পরনে সস্তা ছাপা শাড়ি৷ পায়ে ক্ষতবিক্ষত প্লাস্টিকের চটি৷ চটির সঙ্গে পায়ের সম্পর্ক টিকে একটা সেপ্টিপিনের সুবাদে৷ হাতে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া নাইলনের ব্যাগ৷ তাতে অ্যালুমিনিয়মের টিফিন বাক্সটা দুলছে৷
তিনি ছুটছেন৷ ৮-১০-এর ব্যারাকপুর লোকালটা ধরতেই হবে৷ ট্রেন সময়ে এলে বিপদ, না এলে আরও বিপদ৷ দ্বিতীয়টাই যেন দস্তুর৷ মাসের মধ্যে এক-দু’দিন সময়ে আসে৷ অফিস যাত্রীরা সেই মতো ধীরে-সুস্থে, পান চিবোতে চিবোতে খোস মেজাজে যান৷ তাঁরা লেট ট্রেনেরই ভক্ত বলা চলে৷ তারাপদ রায়-মার্কা গল্প বলে মনে হতে পারে, কিন্তু ব্যান্ডেল লাইনের কোনও স্টেশন থেকে সত্যি সত্যিই একদিন একটা ট্রেন সময়ে চলে গেল হাওড়া। রোজ রোজ লেট ট্রেন ধরতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা যাত্রীরা তা মানবেন কেন? স্টেশন ম্যানেজারকে এই মারি কি সেই মারি অবস্থা।
ট্রেন লেট মানে স্টেশনেই এক দফা তাসের আড্ডা৷ তারপর ট্রেনের কামরা তো আছেই৷ দশটার ট্রেন এগারোটাতে এলেও কুছ পরোয়া নেই৷ রেলের লেট-স্লিপ জমা দিলে হাজিরা খাতায় লালকালির দাগ পড়ে না৷
কিন্তু তিনি এবং আরও অনেকে রোজ রোজ ছুটছেন তো ছুটছেন৷ চেনা দৃশ্য। কোনও দিন পরিচিত কেউ হয়তো বলেছেন, ‘অমন ছুটছো কেন? ঘরের বউ৷ একটু আস্তে-ধীরে চলো৷ আরও একটু আগে বেরতে পারো না?’ কেউ গলা নামিয়ে টিপ্পনি করেছেন, ‘রাজনন্দিনী চললেন৷ কোথায় যায় জানি না মনে করে৷ সব জানি৷ ভদ্রঘরের বউ কখনও……৷’
সব কথাই তাঁর কানে যায়৷ রা কাড়েন না৷ ৮-১০-এর ব্যারাকপুর লোকাল ধরতেই হবে যে। মিস করার উপায় নেই৷ সে ট্রেন সময়ে না এলে, লেটে আসা আগের কোনও ট্রেন লটারি জেতার মতো জুটে যেতে পারে৷ বেশিরভাগ দিনই ভাগ্য সহায়৷ লটারি জেতেন তিনি৷ কোনও কোনও দিন চাকা উল্টো দিকে ঘোরে৷ লেট ট্রেনও উধাও৷ মাইকে ঘোষণা হয়, ‘অনিবার্য কারণবশত……৷’ রেলের টাইম-টেবিল যেন মূর্তিমান রসিকতা৷ প্রায়ই ক্ষুব্ধ, মারমুখী যাত্রীর দল স্টেশন মাস্টারকে ঘিরে ধরে বলেন, ‘একটা ট্রেনও সময়ে আসে না৷ টাইম টেবিলটা তবে টাঙিয়ে রেখেছেন কেন?’ ক্ষিপ্ত যাত্রীদের ভিড় থেকেই ভেসে আসে টিপ্পনী, ‘ট্রেন কতটা লেট বুঝবেন কী করে, টাইম-টেবিল না থাকলে?’ হাসির রোল ওঠে। ফুরিয়েও ফোরায় না নিত্যযাত্রীর প্রাণশক্তি।
এভাবেই চলতে থাকে৷ প্রায়ই যাত্রীর ভিড়ে ঢাকা পড়ে যায় গোটা প্ল্যাটফর্ম৷ যাদের উপায় আছে, বাসে উঠে পড়েন৷ সেখানেও বাদুড়-ঝোলা অবস্থা৷ অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত হলে একটা সময় ফাঁকা হতে থাকে প্ল্যাটফর্ম৷ থেকে যান কয়েকজন৷ ট্রেনের জন্য অনন্ত অপেক্ষা৷ ওদিকে, ছেঁড়া চটি ঘষটাতে ঘষটাতে তিনি প্ল্যাটফর্মের এধার-ওধার করেন৷ ছায়া খোঁজেন। চোখ লেগে আসে৷ লম্বা প্ল্যাটফর্মে দু’চারটে কংক্রিটের বেঞ্চ৷ সেগুলি ঘিরে ভিখারিদের সংসার৷ বাকি অংশে চা-পান-বিড়ির দোকান, বইয়ের স্টল, টুকিটাকি আরও নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে কেউ কেউ৷ কলম থেকে মলম - কী নেই!
