মাস কয়েক পরপর মহিলা বলতেন, শুনতাম, ‘সাইম্নের মাসে দ্যাশে জামু। বাসে জামু বনগাঁ। সেখান থিক্কা হেলিকপ্টারে চাইপ্পা হুশ কইর্যা দ্যাশে ঢুইক্যা পরমু। বৈকালে বাড়ি গিয়া ভাত খামু।’ শেষ বাক্যটায় ‘বাড়ি’ শব্দটার আগে আমি ‘দেশের’ কথাটি জুড়ে নিয়ে আপন মনে দেশের বাড়ির স্বপ্ন আঁকতাম। মায়ের মুখে প্রায়ই শুনতাম, আমাদের দেশের বাড়ির নানা রূপকথা।
‘রূপকথা’ শব্দটি আমার সচেতন প্রয়োগ। বড় হয়ে বুঝেছি, সব মানুষেরই নিজেকে নিয়ে একটা করে রূপকথা থাকে। আমরা সবাই রূপকথার চরিত্র। তাতে প্রেম-ভালবাসা, যৌবনের উদ্দামতা, বাঁচার জন্য লড়াই-সংগ্রাম, সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় ছোটবেলার দিনগুলি। বড় মায়া জড়ানো সময়।
সময় যত এগোয়, ফেলে আসা দিনগুলি ততই হয়ে ওঠে এক-একটি রূপকথা। ফেলে আসা সময়, ফেলে আসা দিন, মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তা হারিয়ে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। এ ক্ষতি পূরণ হয় না। কারণ, তা ফেরে না, ফেরানো যায় না। ধনী-গরিব নির্বিশেষে ক্ষতির অঙ্কটা সকলের অভিন্ন। ফেলে আসা দিনগুলি নিয়ে রূপকথার আকর্ষণেও ধনী-দরিদ্র, ভেদাভেদ নেই। হয়তো সেই কারণে, ছেলেবেলার কথা, ফেলে আসা দিনগুলিকে মানুষ নানা রঙে আঁকতে চায়।সেটাই তার সবচেয়ে বড়, প্রিয় এবং একান্তই নিজের সম্পদ।
আমার ছোটবেলায়, পাড়ার, পরিবারের বড়দের সকলের একটা ‘দ্যাশের বাড়ি’ ছিল। ছেড়ে আসা দ্যাশের বাড়ি, ফেলে আসা দিনগুলি নিয়ে তাদের সব্বার একটা করে মনোহর কাহিনি ছিল। মগ্নচিত্তে তা শুনেছি। ‘চাঁদমামা’, 'শুকতারা' কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের মতো পরিবারগুলির ছিল না। মাঝেমধ্যে পুরনো বইখাতা কিনতে আসা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কিনেছি পুরনো কপি। বড়দের দ্যাশের বাড়ির গল্প দিয়েই আমার বিদেশ চেনা শুরু। একটু বড় হয়ে বুঝলাম, মহল্লার অনেকের দ্যাশের বাড়ি আসলে সেই মহিলার দেশ। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, আম-জাম-কাঁঠালের দেশের অন্য এক কাহিনি শুনেছি তাঁর মুখে। তাঁদেরই মতো আরও অনেকের মুখে। অনটনের রূপকথা।
মলিনা বিবির মুখে হেলিকপ্টার শব্দটিও আমাকে বেশ ভাবাত। অনটনের সংসারের হাল ধরতে গোঁফ-দাড়ি পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই এয়ারফোর্সের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন আমার বড়দা। ছয়-সাতের দশকে বাংলার তরুণদের আর্মি, পুলিশ, সিআরপিতে চাকরি পাওয়া ছিল এভারেস্ট জয়ের মতো। দেশভক্তি নিয়ে সংশয়-সন্দেহের লম্বা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না-পেরে অনেক বাঙালি তরুণেরই দেশরক্ষার চাকরি করা হয়ে উঠত না। দাদাকে দেওয়া হয়েছিল হেলিকপ্টার ইউনিটে। কখনও তাঁর সঙ্গী হয়ে, আরও পরে চাকরি-বাকরির খবর সংক্রান্ত পত্রিকায় এয়ারফোর্সের চাকরি বিষয়ক তথ্য সংগ্রহে পলতায় ব্যারাকপুর এয়ারবেসে গিয়ে খুব কাছ থেকে হেলিকপ্টার দেখেছি। মলিনা বিবির মুখে হেলিকপ্টারে দেশে ফেরার কথা শুনে সব কিছু তখন কেমন রহস্যাবৃত ঠেকত। ছাপোষা মহিলা কী করে এতে চড়বেন?
