদ করে মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করা। সার্জারির টেবিলের উপর শায়িত দেহটিকে চিড়ে ফেলা হয়েছে আমরা বুঝতে পারি, প্রত্যেকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আলাদা করে দেখা হচ্ছে তাও বুঝতে পারি, কিন্তু এগুলি সবই ঘটছে ক্যামেরা ফ্রেমের নীচে! সরাসরি কাটা-ছেঁড়া না দেখিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে শব-ব্যবচ্ছেদকারীর কথোপকথন ও তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে গোটা ব্যাপারটি অনুমিত হতে থাকে আমাদের কাছে! খুন হওয়া লাশ বা অপঘাতে মৃত মানুষের দেহের ব্যবচ্ছিষ্ট বিকৃত চেহারা সরাসরি দেখানো মৃত মানুষটির প্রতি অসম্মান সূচক। কিন্তু শুধু তাই নয়। না দেখতে পাওয়া লাশ ও অনুমান করে নেওয়া সম্ভাব্য ঘটনা, একসাথে যেন গোটা ছবিটির বিষয়-নির্মাণশৈলীর মোক্ষম উপসংহারে এসে স্থিত হয়! মনে হয় ঐ শবদেহের মতই সিনেমার বাকি চরিত্রদের এবং আমাদের সবার জীবন! জীবনের কতটুকু প্রকৃত অর্থবহ হয়? জীবন বিশৃঙ্খল, কিন্তু এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই থাকে একটা শৃঙ্খলা, এটাই প্রকৃতির ও প্রকৃতির সন্তান হিসেবে মানুষের জীবনের সারৎসার। তুরস্কের মানুষের গল্প বলতে বলতে জীবন সম্পর্কে এই সাধারণ ধারণায় এসে উপনীত হন পরিচালক। প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি ‘দি স্মল টাউন’ থেকে তের বছর পরের 'ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন আনাতলিয়া', মোক্ষম কর্ডটিকে ছুঁয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে সেলানের সিম্ফনির।
আসলে স্মল টাউন থেকে আনাতলিয়া একটা অভিযাত্রা। আনাতলিয়ার সিদ্ধিতে ধীরে ধীরে একজনকে উপনীত হতে হয়। পরের দুটি ছবি ‘উইন্টার স্লিপ’ (২০১৪) ও ‘দি ওইয়াল্ড পিয়ার ট্রি’ (২০১৮) বিষয়ের দিক থেকে স্বতন্ত্র কিন্তু বিস্ময়কর ভাবে অতিরিক্ত সংলাপ নির্ভর! দুটি ছবিতেই চরিত্রগুলি অনর্গল কথা বলে চলেছে। নির্মাণকৌশল যেটুকু চোখে পড়ে তাও আনাতলিয়ার খাট অনুকরণ! প্রকৃতপ্রস্তাবে চলচ্চিত্র মূলগত ভাবে দৃশ্য-শ্রাব্যের মাধ্যম, সংলাপের ভূমিকা এখানে নূন্যতম প্রয়োজনীয় পরিপূরকের বেশি কিছু নয়। আধুনিক চলচ্চিত্রে যাদের ছবি দেখে এটা সবথেকে বেশি টের পাওয়া যায় সেলান তাদের মধ্যে অন্যতম। তাই আশা রাখি সংলাপের বাহুল্য থেকে বেড়িয়ে দৃশ্য-শ্রাব্যের নতুন কোনো নির্মিতির পথে পুনরায় তিনি হাঁটবেন। কারণ এর আগে এ কাজে বহুবার তিনি সফল হয়েছেন। এই আশায় তাঁর নতুন ছবির খবর রাখি।