মাইকে ঘোষণা হয়, অবরোধ উঠে গিয়েছে৷ পরবর্তী ডাউন ট্রেন ইছাপুর স্টেশন ছাড়ছে৷ ওই পথটুকু ঘড়ি ধরে আসলে, সোদপুরে সেই ট্রেনের পৌঁছতে আরও মিনিট কুড়ি৷ সময় যত গড়ায়, চোখের সামনে ভাসতে থাকে ট্রেনের চেনা ছবিটা — মালপত্রে উপচে পড়া ট্রাক, লরির মত - ট্রেনের ইঞ্জিন, ড্রাইভার-গার্ডের কামরার বাইরে, দরজার পাদানিতে, ভিড়ের গায়ে ভিড় লেপ্টে৷ মাঝে মধ্যে কানে আসে, সেই ট্রেন থেকেই আগে কোথাও রেলের পোস্টে ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছেন কোনও যাত্রী৷ ট্রেনের ছাদও বাদ যায় না। সেখান থেকে মাঝেমধ্যেই ওভারহেড তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে টপাটপ মানুষ মরে। এই আছি, এই নেই - কী বিচিত্র জীবন।
ইছাপুর ছেড়ে আসা ট্রেন সোদপুরে থামতে ধুন্ধুমার বাঁধল৷ সব ট্রেনেরই ছবিটা এক৷ ভিড় ঠেলে নামতে পারেন না বেশিরভাগেরাই৷ অসীম শক্তি ফলিয়ে জনা দুয়েক নামতেই উঠে পড়লেন দশ-বিশজন৷ মানুষগুলি সব মুহূর্তে পশু বনে যায়৷ ছেঁড়া চটি আর টিফিনের ব্যাগ সামলে তিনিও লড়াই করেন৷ এ কামরা থেকে সে কামরা ছুটে চলেন৷ লেডিস, জেনারেল, ভেন্ডার, কোনও কামরায় পা রাখার সামান্য জায়গাটুকু নেই৷ কিন্তু এই ট্রেনে যে তাঁকে উঠতেই হবে৷
সেদিন কয়েক সেকেন্ড বেশি দাঁড়িয়ে আগরপাড়ার উদ্দেশে রওনা দিল নৈহাটি লোকাল৷ ছেঁড়া চটি ঘষটাতে ঘষটাতে তিনি তখনও খুঁজে চলেছেন, কোন কামরায় একটা পা গলিয়ে দিয়ে ঝুলে পড়া যায়৷ ট্রেনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটেন৷ একের পর এক কামরা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যায়। উঠতে না পারা যাত্রীদের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে, গালমন্দ শুনতে শুনতে তিনি ছোটেন৷ ছুটতে ছুটতে প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে পৌঁছে অন্তিম কামরায় উঠে পড়ার শেষ চেষ্টাও হাতছাড়া হয় চটির সেফটিপিন খুলে যেতে৷ তাল রাখতে না পেরে, পড়ে যান প্ল্যাটফর্মে৷ ট্রেন সোদপুর ছেড়ে যায়।
এমন ঘটনা তো কতই ঘটে৷ কার খবর কে রাখে? পরবর্তী ট্রেনের ঘোষণা হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে৷ বাকিরা প্রস্তুত হচ্ছে আর এক দফা লড়াইয়ের জন্য৷ এক-দু’জন হকার আর প্ল্যাটফর্মে সংসার পাতা ভিখিরিরা এগিয়ে আসেন৷ এমন ঘটনা-দুর্ঘটনায় ওঁরাই ইমার্জেন্সি ফোর্স৷ চার নম্বর লাইন দিয়ে বেশিরভাগ থ্রু ট্রেন ছোটে৷ লোকাল থামে কদাচিত্৷ ফাঁকাই থাকে প্ল্যাটফর্ম৷ সকাল-বিকাল কিছু মানুষ হন হন করে হেঁটে ঘাম ঝরিয়ে যায়৷ ছেলে ছোকরারা উদ্দাম গতিতে সাইকেল রেস খেলে৷ বিকালে বয়স্করা এসে বসেন৷ আলো কমলে তাঁরা চলে যান৷ প্ল্যাটফর্মের বেশিরভাগ বাতিই অচল৷ আধো-অন্ধকারে মদ-গাঁজা-জুয়ার আসর বসে৷ মনের কথা, দেহের ভাষা বিনিময় করতে এসে বসে নানা বয়সের নারী-পুরুষ৷
