আরও কয়েকজনের মতো রোজ সকালে আমার কাছের মানুষদের একজন সুকান্তর কাছ থেকে দিন শুরুর শুভেচ্ছা পাই। হোয়াটসঅ্যাপে তাকালেই দেখতে পাই সুকান্তর পাঠানো একটিমাত্র শব্দ—শুভেচ্ছা। শুক্রবার সকালে সুকান্ত সঙ্গে একটা ভিডিও পাঠিয়েছে। এক ভদ্রলোকের পাখির ডিমের পরিচর্যা, পরম নিষ্ঠা, যত্নে ডিম ফুটিয়ে শিশু পাখিকে পৃথিবীর আলো দেখানোর আয়োজন, তারপর একটু একটু করে সেটিকে বড় করে তুলে ডানা মেলে উড়তে সেখানোর নিপুণ বর্ণনা। এক কথায় পাখির সিঙ্গল প্যারেন্টহুডের গল্প।
অশোকদা, বর্ষীয়ান সাংবাদিক অশোক বসু রোজ সকালে একটি ছবি পাঠান। নিজের তোলা, অথবা ওঁকে কারও পাঠানো ছবি। সেই সব ছবি আসে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে। বেশিরভাগ ছবিতেই কোনও না কোনওভাবে বিরাজ করে প্রকৃতি। সেই কবে, অনেককাল আগেই, ব্যক্তিগত বোধ, উপলব্ধি থেকে প্রকৃতির প্রতিশব্দ করেছি ‘সম্পর্ক’। সম্পর্ক থাকলে, টিকিয়ে রাখলে, আসে দায়। দায় পালন করলে সম্পর্ক টিকে যায়, মজবুত হয়। একেই বুঝি বিজ্ঞানে বলে বাস্তুতন্ত্র। আমি অন্তত এভাবেই বুঝতে শিখেছি।
অশোকদার পাঠানো ছবিগুলির মধ্যে নিজের উপলব্ধিকে খুঁজে পাই। এই করোনাকালে, লকডাউনের সময়ে থমকে যাওয়া জনজীবনেও ছবিগুলিতে বেশ জাগ্রত নানা ধরনের সম্পর্ক। এই তো দিন পাঁচ-ছয় আগে অশোকদা পাঠালেন নিজের মোবাইলে তোলা ছবি—একটা কংক্রিটের চাতালের চারধারে ডালপালা মেলেছে কিছু আগাছা, মাঝখানে একদল কাক কিছু খাচ্ছে। অশোকদা ক্যাপশন লিখে পাঠিয়েছেন, প্রাতরাশ। আরও কিছুদিন আগে অশোকদা তাঁর পরিচিত অপূর্ব সিংয়ের তোলা একটি ছবি পাঠালেন। পক্ককেশ প্রবীণের কোলে এক দুধের শিশু। ছবির ভাষাতেই বেশ মালুম হয়, নবীন-প্রবীণের ভাব-বিনিময় মুহূর্তের ছবি। অশোকদার ক্যাপশন—কথোপকথন।
দুধের শিশুরা সব বিশ্ব নাগরিক। তারা এক ভাষায় কথা বলে। সে ভাষা মাতৃভাষা নয়। আমরা বড়রা, বুঝি না সে ভাষা। শুনি কিছু মজাদার শব্দ। সেই সব শব্দ পুত্র-কন্যা, সাদা-কালো, ভারতীয়-পাকিস্তানি-বাংলাদেশি, বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান-ইওরোপিয়-আমেরিকান-আরব-আফ্রিকা, গৃহবাসী-গৃহহীন-বেদুইন, পারিবারিক সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে। শিশুদের অভিন্ন ভাষায় বাধা পড়েছে গোটা পৃথিবী। অবোধ্য সেই শব্দগুলিই একমাত্র আন্তর্জাতিক ভাষা।
কিছুদিন আগে, এক শনিবার সকালে এক সহকর্মী পাঠালেন বেশ কিছু তাজা গাছের গোটা দশেক ছবি। তাতে জবার মতো পরিচিত ফুলের গাছ, আম, নিমের চারা, বাঁশের চটা বেয়ে বেড়ে ওঠা উচ্ছের লতা, আরও কত কী। সঙ্গে সে লিখেছে, পরিবেশ দিবসের শুভেচ্ছা সবাইকে। পৃথিবী সবুজ থাক।