সাংবাদিকতায় এসে ঘটনা-দুর্ঘটনা, সরকারি অনুষ্ঠান, নেতাদের সভা-সমিতি, খবর করতে বহুবার বনগাঁ গিয়েছি। যত বার গিয়েছি, এক ফাঁকে, ভ্যান-রিকশয় চেপে পরম কৌতূহল বুকে বয়ে গিয়েছি বর্ডার দর্শনে। এপারে পেট্রাপোল, ওপারে বেনাপোল। সীমান্তের বেড়া ভেদ করে চলে গিয়েছে যশোর রোড। দুই দেশ, এক রাস্তা। দেখেছি অসংখ্য হেলিকপ্টার। মনে মনে হেসেছি। সাইকেলের পিছনে কাঠের পাটাতনে দু’দিকে মুখ করে দু’জন, সামনে এক জন, সীমান্ত পেরনো মানুষকে নিয়ে এভাবেই একের পর এক সাইকেল ছুটছে যশোর বাসস্ট্যান্ড অভিমুখে। মানুষ আদর করে নাম রেখেছে হেলিকপ্টার। এমনই কোনও হেলিকপ্টারে চেপে মলিনা বিবি ফিরে গিয়েছেন ওপারে। যাওয়ার আগে, নয়-নয় করে বছর তিরিশ আগে, এক দিন এক মুখ মুখ হাসি ছড়িয়ে বলে গেলেন, ‘মাঝেমধ্যে খবর পাই, দ্যাশে এখন ধান-চালের সংস্থান আসে। কাম-কাজও মেলে। দেখি গিয়া।’
মলিনা বিবি এবং আরও কয়েক জন মহিলা ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের তল্লাটে তখন বেশ কিছুকাল ছিলেন। এ-বাড়ি ও-বাড়ি কাপড় কাচা আর বাচ্চাদের দেখভাল করে সামান্য রোজগারে চালিয়ে নিতেন। তা থেকে দু’পয়সা পাড়ার মা-মাসিমাদের কাছে জমাতেন ওঁরা। দেশে যাওয়ার সময় চেয়ে নিতেন। এ তল্লাটে, অর্থাৎ উত্তর-শহরতলির পাড়াগুলিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করা একটা গোটা প্রজন্ম আছে, যারা ওঁদের কোলে-পিঠে মানুষ হয়েছেন। ওঁদের নাগরিকত্বের বিষয়টি তখন সত্যিই মাথায় আসেনি। জানা হয়নি ওঁদের পাসপোর্ট-ভিসা ছিল কি না। ‘উইপোকার মতো ঢুকছে ওরা’, বাংলার বিধানসভা ভোটের আগে, এনআরসি/নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিতর্কে দিল্লির শাসকগোষ্ঠীর এক নেতার ওঁদের সম্পর্কে এমনই অমিতবিক্রম মন্তব্য আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল বছর তিরিশ-পঁয়তিরিশ আগে।
শহিদুল, মহিদুল, ওদের দিদি চম্পা এবং মা মলিনা বিবি। শহিদুল, মহিদুলদের ডাকনাম ছিল বাবর, আকবর। মলিনা বিবিকে গোটা তল্লাট আকবর-বাবরের মা বলে ডাকত। নাবালক দুই ভাই, চম্পা কিশোরী। মা-মেয়ের বয়সের ফারাক বড়জোর পনেরো, কী একটু বেশি। প্রতি সকালে সন্তানদের নিয়ে মহিলা আমাদের পাড়ায় চলে আসতেন। ফিরে যেতেন সন্ধ্যা নামার আগে। কোথায় যেতেন, কোথায় থাকতেন, জানা ছিল না। ওদের সঙ্গে আসতেন আরও কয়েক জন মহিলা। তাঁদের দু’জনের নাম মুখে মুখে ঘুরত। সাদা নানি, কালো নানি। গলির মুখে কেউ কেউ গলা চড়িয়ে বলতেন, ‘আজ দু’বালতি আছে। কেচে দিয়ে যেও।’
বাড়িতে কাজের লোকেরা যা যা কাজ করে তার সবই করতেন ওঁরা। বাড়তি এবং বিশেষ কাজ ছিল কাপড় কাচা। বালতি পিছু দশ টাকা। ক্রমে সেটা এমন নিয়ম হয়ে গেল যে সব বাড়িতেই নির্দিষ্ট মাপের বালতি। একটু একটু করে ঢালাই লোহার বালতির জায়গা নিতে শুরু করেছে পলিথিনের নানা রংয়ের বালতি। আর একটা কাজ করতেন ওঁরা। শিশুদের যত্নআত্তি। চার বেলা ঘড়ি ধরে খাওয়ানো, নিয়ম করে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে মায়ের পিছনে লেগে থাকা, তেল মাখানো, রোদ খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, সন্তানের প্রতি মায়ের যাবতীয় কর্তব্য সারতেন ওঁরাই।
কলোনির সাধারণ জীবনযাত্রায় ওদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল অভিনব এই পেশা। বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাপড় কাচাও রোজগারপাতির জনপ্রিয় উপায় হয়ে উঠেছিল ওঁদের হাত ধরেই।
কলোনির বহু পরিবারেই কুপি, লণ্ঠন জ্বলে। খাটা পায়খানা। কয়লা ঘ্যাঁসের রাস্তা। রাস্তার কলের জল খায় বেশির ভাগ পরিবার। একটু রোজগার ভাল, এমন পরিবারে বড়জোর একটা সাইকেল, একটা ট্রানজিস্টার। মোটের উপর কলোনির চেনা ছবি। বিচ্ছিন্ন সাজানো দ্বীপের মতো এক-দু’টো বাড়ি পাকা, কয়েকটা দোতলাও এবং কিছু ঘরে সাদাকালো টেলিভিশন। বুধবার রাতে জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার গানের অনুষ্ঠান চিত্রহার, শনিবার-রবিবার বলিউড ফিল্ম দেখার বাসনায় টিভিওয়ালা বাড়িগুলি হয়ে উঠত মিনার-বিজলী-ছবিঘর, প্রাচী, প্রিয়া, বসুশ্রী। বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেটের সময় ঘরের টিভি চালান হয়ে যেত লাগোয়া রাস্তায়, মাঠে। তারই মধ্যে এসে হাজির হয়েছিল যৌথ পরিবারে ভাঙনের সংস্কৃতি।
অনটনের সংসারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ভাল থাকার স্বপ্ন পূরণে আলাদা হয়ে যাওয়াটা ছিল প্রাথমিক সিদ্ধান্ত। দেশ-কাল-সমাজের নানা অভিঘাতে বেসামাল হয়ে পড়ে সংসাদের আত্মিক এবং আর্থিক বন্ধন। রক্ষা পায় না কুঁড়ে ঘরের সংসারও। কলোনির ঘরে-ঘরে শিশুদের দাদু-দিদা-ঠাকুমা-ঠাকুরদা-কাকিমা-জেঠিমা নেই। তাদের ভিন্ন সংসার, ভিন্ন হাঁড়ি, অন্য বাড়ি। এমন সন্ধিক্ষণে শিশুদের পরিজন হয়ে ওঠেন নানি, মলিনা বিবিরা।
