এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  সমাজ  শনিবারবেলা

  • আমি মরলে শ্মশানে যাইয়ো গদাধর

    অমল সরকার
    ধারাবাহিক | সমাজ | ২৪ জুলাই ২০২১ | ২০৮১ বার পঠিত
  • সম্পর্ক-সূত্র বীজ বপনে শুরু। তার পর দশ মাস দশ দিন। রক্তের সেই সম্পর্ক ভালবাসা যায়, অবহেলা করা যায়। ছেঁড়া যায় না। পাল্টানোও যায় না। তার পর জীবনভর কত না সম্পর্কের জন্ম। এবং মৃত্যুও। কিছু সম্পর্ক শাসনের, অনুশাসনের, বাঁধনের। কিছু সম্পর্ক ভেসে যাওয়ার। চলতি হাওয়ার পন্থী। কিছু সম্পর্ক আঁকড়ে রাখি। কিছু আপনিই বয়ে যেতে দিই। নাম দিতে পারি না এমন অনেক সম্পর্ক থেকে যায় মনের মণিকোঠায়। সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা দিচ্ছে নেট মাধ্যমও। শুধু কি মানুষ, সম্পর্ক তো চার পাশের কত কিছুর সঙ্গে। পুঁথি বা পর্দার চরিত্র, পুকুর ঘাট বা চিলেকোঠার সিঁড়ি। পাতার ভাঁজে রেখে দেওয়া প্রথম পাওয়া গোলাপ। রাতে গলির মোড়ে আমার ফেরার অপেক্ষায় থাকা নেড়ি। সম্পর্কের সাগরে ভাসছি, ডুবছি। সম্পর্কের নুড়ি কুড়িয়ে চলেছি। ছুঁড়ে ফেলছি। - চলছে, ধারাবাহিক, সম্পর্ক ।

    তরুণ পুলিশ অফিসার সব শুনে বুঝলেন, ব্যাপারটা বড় কিছু নয়। স্রেফ সরকারি কর্মচারীর আঁতে ঘা আর কী। কিন্তু তিনি নিরুপায়, আফটার অল অভিযোগকারী ‘গভমেন্ট এমপ্লয়ি’৷ মঞ্চে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে গলা খেলিয়ে ডায়লগ দেওয়ার মতো করে তিনি বললেন, ‘আপনারা আমার সঙ্গে থানায় চলুন। যা বলার দারোগাবাবুকে বলবেন।’

    দারোগা শব্দটি তত দিনে সরকারি পরিভাষা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তবে আর পাঁচটা বাতিল শব্দের মতো সেটিও মুখে মুখে টিকে ছিল বহু কাল। এখনও কখনও-সখনও কানে আসে। পুলিশের লোকজনও সযত্নে দারোগা শব্দটির ব্যবহার চালিয়ে যান বহু বছর। অনেক পরে থানার ওসি, আইসিরা পাঁচজনের মুখে হয়েছেন বড়বাবু আর পুলিশ সুপার হয়েছেন বড়সাহেব। তবে, বড়সাহেব, কিংবা বড়বাবু, পদ যার যত ভারীই হোক না কেন, প্রাণে ভয় ধরানো আর সমীহ আদায়ে দারোগার ধারে কাছে কেউ না। পুলিশের ডিজি-ও না। বছর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ আগে পাড়ায় এক প্রতিবেশী পাঁচজনকে খাটো করতে কথায় কথায় বলতেন, ‘হে! কোথাকার কে দারোগা এসেছে।’ তর্কাতর্কিতে হেরে প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্য বলতেন, ‘তুই নিজেকে কী মনে করিস বল তো? তুই কি দারোগা, যে তোর কথা শুনতে হবে?’ মজার ব্যাপার হল, এই জাতীয় ভয়, সমীহ আদায় করা চরিত্রদের নিয়ে আবার তারাপদ রায় ব্র্যান্ডের বিস্তর গল্প চালু আছে।