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে কংক্রিটের বেঞ্চে তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হয়৷ চোখ-মুখে জল ছেটালে হুঁস ফেরে৷ ট্রেনের ঘোষণা শুনে উঠে বসেন৷ টিফিনের ব্যাগ, চটির সন্ধান করেন৷ সে সব উধাও৷ ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে টের পেতে উঠে দাঁড়ান৷ বাড়ির ঠিকানা জানতে চান বাকিরা৷ বাড়ি ফিরে যেতে বলেন৷ তিনি যেন বোবা-কালা৷ অনেকে সেটাই ধরে নিলেন। খালি পায়ে হন হন করে লাইন পেরিয়ে দু-নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুট লাগালেন৷ সেখানেই আসে শিয়ালদাগামী বেশিরভাগ ট্রেন। প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ান, ফার্স্ট কামরা যেখানে এসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দাঁড়ায়৷ অবিকল এক ছবি পরের ট্রেনের৷ মানুষে ঢাকা পড়ে গোটা ট্রেন৷ ড্রাইভারের কামরার সামনের তারজালি ধরে ঝুলে জনা কয়েক৷ কালক্ষেপ না করে এক কোনায় তাতে ঝুলে পড়েন তিনিও৷ বাকিরা তাতে বিরক্ত, বিস্মিতও বটে৷ কোনও মহিলাকে ওখানে দাঁড়াতে কেউ কখনও দেখেনি৷ দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে ড্রাইভার ধমকে ওঠেন৷ তুই তোকারি করে যা নয় তাই বলেন৷ সঙ্গত করেন ট্রেনে উঠতে না পারা, লড়াইয়ে ব্যর্থ পুরুষ যাত্রীরা৷ ভিড় থেকে মন্তব্য ভেসে আসে, ‘বাবু অপেক্ষা করছে যে’, ‘সোনাগাছিতে ঘর ভাড়া নেওয়া আছে,’ হাড়কাটা গলির মাসি’ ইত্যাদি ইত্যাদি৷ তাঁর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই৷ এসব কথার অর্থ তিনি বোঝেন না৷ সোনাগাছি, হাঁড়কাটা গলি তিনি চেনেন না৷ কী আছে সেখানে জানেন না৷ তিনি জানেন, উল্টোডাঙায় তাঁকে পৌঁছতেই হবে৷
বেলঘরিয়া থেকে ট্রেন দমদম অভিমুখে রওনা হয়ে বরানগরগামী রেল ব্রিজের কাছে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে গেল৷ দেখা যায় না, টের পাওয়া যায়, ডান দিকে দক্ষিণেশ্বর মন্দির৷ ভিড়ে ঠাসা ট্রেনেও মা কালীর মহিমা মালুম হয়৷ ঝিমিয়ে-ঘুমিয়ে থাকা, ভিড়ে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা যাত্রীর কপালে হাত ওঠে। ওখানে ট্রেন থামলে নিত্যযাত্রীদের বায়োলজিক্যাল ক্লক যেন অ্যালার্ম দেয়৷ মজা করতে কেউ গোটা কামরা শুনিয়ে বলেন, ‘মা হয় দেখা দে, নয় টাইমলি পৌঁছে দে।’
রেল ব্রিজের ধারে ঘেঁষের স্তূপে কয়লা খোঁজে অসংখ্য মানুষ৷ মহিলা, শিশু-কিশোর৷ পুলিশের ভয়ে পুরুষেরা আসে না। তারা দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে - কখন একটা বস্তা ভর্তি হয়। ছুটে এসে মাথায়, পিঠে চাপিয়ে ছুট লাগায় তারা। প্রায়ই খবর আসে, ঘেঁষে চাপা পড়ে প্রাণ গিয়েছে একজন-দু’জন-দশজনের৷ ঘেঁষের সেই স্তূপের উপর দিয়েই এখন চলে গিয়েছে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে৷ সেটা তৈরির সময় আমি পুরোদস্তুর সাংবাদিক। ঘেঁষ চাপা পড়ে মৃত্যুর খবর কভার করতে গিয়েছি বেশ কয়েকবার। মৃতরা অধিকাংশই নাম-গোত্রহীন। পরে জেনেছি, মরে গেলে অনেকের পরিবারই পরিচয় পাঁচকান করত না পুলিশের ভয়ে। কয়লা-চোর বলে যে কোনওদিন বাকিদের তুলে নিয়ে যেতে পারে।