১৯৮২-তে দিল্লির এশিয়ান গেমস ঘরে বসে দেখার সুযোগ করে দিল দূরদর্শন। চালু হল তাদের রঙিন পরিষেবা। নির্ঝঞ্জাট প্রোগ্রাম দেখার বাসনায় অনেকেই টিভি সেটের উপর বসালেন বুস্টার নামক চৌকো এক যন্ত্র। দূরদর্শনের ‘হমলোগ’, ‘বুনিয়াদ’-এর পাশাপাশি এই বাংলার ঘরে-ঘরে ঢুকে পড়ল ঢাকা টেলিভিশনের জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রি ’, ‘ঢাকায় থাকি ’ ‘যদি কিছু মনে না করেন’। সিরিয়াল কথাটির তখন খুব একটা চল ছিল না। কলকাতা দূরদর্শনের গোড়াকার জনপ্রিয় মুখ পঙ্কজ সাহা। তিনি যেন কলকাতা দূরদর্শনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। তাঁকে দেখলে চোখে ভেসে ওঠে দূরদর্শনের লোগো, কানে বেজে ওঠে পুরনো টাইটেল সং। তাঁর লেখায় পড়েছি, ‘পূর্ব ভারতে প্রথম টিভি কলকাতায়। পৃথিবীতে টেলিভিশন অনুষ্ঠান শুরুর সময় আকাশবাণী কলকাতার ‘বেতারজগৎ’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘জগতে এমন একটি যন্ত্র এসে গিয়েছে, যাতে একই সঙ্গে কথা শোনা যায়, ছবিও দেখা যায়, তার নাম টেলিভিশন। কলকাতায় টেলিভিশন আসতে আর দেরি নেই, এখন থেকে তরকারি কুটতে কুটতে আঙুরবালার গান শোনা যাবে, আবার তাঁকে দেখাও যাবে।কলকাতায় তখনও টিভি আসেনি। কলকাতার অনেক আগেই ঢাকায় টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সূচনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রথম বিদেশ ভ্রমণে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কলকাতায় এলেন। কলকাতা ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনা কভার করার জন্যে বাংলাদেশ টিভির ওবি ভ্যান এল। আকাশবাণী থেকে ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে আমরা সেই ওবি ভ্যানের ভিতরে ঢুকে টিভির আশ্চর্য কর্মকাণ্ড প্রথম দেখার সুযোগ পাই। কলকাতায় তার বছর চারেক পর টিভি চালু হল।’
বাংলাদেশের তখন শৈশব। ধারাবাহিকের কাহিনি জুড়ে তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রলেপ, সদ্য স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, নৈতিকতার স্খলন, দেশ-সমাজ-সংসারের নানা সংকট, ভাল থাকার দৌড়, সম্পর্কের টানাপড়েন, প্রেম-ভালবাসা। টিভিওয়ালা বাড়িগুলিতে ভিড় বাড়ত ঢাকার সিরিয়াল দেখতে। শুনেছি, ওসব সিরিয়ালের সময় ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহি, সিলেটের মতো বড় শহরগুলিতে মানুষজন ঘরে ঢুকে পড়ত। এপারে টলিপাড়ার উত্তম-সুচিত্রা, সৌমিত্র-সাবিত্রী, চিৎপুরের যাত্রাপাড়ার অরুণ দাশগুপ্ত, বীণা দাশগুপ্ত, স্বপনকুমার-স্বপ্নাকুমারী, বর্ণালী ব্যানার্জি, অরুণ চট্টোপাধ্যায়দের মতোই এখানেও অনেকের মুখে সুবর্ণা মুস্তাফা, আসাদুজ্জামান নূর, হুমায়ুন ফরিদি, দিলারা জামানদের নাম। অনেক পরে, এ দেশেও সকাল সকাল কাজ সেরে মানুষ টিভির সামনে বসে পড়ত দূরদর্শনে রামায়ণ, মহাভারতের মতো মেগা সিরিয়াল দেখতে।
সেই সব দিনে, দূরদর্শন ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা ব্যাপারে ছিল দারুণ মিল। দূরদর্শনের খবরে অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকতেন রাজীব গান্ধী। বাংলাদেশ টেলিভিশনে হুসেইন মহম্মদ এরশাদ। আমাদের তরুণ, সুদর্শন প্রধানমন্ত্রীর পিছু পিছু ছুটত দূরদর্শনের টিম। এরশাদের কনভয়ে এক-দু’টি গাড়ি থাকত বি-টিভির। সামরিক প্রশাসক সেনাপ্রধান এরশাদ রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হস্তগত করে রাষ্ট্রপতি হন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেখতাম, দুর্গত এলাকায় গিয়ে এরশাদ একহাতে মানুষের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিচ্ছেন, অন্য হাতে রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন। অন্য দিকে, নিজেই জিপ চালিয়ে অলিগলি, গ্রামগঞ্জ চষে ফেলছেন রাজীব। দুই দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সেই সব দৃশ্য দেখে ধন্য ধন্য করতেন বহু মানুষ। সরল, সাদাসিধে মানুষ নেতাদের নিঁখুত অভিনয় গোগ্রাসে গিলত।
আমাদের বাড়ির পাঁচ ব্যান্ডের মহার্ঘ রেডিওটি বেশিক্ষণ থাকত আমার জিম্মায়। আকাশবাণী ছাড়াও দেশ-বিদেশের নানা রেডিও স্টেশনের বাংলা সার্ভিসের অনুষ্ঠান তাতে ধরা যেত। স্পষ্ট ধরা দিত যশোর, খুলনার অনুষ্ঠান। কখনও-সখনও ঢাকা রেডিও। জন্ম নিয়ন্ত্রণ আর স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক অনুষ্ঠানটি এখনও যেন কানে বাজে। বোকাহাঁদা গোছের একটি লোকের বোকা বোকা প্রশ্নের জবাব দিতেন এক ভদ্রমহিলা ও এক ভদ্রলোক। বোকাহাঁদা লোকেরা সব সমাজবন্ধু। সমাজের অগ্রগতিতে তাঁদের ভূমিকা অপরিসীম। এঁরা এমন এমন সরল, সোজা, বোকা বোকা মার্কা প্রশ্ন করেন, যার উত্তর সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিতেরও অজানা। অথচ উত্তরটা জানা জরুরি। পাছে লোকে বোকা ঠাওরায়, তাই অনুচ্চারিত প্রশ্নগুলির উত্তর অজানাই থেকে যায়।
এক দিনের একটি প্রশ্ন— এই যে আপনারা কথায় কথায় বলেন, সন্তান হল গিয়ে সম্পদ। তা সম্পদই যদি হবি তয়লে বেশি হলি ক্ষতি কী? মায়া বড়ির বিজ্ঞাপনটি ছিল বড্ড মায়া জড়ানো। স্বামীকে স্ত্রী বলছেন, ‘ময়নার বাপে ওর মায়রে মায়া করসে। তুমি আমারে একটু মায়া করতে পারো না?’