    তরুণ পুলিশ অফিসারের প্রসঙ্গ থেকে সরে দারোগা নিয়ে সাত কাণ্ড রামায়ণে ঢুকে পড়ার কারণ সেই সরকারি কর্মচারী। মানে ক্ষমতার রাজদণ্ড। পরাধীন দেশের শাসন-সংস্কৃতি যারা স্বাধীন দেশেও সযত্নে লালনপালন করতেন, এখনও করেন, তাদের উল্লেখযোগ্য হল সরকারি কর্মচারী সম্প্রদায়। ফলে শত অপরাধেও তাদের দিকে চোখ তুলে কথা বলাতেও বিপদআপদ কিছু কম ছিল না। আমাদের সেই প্রতিবেশী যেমন কথায় কথায় কলোনির বাকিদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘মনে রাখিস, আমি কিন্তু সরকারি কর্মচারী।’ পান থেকে চুন খসলে সমবয়সি প্রতিবেশীকেও এই বলে হুঁশিয়ারি দিতেন, ‘ভুলে যাবেন না আমি সরকারি কর্মচারী। আমি ডাকলে পুলিশ খালি হাতে ফিরবে না, এই বলে রাখলাম।’

    সে দিনও তা-ই হল। সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া অফিসারও সিদ্ধান্ত নিলেন, খালি হাতে ফিরবেন না। কারণ অভিযোগকারী সরকারি কর্মচারী। অথচ, রাইটার্স বিল্ডিংসে আমার মুখে এই আপাতনিরীহ কিন্তু ক্ষমতার প্রতীক হয়ে যাওয়া শব্দ দু’টি বারে বারে শুনে কী রেগেই না গিয়েছিলেন সেই ভদ্রলোক। সরকারি পরিভাষায় তাঁর পদের নাম অবর সচিব। মানে আন্ডার সেক্রেটারি। ভারত সরকারের চাকরিতে ওই পদে আছেন শয়ে শয়ে আধিকারিক। রাজ্যগুলিতে মাত্র এক জন। এক দিন রাইটার্সে সেই একমাত্র অবর সচিব খানিক অনুযোগের সুরে বললেন, ‘মিস্টার সরকার, আপনি সেই থেকে আমাকে সরকারি কর্মচারী, সরকারি কর্মচারী বলছেন। সরকার যখন বেতন দেয়, তখন সরকারি কর্মচারী তো বটেই। তবে আমি কিন্তু অফিসার, বাংলায় যাঁকে বলে আধিকারিক। সরকারের বেতনভুক সবাই সরকারি কর্মচারী, কিন্তু সবাই সরকারি আধিকারিক নয়।’ কর্মচারী আর আধিকারিকের ফারাক তার পর থেকে আর ভুলিনি।

    ‘আপনারা আমার সঙ্গে থানায় চলুন…’ কমবয়সি পুলিশ অফিসারের সেই কথাটা মূহূর্তের মধ্যে গোটা পাড়া রাষ্ট্র হয়ে গেল সে দিন। কার্ফু ভেঙে জনতার পথে নেমে আসার মতো করে পাড়ার মেয়ে-বউরা বেরিয়ে এলেন। হাঁকডাক, স্লোগানের বালাই নেই, কেউ বলেওনি কী করতে হবে, মা-কাকিমারা ঘিরে ফেললেন পুলিশের জিপটা। পুলিশ অফিসারের মুখ গেল শুকিয়ে। তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না কী করণীয়। হাতে গোনা এক-দু’জন ছাড়া পুলিশে, রেলে টিকিট চেকারদের মধ্যে তখনও মহিলাদের ঠাঁই হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মহিলা। কিন্তু মহিলারা পুলিশে চাকরি করবে, ভাবতেই পারত না দেশ-সমাজ।