অমর চৌধুরী, আরএসপির নেতা ও বিধায়ক, আমার পাশের পাড়ার বাসিন্দা। পূর্তমন্ত্রী হওয়ার পর একদিন কথায় কথায় বললাম, বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের ধারে একটা স্মৃতি স্তম্ভ করা উচিত। অত মানুষের মর্মান্তিক মৃত্য। অবাক হলেন। সত্তরের দশক, সিঁথি, বরানগর, বেলঘরিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে। বরানগর গণহত্যার এ বছরই পঞ্চাশতম বার্ষিকী। অমরবাবুর বিধানসভা বরানগর। গোড়ায় তাই ভাবলেন বরানগর গণহত্যা বা অতীতের রাজনৈতিক কারণে নিহতদের স্মরণে কিছু করার কথা বলছি। ভুল ভাঙলে বললেন, ‘বলেন কী, পুলিশের খাতায় ওরা কয়লা চোর।’ বললাম, সে তো নিছকই পেটের দায়ে। গরিব মানুষ। অভাবে স্বভাব নষ্ট। এমন কত মানুষের ডেড বডি চাপা পড়ে থাকছে রাস্তাটার নিচে। অমরবাবু কথাটা মানলেন। মন্ত্রী হিসাবে অসহায়, সে কথাও জানিয়ে দিলেন। রাস্তা, সেতু, এক্সপ্রেসওয়ের মতো ঝাঁ চকচকে উন্নয়ন নিয়ে শাসক-প্রশাসকেরা ততদিনে বেশ ব্যাকুল। দিল্লির টাকা সময়ে খরচ না হলে ফেরৎ যায়। উন্নয়নে গতি আনার দারুণ প্যাঁচ। রাস্তা হওয়ার আগে ফাঁকা জমিতে কিছু মানুষ ঘর বেঁধেছিলেন। এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরুর আগে পুলিশ তুলে দিয়েছে।
বেলঘরিয়া-দমদম স্টেশনের মাঝে ওই জায়গায় বাঁ-দিকে রামকৃষ্ণ মিশন শিল্পপীঠের জমিতে ধান, সবজির ক্ষেত এখনও চোখ জুড়োয়৷ তখন, সেখানে প্রায় সব ট্রেনেরই যেন যাত্রা বিরতি বাধা। সামান্য এগিয়ে আবার থেমে যায়৷ ভিড় ট্রেনের দরজার বাইরে ঝুলছে যারা - শরীরের ভার বইতে বইতে একটা সময় যন্ত্রণা সইতে না পেরে অনেকেই নেমে পড়েন। হেঁটে বেলঘরিয়া ফিরে গিয়ে ফাঁকা ট্রেনের আশায় স্টেশনে গিয়ে শুরু হয় অপেক্ষা।
নোয়াপাড়ায় মেট্রোর কারশেডের জন্য উচ্ছেদ অভিযান ঘিরে নিত্য অবরোধ তখন৷ সে বাধা পেরিয়ে দমদমের দিকে সামান্য এগোনোর পর ট্রেনের গতি-সতর্কতা৷ লোডশেডিংয়ে থমকে যাওয়াও বিচিত্র নয়। কচ্ছপের গতিতে ধুঁকতে ধুঁকতে ট্রেন থামে দমদমে৷ সামনে আগের ট্রেন দাঁড়িয়ে অথবা সিগন্যালের বিভ্রাট - ইত্যাদি ঝামেলা সামলে, দমদম ছেড়েই ফের দাঁড়িয়ে যায় লোকাল। এবারও হয়তো অদূরে দাঁড়িয়ে অন্য কোনও লোকাল। দশটার ট্রেন বারোটা-সাড়ে বারোটায় ঢোকে উল্টোডাঙায়৷
সেখানে ট্রেন থেকে নেমেই লাইন ধরে ছুট৷ তিনি এবং নানা বয়সের আরও অনেকে৷ বেশিরভাগের হাতেই খবরের কাগজে মোড়া টিফিন বাক্স, ব্যাগ ইত্যাদি৷ লাইন ধরে তাঁরা ছোটেন৷ পিছন পিছন হর্ন দিতে দিতে এগোয় শিয়ালদহগামী ট্রেন৷ ট্রেন কাছে চলে এলে লাইন ছেড়ে মিশে যান লোকালয়ে৷ উল্টোডাঙা আর কাঁকুড়গাছির মাঝে রেল লাইনের দু’পাশে অগুনতি ঝুপড়ি৷ একটি-দু’টির মাথায় টিন-টালির ছাউনি৷ বাকিগুলির মাথায় চট, প্লাস্টিক শিটের আড়াল৷ সেই মহল্লার মধ্যেই একটি-দু’টি পাকা বাড়ি৷ ট্রেন দাঁড়িয়ে গেলে মল-মূত্রের গন্ধে গা-বমি করে ওঠে৷ স্বচ্ছ ভারত অভিযান তখন স্বপ্ন৷ রেলের ধার-ঘেঁষে খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত শৌচাগার৷ সারিবদ্ধ হয়ে বসে নানা-বয়সের নারী পুরুষ৷ ট্রেন দাঁড়িয়ে গেলে, লজ্জা ঢাকতে, প্রকৃতির ডাক চেপে রেখে উঠে দাঁড়ান মহিলারা৷ অপেক্ষা করেন কখন ট্রেন সরে যাবে৷ পুরুষের সে সবের বালাই নেই৷ মহিলা যাত্রীরা নাকে রুমাল চেপে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা গোনেন৷ পুরুষ যাত্রীদের কেউ কেউ বস্তির মানুষের সংকোচহীন, উদ্দাম প্রাতঃকৃত্য দেখে রঙ্গ-রসিকতায় মেতে ওঠেন৷ কখনও সখনও দশ-বিশ-পঁচিশ মিনিট৷ ট্রেন নড়ে না৷ ঝুপড়ির মহিলারা সম্ভ্রম রক্ষার অগ্নিপরীক্ষা দেন প্রকৃতির ডাককে দমন করে৷