মলিনা বিবিদের এ সব অনুষ্ঠানের কথা, এরশাদের কথা, তাঁদের দেশের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার কথা আমরা বলতাম। ঝড়, বন্যা, নৌকাডুবি বাংলাদেশে লেগেই থাকত। শোনাতাম সে-সবের খবর। কিন্তু কে এরশাদ, কাকে বলে রাষ্ট্রপতি, দেশ কী, এ সব ওঁরা জানতেন না, বুঝতেন না। তার প্রয়োজনও পড়েনি। মা, বৌদিদের মুখে ঢাকার সিরিয়ালের গল্প শুনেও দেশ নিয়ে বিন্দুমাত্র কৌতূহল লক্ষ্য করিনি।
আমাদের যৌথ পরিবারে তখন অনেকগুলি ছোট ছেলেমেয়ে। তাদের সঙ্গে হই-হুল্লোড় করে, টিভি দেখে কাটত আকবর-বাবরদের। কাজের ফাঁকে কখনও-সখনও টিভির সামনে দু’দণ্ড বসতেন ওদের মায়েরা। চোখমুখ দেখে বেশ ঠাওর হত, ঢাকার নাটক দেখেও দেশ নিয়ে কোনও অনুভূতি কাজ করত না ওঁদের। আসলে বুঝতেন না। এক দিন, আরও অনেক দিন, কথায় কথায়, নিছকই মজা করতে জানতে চেয়েছি, তোমাদের বাড়ি কোথায়? কোন দেশের মানুষ তোমরা? জবাব মেলেনি। এ সব প্রশ্ন শুনে বেশির ভাগ সময় ওরা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন। কখনও মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে হাসতেন। প্রথম প্রথম অবাক হতাম। অনেক পরে, নানা কথায়, নানা প্রতিক্রিয়ায় বুঝেছি, ঠিকানা, নাগরিক, নাগরিকত্ব, দেশ, বিদেশ, বিদেশি, জেলা, উপজেলা, এ সব ওঁদের বোধবুদ্ধির বাইরে। এক নানি অনেক কষ্টে এক দিন গ্রামের নামটি মনে করতে পেরেছিলেন।
ওঁরা ভিটে ছাড়েন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে বাঁচবেন বলে। কাজের খোঁজে দালালের হাত ধরে এ দেশে চলে এসেছিলেন। দালালকে পয়সা দিয়েই বছরে এক-দু’বার নিজের ভিটেতে কিছুদিন কাটিয়ে আসতেন। এক বার, মলিনা বিবি দেশে যাওয়ার আগে কিনে আনলেন একটি খেলনা গাড়ি। চম্পা, আকবর, বাবরদের তখন ওসব খেলার বয়স নয়। মায়ের মুখে শুনলাম, স্বামীর দ্বিতীয় পক্ষের সংসারও ওই মহিলাই টানেন। কয়েক মাস পরপর তাঁর দেশে যাওয়ার আসল রহস্য ছিল সেটাই। মায়ের কাছে প্রতি মাসে একটু একটু করে জমানো টাকা পরিমাণে বাড়লে দেশে গিয়ে সতিনের হাতে তুলে দিয়ে আসতেন মহিলা। দ্বিতীয় বিয়ের পর দুর্ঘটনায় কর্মক্ষমতা হারান মলিনা বিবির স্বামী। এক দিকে স্বামী শয্যাশায়ী। অন্য দিকে, কোলে দুধের শিশু। সতিনের জীবনে নেমে আসা দুর্যোগ দূর দেশে এসেও পরম মমতায় সামাল দিয়েছেন মহিলা। স্বামীর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তানের জন্যই সে বার খেলনা গাড়ি নিয়ে দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন মলিনা বিবি। সতিনের প্রতি তাঁর কোনও রাগ ছিল না। মাকে কথায় কথায় বলেছেন, ‘মাইয়্যাটা তো দোষ করে নাই। আমার সোয়ামি সংসার গোপন কইর্যা বিয়া করসে।’ স্বামীকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন মহিলা। সম্পর্কে দাঁড়ি টেনে দেননি।
আমার মা এবং কলোনির আরও কিছু সমবয়সি মহিলার সঙ্গে বেশ সখ্য তৈরি হয়েছিল দুই নানি ও মলিনা বিবিদের। হয়তো জীবনযুদ্ধে সাদৃশ্যই কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল তাঁদের। দু’য়েরই উদ্বাস্তু জীবন। আমাদের এবং এ তল্লাটের আরও কিছু পরিবার দেশভাগের কিছুকাল আগে জীবিকার সন্ধানে কলকাতায় চলে এসেছিল। থিতু হওয়ার আগেই দেশভাগ। সেই অভিঘাতে উদ্বাস্তু জীবন।
কলোনির সর্বাঙ্গে তখন জোঁকের মতো লেপ্টে রোগব্যাধি। টিবি, হাঁপানি বলতে গেলে ঘর-ঘর কি কহানি। হয়তো ক্যান্সারও। রোগ ধরা পড়ার আগেই জীবন প্রদীপ নিভে যায় বেশির ভাগের। দেশে মৃত্যুর গড় বয়স তখন ষাটের নীচে। কলোনিতে আরও কম। অনটনের সংসারে অনাহার-অপুষ্টি থেকে রোগব্যধি, চিকিৎসার অভাব, সব মিলিয়ে ৫০-৫৫ পেরনোর আগেই পুরুষদের অনেকেই গত হতেন। লড়াই তীব্রতর হত তাঁদের বিধবাদের। এ তল্লাটে আরও অনেক অকাল বিধবার মতো মাকেও এমনই এক সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল। ভিটেমাটি রক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয় বেঁচে থাকার নয়া লড়াই।