    মহিলাদের হটিয়ে সে দিন গাড়ি বের করাই সমস্যা হয়ে গেল তরুণ অফিসারের। মামুলি মামলা যে এত দুর গড়াতে পারে, ভাবতে পারেননি তিনি। বিচিত্র আওয়াজ করে অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাওয়া জিপের ওয়্যারলেস সেটটাও একটা সময় বন্ধ হয়ে গেল ব্যাটারির আয়ু ফুরিয়ে যাওয়ায়।

    পাড়ায় পুলিশ, তখন অনেকটাই চোখ সওয়া ব্যাপার। প্রায়ই আসে। গোলমাল তো লেগেই থাকে। অভাব ঘিরে অশান্তি লেগেই থাকত। ছোটখাটো চুরিচামারি, গরু-ছাগলে সখের গাছ, বাগান হাপিস করে দেওয়া, কলোনির দখলি জমির মাপজোক নিয়ে বিবাদ ইত্যাদি নিয়ে বড় ধরনের একটা দু’টো গোলমাল ছিল বাৎসরিক পরবের মতো। পাড়ায় পুলিশ আসত। কী থেকে কী হচ্ছে আমরা ছোটরা নয়-নয় করেও কিছু কম বুঝতাম না। জীবনে প্রথম দেখা গাড়ি পুলিশেরই কল্যাণে, পুলিশের গাড়ি। কালো ভ্যান একটা। এখনও চালু আছে সেই বড় চেহারার গাড়িগুলি। আইন অমান্য আন্দোলন আর জেলবন্দিদের আনা-নেওয়ার জন্য ব্যবহার হয়। তখন ছোটখাটো ঝুটঝামেলাতেও চলে আসত ওই গাড়ি বোঝাই পুলিশ। পাড়ার ভিতরে ঢোকার চওড়া রাস্তা ছিল না। বড় রাস্তার মোড়ে এসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দাঁড়াত। সেই থেকে পুলিশের গাড়ির দীর্ঘশ্বাস ছিল চেনা শব্দ। সেই শব্দ শোনা মাত্র গোটা পাড়ায় যেন অঘোষিত কার্ফু জারি হয়ে যেত। দুশ্চিন্তার কালো মেঘ মুহূর্তে এসে গ্রাস করত জওয়ান ছেলে থাকা পরিবারগুলিকে। পুলিশ কোন বাড়িতে যায়, কার খোঁজ করে, উত্তর জানতে কয়েক মিনিট যেন অনন্ত অপেক্ষার বোঝা হয়ে দাঁড়াত। আমরা ছোটরাই ছিলাম পাড়া-গোয়েন্দা। পুলিশের গতিবিধি, কার খোঁজ করে, কোন রাস্তায় গেল, ক্যামেরা প্যান করে ছবি তুলে রাখার মতো তীক্ষ্ম নজরদারি চলত আমাদের। কিছু না বোঝার ভান করে থাকাটাই ওই বয়সে অবশ্য পালনীয় অনুশাসন ছিল। আমার তখন বয়সের সেই পর্ব চলছে। তবু জানার তুমুল কৌতূহল ছিল, পুলিশে খবর দিল কে? কে বা কারা কখন থানায় গেল?

    পাড়ায় টেলিফোনের বালাই নেই। থানাতেও ছিল কি না সন্দেহ। থাকলেও খারাপ হয়ে পড়ে থাকা অসম্ভব নয়। থানা ঢিল ছোঁড়া দূরে, তা-ও না। তবু পুলিশ চলে আসত। অনেকে সন্দেহ করতেন সেই সরকারি কর্মচারীকে। যদিও প্রমাণ মেলেনি। তিনি এমনিতে ছিলেন নিষ্ঠাবান গভর্নমেন্ট সারভেন্ট। সকাল ন’টা-সওয়া ন’টায় বেরোতেন। ফিরতেন সন্ধে পার করে। বোঝা যেত সরকারি কাজে ফাঁকি নেই। পাড়ায় মেলামেশার বালাই ছিল না। কিন্তু বাড়ির সামনে সামান্য হল্লা, গাছের পাতা ছেঁড়া, ফুলে হাত দেওয়ার মতো কাজও ছিল তাঁর কাছে অমার্জনীয় অপরাধ।