হোয়াটসঅ্যাপের কল্যাণে বিশেষ বিশেষ দিনগুলির কথা, তাৎপর্য সম্পর্কে ঘরে বসে, সহজেই অনেক কথা জানা, শেখা যায়। ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসের হোয়াটসঅ্যাপ উদযাপন অবশ্য নতুন নয়। কিন্তু পরিবেশ দিবসের শুভেচ্ছা পেলাম এই প্রথম। সহকর্মীকে লিখলাম, অনেক শুভকামনা। এরকম ছোট ছোট ফুল গাছ দেখলে মায়ের কথা মনে পড়ে। পরম মমতায় ফুল-ফলের গাছের যত্ন করত মা। অনটনের সংসার সামলে গাছ-গাছালির যত্ন নেওয়াই বুঝি ছিল ক্ষণিকের বিশ্রাম মায়ের। তখন ঘুলঘুলির ঘর থেকে মাঝেমধ্যেই চড়ুইয়ের ছানা পড়ে আহত হত। সারাদিন ধরে চলত সেটির শুশ্রূষা। অন্তত একটি বিষধর সাপ কিংবা বিছার আবির্ভাব ছিল বাৎসরিক ঘটনা, যেগুলির এক ছোবলে মৃত্যু অনিবার্য জেনেও হত্যা না করে তাদের নিজেদের আস্তানায় চলে যেতে দেওয়াই ছিল সর্বগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত।
সেই সব দিনে প্রকৃতি বাঁচাও, সবুজ বাঁচাও, গাছ বাঁচাও বলে হাহাকার ছিল না। এত সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ছিল না। পরিবেশ দিবস বলে কিছু ছিল না। কিন্তু পরিবেশ দিবসে এখন এবং বিগত কয়েক দশক ধরে যা হয়ে আসছে, সারা বছর সেটাই করতেন শিবপ্রসাদ নাগ। আমাদের কলোনির স্কুলের হেডমাস্টার মশাই। স্কুল ছুটির পর তিনি বসতেন পড়াশুনোয় দুর্বল ছেলেদের নিয়ে। আর ছিল গাছের যত্ন-আত্তি। কেউ কি জানে, পরিবেশ দিবস আর বৃক্ষরোপণ সপ্তাহে এযাবৎ কত গাছ লাগানো হয়েছে? সরকারি কোষাগার থেকে কত অর্থ ব্যয় হয়েছে সেই খাতে। অনুমানে বলাই যায়, নেতাদের প্রতিশ্রুতিকে সিঁড়ির ধাপের মতো সাজালে যেমন চাঁদে পৌঁছে যাওয়া যাবে, যত গাছ পোঁতা হয়েছে, তার সিকিভাগ বাঁচলে নতুন চারা রোপণের জায়গা থাকত না আর। হেড স্যার সেই কবেই বুঝেছিলেন, শিশুর মতো গাছকেও একটা বয়স পর্যন্ত আগলে আগলে রাখতে হয়। একটা বয়সের পর সে নিজেকে নিজে রক্ষা করে চলে। শিবপ্রসাদ নাগ অবসর নেন প্রায় চার দশক আগে। প্রয়াত হয়েছেন আড়াই-তিন দশক হল। তাঁর যত্নে বেড়ে ওঠা গাছগুলি আজও দিব্যি আছে। সেই গাছগুলির দিকে চেয়ে মনে হয়, গাছ লাগানো চলুক। কিন্তু নাগরিক কর্তব্য বোধহয়, সরকার-পুরসভার উদ্যোগে রাস্তার ধারে লাগানো গাছটিকে দত্তক নেওয়া। দিনে কিংবা সপ্তাহে একদিন অন্তত খোঁজ নেওয়া, কেমন আছে শিশু গাছটি।