হাসপাতালের মৃত্যুশয্যায় বাবা পাশের বেডের রোগীর কাছে স্ত্রীর উদ্দেশে শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করে গিয়েছিলেন, শত কঠিন পরিস্থিতিতেও সন্তানদের পড়াশুনোয় যেন ছেদ না-পড়ে। পাশের বেডের রোগীর মুখে শোনা স্বামীর শেষ ইচ্ছাকেই লড়াইয়ের পাথেয় করেছিলেন মা। সেই লড়াইয়ের সড়কে দেখা হয়েছিল দুই নারীর। মা এবং মলিনা বিবি।
জন্মলগ্ন থেকে আমাদের কলোনিতে গোটা চারেক প্রাইমারি এবং সমসংখ্যক সেকেন্ডারি স্কুল। তার মধ্যে সেকেন্ডারি দু’টি স্কুল মেয়েদের। দেশভাগের বলি ছিন্নমূল মানুষগুলি মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত হতেই স্কুল তৈরিতে হাত লাগিয়েছিলেন। শিক্ষানগরী শিরোপা মিলতেই পারত আমাদের কলোনির। স্কুল গড়ার কাজে অনেকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন বাবা-কাকারাও। হয়তো সেই কারণেই বাবার শেষ ইচ্ছা ছিল সন্তানদের শিক্ষা। কলোনির সব ঘরেই বাবা-মায়েরা এমনই ছিলেন। সব ঘরেই অনটনের অন্ধকার এবং শিক্ষার আলোর সহাবস্থান। দারিদ্র, অনটনের সঙ্গে শিক্ষার সংঘাত তখনও শুরু হয়নি। শিক্ষা অবৈতনিক ছিল না। মাইনে দিতে হত। আবার ইচ্ছে থাকলে উপায় ছিল। দুঃস্থ পরিবারের ছেলেমেয়েদর জন্য হাফ ফ্রি, ফুল ফ্রি-র সুবিধা ছিল। বছর বছর সিলেবাসের বদল হত না। এক বই বছর বছর পাড়ায় এ-হাত ও-হাত ঘুরত। নতুন বইয়ের দেখা মিলত শুধু লাইব্রেরিতে। না বলা, না লেখা একটা স্লোগান সর্বক্ষণ ভেসে বেড়াত— কেউ পড়বে, কেউ পড়বে না, তা হবে না, তা হবে না।
নানিরা, মলিনা বিবিরা জানতেন না, বুঝতেন না এ দেশে তাঁরা বিদেশি। তাঁদের দেশের নাম বাংলাদেশ। অনেক পরে জেনেছি, এমন বিদেশিদের বলে ইললিগ্যাল মাইগ্র্যান্ট বা অবৈধ অভিবাসী। অর্থাৎ বৈধ অনুমতি ছাড়া যারা সীমান্ত অতিক্রম করেছে। ১৯৮৭-তে ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে শব্দ দু’টি প্রথম আইনে জুড়ে দেওয়া হল। আকবর-বাবরদের আইনি পরিচয়টা অবশেষে স্পষ্ট হয়। এ দেশে ওরা ছিল অবৈধ অভিবাসী। ভাগ্যের কী পরিহাস, বিদেশি ভূখণ্ডে এসে নানিরা প্রথম বুঝেছিলেন কাকে বলে দেশ, কোনটা নিজের দেশ। আসলে বুভুক্ষু মানুষের কোনও দেশ থাকে না। সীমানা মানে না খিদে। ক্ষুধার্ত মানুষ মাত্রেই রাষ্ট্রহীন নাগরিক।
ইললিগ্যাল মাইগ্র্যান্ট শব্দ দু’টি আইনের বইয়ে জায়গা করে নিলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে বহুলব্যবহৃত হতে থাকল অনুপ্রবেশকারী অর্থাৎ ইনফিলট্রেটর কথাটি। বিধানসভা ভোটের প্রচারে অমিত শাহ, জেপি নড্ডারা ‘ঘুসপেটিয়ো’ বলে যাদের এ দেশ থেকে তাড়ানোর হুমকি দিয়েছেন। অভিবাসী সংক্রান্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের কোনও দলিলে ঘুসপেটিয়া অর্থাৎ অনুপ্রবেশকারী শব্দটি নেই। নেই এ দেশের নাগরিকত্ব আইনেও। আছে বিজেপির শব্দকোষে। কারগিলে সীমান্তরক্ষীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়া পাক জঙ্গি আর জীবন-জীবিকার স্বার্থে, পেটের দায়ে এ দেশে আসা সাধারণ নাগরিক, গেরুয়া শিবিরের চোখে তারা সব অনুপ্রবেশকারী।
মন্দির-মসজিদ রাজনীতিতে জ্বালানি জোগাতে তারা অভিধান থেকে বাছাই করা শব্দটি তুলে আনে আটের দশকের শেষ লগ্নে। নয়ের দশকের গোড়ায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং তার জেরে মুম্বই, কলকাতা-সহ একাধিক শহরে দাঙ্গা, দেশব্যাপী অস্থিরতা, এমন আবহে অনুপ্রবেশ-অনুপ্রবেশ করে চিল চিৎকার জুড়ে দেয় তারা। দিল্লি, মুম্বই, নাগপুর, কানপুর, লক্ষ্ণৌ, জয়পুর, বেনারস, বেঙ্গালুরু থেকে পাততাড়ি গোটাতে হয় বহু বাঙালিকে। কারণ, তারা মুসলিম। মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, দিনাজপুর, বাদ গেল না কেউ। ধরেই নেওয়া হল, মুসলমান এবং বাংলাভাষী, অতএব তারা বাংলাদেশি। তাই তারা অনুপ্রবেশকারী। তা নিয়ে বাংলা থেকে যত না প্রতিবাদ হল, তার চাইতে বেশি হল রাজনীতি। অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গেল রাজ্য-রাজনীতির নয়া সমীকরণ।