    মহিলারা ঘিরে আছেন, নিরুপায় অবস্থা, তবু যেন বুকে বল এনে অফিসার বললেন, অভিযুক্তদের থানায় যেতে হবে৷ তাতে শোরগোল বাঁধল। ভিড়ের দাবি, বোঝাপড়া যা হওয়ার এখানেই হোক। থানায় নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। এরই মধ্যে ভিড় থেকে এক জন বলে বসলেন, ‘স্যার, ব্যাপারটা বোঝেন, লোকটা মোটেই ভদ্রলোক না৷ কত বড় হারামি চিন্তা করেন৷ হারামি না হইলে কেউ পুলিশের লগে কারবার করে?’

    তরুণ অফিসারের যেন ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা। ভিড়ের কোলাহল থেমে গিয়েছে। তিনি বলে চলেন, ‘পুলিশের লগে কারবার কাগো? চোর-ডাকাত-গুন্ডা-বদমাইস৷ আপনি আমারে বলেন, পুলিশের লগে ভদ্রলোকের কী সম্পর্ক!’ তরুণ অফিসারকে আরও অসহায় করে তোলে পরের ঘটনা। সমবেত ভিড় সমস্বরে স্লোগান তুলেছে, ‘গদাধর কর্মকার জিন্দাবাদ’, জয় বাবা তিন্নাথের জয়।’

    নিজেকে কিঞ্চিৎ সামলে নিয়ে পুলিশ অফিসার ভিড়ের উদ্দেশে বললেন, ‘আমাকে দেখে কি ভদ্রলোক মনে হয় না আপনাদের?’ এই বলে অভিযুক্তদের ব্যাপারে আর কথা না-বাড়িয়ে খালি হাতে ফিরে গেলেন তিনি৷ তরুণ পুলিশ অফিসারের অসহায় উক্তি অনেকের মন ছুঁয়ে গেল৷ এক জন বললেন, ‘কী আর করবে, চেহারা দেখেই বোঝা যায়, পড়ালেখা জানা ভদ্রঘরের ছেলে, পেটের দায়ে পুলিশে চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছে৷’ পাড়ায় পুলিশ ডাকায় সে দিন সেই সরকারি কর্মচারী ভদ্রলোক আরও এক বার সর্বসমক্ষে ‘অভদ্রলোক’, পরিগণিত হলেন৷ গদাধর কর্মকার ক্রমে হয়ে উঠলেন লোক আদালত। পাড়ার যা কিছু ঝুটঝামেলা, যত জটলা গদাধর কর্মকারের দোকানের সামনে। তাঁর বিধান সকলে মান্য করেন। কথায় কথায় পাড়ায় পুলিশ আসা আস্তে আস্তে বন্ধ হল। কেউ মুখ ফস্কে পুলিশ ডাকার কথা বলে ফেললে ধমকে উঠতেন গদাধর। বলতেন, ‘ক্যান, পুলিশ আইসা কী করব? তগো মিলমিশ করাইবো কি?’
    প্রায় সব পাড়াতেই তখন শিক্ষক, চিকিৎসকের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদেরও বিশিষ্ট বাসিন্দার তালিকায় স্থান হত৷ উদ্বাস্তু কলোনিতে বড়জোর এক-দু’জন ছিলেন এমন ভাগ্যবান৷ তবে সকলেই ভাগ্যবান ছিলেন বলা যায় না। বেশির ভাগই পূজ্য, একই সঙ্গে পরিত্যাজ্য ছিলেন। বয়স্করা রসিকতা করে বলতেন, ‘সরকারি পেয়াদা’৷ তাঁদেরই কেউ কেউ আচার-আচরণে ছিলেন ‘কথা বলা অশোক স্তম্ভ৷’ পাড়ার ছোটখাটো ক্যাচাল, পুজো কমিটির গোলমাল, পারিবারিক বিবাদ, সবেতেই সেই এক-দু’জন পালা করে বিচারকের আসন অলঙ্কৃত করতেন৷ সালিশি সভায় টের পাওয়া যেত, পদমর্যাদার সরকারি মাপকাঠিতে কে বড়, কে ছোট৷ সেই মতো একমাত্র চেয়ারটি বরাদ্দ হত৷

