ক্যামেল স্যারের হাতে ছড়ি ওঠার ঘটনাটা মনে পড়ে গেল ধীরেন স্যারের খবরটা পেয়ে। দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে তত ক্ষণে শিয়ালদাগামী ব্যারাকপুর লোকাল ঢুকে পড়েছে৷ মোবাইল বেজে উঠল৷ দাদা জানতে চাইলেন, ‘তুই কোথায়? বেরিয়ে পড়েছিস?’ বললাম, ‘ট্রেনে উঠছি, অফিস যাচ্ছি৷’ দাদা বললেন, ‘ধীরেন স্যার সকালে চলে গেলেন৷ স্কুলে বডি আসছে৷ এক বার ঘুরে যেতে পারিস কি না দ্যাখ৷’ মোবাইলে কথা বলতে বলতেই আমি ভিড় ঠেলে কামরার অনেকটা ভিতরে ঢুকে পড়েছি৷ একে গুঁতোগুতি ভিড়। তার উপর পিঠে ব্যাগ, কানে ফোন। যাচ্ছেতাই অবস্থা। কথা বলতে বলতেই সহযাত্রীদের চোখ-মুখে বিরক্তি টের পাচ্ছি। তবে ফোনালাপ শুনে হয়তো কেউ কেউ অনুভব করলেন পরিস্থিতিটা।
ধীরেন স্যারের বাড়ি, পরের স্টেশন আগরপাড়ায়, প্ল্যাটফর্ম থেকে ঢিল ছোড়া দূরে৷ আগরপাড়ায় নেমে স্যারের নিথর দেহটার সামনে দু’দণ্ড মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, পরের ট্রেনে যাত্রা করলেই হত৷ সে উপায় যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ট্রেন বেলঘরিয়া, দমদম পেরিয়ে গেল৷
শুধু কি সেই কারণেই আগরপাড়ায় নামতে পারলাম না? ভিড় ঠেলে আগরপাড়ায় নেমে যেতে পারতাম না কি? নিজেকেই প্রশ্নটা করলাম৷ কী হত, ভিড় ঠেলে নামতে গেলে? সহযাত্রীরা বড়জোর দু’কথা শোনাত, এত ক্ষণ কি নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন? নামার কথা মনে ছিল না! এত ক্ষণে নামার সময় হল? এ সব তো প্রায় রোজই শুনি৷ আমি বা অন্যরা৷ সে দিনও না হয়, এই কথাগুলিই ফের শুনতাম, নেমে তো যেতেই পারতাম৷ কেন নামলাম না? আমাকে আমি জবাব দিতে পারিনি৷
দমদম ছাড়ার পর লটারি জেতার মতো একটা সিট পেয়ে গেলাম৷ কেউ ভাবতে পারেন, এ আবার কী কথা! ট্রেনের সিট পাওয়ার সঙ্গে লটারি জেতার কী সম্পর্ক? বছর কয়েক আগেও কিন্তু এমনই ছিল পরিস্থিতি। কেউ একটা সিট পেয়ে গেলে পরিচিত সহযাত্রীরা বলে উঠতেন, যা! একটা লটারি হাতছাড়া হয়ে গেল তো? আপনি তো বঙ্গলক্ষ্মীর খরিদ্দার তাই না? এক লাখ টাকা, বুঝলেন এক লাখ। মিছিমিছি লাখপতি হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলেন।’
সে দিন সিট পেয়ে যাওয়াটা আমার কাছে লটারি জেতার থেকেও বেশি মনে হচ্ছিল। বসার মুহূ্তে মনে হচ্ছিল দুর্মূল্য কিছু পেয়েছি, হাতছাড়া করা যাবে না। আসলে নিজেকে জবাব দেওয়ার জবাব খুঁজছিলাম আমি। রোজ কত কষ্ট করে, রীতিমত লড়াই করে যাতায়াত করি, আজ যখন সিটটা পেয়ে গেছি, তখন শিয়ালদা পর্যন্ত যাই। এমন দিন তো তেমন একটা আসে না। নিজেকেই বুঝ দিই, ধীরেন স্যারের বাড়ি তো আগরপাড়া স্টেশন থেকে মাত্র কয়েক পা। এক দিন অফিস যাতায়াতের পথে না-হয় আগরপাড়ায় নেমে যাব, অথবা অফ-ডে’তে সাইকেলে করে এসে ঘুরে যাব।
এক বার ভাবলাম, নেমে তো যেতেই পারতাম আগরপাড়ায়। কিন্তু তাতে অফিসের দেরি হয়ে যেত। সেটা কি ঠিক? আমি তো আফটার অল একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। তারা আমাকে মাইনে দেয়। স্কুলের মাস্টার মশাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে তাঁর বাড়ি ছুটে যাওয়ার জন্য বিলম্ব মানবে কেন অফিস? আমি নিজেই তো খবরের কাগজের পাতায় ফাঁকিবাজ সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। আমি কী করে অফিসে দেরি করে যাব?