পুরসভায় যাতায়াত শুরু হতে প্রথমে কমল বসু, পরে মেয়র প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় - দুই মেয়রের কাছেই কথায় কথায় বলি, পুরসভা কি পারে না, রেলের ধারে ঝুপড়িবাসীর জন্য একটা-দু’টো গণ-শৌচালয় গড়ে দিতে? মল-মূত্র ত্যাগ করার জন্য একটু আড়াল, একটু নিরিবিলি পরিবেশ, একটু স্বচ্ছতা, এই তো সামান্য আয়োজন। অফিসারকে ডেকে দু’জনেই বলেছেন, দেখুন তো কী করা যায়। হয়নি কিছুই। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সেই আইনের মারপ্যাঁচ। ওটা রেলের জমি। তাছাড়া বাসিন্দারা বেআইনি বসবাসকারী।
সেই সব দিনে উন্মুক্ত গণ-শৌচালয়ের মধ্য দিয়ে কোনওরকমে পা বাঁচিয়ে দলে দলে মানুষ ছোটেন রেল-লাগোয়া কারখানায়৷ কারখানা মানে - ঝুপড়ি ঘরে পুরনো শিশি বোতল, লোহালক্কড়, বাসনকোসন অ্যাসিড জলে চুবিয়ে পরিষ্কার করার আয়োজন৷ এক-দু’টি হিমঘর৷ মাটির ভাঁড় তৈরি, সস্তার কাশির সিরাপ বোতল বন্দি করা, রং-আলতা-সিঁদুর তৈরির অসংগঠিত ক্ষেত্র৷
সেখানে এবং আরও অনেক জায়গায়, ছোট ছোট ঢালাই মেশিনে প্লাস্টিকের ডট পেন, পুতুল ইত্যাদি তৈরি হয়। ট্রেনে দেদার বিক্রি হয় দশ টাকায় দশটি কলম। প্লাস্টিকের বাসন কোসন, বাটি থেকে বালতি - তাও তৈরি হয় ব্যাঙের ছাতার মতো ছোট ছোট ঘরে। সেগুলির কাঁচামাল প্লাস্টিকের গ্র্যানিউলস আসে গুজরাটের কারখানা থেকে। বাংলার দেওয়ালে তখন হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস কারখানা নিয়ে শিল্পায়ন এবং রাজনীতি, দুই-ই তুঙ্গে। দু’লাখ লোকের কর্মসংস্থানের কথা সিপিএম এবং সরকারের মুখে মুখে। চাকরি শব্দটি বিলুপ্তপ্রায়। নেতাদের মুখে কর্মসংস্থানের কথা।
উল্টোডাঙা, মানে আজকের বিধাননগর স্টেশনের আশপাশটা, যেন মিনি শিল্পনগরী। কত যে মানুষের পেটে ভাত জোগায়। দমদম, বেলঘরিয়া, আগরপাড়া, সোদপুর, আরও এমন অনেক স্টেশনের আশপাশে গিজগিজ করে ছোটখাটো কলকারখানা। নিত্যযাত্রীর একটা অংশ সেখানকার কর্মচারী। দল বেঁধে আসে, দল বেঁধে ফিরে যায়। ডেলি প্যাসেঞ্জার। যদিও শব্দটি যেন শুধুই অফিসকাছারির চাকুরিজীবীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ক্ষুদ্র কারখানায় বেতন যৎসামান্য, তাও সময়ে হয় না। কিন্তু হাতে হাতে কাজ। এক-খণ্ড আত্মনির্ভর ভারত।
নয়ের দশকের গোড়ায়, উদার অর্থনীতির দমকা হাওয়া আছড়ে পড়ল একদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানার উপর, অন্যদিকে ক্ষুদ্র-কুটির ও মাঝারি শিল্পে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে হাতিয়ার করা হল পরিবেশকে। রাজ্যে রাজ্যে চালু হল দূষণ-নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। শহরের কোথায় কত কারখানা, কোন কারখানার কোন রাসায়নিকে কত ক্ষতি - তার হিসেব-নিকেষ শুরু হল। প্রথম প্রথম দূষণ পর্ষদের লোকজন, তারপর এল পুলিশ। ফতোয়া জারি হল, কারখানা গোটাও। শ্রমিক-মালিক কারোরই ক্ষতিপূরণের বালাই নেই। বছর কয়েকের মধ্যে এলাকা সাফসুতরো হয়ে মাথা তুলল বহুতল। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, পরিবেশপ্রেমীরা বলছেন, কলকাতায় এত দূষণের নজির নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা ধুলো। উৎস নির্মাণ শিল্প।
