(১) ইনা-মিনা-ডিকা
গুরুরা বললেন, “লেখো!”
ঠিক অতটা বকা দিয়ে কেউ বলেনি যদিও। অনেকটা, “লিখছো না কেন?”-মার্কা নরম করে বলা। ব্যস্, হিট খেয়ে গেলাম।
--
না। ‘বার’ খাইনি। কারণ আছে। বলছি।
কলেজের প্রথম বছর। মফঃস্বল থেকে আসা কচি মাথা। মুখের ভাষা প্রায় লিখিতর মতোই প্রমিত। এমতাবস্থায় একদিন সিনিয়রের মুখে শুনলাম এক অনন্য শব্দবন্ধ, “আর বার খাওয়াস না তো!”
আমার মাটিতে-গড়াগড়ি-যাওয়া-চোয়ালটাকে আবার স্ব-স্থানে বসিয়ে, অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা শেষমেশ জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “বার খাওয়া মানে কি?”
হাতে মোবাইল থাকলে, গুগল নামে কিছু আছে আর তাতে বাংলায় প্রশ্ন করা যায় – জানলে, কদাপি এ ধৃষ্টতা করতাম না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, তখনও সেই যুগ চলছে – যখন ঠেকায় পড়লে অ্যান্টেনা-শোভিত যন্ত্রগুলি আত্মরক্ষার কাজে ব্যবহার করা যেত, আর ‘ইনকামিং চার্জ’ বলে একটি জিনিসের অস্তিত্ব ছিল। মধ্যবিত্ত ঘরের ছাত্র কেন, চাকুরেরাও তখনও মোবাইল হাতে নিয়ে দেখেনি। অতএব – মাথায় প্রশ্ন জাগলে, মানুষকে ধরেই জিজ্ঞেস করতে হত।
গোলবাড়ির কষা মাংসের কালো তেলে স্নান করতে করতে যখন সঙ্গের তেঁতুলের টকটা মুখে পড়ে, সেই বিরল অনুভূতির ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন[1]। খুব কাছাকাছি একখানা বিস্ময়-মিশ্রিত পরিতৃপ্তির অনুভূতি সম্ভবত তৈরী হয়, যখন নবীন অনুজপ্রতিম প্রশ্নের মাধ্যমে নিজেকে অর্বাচীন প্রমাণ করে। সিলেবাসের বাইরের জ্ঞান – যা উক্ত পরিস্থিতিতে প্রায় সদগুরু-সুলভ অর্ধপাচিত - প্রায় সদগুরু-সুলভ গাম্ভীর্যের সাথেই হাঁ-মুখ জুনিয়রের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার আনন্দ যে পায়নি, তাকে সে জিনিসের ‘kick’-এর তীব্রতা বোঝানো আমার কম্মো নয়।
মোদ্দা কথা, উদ্দিষ্ট দাদাটি, যাকে এখন থেকে আমরা নাহয় ‘র’-দাদাই বলবো’খন (pun intended[2]), আমায় পাকড়ে বসে – নাহ্, উত্তর মোটেই দিলেন না। উলটে অজস্র প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে জেনে নিলেন আমার extra-curricular শিক্ষার সীমাবদ্ধতা। বেশি ব্যাখ্যানে যাব না – অন্তিমে সকলেরই সেই এক ব্রহ্মজ্ঞানই লাভ হয় কিনা – শিক্ষা শেষ হতে বেশ রাত হল। সে রাতে আমার বিশেষ ঘুম হয়নি, নানাবিধ existential প্রশ্নে। যেমন,
“গ্যাস খেলে না হয় লোকে ফোলে, আর গ্যাস অন্তঃসারশুন্য – তাই গ্যাস খাওয়া বোঝা গেল, কিন্তু লোকে ঠিক ‘বার খায়’ কেন?”,
“বিরক্তি-অনুভূতিটার সাথে, অস্থান-কুস্থানের কেশরাশির জ্বলে যাওয়ার সম্পর্কটা ঠিক কি?”
অথবা,
“বাঞ্ছারাম কেন দাঁত/আতা-ক্যালানে?”, “গামছাওয়ালা কেন সবজান্তা?” – ইত্যাদি।
“বাঙালি সবকিছু খায় কেন”-ধর্মী আপাত-গভীর, আসলে ফোকলা - সব প্রশ্নও জেগেছিল, যা নিয়ে রীতিমত সমাজতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, identity-politics – এ সবের ত্যানা-প্যাঁচানো যায়, কিন্তু সে নিয়ে মাথা ঘামানোর আগেই সম্ভবত নাক ডাকতে শুরু করি।
এতসব গুরু-গম্ভীর প্রশ্নের কিছু জোড়াতালি উত্তর আমায় দেওয়া হয়েছিল - তাতে আজও ঠিক বিশ্বাস হয়না। অতএব, এই এত বছর পরেও, যখন ‘বার খেয়ে বাপি’-শব্দবন্ধ শুনে, মুচকি হাসির বদলে, নির্লোভ সাহসিকতার প্রতি আমাদের গোষ্ঠীগত ‘আতাক্যালানে’ প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে ‘%# জ্বলে’, তখনও -
বার, আমি বাপু, খাইনে।
‘হিট’ – অন্য প্রস্তাবে – খেয়েই থাকি। অহরহ। মূল পার্থক্য, আমার মনে হয়েছে - ‘হিট’ জিনিসটা নিজে নিজে খাওয়া যায়। অপরপক্ষে, বন্ধুমহলে ‘অটো-বার’ বলে একটি জিনিসের প্রচলন আছে ঠিকই, কিন্তু ‘হিট’ বলা অপেক্ষাকৃত সহজ নয়?