এ সব সাত-পাঁচ যত ভাবি ততই যেন শরীরটা সিটের সঙ্গে সেঁটে যায়। অজুহাত গোছাতে গোছাতে এটাও টের পাই শরীরে-মনে একটা বোঝাপড়া চলছে। মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে সামনে। ক্যামেল স্যার যে ভাবে টেবিলে ঝুঁকে পড়েছিলেন, অনেকটা যেন সেই রকম?
চিন্তার সূত্রটা ছিঁড়ে যায় ভিড় উজিয়ে কানে আসা নানান কথায়।
ফার্স্ট কিংবা লাস্ট, তাজা খবর কাটাছেঁড়ায় লোকাল ট্রেনের কামরায় দিনভর তখন ‘প্রাইম টাইম’ আলোচনা৷ টিভির আলোচনার মতো এখানেও পক্ষ-বিপক্ষ দু’টো প্যানেল তৈরি হয়ে যেত। আরও অদ্ভুত লাগত, এক-দু’জন কী চমৎকার অ্যাঙ্করের ভূমিকা পালন করতেন। একনাগাড়ে বলতে থাকা যাত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘আপনি এবার থামুন। একাই বলবেন শুধু? উল্টো দিকের কথাও তো শুনতে হবে।’ এই বলে আর এক জনকে বলতেন, ‘বলুন, বলুন, আপনি বলুন।’
সেই ছবিটা বদলে দিয়েছে মোবাইল। এখন ট্রেনে সময় কাটানোটাও যার যার তার তার। দুই বন্ধু একসঙ্গে গুঁতোগুতি করে উঠল। এক জন আর এক জনের জন্য সিট দখল করল। তার পর যে যার মোবাইলে ডুবে গেল। যেন কেউ কাউকে চেনে না।
বছর কয়েক আগে, তখনও হাতে হাতে মোবাইল ওঠেনি, পাশাপাশি বসে এক জন আর এক জনের মোবাইলে চোখ রাখত।হেডফোনের দু’প্রান্ত দু’জনের কানে, এমন দৃশ্যও খুব চেনা হয়ে গিয়েছিল। সে সবের পালাও চুকেবুকে গেছে।
মোবাইল আসার আগে ছিল অন্য রকম। যাকে বলে ব্রেন খোলসা করে নেওয়ার কর্মশালা। পাবলিক স্পিকিং স্কুল বললেও ভুল বলা হত না। এলেবেলে আলোচনা, যাকে বলে গুলতানি করা, বহু দিনই সে সব ছাপিয়ে সিরিয়াস বিষয়ে রীতিমতো তর্ক-বিতর্ক হত। বিষয়বস্তু নির্ধারণে খবরের কাগজের প্রথম পাতার প্রধান খবরের প্রভাব টের পাওয়া যায়।
এক দিন, ভিড়ের মধ্যে সেট হয়ে নিয়ে এক জন আর এক জনকে বললেন, ‘খবরটা পড়লেন? কী অবস্থা বুঝুন। কী দিনকাল এল! আমরা ভাবতে পারতাম এ সব? সে দিনের আলোচনার বিষয়, স্কুলে পড়ুয়াকে শিক্ষকের বেধড়ক মারধর। কাগজে বেরিয়েছে, শিক্ষকের মারে গুরুতর জখম ছাত্রের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সেই আলোচনায় এক জন তাল কেটে দিয়ে বললেন, ‘এই হল বাঙালির সমস্যা। আত্মবিস্মৃত জাতি। আরে মশাই নকশালরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে তাঁর চেম্বারে ঢুকে খুন করেছিল। এ সব ভুলে যাচ্ছেন কেন?’
কোত্থেকে কী বিষয় টেনে আনলেন ভদ্রলোক। আলোচনা ঝগড়ায় পরিণত হয়। এক জনের বক্তব্য, ‘আজকালকার ছেলেপুলেরা সেয়ানা৷ লেখাপড়া করবে না, স্কুলে বকাঝকা করলে বাড়ি ফিরে ঠোঁট ফুলিয়ে নালিশ করা চাই৷ আর বাবা-মায়েদেরও বলিহারি৷ মাস্টার শাসন করবে না তো কে করবে? বাড়িতে তো শাসন-অনুশাসনের পাঠ উঠেই গেছে৷ শুধু আদর আর আদর৷ ফ্যামিলির আশকারা পেয়ে পেয়ে…।
প্রতিপক্ষের জবাব, ‘তাই বলে বাচ্চা ছেলেমেয়ের গায়ে হাত তোলা কোনও কাজের কথা নয়৷ বাচ্চারা তো দুষ্টমি করবেই৷ এটাই তো বয়স৷ বাচ্চা শান্তশিষ্ট মানে অসুস্থ৷ তাই বলে ফ্যামিলির বা পলিটিক্যাল ফ্রাস্ট্রেশনের ঝাল ঝাড়বে ছাত্রের পিঠে!’