ফিরে যাই আগের প্রসঙ্গে। রেললাইন-লাগোয়া বস্তির ওই সব কারখানায় গোলমাল লেগেই থাকে। মালিকের খোঁজ পড়ে ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে গেলে৷ প্রায়ই আগুন লেগে ছাই হয়ে যায় বস্তির পর বস্তি৷ অনেক ডাকাডাকিতে দমকল এসে আগুনে ঝলসে যাওয়া প্রাণহীন দেহগুলি বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে মর্গে জমা করে দেয়। হাজিরা খাতার বালাই নেই৷ বালাই নেই নাম-ঠিকানারও৷ পুলিশ ম্যানেজারকে থানায় তুলে নিয়ে যায়৷ তারও নিয়োগপত্র নেই। দু’দিন বাদে ফিরে এসে নতুন কোনও আখড়ায় ম্যানেজারি শুরু করেন তিনি৷ ম্যানেজারি মানে খবরদারি৷ ন’টার মধ্যে না ঢুকলে গালমন্দ, কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি, অশ্লীল কথা, ইঙ্গিত - কিছুই বাদ যায় না৷ শ্রম আইন নামে কোনও শব্দ এ তল্লাটে উচ্চারিত হয় না৷ ট্রেড-ইউনিয়নের সিলেবাসেও নেই অসংগঠিত শিল্প-শ্রমিকের কথা।
উল্টোডাঙা স্টেশন-লাগোয়া ছোট কারখানাগুলির কর্মীদের বেশিরভাগই উঠতি বয়সের৷ স্কুলের ত্রিসীমানা মাড়ায়নি কেউ৷ শরীরে বয়সের বান ডেকেছে৷ অনেকেরই বিয়ে-থা হয়ে গিয়েছে৷ কচি বয়সে দাম্পত্য জীবনের ভার বইতে বইতে শরীর ভেঙে গিয়েছে কারও কারও৷ শরীর নিয়ে চর্চাই তবু ওদের কাছে নিখরচার একমাত্র বিনোদন৷ পোস্টারে নগ্ন নারীর ছবি দেখলে ওরা সদলবলে সিনেমা হলে ছোটে৷ ঘরের বউ, সদ্য বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, ঝুপড়ির কারখানা সকলকেই রসদ জোগায়৷ কারও কারও কোলে দুধের শিশু৷ রাস্তায়, ট্রেনে সুযোগ পেলেই ওদের গায়ে পড়তে চায় পুরুষ সহকর্মীরা৷ কথার ভাঁজে, চোখের ইশারায় থাকে শরীর নিয়ে খেলা করার প্রস্তাব৷ কাঁকুড়গাছিতে, রেলের ধারে, রিজওয়ানুর রহমানের দেহ পাওয়া গিয়েছিল যেখানে, সে তল্লাট যেন সাক্ষাত্ মৃত্যুপুরী৷ ষাট-সত্তরের দশকে, তারও পরে - রাজনৈতিক খুনের সাক্ষী থেকেছে ওই এলাকা৷ মাঝেমধ্যে পাওয়া যেত কমবয়সি মহিলার নিথর দেহ৷ কখনও কাগজে মোড়া সদ্যোজাতর দেহ। সাপের খেলা, ম্যাজিক শো দেখার মতো - ডেডবডি দেখার ভিড় লেগে যায়।
খুন না আত্মহত্যা, খুনের আগে ধর্ষণ কিনা - সে প্রশ্ন তুলে রেল, রাস্তা অবরোধ করার প্রশ্নই ওঠে না নাম-গোত্রহীন মহিলার জন্য৷ মানবাধিকার, নারী স্বাধীনতা, এলজিবিটি রাইটস—দেশের ভাবনায় তখনও নেই কোনও কমিশন। এপিডিআর-এর মতো সংগঠনগুলি সরব শুধুমাত্র পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে৷ শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ ইত্যাদি শব্দগুলি তখনও অভিধানে, গল্পে-সাহিত্যে আটকে৷ কাগজে লেখা হত ‘বলাত্কার’ শব্দটি৷ ধর্ষণ, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্ভোগ কিংবা পেটে সন্তান চলে এলেও থানা-পুলিশ না করে চেপে যাওয়া, আত্মহত্যা, বড়জোর গোপনে গর্ভপাত, তখনও সেটাই দস্তুর৷