নয়া রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বিপন্ন করে তুলল আকবর-বাবরদের। কলোনির আরও যারা, এত কাল আশ্রয়, প্রশ্রয়ের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, ওদের অসহায়তায় ফিরে দেখেছে নিজের উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণাময় দিনগুলি, তারাও বলতে শুরু করল, ভাগাও এদের। ভয়ের আবহে প্রথমে বন্ধ হল স্টেশনে ওদের জুতো পালিশের কাজ। কেউ বকেনি, মারেনি। কিন্তু পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্ল্যাটফর্মে পাঁচজনের আলোচনা ভাল ঠেকছিল না ওদের। ট্রেনে-বাসে-পথে-আড্ডায় বহুল ব্যবহৃত শব্দ হয়ে উঠল অনুপ্রবেশ। রেল স্টেশনে, এখানে-ওখানে, দেওয়ালে, ল্যাম্প পোস্টে তখনও টিকে আছে চুন দিয়ে লেখা সন্তান দলের মন্ত্র 'রাম নারায়ণ রাম'। তবে তত দিনে দৃষ্টি টেনে নিয়ে অন্য স্লোগান চোখে পড়ে গাড়ির উইন্ড স্ক্রিনে সাঁটা নজরকাড়া স্টিকারে লেখা স্লোগান, ‘গরব্ সে কহো হাম সব হিন্দু হ্যায়’, ‘জয় শ্রী রাম’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মলিনা বিবি, সাদা নানি, কালো নানিরা একে একে চলে গেলেন।
পেটের টানে মুর্শিদাবাদের মইনুল শেখ, আমিনুল শেখরা তখন কলকাতায়। ওঁরা দুই ভাই এবং আমার কর্মস্থল তখন একই বাড়ি। দু’হাজার দুই তিন চার পাঁচ। ইএম বাইপাস ক্রমে হোটেল ও হাসপাতাল সরণি হয়ে উঠছে। কয়েক হাত পরপর মাথা তুলছে নিত্যনতুন বহুতল। ঠিকাদারের কৃপায় আরও অনেকের সঙ্গে মইনুল, আমিনুলরা যোগ দিয়েছে এমনই এক বহুতলের বহিরঙ্গের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে। সেটা খবরের কাগজের অফিস। মুশির্দাবাদের গ্রামের এই শ্রমিকেরা সিমেন্ট-বালিতে সৌন্দর্যায়নের কাজে বিশেষ পারদর্শী। সাধারণ নির্মাণ শ্রমিকের তুলনায় পারিশ্রমিক তাই খানিকটা বেশি। ওঁরা জানতেন না বাড়িটা খবরের কাগজের অফিস। আমরা, কাগজের লোকেরা সাংবাদিক এবং আরও নানা বিভাগের কর্মীরা ফাঁক পেলেই ভিড় করে দেখতাম কী ভাবে কোল্ড স্টোরের আদলে তৈরি হওয়া মূল বাড়িটা মইনুল, আমিনুলদের ছোঁয়ার বাকিংহাম প্যালেস হয়ে উঠল। অদূরে ঠিকাদারের দেওয়া ডেরাতে আরও অনেকের সঙ্গে রাত কাটে দুই ভাইয়ের।
পরিযায়ী শ্রমিক কথাটা তখন শুনিনি। কোনও খবর লিখিনি। শ্রমিক, শ্রমিক নেতা, শ্রমমন্ত্রী, কারও মুখে শুনিনি শব্দ দু’টি। খবরের কাগজ, টেলিভিশনের খবরে এ নিয়ে কোনও খবর, আলোচনা নজরে আসেনি। মইনুল, আমিনুল এবং ওদের আরও অনেকের সঙ্গে আমাদের তখন রোজকার আড্ডার সম্পর্ক। ওদের মুখেই জানতে পারি, মুর্শিদাবাদের গ্রামে জোয়ান ছেলেদের অনেকেই গ্রামছাড়া। কেউ কাজের সন্ধানে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। কেউ পুলিশের ভয়ে এলাকাছাড়া। সে জেলার খবর শিরোনামে আসে গঙ্গা-পদ্মা-জলঙ্গির ভাঙন আর সিপিএম-কংগ্রেস মারামারি-খুনখারাপির সুবাদে। ছাপা হয়, খোলা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু পাচার, মানুষ পাচার, নানা সামগ্রী চোরাচালানের খবর। আর ছাপা হয় আইএসআই চর ধরার রোমহর্ষক কাহিনি।