থাইল্যান্ডের বিমা কোম্পানির সেই ভিডিও-টি সারা বছর সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাফেরা করে। দোতলা বাড়ির নল থেকে পথচারী তরুণের গায়ে এসে পড়ল নোংরা জল। বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে সে রাস্তার ধারের টবে অযত্নে মরতে বসা ফুল গাছটিকে সেই জলধারার নীচে বসিয়ে দেয় সে। ক’দিন পর সে গাছ ফুলে-ফলে পল্লবিত। এল মৌমাছি, প্রজাপতি। সম্পর্কের ছোঁয়ায় কী জাদু। সেই তরুণ পথচলতি দুর্বল মহিলা ফেরিওয়ালাকে গাড়ি টানতে সাহায্য করে, একাকী বৃদ্ধার ফ্ল্যাটে খাবার পৌঁছে দেয়, পথের ভিখারিণীকে মোটা অর্থ দান করে। দানের টাকায় সে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে। স্কুল ফেরৎ নাবালিকার মুখে সাধ পূরণের হাসি। দিনের শেষে সেই তরুণ নিজের খাবার ভাগ করে নেয় প্রিয় কুকুরটির সঙ্গে। এভাবেই সম্পর্কের জাল বুনে চলে সে। জীবনের আসল বিমাও তো সেই সম্পর্কই। ওটাকে অস্বীকার করে…।
আমাদের ছোটবেলায় বাড়িতে ছোটদের জন্য নিয়ম ছিল, সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধোয়ার পর নিজে কিছু মুখে দেওয়ার আগে রুটি-মুড়ি-বিস্কুট, যা হোক কিছু আগে উঠোনে ছড়িয়ে দিতে হবে। ওসব বাড়ন্ত হলে, চাল-গম-খুদ দিতে হত। কাক-শালিক-চড়ুই এসে খেয়ে যেত। কাকেরা শক্তিশালী। তারাই বেশিরভাগটা সাবার করে দিত। লাঠি উঁচিয়ে হুঁস হুঁস করে কাক তাড়িয়ে শালিক, চড়ুইয়ের খাওয়ার সুযোগ করে দিতে হত। সেই সব দিনে যে যে অপরাধে মায়ের হাতে হাত পাখার ডাঁটির বাড়ি খেতে হয়েছে তার একটি হল, সকালে কাক-শালিককে প্রাতরাশ দিতে ভুলে যাওয়া।
সেই সব দিনে, বড়রাও নিয়ম করে একটা জিনিস নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। দুপুর-রাতে খাওয়ার পর শেষপাতের এক দলা ভাত, মাছের মাথা, কাঁটা, এসব নিয়ে সটান হাজির হতেন কুয়োতলায়। পাড়ার কুকুর-বিড়ালেরা জানত কোন বাড়ির কে, কখন, কোথায় ওদের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করবে। ওদের শরীরেও কাজ করে বায়োলজিক্যাল ক্লক। কী অপূর্ব।
স্ট্রিট ডগ কথাটা আজকাল খুব শুনি। কথাটা কানে বাজে। কিন্তু বাস্তব সেটাই। বছর কয়েক আগেও রাস্তার কুকুর কথাটা শুনিনি। এ বাড়ির কুকুর, ও বাড়ির বিড়াল, সবই ছিল পাড়ার পোষ্য। গোটা পাড়া ছিল ওদের বাবা-মা-ভাই-বোন-দাদা-দিদি। এখন ওরা স্রেফ রাস্তার কুকুর। পাড়ার কোনও দায় নেই। সম্পর্ক ভেঙে চুরমার। কেউ ওদের ভালোবেসে খাওয়ায়। কারও তাতেও ঘোর আপত্তি। তা নিয়ে তর্কাতর্কি, সংঘাত খুনোখুনি পর্যন্ত গড়িয়ে যাচ্ছে। নাগরিক জীবনের নয়া উৎপাত স্ট্রিট ডগ। পাড়ার মোড়ে, গলির মুখে ‘কুকুর হতে সাবধান’ সাইনবোর্ড এলো বলে। কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ বা আইসার-এর এক সমীক্ষাপত্র বলছে, এ রাজ্যে ৬৩ শতাংশ সারমেয়র মৃত্যুর নেপথ্যে রয়েছে মানুষের হাত। স্রোতের উল্টো দিকে, চাঁদা তুলে পাড়ার কুকুরের চিকিৎসা, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের বিচ্ছিন্ন আয়োজনগুলি তাই মিডিয়ার এখন বড় খবর।
বছর কয়েক আগে রেঙ্গুন, মানে অধুনা ইয়াঙ্গনে এক সকালে হাঁটতে বেরিয়ে শুনি, গোটা শহর জুড়ে পাখির কলতান। ভোরের আলো ফোটার আগে কিছু মানুষ ছোলাভাজা, ডালভাজা নিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, পার্কের গেটে বসে পড়েছেন। পথচলতি মানুষ তাদের হাতে টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। দোকানিরা ছোলাভাজা, ডালভাজা ওজন করে ফাঁকা রাস্তায়, পার্কে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। পাখিদের প্রাতরাশ। ক্ষণিকের হলেও শহর হয়ে উঠছিল পাখিদের অভয়ারণ্য।
শনিবার গেল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশ যদিও এখন সারা বছরের চর্চার বিষয়, তবু এই দিনে নানা, আয়োজনে, অনুষ্ঠানের আলোচ্য বাড়তি মাত্রা পায়। বিকালে সুন্দরবনের বিপন্নতা নিয়ে আড়াই ঘন্টার ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সেখানকার মানুষের বলা কথাগুলি কানে বাজছিল। বিশেষজ্ঞ বক্তা, সাংবাদিকদের উপলব্ধি, পর্যবেক্ষণ থেকে তা আলাদা। বছর বছর ঘূর্ণিঝড় এবং পরিবেশজনিত নানাবিধ সমস্যা ঘিরে সেখানে মাথাচাড়া দিচ্ছে রুটিরুজির সংঘাত। পরিবেশের সঙ্গে অকৃত্রিম সম্পর্ককে অস্বীকার করে এগতে গিয়ে তারই রোষে বিপন্ন গোটা ব-দ্বীপ, এলাকাবাসী তা জানেন, বোঝেন। সেই বিপন্নতা ভাঙন ধরাচ্ছে পরিবারে, সমাজে।
কী আশ্চর্য, পরিবেশ রক্ষার অনেক উদ্যোগও যেন খানিক সম্পর্ককে অস্বীকার করারই আয়োজন। ফুসফুস বনাম পাকস্থলীর লড়াই। বাতাসে দূষণ ছড়ানোর অপরাধে কারখানার দরজায় তালা পড়ছে। ফুসফুসের জন্য নিশ্চিত করা যাচ্ছে বুক ভরা বিশুদ্ধ বাতাস। কিন্তু বন্ধ করে দেওয়া সেই কারখানার শ্রমিকের পেট চলবে কীভাবে, সেই প্রশ্নের জবাব মেলা দূরে থাক, আলোচনাতেই তা স্থান পাচ্ছে না। শ্রমিকের সঙ্গে সম্পর্ককে স্বীকার করছে না সমাজ, রাষ্ট্র। ওঁদের দায় তাই কারও নয়।