ছেলের বয়সি কেউ মাঝেমধ্যে কখনও দিদি, কখনও বৌদি সম্বোধন করে বধূর গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সংসারের অভাব অনটনের কথা শুনতে চায়৷ অপেক্ষায় থাকে কখন সংযম ভাঙে, প্রলোভনের ফাঁদে পা দেয়, টাকা-পয়সা চেয়ে হাত পাতে৷ আর সেই সুযোগে…..৷ সে সুযোগ আসে না৷ ভাবলেশহীন তিনি৷ বয়স বড়জোর তিরিশ-বত্রিশ৷ অনাহার-অপুষ্টিতে তা যেন চল্লিশ ছুঁয়েছে৷ তামাটে গায়ের রং, শরীরে তেল-সাবানের বালাই নেই৷ তা হোক, বয়সের একটা ভাষা আছে৷ শরীরের কোথাও না কোথাও, কখনও না কখনও তা ঠিক ঠিকরে বের হয়৷ সহযাত্রী, সহকর্মী কিশোর-তরুণেরা নারী দেহের স্বাদ নিতে মুখিয়ে থাকে৷ বধূ সে সবের তোয়াক্কা করেন না, অথবা এ সবের অর্থ বোঝেন না৷ তিনি যেন বোবা-কালা৷
সেদিন, আরও অনেক দিন, ছুটতে ছুটতে তিনি কারখানার ঝুপড়িতে ঢোকেন এবং ঝড়ের মুখে পড়েন৷ রা কাড়েন না৷ কাজে হাত লাগান৷ হাতে মাত্র ঘণ্টা চারেক৷ তার মধ্যে দিনের বরাদ্দ কাজ শেষ করতে না পারলে পুরো মজুরি জুটবে না৷ হারাতে হতে পারে কাজটাও৷ সন্ধ্যা নামলে, মজুরির টাকা হাতে নিয়ে ছোটেন স্টেশন মুখে। চলে আরও এক দফা লড়াই৷ শিয়ালদা থেকে সাড়ে ছ’টার আপ ট্রেন কোনও দিন সাতটা, কোনও কোনও দিন তারও পরে ছাড়ে৷ উল্টোডাঙায় ট্রেন ঢোকে বাদুড়-ঝোলা হয়ে৷ ঠেলেঠুলে তাতে উঠতে পারলে সোদপুর পর্যন্ত পঁচিশ মিনিটের যাত্রা কোনও কোনও দিন এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যায়৷ ট্রেন বিকল, সিগনাল-বিভ্রাট, লোডশেডিং, দমদমের আগে-পরে রেলের গতি-সতর্কতা - লেগেই থাকে৷
সোদপুর পৌঁছে তিনি ছোটেন স্টেশন লাগোয়া বাজারে৷ চাল-ডাল-তেল-নুন, রোজকার মতো কিনে দৌড় বাড়ি অভিমুখে৷ টালি-বেড়ার এক কামরার ঘরে কুপি জ্বেলে, পেটে খিদে চেপে, মায়ের জন্য অধীর অপেক্ষায় দুই কিশোরী৷ ঘরে ঢুকে ছোটেন রাস্তার কলে৷ ঢক ঢক করে এক ঘটি জল গিলে উনুন সাজিয়ে বসেন৷ এক আঁচ, এক হাড়ি, এক কড়াইয়ে দু’বারের রান্না চড়ে, রাতের আর পরদিন দুপুরের৷ রান্নার ফাঁকে বিছানায় পড়ে থাকা পঙ্গু স্বামীর যত্ন-আত্তি চলে৷ কোনও কোনও দিন প্রতিবেশি, প্রায় রোজই এটা সেটা নিয়ে বাড়িওয়ালার গঞ্জনা তো থাকেই৷ বাড়িভাড়াই বাজারে একমাত্র ধার৷ দারিদ্র তাঁর চেহারায়, পোশাকে ধরা পড়ে, স্বভাবে নয়৷ পুজোয় ক্লাবে দুঃস্থ মহিলাদের শাড়ি, বাচ্চাদের জামাকাপড় দেওয়া হয়৷ তাতে নাম লেখানোর ভিড়ে তিনি নেই৷ বড়লোক বাড়ির বিয়ে, অনুষ্ঠানেও শাড়ি-এটা-সেটা পাওয়ার ভিড়ে তিনি অনুপস্থিত৷ দারিদ্র হার মানে তাঁর লড়াইয়ের কাছে৷
অভাবের সঙ্গী হয় নতুন উৎপাত৷ মেয়েদের নিয়ে প্রতিবেশীদের সত্য-অর্ধসত্য, মুখে আনা যায় না - এমন সব কুত্সিত অভিযোগ শুনতে হয়৷ মায়ের চিন্তা বাড়িয়ে মেয়েদের শরীরে বয়স ফুটে ওঠে৷ পাড়ার ছেলে ছোকরারা প্রায়ই হানা দেয়৷ সন্ধ্যা গড়ালে উত্পাত বাড়ে৷ রাত যত গভীর হয়, জেগে থাকার লড়াই তত বেড়ে চলে৷ বিছানায় অসুস্থ স্বামীর গোঙানি৷ কোনও কোনও দিন বাড়তি উত্পাত এসে জোটে৷ পাড়ার মাঝবয়সি কোনও মদ্যপ, লম্পট দরজায় কড়া নাড়ে৷ পঙ্গু স্বামী, হত-দরিদ্র, অসহায় যুবতী বধূকে কাছে পাওয়ার বাসনা৷ মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতে আসে উঠতি বয়সের মস্তান গোছের ছেলেরা৷ ঘুম মানে তাই দু’চোখ বুজে বিছানায় পড়ে থাকা৷ ভোরের আলো ফোটার আগেই শুরু হয় পরের দিনের লড়াই৷ পঙ্গু স্বামীর মল-মূত্র পরিষ্কার করে, স্নান করিয়ে, খাইয়ে, মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে আবার ছুট ৮-১০-এর ব্যারাকপুর লোকালের উদ্দেশে৷