দিল্লি-কলকাতার প্রশাসনে তখন দারুণ সখ্য। আইএসআই চর আর মাওবাদী খুঁজতে ব্যস্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর পুলিশ। প্রশাসনের শীর্ষমহলের ইশারায় পুলিশ আইএসআইয়ের সন্ধানে হানা দেয় মাদ্রাসায়। সেগুলির বেশির ভাগেরই সরকারি অনুমোদন নেই। দানের টাকায় চলে। যে ভাবে চলে আর পাঁচটা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আরবি-ফারসি পড়ানো হয়। শিখতে হয় ইসলামের বিধান। ছাত্ররা নিয়ম করে নমাজ পড়ে। দু’য়ে-দু’য়ে চার করে কর্তাদের কাছে রিপোর্ট যায়। এলাকায় সন্দেহের মুখে পড়ে এমন অনেক মাদ্রাসা। তা থেকে চেনা মানুষের সঙ্গে মুখ দেখাদেখি, কথাবার্তা, পথেঘাটে দেখা হলে খোঁজখবর নেওয়ার সম্পর্ক ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়।
মাওবাদী খুঁজতে জঙ্গলমহল জুড়ে অভিযান চালায় পুলিশ, খোঁজ নেয়, কাগজপত্র, পরিচয়পত্র দেখে পরীক্ষা করে কে স্থানীয়, কে বহিরাগত। দিল্লির কর্তারা খুশি। তারা সাধ্যমত কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠায়। আধাসেনাকে সামনে রেখে চলা অভিযানে শত-শত তরুণ, যুবার স্থান হয় জেলে। গ্রামে গ্রামে তাতে ফল মেলে হাতে হাতে। বিরোধী স্বর উধাও। সিপিএম একচ্ছত্র। দু’হাজার তিনের পঞ্চায়েত ভোটে হাজার পাঁচেক আসন বিরোধীশূন্য। তার বেশির ভাগই জঙ্গলমহলে।
এক বিকালে আমিনুল কথার ফাঁকে গলা নামিয়ে জানায়, আগের রাতে তাদের ডেরায় পুলিশ এসেছিল। বছর তিরিশের যুবকের চোখ-মুখে ভয়, উৎকণ্ঠা। জানায়, পুলিশ সকলের কাগজপত্র চেক করেছে। যার কাছে যা ছিল দেখিয়েছে। সন্তুষ্ট হয়নি। এক পুলিশকর্তা বলেন, তোরা যে বাংলাদেশি নোস, প্রমাণ দিতে পারবি? ভারতীয় প্রমাণ করার নথি কারও কাছে নেই। সকলেই জন্মেছে বাড়িতে কাকিমা-জেঠিমা কিংবা দাইমার হাতে। জন্ম সার্টিফিকেটের তাই বালাই নেই। অমন সার্টিফিকেটের কথাও বেশির ভাগের অজানা। মাধ্যমিক দূরের কথা, প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোয়নি প্রায় কেউই। কাগজপত্র বলতে একমাত্র রেশন কার্ড। সেটা সঙ্গে নিয়ে এলে রেশনের কী হবে। বাড়ির লোক কী খেয়ে বাঁচবে। তবু, পুলিশের হুকুম। কাগজ দেখাতেই হবে। মইনুল এবং আরও কয়েক জন তাই গ্রামে গিয়েছে কাগজ আনতে। কাগজ দেখানো হয় পুলিশকে। কিন্তু সন্দেহ যায় না। ঠিকাদারের উপর নির্দেশ জারি হয়, এলাকা ছাড়ার আগে থানায় জানাতে হবে। আমিনুল, মইনুলরা সেই থেকে হয়ে যায় সন্দেহভাজন বাংলাদেশি। কথায় কথায় এক দিন বলেছিল, তাদের পূর্ব পুরুষেরা ছিল নবাব পরিবারের কর্মচারী।
বিক্রম সেন তখন খুবই ব্যস্ত। প্রায়ই মুর্শিদাবাদ অথবা দিল্লি ছুটতে হয় তাঁকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পদস্থ এই আমলা কেন্দ্রীয় সরকারের জনগণনা বিভাগের পূর্বাঞ্চলের অধিকর্তা তখন। তাঁরই অফিসের উপর দায়িত্ব বর্তেছে বহুমুখী জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজের। রাজ্যে সে কাজ প্রথমে হবে মুর্শিদাবাদ ব্লক আর জিয়াগঞ্জ শহরে।
সংসদে সদ্যই পাশ হয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-২০০৩। তাতে জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিকত্বের অধিকারের ধারাটিকে আরও কঠিন, কঠোর করল বাজপেয়ী সরকার। একপ্রকার সর্বসম্মতিতেই পাশ হয়ে গেল বিল। অনুপ্রবেশ ইস্যুতে বিজেপির তখন অনেক বন্ধু। সংসদে, সংসদের বাইরে। ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইনে সদ্য স্বাধীন দেশ জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের যে মুক্তধারা যুক্ত করেছিল, ১৯৮৭-র সংশোধনীতে তাতে জুড়ে দেওয়া হল বংশগত সম্পর্কের শর্ত। তার আগে এমনই শর্ত জুড়ে অসম চুক্তি করলেন যুবা প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। ১৯৮৫-তে অসম চুক্তির দু’বছরের মাথায় সংশোধনী এনে বংশভিত্তিক নাগরিকত্ব বাধ্যতামূলক করা হল। নাগরিকত্ব নিয়ে সংবিধান প্রণেতাদের উদার ভাবনার সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে যুক্ত করা হল বাবা কিংবা মায়ের এদেশের নাগরিকত্বের বাধ্যতামূলক শর্তটি। এ দেশে জন্ম নেওয়া শিশুর বাবা অথবা মা’কে এক জনকে বৈধ ভারতীয় নাগরিক হতেই হবে। সেই সঙ্গে যুক্ত হল অবৈধ নাগরিক চিহ্নিত করার বিধান।