এনভিরনমেন্টাল রিফিউজি বা জলবায়ু শরণার্থী শব্দ দুটি আজকাল খুব চালু। পরিবেশের বিপন্নতার কারণে ঘর-বাড়ি, বসত এলাকা ছাড়তে হচ্ছে লাখ লাখ মানুষকে। সুন্দরবনের এমন কত মানুষ দেশের নানাপ্রান্তে জীবন-জীবিকার লড়াই চালাচ্ছেন কেউ খোঁজ রাখেন না। আবার পরিবেশ রক্ষার আয়োজনেও জীবন-জীবিকা বিপন্ন বহু মানুষের। দূষণ ছড়ায় বলেই কলকাতার পূর্বতম প্রান্তে গড়ে উঠেছিল ট্যানারি শিল্প। ক্রমে শহরটা পূর্ব দিকে বাড়ল। বর্ধিত শহরের মানচিত্রে ট্যানারি পড়ল শহরের প্রায় মাঝখানে। ফতোয়া জারি হল, দূর হটো। বানতলায় সরে গেল চামড়ার শতাব্দী প্রাচীন কারবার। নতুন জায়গায় কাজ জুটল না দুই-তৃতীয়াংশেরই। কর্মহীন এই শ্রমিকেরা কেন পরিবেশ-শরণার্থী বলে গন্য হবেন না? পরিবেশ রক্ষা ঘিরে উদীয়মান এই শ্রেণি সংঘাত নিয়ে আমরা কী ভাবছি?
আমফান, ইয়াসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বাঁধ নতুন করে মেরামত করতে হবে। ভেঙে পড়া বাঁধ যেখানে ছিল তার থেকে আর ভিতরে হবে নতুন বাঁধ। তা না হলে বিস্তীর্ণ জনপদকে পরের ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করা যাবে না। কিন্তু জমির কী হবে? সে প্রশ্ন ঘিরে বাঁধ পুনর্নির্মাণের ঘোষণায় আনন্দ, সঙ্গে চাপা আতঙ্ক, দুই-ই আছে। জমি চলে গেলে খাবো কী, প্রশ্ন অনেকের।
এত গেল পরিবেশের রোষ মোকাবিলার উদ্যোগ। সমুদ্র ঘিরে সামরিক প্রস্তুতি, আর বাণিজ্য ভাবনা যে দিকে এগোচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবন ঘিরে ‘মহা-উন্নয়ন’ অসম্ভব নয়। কে বলতে পারে, তখন আবার রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যসাধনের দায় স্বীকার করতে উন্নয়নের বলি হতে হবে না।
তিন দশক আগে, ১৯৯১-এর ২৪ জুলাই কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে দেশকে উদার অর্থনীতির পথে চালিত করার কথা ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং। সেই নীতির ভালো-মন্দ, পাল্লা ভারী দু-দিকেই। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, ফোন, রান্নার গ্যাস, হাতে হাতে মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ, রাস্তায় সারি সারি বিদেশি গাড়ি, মোটা টাকা ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, সুদৃশ্য ফ্ল্যাট, উদার অর্থনীতি দিয়েছে আরও কত কী। নীতি না বলে তাকে সংস্কৃতি বলাই ভালো। বেশ মনে আছে, রাষ্ট্রীয় স্তর থেকে অর্থনীতির উদারতার পথে হাঁটার যে দৃষ্টান্তগুলি দীপ্যমান হয়েছিল তার সব ক’টিই ছিল সম্পর্ককে অস্বীকার করার আয়োজন। রাষ্ট্রীয় সংস্থার কর্মচারীদের চাকরি থেকে মাঝপথে বসিয়ে দেওয়ার প্যাকেজের গালভরা নাম রাখা হয়েছিল—গোল্ডেন হ্যান্ডশেক। পকেটে এককালীন কিছু টাকা ভরে দিয়ে চাকরিটি খেয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। সেই পর্বে সরকার ছিল অনেকটা বাসের সেই সহৃদয় যাত্রীর মতো। যিনি প্রথমে সহযাত্রীর পকেটটি মেরে দেন। তারপর কন্ডাক্টর সেই সহযাত্রীর কাছে ভাড়া চাইলে ঠগ যাত্রীটি বিপন্ন সহযাত্রীর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ভালোমানুষি করেন।