ব্যারাকপুর লোকাল
ব্যারাকপুর লোকাল - সব লোকাল এখন গন্ডায় গন্ডায়৷ বাদুড়-ঝোলা ভিড় উধাও৷ ঝকঝকে কামরা৷ আলো-পাখা, মিউজিক, হাত-পা ছড়িয়ে বসার ব্যবস্থা - অনেক ট্রেনই বারো বগির৷ মহিলা যাত্রীদের জন্য আছে মাতৃভূমি লোকাল৷ লেডিস কমপার্টমেন্টের গায়ে লেখা - পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ৷ মাতৃভূমি লোকালে এক-দু’টি জেনারেল কামরা চালু করেও মহিলা যাত্রীদের আপত্তিতে তুলে নিতে হয়। দমদম থেকে মেট্রো আরও উত্তরে নোয়াপাড়া পর্যন্ত এগিয়েছে৷ দক্ষিণে ঠাকুরপুকুর, গড়িয়া। উল্টোডাঙা স্টেশনের আগে-পরে দু’পাশে ঝুপড়ি হাতে-গোনা কয়েকটি৷ ঝুপড়ি, বন্ধ কারখানার জমিতে মাথা তুলেছে চোখ ধাঁধানো বহুতল৷ চারধারে আলোর বন্যা৷ অনেকখানি বদলে গেছে৷ একের পর এক লোকাল কামরা খালি করে শিয়ালদহের দিকে এগিয়ে যায়৷ প্ল্যাটফর্মের সেই ভিড়ে কোনও মহিলা কি থাকেন, যাঁর সকালে বিধাননগর না আসলে, বিকালে সোদপুরের বাড়িতে ফিরে না গেলেই নয়? আছে, নিশ্চয়ই আছে৷ দেখার চোখ, খোঁজার সময় কই আমাদের!
যে মহিলার কথা বলছিলাম, পাড়ার লোকের মুখে তিনি ছিলেন ‘সুপ্রিয়ার মা’। পরিবারের দেওয়া ভালো নাম নিশ্চয়ই কিছু একটা ছিল। সে নামে শেষ কবে কে ডেকেছে কে জানে। নিজেও নিজের নামটি মনে রেখেছিলেন কি না সন্দেহ। বার্থ সার্টিফিকেটের বালাই নেই, স্কুলে যাননি কখনও। রেশন কার্ড মেলেনি। ভোটার তালিকায় নাম থাকলেও জানার উপায় নেই। ভোটার আইডি হয়তো হয়েছে, চোখে দেখেননি।
এক পাড়ায় বাস, ধরেই নিয়েছিলাম, তিনি বোবা-কালা অথবা মানসিক ভারসাম্যহীন। পাড়ায় প্রতি ঘরে অভাব-অনটন নিয়ে সাংসারিক ঝগড়াঝাঁটি তখন প্রাত্যহিক ব্যাপার। তার মধ্যে একটি পরিবারের অভাব ছিল সীমাহীন। তাঁরা চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা। নিজেদের মধ্যে চাটগাঁয়ের ভাষায় কথা বলতেন। ঝগড়াঝাঁটি লাগলে গোটা পাড়া জড়ো সেই বাড়ির সামনে। তাদের চাটগাঁইয়া ঝগড়া ছিল হাতে-পাওয়া চোদ্দ-আনার মতো ফোকটে মজা। দারিদ্রের কী মর্মান্তিক উপহাস।
ব্যতিক্রম বলতে ওই একটি পরিবার। পুকুরঘাটের আড্ডাতে বাকিরা রঙ্গ-রসিকতায় মাতেন। তিনি এক কোণে বাসন মেজে, স্নান সেরে বাড়ি ফিরে যান।
সেদিন, যেদিন প্ল্যাটফর্মে পড়ে গেলেন - কাছেই ছিলাম এবং প্রতিবেশী হিসাবে আমারই সেদিন সবার আগে পাশে দাঁড়ানো উচিত ছিল। কিছু না হোক, পাড়ায় ফিরে গিয়ে খবর দিতে পারতাম। করিনি। কোনও দিন ভুলেও কথাও বলিনি সেই প্রতিবেশীর সঙ্গে। এই যে অপলক দেখে গিয়েছি তাঁর লড়াই - তারও কোনও পূর্ব সিদ্ধান্ত ছিল না। আলাপহীন সম্পর্ক।
কি দিশাহারা অবস্থায় প্রতি মুহূর্ত
কাটানো - এ লড়াইয়ের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয়না