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন দেশ বলে ঘোষণা করে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে তাঁর দেশকে মুক্ত করার ডাক দিয়েছিলেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাক বাহিনীর অত্যাচারের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন লাখ লাখ বাঙালি। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা এক কোটির মতো। তাদের আশ্রয় দিতেই সীমান্ত চৌকি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। অসম আন্দোলনে সংঘাতের মূলে ছিল এই বাঙালিদের তাড়ানো। সেই দাবি মেনে নিয়েছিলেন ইন্দিরারই পুত্র রাজীব, শুধু অসম চুক্তিতে সায় দিয়ে। বাজপেয়ী, আডবাণীদের নয়া পার্টির বয়স তখন সবে সাত। নিতান্তই শৈশব। তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি এজেন্ডায় শিলমোহর পড়ে গিয়েছিল তখনই।
২০০৩-এ সেই একই আইনের একই ধারায় সংশোধনী এনে বলা হল বাবা কিংবা মায়ের যে কোনও এক জন শুধু ভারতীয় নাগরিক হলেই চলবে না, অপর জন নাগরিক না-হলেও তাঁকে অবশ্যই এ দেশে বৈধ বসবাসকারী হতে হবে। তাতেই নয়া মাত্রা পেল আইএসআই ধরার অভিযান। কারগিলের পাহাড় টপকে পাক জঙ্গি, মিলিটারির ভারতে ঢুকে পড়া, সেই সূত্রে যুদ্ধের পরিনামে এল মাল্টি পারপাস ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড তথা এমএনআইসি। বিএসএফ, মিলিটারি নয়, পাক চরেদের ঢুকে পড়া, শক্রসেনার আনাগোনা টের পেয়েছিল এলাকার মেষ পালকেরা। তারাই খবর দিয়েছিল দেশের সেনা ছাউনিতে। তবু বাজপেয়ীর তৈরি মন্ত্রিগোষ্ঠীর সুপারিশ ছিল দেশের সুরক্ষায় সীমান্ত এলাকায় নাগরিকত্ব যাচাই দরকার অবিলম্বে। সীমান্তবর্তী বারোটি রাজ্যের বাছাই করা জায়গায় তাই শুরু হল এমএনআইসি তৈরির কাজ। বাংলার প্রশাসন বাছাই করল মুর্শিদাবাদ ও জিয়াগঞ্জ ব্লক। আসামের বাইরে এনআরসি তৈরির কাজ শুরু সেই প্রথম।
এমএনআইসি-র সচিত্র পরিচয়পত্রের জন্য পারিবারিক ঠিকুজির সঙ্গেই নেওয়া হল বায়োমেট্রিক তথ্য। চোখের মণির ছবি এবং হাতের আঙুলের ইলেকট্রনিক ছাপ। কিন্তু বাদ সাধল নথি। নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে পারলেন না অর্ধেকের বেশি নাগরিক। তিন-চার পুরুষের বাস, এমন পরিবারগুলিও তেমন কোনও নথি হাজির করতে পারলেন না নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে প্রশাসনের কাছে যা গ্রাহ্য হতে পারে। নয়ের দশকের মাঝামাঝি বিধ্বংসী বন্যা ভিটেমাটির সঙ্গেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় জমি-জায়গার দলিল এবং আরও যা যা কাগজপত্র ছিল, সব। পঞ্চায়েত, সরকারি দফতর নতুন কাগজ আজ দেব, কাল দেব করে দেয়নি। উল্টে বছরভর বন্যায় কাগজ সংগ্রহের তাগিদটাই উবে যায় একটা সময়। তারই জেরে প্রশাসনের সামনে নিজ ভূমে পরদেশি সাব্যস্ত হলেন বহু মানুষ। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, বাদ গেলেন না কেউ। এমএনআইসি নিয়ে আর এগোয়নি সরকার। কিন্তু মডেলেই বুঝে নিয়েছে, এনআরসি-তে কত ধানে কত চাল। অদূরে, ঢিল ছোড়া দূরে বাংলাদেশ। বিস্তর সন্দেহ, সংশয় মাখিয়ে মিডিয়ায় ছাপা হল অ-নাগরিক বৃত্তান্ত। তাতে কি-ওয়ার্ড‒ 'ইনফিলট্রেটর'।
হুঁ।
২০০৩ এ ওই আইনটা সবাই সই করেছিল। সবকটা দল।
একদম ঠিক বলেছেন । সোদপুর 1নং দেশবন্ধু নগর কে শিক্ষা নগরী বলা যেতেই পারে। আমার বাবা বলতেন মানুষ গুলো কি খাবে কোথায় থাকবে ঠিক করার পরে স্কুল তৈরি করেছিল। আর আপনার মা জীবনে র প্রায় শেষ লগ্নে ও সেই স্কুল গুলো র উন্নতি তে হাত লাগিয়েছিলেন ।