--
মেলা বাজে বকে ফেললাম। সে সব থাক। আসল কথা হল – হিট খেয়ে গেলাম। ভীষণ বক্তিমেবাজ হওয়ার কারণে অধুনা শঙ্খবাবুর শ্লেষ শিরোধার্য করে চলি। কিন্তু লিখতে তো তিনি বারণ করেননি, মুজতবা করেছিলেন। তিনি আবার নিজেই নিজের কথা শুনতেন না – অতএব...
লিখতে বসে পড়লাম। কি লিখি? এমন কিছু, যা গুরুতে কেউ কখনও লেখেনি? কি সেই অসূর্যম্পশ্য, অচ্ছুৎ বিষয় – যা একাদিক্রমে গুরু ও চণ্ডাল দ্বারা অবহেলিত/উপেক্ষিত? সে’ গুরুতর বিষয় আমার গুরুপাক হয়ে যাবে না তো?
সবচেয়ে বড় কথা – সে নিয়ে আমিই ছাই কি জানবো, যে লেখনীর জয়ধ্বজা ওড়াতে হবে? আমি জেতে চাঁড়াল, শুনতে-ভাবতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। লিখবটা কি?
অনেক ভেবে মাথায় এল – ‘ফ্যান্টাসি’। ওসব ‘কুয়াশানগরীর উপাখ্যান’-মার্কা কবিতা-কবিতা গপ্পো নয় (লেখার এমন বেগ – কি না কি বলে চলেছি), গভীর Genre-fiction, বিশেষ করে – হাই-ফ্যান্টাসি।
এই দেখুন, বলা হয়নি, ব্যাপারটা কি। আপনি যদি কেবলমাত্র ওই চন্দ্রিলবাবুর ‘কিছু Dystopia’ দেখে সায়েন্স-ফিকশন সম্পর্কে, আর গেম অব থ্রোন্স/লর্ড অব দ্য রিংস দেখে ফ্যান্টাসি সম্পর্কে ধারণা তৈরী করে থাকেন, তা হ’লে হবে না – ঐসব রোগের উপসর্গ মাত্র। এই ছড়ানো জঁরাগুলির (হ্যাঁ, অনেক ঠেকে শিখেছি বস্; Genre-কে বাংলায় জঁরা-ই লিখব – তাতে আমায় যতই জরাগ্রস্ত মনে হোক না কেন) বিস্তৃতি বহুদূর। সেই বিখ্যাত কুম্ভকার-সন্তান, যিনি পেশাদার জাদুকর হওয়ার চেষ্টায় বংশের মুখে চুন-কালি লেপেছিলেন, আর যাঁর কৈশোর-অ্যাডভেঞ্চারগুলি লিখে ফেলে ওই বয়স্কা, আপাত-trans-phobic মহিলা এখন টাকার স্তূপের ওপর ‘রোলিং’, তাঁর গপ্পোগুলিও পড়ে এর আওতায়। আরও কত কি-ই না আছে এই জঁরায়! এই উইকি-পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই বুঝবেন কি বলতে চাইছি। এরই একটি sub-genre হল হাই-ফ্যান্টাসি। ভেবেচিন্তে, আর গুরুর লেখাপত্র-আলোচনার গতিপ্রকৃতির সঙ্গে সামান্য পরিচিত হওয়ায়, এইটেই সেই আইসোলেশনে থাকা (অতএব নিরাপদ) বিষয় মনে হল।
ভাবলেই তো হল না, যাচিয়েও দেখতে হয়। ‘ফ্যান্টাসি’ লিখে গুরু-সন্ধান করলুম। একটি দু’টি নয়, ছ’পাতা-জোড়া লেখার লিস্টি চলে এল টপ করে। বেশ, পাশের ট্যাবে fantasy লিখে একই কাজের পুনরাবৃত্তি। এবার কোনও লেখা এল না। খোঁজ শুরু হল – আমার মনের কথাটি কে আগে গেছেন বলে?