তাঁর সমর্থনে আর এক জন যোগ করেন, ‘বাচ্চা দুষ্টু মানে তার মস্তিষ্ক সচল৷ আমরা ছোটবেলায় দুষ্টুমি করিনি? ক্লাস ফোরে পড়ার সময় আমার এক সহপাঠী প্রায়ই মাস্টারমশাইদের জুতো লুকিয়ে রাখত৷ বাপ রে বাপ, কী বিচ্ছু ছিল! ভয়ে আমরা কেউ ওর নাম মুখে আনতাম না৷ গোটা ক্লাস নিল ডাউন করিয়ে রাখতেন মাস্টারমশাইরা৷’ আর এক বক্তার সংযোজন, ‘ওটা ছিল ছাত্রদের মাস্টার শাসন, আমরাও করেছি, মাস্টার ক্লাসে এসে ঘুমিয়ে পড়লে তাঁদের শিক্ষা দেওয়ার ওটাই ছিল মোক্ষম অস্ত্র৷’
পরের বক্তা বলেন, ‘দিনকাল বদলে গেছে বুঝলেন৷ বাচ্চাদের দোষ দিয়ে কী লাভ বলুন৷ বাবা-মায়েরই বা কী দোষ? বাচ্চাগুলোর না আছে ভাই-বোন, না আছে দাদু-দিদা, না কাকা-জ্যাঠা৷ রাষ্ট্র বলল, হাম দো, হামারা দো। আমরা খরচ বাঁচাব, স্বামী-স্ত্রী সুখে খাকব বলে হাম দো হামারা এক করে নিলাম। আরে বাবা, দুষ্টুমি হল গিয়ে ছোটদের ফান্ডামেন্টাল থিং। কী আর করা, মোবাইলই ওদের বন্ধু।'
তাঁর কথা কেড়ে নিয়ে এক জন যোগ করেন, ‘চীনের কী হাল হয়েছে দেখেছেন। মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় বাবা-মাকে কথা দিয়ে যেতে হচ্ছে, অসুখ-বিসুখ হলে, বেশি বয়সে শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে পড়লে, সে দায়িত্ব নেবে। ইউরোপের অনেক দেশে আবার শুনছি সরকার পাবলিককে হাতজোড় করে বলছে, বেশি করে পয়দা করো। যেন বাচ্চাকাচ্চা হল গিয়ে ধান-চাল। বীজ ছড়াও, সার-জল দাও, সোনার ফসল ঘরে তোলো। ও সব দেশে কী সব কালচার। ঘুরব, ফিরব, এক বিছানায় কাটাব, ফূর্তি করব, পয়দা করব না।'
কোত্থেকে কী, চলে এল নেপালের ভূমিকম্পের প্রসঙ্গ। দেশটায় তখন ত্রাণ, উদ্ধারের কাজ চলছে, তারই মধ্যে বড়লোক দেশের লোকেরা প্রাইভেট জেটে এসে কিছু মহিলাকে তুলে নিয়ে গেল। মহিলাদের পেটে নাকি ওদের বাচ্চারা বড় হচ্ছে। সারোগেসি। একজন বললেন, ‘বুঝুন কারবার। বিজ্ঞান আর ব্যবসা একাকার।’
এক জন খানিক বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলেন, কোথা থেকে কোথায় চলে গেল সব। একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। ঢুকে পড়ল রসের আড্ডায়। মূল আলোচনায় ফিরিয়ে আনলেন এক জন। বললেন, ‘এখন মশাই একটাই সন্তান৷ তাঁকেই ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে, কুইজ কনটেস্টে, আঁকা প্রতিযোগিতায়, সাঁতারে ফার্স্ট প্রাইজ আনতেই হবে, দিব্যেন্দু বড়ুয়া হতে হবে, সচীন, সৌরভ সব হতে হবে৷ রবিবার সকালে দেখেন না, বাপ-মায়ের কাঁধে ব্যাট-প্যাডের ব্যাগ, খোকা চলেছে ক্রিকেট ক্যাম্পে৷’
তাঁর কথা অনেকেরই যেন মনে ধরল। খানিক নিস্তব্ধতায় তা টের পাওয়া যায়। তিনি বলে চলেন, ‘এই যে দীপা কর্মকার৷ অলিম্পিকে যাওয়ার আগে ক’জন জানত মেয়েটার কথা৷ ওর ইভেন্টটা কী জানতে চান, একশোয় শূন্য পাবে সব৷’
তাঁর কথার রেশ ধরে আর এক জন বলেন, ‘মাঝে মাঝে হিসেব মেলাতে পারি না বুঝলেন৷ মেসি, রোনাল্ডদের নিয়ে কত আলোচনা, রাত জেগে সব ইউরো, কোপা আমেরিকা দেখল৷ অথচ পাড়ায় একটাকেও ফুটবল খেলতে দেখি না৷ সে দিন একটা বাচ্চার মোবাইলে দেখলাম প্রোফাইল ছবি মেসির৷ তার উপর লেখা, ‘মাই মেসি, মাই লাভ।’ বললাম, তুই মেসির এত ভক্ত! কই তোকে তো ফুটবল খেলতে দেখি না৷ কী জবাব দিল জানেন, তুমি যে শাহরুখ, সলমনের এত ভক্ত, তুমি কি সিনেমায় অভিনয় করো? আজকালকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলা খুব রিস্ক৷’