উদার অর্থনীতি আম ভারতীয়কে ভালো থাকার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। স্বপ্ন সফল করার রাস্তা বাতলে দিয়েছে। শিখিয়েছে কীভাবে রোজগার বাড়াতে হয়। শিখিয়েছে রোজগার বাড়াতে শুধু সোজা পথে হাঁটলে চলবে না। স্বচ্ছন্দ হতে হবে বাঁকা পথেও। আর শিখিয়েছে, সম্পর্ক নিয়ে বেশি মাথা ঘামিও না। ওটা পাহাড়ের মেঘমুক্ত আকাশের মতো। যতক্ষণ আছে, ততক্ষণই সই। নেই তো নেই। আক্ষেপ করা বাতুলতা। আকাশ আলো করে যে সূর্যটা উঠবে, সেটা নতুন। আগেরটা নয়। উদার হও। পুরনো যা কিছু, ভুলে যাও, ফেলে দাও। সর্বদা নূতনের আবাহন করো। সেই মন্ত্র, সেই ভাবনা থেমে নেই শুধু মানুষে মানুষে সম্পর্ক নসাৎ করাতে। গাছ-ফুল-ফল-পাখি-কুকুর-বিড়াল, কোনও কিছুরই প্রয়োজন, সম্পর্ক তেমন অনুভব করে না সে। সুতোর মতো ঝুলছে যেটুকু তা বড় ফংফংয়ে।
পরিবেশের সংকট গত তিরিশ বছরে দ্রুত হারে বেড়েছে সে কথা সত্য। কিন্তু এই সমস্যা এই পর্যায়ে পৌঁছেছে অনেক যুগ ধরে। শুধু উদারীকরণকে দোষ দিয়ে নন্দঘোষ বানানোটা অতি সরলীকরণ। শিল্পবিপ্লবকে হিসাবের গোড়া হিসেবে ধরা হয়। আর সেই কারণেই আন্তর্জাতিক স্তরে ‘ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা’র প্রসংগটি ওঠে। আর আজকের সময়ে জোরদার হয়ে উঠছে আরেকটি প্রসংগ। নাগরিক দায়বদ্ধতা।
পরিবেশ মানুষকে বাদ দিয়ে নয়।
পরস্পরের ছোট-বড় প্রয়োজন, স্বাধীন ইচ্ছা-অনিচ্ছা-স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে টিকতে পারে না কোনও সম্পর্ক।
প্রথম পর্ব পড়ে মনে পড়ল গানটির কথা। হিন্দি-পঞ্জাবি মিশিয়ে হলেও আবেদনে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ভাষান্তর না-ই বা করলাম:
“...
ও ইকোফ্রেন্ডলি, নেচার কে রকষক, ম্যায়ঁ ভি হুঁ নেচার
রিওয়াজো সে, সমাজো সে, কিউঁ তু কাটে মুঝে, কিঁউ বাঁটে মুঝসে ইস তরাহ
কিউঁ সাচ কা সবক শিখায়ে, জব সাচ সুনভি না পায়ে
সাচ কোই বোলে তো, তু নিয়ম কানুন বাতায়েঁ
তেরা ডর…
তেরা প্যায়ার…
তেরি ওয়াহ্…
তু হি রাখ
...
সড্ডা হক, অ্যাত্থে রাখ
”
ভাল লাগল পরিবেশ প্রতিশব্দ সম্পর্ক। পরের পর্ব কবে?
একদম মনের কথা, প্রাণের কথা - অপেক্ষায় থাকলাম পরের পর্বের...