সেই গুরু-এষণার ফল? যখন আমি প্রায় নিশ্চিত, যে এক্ষুনি খুলে ফেলব বঙ্গ-পর্যালোচনা-সাহিত্যের এক বন্ধ দরজা, তখনই, বেবাক বেরিয়ে এল – রৌহিন-নাম্নী এক হরিদাস পালের ব্লগের এই লেখাটি। ব্যস, হয়ে গেল।
কোথায় রইল আর সেই বিষয়-কৌমার্য? কোথায় সেই পাণ্ডব-বর্জিত, অনাবিষ্কৃত, পেলব বিষয়-খণ্ডে পতাকা উত্তোলনের উত্তেজনা? যে বিষয়ই খুঁজে বের করি, শঙ্খবাবু হয়তো আমার অবিমৃশ্যকারী উচ্ছ্বাসের উদ্দেশে কড়া অঙ্গুলিনির্দেশ করবেন – “আছে, এসবও আছে।”
কবিদের নিয়ে আর পারা গেল না।
কিন্তু না, এখনও আছে সামান্য আশার আলো। প্রথমত, উক্ত লেখাটি যে গল্প-গুলিকে নিয়ে, তাদের লেখক আমাদের বয়সী হলেও, প্রথম গল্পটি লেখার সময় তার বয়স ছিল নেহাত পনেরো (খুব ইম্প্রেশনেবল বয়স) – ফলতঃ, লেখায় ‘একটু পুরনো’ লর্ড অফ দ্য রিংস-এর ছাপ স্পষ্ট। অতএব, আমি একে ‘কন্টেম্পোরারি’ আখ্যা দিতে নারাজ। তার ওপর, গপ্পের বিষয়বস্তু অনুসারে, এ লেখা অনেক বেশি ‘ইয়ং অ্যাডাল্ট (YA)’-ধাঁচের (রৌহিনের অন্য লেখা থেকে জানলাম, ভদ্রলোক আমার থেকে দশ-বারো বছরের বড় – ওঁর পড়ার ব্যাপ্তি নমস্য!)। আমি কথা বলতে চাই বড়দের উদ্দেশ্যে লেখা গল্প নিয়ে। আরও আছে। ভেবে দেখুন তো একবার - এই বিরাট গুরু-তরঙ্গে – মাত্র একটা লেখা? রৌহিন শুরু করেছিলেন ঠিকই – কিন্তু সে তো সেই ২০১৮ সালে! নাহ্ - গুরুর ফ্যান্টাসি-ল্যান্ডে উনি আমুন্ডসেন হতেই পারেন, আমার রবার্ট স্কট হওয়া কেউ ঠেকাতে পারছে না।
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল। তবু কিছু ছুটকো চিন্তা থেকেই যায়। নিজেকে শুধু ফ্যান্টাসিল্যান্ডে আবদ্ধ রাখি কেন? লেখাকে রিভিউ-ই হতে হবে, সেরকম মাথার দিব্যিই বা কে দিয়েছে? অতএব, অন্তিম সিদ্ধান্ত – এই লেখার কিস্তিগুলি হবে আমার গপ্পো পড়ার গপ্পো - ২০১০–পরবর্তী, সাথে সেই পড়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্যান্য গল্পগাছা।
২০১০-এর আগে কেন নয়? ভালো প্রশ্ন। ওই যে লেখা-সিরিজটির গল্প রৌহিন করেছেন বললাম, তার প্রথম দু’টি খণ্ড আমি পড়ি কলেজে পড়াকালীন। পনেরো বছরের ছোকরার এই কীর্তিকলাপ এতটাই উত্তেজিত করে তোলে, যে ঠিকই করে ফেলি – বঙ্গভাষায় হাই-ফ্যান্টাসি লেখাই হবে আমার জীবনের উদ্দেশ্য।
তারপর অনেক সময় পেরিয়েছে, দক্ষিণ কলকাতার অনেকগুলো লেক মাটি-চাপা পড়েছে। বহুদিন ঐ ধরণের লেখা পড়া হয়নি। ২০১৩ থেকে আবার অল্প অল্প পড়ার সুযোগ পাই। কিন্তু এবার উক্ত সিরিজের পরের দু’খণ্ড নিয়ে বসে দেখি – আর তো পড়তে ভালো লাগে না! ইতিমধ্যে স্বাদ বদলেছে। শুঁটকি ভালো লেগেছে, ভুত-জোলোকিয়াও। প্রাণ-প্রিয় গরম দুধ আর পেটে সহ্য হয় না। এমন সব বৈপরীত্যের প্রভাব বই-রুচির ওপরও পড়েছে বৈকি!
সেই ‘পরিবর্তিত’ স্বাদের গল্পই হবে তবে। ২০১০-এর পরের।
কি করে আবার এই জঁরা পড়া শুরু করলাম, আর কি করে এত ভালো লেগে গেল, যে আমার নিশ্চিন্ত অবসর হোক বা বাস্তবের হাত থেকে পালানোর অজুহাত – সবেতেই আসে ফ্যান্টাসি বা সায়েন্স ফিকশন – এ নিয়েও গল্প হবে’খন এই লেখাগুলোয়।
গৌরচন্দ্রের গুণগান শেষ। পরের লেখা থেকে কাজের কথা হবে – প্রমিস।
[1] সদ্য-অতিবাহিত করোনাকালে দক্ষিণ-কলকাতায় এর একটি তুল্য-দোকান পেয়েছি – ‘কষে কষা’। আমার সাথে কোন যোগাযোগ নেই। কখনও - এই লেখা পড়ার পর - সেথায় গেলে আমার হয়ে একটু কমিশন চাইবেন তো --
[2] এই কথাটার বাংলা জানা আছে?