এক জন, অনেকটা সঞ্চালকের মতো করে বললেন, ‘তা হলে কি আজকের প্রজন্মকে আমরা বুঝতে পারছি না?’ এক জন জবাব দিলেন, ‘বোঝার চেষ্টাটাই করছি না৷ এই যে বালিগঞ্জে বড়লোক বন্ধুর বাড়িতে ফুর্তি করতে গিয়ে আবেশ বলে ছেলেটা টপ করে মরে গেল৷ খুন না দুর্ঘটনা, সে তো পুলিশ বলবে৷ কিন্তু এই বয়সের ছেলেমেয়েরা যে মদ-গাঁজা ধরেছে, আমরা কি জানি না? জানি। কিছু বলি না। বলার মরাল নেই৷ উই অল আর মরালি ডোয়ার্ফ৷’
ট্রেন শিয়ালদায় ঢুকে পড়ে৷ কয়েক দিন আগের এই আলোচনার স্মৃতিচারণার মধ্যেও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ধীরেন স্যারকে নিয়ে নানা মুহূর্ত৷ এক ঝলকে ভেসে ওঠে হেড স্যারের অনেক কথা, ক্যামেল স্যারের বিশেষ সেই দিনটির কথা। স্মৃতি বড় বিচিত্র। পাহাড়ি নদীতে আসা হড়পা বানের মতো। নুড়ি-পাথরের উপর দিয়ে নীরবে বয়ে চলা জলের স্রোত হঠাৎই সাপের মতো ফনা তোলে।
আমার কেন জানি না মনে হয়, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটা বিশেষ চেহারা থাকতে হয়৷ সেটা চোখ-কান-নাক-মুখ-হাত-পা-লম্বা-বেটে-রোগা-পাতলা-ফর্সা-কালো, এ সব কিছুই নয়। মনের চেহারা, যা তাঁর আচরণে উপলব্ধি করা যায়৷ ধীরেন স্যার ছিলেন, মাঝারি উচ্চতা, খানিক স্থূল, ফর্সা, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, গড়পরতা মধ্যবিত্ত অবয়ব৷ দু’চার জন তরুণ শিক্ষক ছাড়া বেশির ভাগেরাই তখন ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন৷ ব্রহ্মচারী স্যার, সমর স্যার, বীরেন স্যার, করুণেশ স্যার, বড় দিলীপ স্যার‒ শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস ওটাই ছিল ওঁদের চেনা পোশাক৷ আর ছিলেন হেডস্যার শিবপ্রসাদ নাগ৷ সই করতেন ‘এস নাগ’৷
ছোট ক্লাসে পড়ার সময় ‘নাগ’ শব্দটায় আমরা বেশ মজা পেতাম। নাগ মানে তো সাপ, সেটা কারও পদবি হতে পারে! ছ’ফুটের উপর লম্বা। রাশভারী চেহারা৷ সাংবাদিকতায় আসার পর হিসেব মেলাতে চাইতাম, নেতাজির প্রকৃত অনুগামী কে, ফরওয়ার্ড ব্লকের অশোক ঘোষ, না কি আমাদের স্কুলের হেড স্যার শিবপ্রসাদ নাগ!
২৩ জানুয়ারি বাড়িতে গোটা দিন নেতাজির ছবির সামনে বসে কাটিয়ে দিতেন স্যার৷ সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে তিনি যত বলেছেন, তাঁর পার্টি ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতৃবৃন্দ কিংবা স্বনামধন্য নেতাজি বিশেষজ্ঞেরা তত আলোচনা করেছেন কি না সন্দেহ৷ পাঠ্য যাই থাক, হেড স্যার ক্লাসে কখন যেন ঢুকে পড়তেন নেতাজিতে৷ রূপকথার মতো শোনাত৷
বাড়ি আর স্কুল, এই ছিল তাঁর বাঁধা জীবন৷ স্কুলের রুটিন কাজকর্ম শেষে কাঠের মই বেয়ে দোতলা থেকে নেমে আসতেন চওড়া কার্নিসে৷ কয়েকশো টব সেখানে৷ প্রতিটি গাছকে যত্ন করে স্নান করিয়ে, খাইয়ে-দাইয়ে, তার পর বাড়ির দিকে হাঁটা দিতেন৷ আমরা বলতাম, ‘স্নান-খাওয়া শেষ হল, এ বার গাছেরা ঘুমোবে৷’ আরও একটা কারণে প্রায়ই সন্ধ্যা গড়িয়ে যেত তাঁর। বোর্ডের পরীক্ষার আগে দুর্বল ছাত্রদের নিয়ে ক্লাস শেষে বসতেন।
স্কুল মাস্টারদের মাস মাইনের ভার তখনও সরকার নেয়নি৷ প্রধান করণিক বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় যেন ছিলেন কালেক্টর অফিসের খাজাঞ্চিবাবু৷ তিনি সকালে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, দুপুরে সেকেন্ডারি স্কুলের করণিক। স্যারেরা স্কুলে ঢুকে হাজিরা খাতায় সই করার আগে তাঁকে গিয়ে বলতেন, বঙ্কিমবাবু, আজ যদি কিছু দেন তো রেশনটা তুলতে পারি৷ তা না-হলে কার্ডগুলো এ বার ‘নন ড্রয়াল’ হয়ে যাবে৷
তখন পরপর তিন সপ্তাহ রেশন না-তুললে চতুর্থ সপ্তাহে কার্ডের উপর ‘নন-ড্রয়াল’ ছাপ মেরে দেওয়া হত৷ ধরে নেওয়া হত, রেশন দরকার নেই বলেই পরপর তিন সপ্তাহ তোলা হয়নি৷ বাস্তব কারণটা ভিন্ন৷ রেশন তোলার টাকা জোগাড় করতে অনেক রক্ত জল করতে হত৷ বেশির ভাগ পরিবারই নিয়মিত রেশন তুলতে পারত না৷ বাদ ছিলেন না হাই স্কুলের মাস্টারমশাইরাও৷ রেশন অফিসে গিয়ে কারণ-সহ দরখাস্ত করে ফের রেশন তোলার অনুমতি আদায় করতে হত৷
বঙ্কিমবাবু বেশির ভাগ দিন স্যারেদের বলতেন, ‘এখন ক্লাসে যান৷ ছেলেরা জমা করুক৷ বিকালে আসবেন৷’ মাইনে বাবদ যা জমা পড়ত, দিনের শেষে অনেক দিনই স্যারেরা ভাগাভাগি করে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন।
এ সবের থেকে খানিকটা হয়তো মুক্ত ছিলেন স্কুলে নতুন যোগ দেওয়া স্যারেরা। পোশাক-আশাকে দু’টো প্রজন্মকে আলাদা করা যেত। কমবয়সিদের অনেকেই প্যান্ট-শার্ট পরে আসতেন। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ করে আসা এক জন দামি প্যান্ট-শার্ট এবং রোদ চশমা পরে আসতেন। চেহারা, চলাফেরা, কথাবার্তা এবং পড়ানো, সব কিছু মিলিয়ে ছাত্রদের মধ্যে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু পাড়ায় বয়স্কদের মধ্যে গুঞ্জন। মাস্টারের চোখে গগলস! স্টাইল করা জামা-প্যান্ট! কেমন যেন সিনেমার নায়ক-নায়ক ভাব। ছেলেপুলেগুলো উচ্ছন্নে যাবে। স্যারেদের অনেকের কথাবার্তাতেও ওই বিশেষ স্যারের পোশাক-আশাক নিয়ে ফিসফিসানি।
স্যারেরা বেশির ভাগই এলাকাবাসী। দোকান-বাজারে তাঁদের সঙ্গে অভিভাবকদের দেখা হয়, কথা হয়। বিষয়টি চাপা থাকেনি সেই স্যারের কাছেও। পোশাক নিয়ে এত কথা হচ্ছে শুনে, বলা চলে স্রেফ অভিমান করে কিছু দিন স্কুলে আসাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
তখন বুঝিনি, অনেক পরে, নয়ের দশকের মাঝামাঝি এক সহকর্মীর স্ত্রীর স্কুলের ঘটনায় অনুমান করতে পেরেছিলাম, আমাদের স্কুলের সেই স্যারের পোশাক-আশাকে কেন আপত্তি ছিল এলাকাবাসী এবং বয়স্ক মাস্টারমশাইদের। সহকর্মীর স্ত্রী পড়াতেন সিঁথি-বরানগর চত্ত্বরে মেয়েদের সেকেন্ডারি স্কুলে। দিদিমণিদের পোশাকবিধি নিয়ে বিরোধ-বিবাদের খবর প্রায়ই শোনা যায় তখন। ঘোর আপত্তি দিদিমনিদের সালোয়ার কামিজ পরাতে। শাড়িই নাকি পরতে হবে তাঁদের, ফতোয়া জারি করেছে অনেক স্কুল। সহকর্মীর স্ত্রী এবং তাঁর কয়েক জন সহকর্মী স্কুলে যেতেন বেশ সেজেগুজে। এলাকাবাসী, ছাত্রী, কেউ তাতে আপত্তি তোলেনি। প্রধান শিক্ষিকা শুধু ডেকে বলেছিলেন, আমাদের মেয়েরা বেশির ভাগেরাই গরিব ঘরের। দিদিমণিরা এত সেজেগুজে এলে ওদের মনে প্রভাব পড়তে পারে। সাজগোজের বাসনা জাগতে পারে। ওদের বাবা-মায়েরা পেরে উঠবে না।
প্রধান শিক্ষিকার এই পরামর্শকেই ফতোয়া মনে হয়েছিল দিদিমণিদের। হয়তো বা আমার সেই সহকর্মীর স্ত্রীকে তাঁর সহকর্মীরা বলে থাকবেন, তোর বর তো খবরের কাগজে আছে। একটু লেখালেখি হলে বড় দিদিমনির গার্জেনগিরি করা বন্ধ হবে। সেই সহকর্মী আমারই দ্বারস্থ হলেন। স্কুল অবধি যাওয়ার দরকার হল না। এলাকার পরিচিতদের কাছ থেকে সব শুনে বুঝলাম শিক্ষাঙ্গনে শিবপ্রসাদ নাগেরা আছেন।
সরকার স্কুল মাস্টারদের মাইনে দেওয়ার ভার নিয়েছে বহু কাল। পরিমাণটাও বেশ সম্মানজনক হয়ে উঠেছে। নিজের কষ্টার্জিত অর্থে ভাল পোশাক, একটু-আধটু ফ্যাশন করলে কার কী বলার থাকতে পারে? কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেরই যে তখনও দু’বেলা পেট ভরে খাবারের জোগাড় নেই। কোথায় তখন মিড-ডে মিল। স্কুলের বই, লেখাপড়ার আরও নানা সামগ্রী এবং ইউনিফর্ম, সবই বাবা-মাকে জোগাতে হয়। রাষ্ট্র তখনই এ দায়িত্ব নিতে পারত কি পারত না, সে অন্য বিতর্ক। কিন্তু মোটা মাইনে পাওয়া প্রধান শিক্ষিকা অন্তত ভাবনায় ব্যাকুল ছিলেন তাঁর হতদরিদ্র ছাত্রীদের নিয়ে।
আমাদের স্কুলবেলায় হয়তো বা এই কারণেই তরুণ মাস্টার মশাইয়ের পোশাক-আশাক নিয়ে খানিক বিচলিত বোধ করতেন এলাকার প্রবীণ এবং বয়স্ক মাস্টারমশাইয়েরা। মনে পড়ে যায়, স্যারের পোশাক-আশাক আমাদের কিশোর মনে কেমন ঝড় তুলেছিল তখন। স্রেফ অনুমান, সেই হেড দিদিমণির মতোই আমাদের হেড স্যারও সদ্য চাকরি পাওয়া তরুণ শিক্ষককে বলে থাকবেন, পোশাক-আশাকটা একটু স্থান-কালের সঙ্গে মানানসই হলেই ভাল হয়। তাতেই অভিমান করে ক’দিন আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
পড়ুয়াদের বেশির ভাগই তখন হাফ ফ্রি, ফুল ফ্রি-র দলে৷ তার উপর বেতন বকেয়া থাকত মাসের পর মাস৷ দিনের শেষে স্যারেদের কারও ভাগ্যে ১০ টাকা, বড়জোর ২০ টাকা জুটত৷ এ ভাবেই মাস মাইনের পুরোটা জুটত হয়তো দশ দিনে৷ বেশির ভাগই তা মেনে নিয়েছিলেন৷ কেউ কেউ খোলামেলা কথা শোনাতেন হাফ ফ্রি, ফুল ফ্রি নিয়ে৷ হেড স্যারের সঙ্গে তাঁদের খটাখটি লেগে থাকত৷ বড়দের মুখে শুনতাম, ম্যানেজিং কমিটির বৈঠকেও হেড স্যারকে এ নিয়ে কথা শুনতে হয়৷ চাপাচাপি করলে তিনি রীতিমতো গর্জে উঠে বলতেন, ‘তা হলে আমাকে ছেড়ে দিন৷ এটা তো স্কুল। প্রাইভেট কোচিং সেন্টার তো নয়, যে মাইনে না-দিতে পারলে ছাড়িয়ে দেব।’
দেশভাগের পর দখলি জমিতে কলোনি স্থাপনের সময়ই স্কুলের জন্য চারটি জায়গা চিহ্নিত করা ছিল৷ নিজেদের ঘর-বাড়ি তৈরির পাশাপাশি এর-ওর কাছ থেকে পাওয়া দানের টাকায় চলে স্কুল তৈরির কাজ৷ ‘বহিরাগত’ শিবপ্রসাদ নাগ কলোনি আর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাদের সেই লড়াইয়ের কথা মনে রাখতেন৷ পয়সার অভাবে কারও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে, মানতে পারতেন না৷ তবু ম্যানেজিং কমিটির সদস্যেরা, তাঁরা আবার কলোনিরই মানুষ, রোজগার বাড়াতে নিয়ম করলেন, মাইনে এবং পরীক্ষার ফি বকেয়া যাদের, তাদের মার্কশিট দেওয়া হবে না৷ চাপের মুখে হেড স্যার সে নিয়ম মানলেন৷ ফলে বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন দেখা গেল সব ক্লাসেই অর্ধেকের বেশিরভাগ ছাত্র অনুপস্থিত৷ হেড স্যারের ঘরের বাইরে অন্য দৃশ্য। অভিভাবকদের লম্বা লাইন৷ স্যার খাতা খুলে বলে দিচ্ছেন পুত্র উত্তীর্ণ নাকি অনুত্তীর্ণ৷ ২৪ ডিসেম্বর রেজাল্ট প্রকাশের পর বিদায়ী বছরের বাকি দিনগুলি বন্ধ থাকত স্কুল৷ আসতেন শুধু হেড স্যার৷
অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যার ধীরেন স্যারকে ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলাতে হত৷ তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল স্কুলকে কোলাহল মুক্ত রাখা। লাঠি হাতে তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেই হত৷ মুহূর্তে কোলাহল উধাও৷ তিন তলা স্কুলবাড়ির কোনায় কোনায় চাপা স্বরে খবর পৌঁছে যেত, ‘ধীরেন স্যার আসছেন, ধীরেন স্যার আসছেন’৷ হাতের সামনে কেউ পড়ে গেলে লাঠি তুলতেন৷ কিন্তু মারতেন কদাচিৎ৷ আর যদি মারতেন তা হলে? মারের দাগ আড়াল করার কৌশল খুঁজতে খুঁজতেই ব্যথা উধাও৷ স্কুলে মার খেলে বাড়িতে আর এক দফা মার বরাদ্দ ছিল৷ মাস্টারমশাই মারলেন কেন, এই প্রশ্ন তোলার স্পর্ধা তখন কারও ছিল না।
এক সহপাঠীর কথা মনে আছে, দিনরাত দস্যিপনা করে বেড়াত৷ তার বাবা নিয়মিত খোঁজ নিতেন স্কুলে মাস্টারমশাইরা ছেলেকে ধোলাই দিয়েছেন কি না৷ মেরেছেন শুনলে বাড়িতে আর এক দফা ধোলাই দিতেন৷ সেই সহপাঠীর মুখেই শুনেছি, তাঁর বাবা বলতেন, ‘তোমার লজ্জা করে না, স্কুলে পড়া পারো না, দুষ্টুমি করো, মাস্টারের হাতে মার খাও৷’ হোম টাস্ক নিয়ে সেই বন্ধুকে ক্লাসে স্যারেদের প্রশ্নের উত্তর জুগিয়ে, চোখের আড়ালে রেখে রক্ষা করতাম বাকিরা৷
সেই ছেলেটির আচরণে এক দিন গোবিন্দ স্যারের মতো মানুষও ধৈর্য্য হারালেন৷ ছ’ফুটের উপর লম্বা মানুষটি সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন৷ গলাটি ছিল দৃশ্যত একটু বেশি লম্বা৷ গোবিন্দ সাহাকে আমরা তাই আড়ালে বলতাম ক্যামেল স্যার৷ পড়াতেন ইংরিজি৷ শান্ত মানুষ। ক্লাস রুমের বাইরে কারও সঙ্গে কথা বলতেন না৷ টিচার্স রুমে যেটুকু সময় কাটাতেন, বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতেন৷ স্কুলে আসতেন রাস্তার এক ধার ঘেঁসে, মুখ নামিয়ে৷ সেই তিনি ওই সহপাঠীর আচরণে সে দিন এতটাই ক্ষিন্ত যে আর এক ছাত্রকে হুকুম করলেন, টিচার্স রুম থেকে একটা ছড়ি নিয়ে আসতে৷ হুকুম তামিল হতে, তিনিই যেন মহা ফাঁপরে পড়লেন৷ অবাধ্য ছাত্রের দিকে লাঠি উঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ‘কেন আমাকে ছড়ি ধরতে হল, আমাকে কেন ছড়ি ধরতে হল৷ বল, বল, বল, কেন ধরতে হল ছড়ি।’
গোটা ক্লাস নীরব। এক দিকে ভাবছি পিঠে পড়ল বুঝি দু’ঘা৷ গোবিন্দ স্যারের হাতে লাঠি, সে-ও এক অচেনা দৃশ্য৷ তাঁর মধ্যেও যে রাগ বস্তুটি আছে, সেই প্রথম টের পেলাম। কেউ বলেছিল, শান্ত প্রকৃতির মানুষেরা রেগে গেলে ভয়ঙ্কর। আমরা ভাবছিলাম, কী না কী হয়। কিন্তু স্যার লাঠি হাতে নিলেন। গলা চড়ালেন, কিন্তু গায়ে কিছুতেই ঠেকাচ্ছেন না। নীরব ক্লাস চোখে চোখে সায় দেয়, দু’ঘা দিলেই বরং ভাল। তা না হলে ক্লাসে ওর বাঁদরামো থামবে না। অনেক হয়েছে।
হট্টগোল শুনে পাশের ক্লাস থেকে অন্য স্যারেরা কয়েক জন চলে এসেছেন৷ গোবিন্দ স্যারকে দেখে তাঁরাও থ৷ কেউ যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। খানিক ধাতস্ত হয়ে এক জন স্যার উৎসাহ জোগান, ‘হাতে যখন নিয়েছেন, বউনি করুন, বউনি করুন৷ দিন দু’ ঘা৷’ তাতে কর্ণপাত না করে গোবিন্দ স্যার বলেই চলেছেন, ‘আমাকে কেন ছড়ি ধরতেন হল, কেন আমাকে ছড়ি ধরতে হল৷ বল, বল, বল৷’
এ ভাবে কিছু ক্ষণ চলার পর স্যার হঠাৎ টেবিলে গিয়ে মুখ নিচু করে বসে পড়লেন৷ লাঠি ছাত্রের গায়ে পড়ল না৷ অন্য স্যারেরা জানতে চাইলেন, গোবিন্দবাবু শরীর খারাপ লাগছে? আমরা কয়েক জন ছুটে গিয়ে টিচার্স রুমে খবর দিলাম৷ বাহাদুর জল নিয়ে এলেন৷ তখন অনেক স্কুলেই নেপালি দারোয়ান। বাহাদুর আর নেপালি দারোয়ান যেন সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। পেশা আর পদবি একাকার। বড় বিচিত্র চরিত্রের ছিলেন মানুষগুলি। পরিবার ছেড়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতেন। ন’মাসে, ছ’মাসে একটা চিঠি। তাতেই যেটুকু যা যোগাযোগ। স্কুলে তখনকার বড় বাহাদুর মানে সিনিয়র যিনি, নাম ছিল তাঁর জ্ঞান বাহাদুর। স্কুলের নানা বিষয়ে হেড স্যার তাঁর মতামত শুনতেন। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ‘বড় বাহাদু-উর’ বলে হাঁক পারতেন। জ্ঞান বাহাদুর হাতের কাজ ফেলে ছুটতেন। যেন ভগবান তলব করেছেন। শিবপ্রসাদ নাগকে শিবের মতই ভক্তি করতেন বলা চলে। তাঁর শাসন-অনুশাসনের অন্যথা হত না।
ব্যতিক্রম ছিল একটি। স্কুল শুরুর পর লোহার গেট খোলার অনুমতি ছিল ছাত্র বাদে বাকি সকলের জন্য। জ্ঞান বাহাদুর নিয়ম ভাঙতেন মুখ দেখে। সেই যে একটা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব ফিরে ফিরে আসে, একটি নাবালক ছাত্র রোজই ক্লাসে দেরি করে আসে এবং সাজা ভোগ করে। শেষে একদিন আর ক্লাসেই ঢুকতে দেন না মাস্টার মশাই। পরে তিনি জানতে পারেন, পরিবারের পাশে দাঁড়াতে স্কুলে আসার আগে ঘুরে ঘুরে খবরের কাগজ বিক্রি করে ছেলেটি। তাই প্রায়ই ক্লাসে আসতে দেরি হয়ে যায়। আমাদের স্কুলে এমন ছাত্রদের মুখ চেনা ছিল জ্ঞান বাহাদুরের। কাউকে কিছু বুঝতে না-দিয়ে গেট একটু ফাঁক করে ঢুকিয়ে নিতেন স্কুলে। কত দিন তার জন্য স্যারেদের গালমন্দ শুনেছেন। গেটের বাইরেও অশান্তি হত। ছাত্রবিশেষে ছাড় দিতেন বলে। তবে হেড স্যারের তাতে সায় ছিল। অন্য শিক্ষকদের বলতেন, ‘স্কুলে ঢুকে পড়লে তবু ভাল। না ঢুকতে দিলে বাড়ি ফিরে তো যাবে না। কোথায় গিয়ে কী বদমাইশি করবে কে জানে।’ এ ভাবে অবিরত চার পাশের সকলের ভাল চাওয়াটাই যেন তাঁদের একমাত্র প্রত্যাশা ছিল জীবনে।
সে দিন জ্ঞান বাহাদুরের সুশ্রুষায় গোবিন্দ স্যার খানিকটা সুস্থ বোধ করলেন। খবর পেয়ে একে একে অন্য স্যারেরাও হাজির৷ এক জন স্যার বললেন, মনে হচ্ছে প্রেশার চড়েছে৷ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভাল৷ তখন সুগার ব্যাপারটা নিয়ে এত সচেতনতা ছিল না। এমন ধরনের অসুস্থতায় এখন প্রেশারের সঙ্গে সুগারের কথাও তোলেন সকলে। বুঝতে চান, হঠাৎ করেই সুগার ফল করল কি না। জানতে চান, সুগার আছে নাকি? ওষুধ খান তো? কিছু খেয়েছেন? খালি পেটে সুগারের ওষুধ খেয়ে ফেলেননি তো?
হাসপাতালের কথা উঠতে স্যার মুখ তুলে বললেন, ‘একটু একা থাকতে চাই৷’ তাঁর আর্জি মঞ্জুর হল৷ বাহাদুরকে রেখে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে এলাম সকলে৷ পরে এক দিন ক্লাসে এসে কার্যত হাত জোড় করে বললেন, ‘প্লিজ, আমাকে আর যেন ছড়ি ধরতে না হয়৷ অনুরোধ করছি তোদের কাছে৷’
অনবদ্য । তবে গোবিন্দ বাবু মনে হয় ভট্টাচার্য কিঃবা ঘোষ
দারুণ ! শিক্ষক সমাজের এই মানবিক মুখ হারিয়ে যাচ্ছে । আমি নিজেও একটি কলেজে শিক্ষকতা করি । মূল্যবোধের অবনমন কোথায় তা না দেখলে বোঝা মুশকিল ।