    এমনই এক জন ছিলেন রাজ্য সরকারের কনিষ্ঠ কেরানি৷ ধরেই নেওয়া যায়, বাকিরা তাঁর চেয়ে ছোট পদে চাকরি করতেন৷ রাজ্য প্রশাসনের সেই কনিষ্ঠ কেরানিকে দেখে বাকিরা রাস্তা ছেড়ে দিতেন৷ শ্রদ্ধা-ভক্তির সঙ্গে ছিল ভয়-ভীতি। ‘চাইলে ক্ষতি করে দিতে পারেন,’‒ মানে শনি-কালী-সন্তোষী মার্কা ভাবমূর্তি। যদিও তাঁদের সুপারিশেই স্কুলে ‘হাফ ফ্রি’, ‘ফুল ফ্রি’-র সুবিধা মিলত৷ রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট মিলত। পুলিশ ভেরিফিকেশনে ছাড়পত্র মিলবে কি না, অনেকটাই নির্ভর করত তাঁদের বয়ানের উপর। পাড়ায় চুরি-ডাকাতি, মারদাঙ্গার ঘটনায় থানার দারোগা এসে তাঁদের সঙ্গেই একান্তে আলাপ করে যেতেন৷

    সে দিন এমনই এক জনের ডাকে পাড়ায় পুলিশ এসেছিল৷ ছেলেছোকরাদের গোলমালে কেউ একজন মাথা গরম করে যাকে বলে ‘বিলো দ্য বেল্ট হিট’ করে ফেলেছিল৷ তাতেই গোলমাল বাধে। সামান্য ধাক্কাধাক্কি। কালক্ষেপ করেননি৷ সটান থানায়৷ কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ চলে এল৷ পুলিশের অমন কর্তব্যনিষ্ঠার আর একটি নজিরও মনে পড়ে না৷
    পুলিশের পিছন পিছন তখন সিআরপিও আসত৷ এখন সিআইএসএফ, বিএসএফ, এসএসবি, আইআরবি— আধাসেনার ছড়াছড়ি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপার হলে আসত শুধু সিআরপি। দিনে এলে মুহূর্তে রাস্তা-ঘাট ফাঁকা৷ রাতে এলে হ্যারিকেন, লম্ফ নিভিয়ে দিয়ে গোটা পাড়া ব্ল্যাকআউট৷ জ্বলত কেবল একটা বাতি৷ গদাধর কর্মকারের দোকানের হ্যারিকেন৷ বেশির ভাগ দিন সেই দোকানে এসেই পুলিশ এর-ওর নাম করে বাড়ি দেখিয়ে দিতে বলত৷ জবাব তৈরিই থাকত তাঁর, ‘আমার দোকানে এই নামে কেউ আসে না৷ খরিদ্দার ছাড়া আমি কাউরে চিনি না৷’

    ‘খদ্দের ভগবান’— কথাটা শুনেছি পরে, উপলব্ধি করেছি আগে, মুদি দোকানি গদাধর কর্মকারকে দেখে। ক্রেতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল ভক্ত আর ভগবানের। বাড়ির এক কোণে এক চিলতে ঘর৷ সামনে সারিবদ্ধ কাঁচের বয়ামে নানা মুদি সামগ্রী৷ একশো খেসারি কিংবা মটর ডাল, পঞ্চাশ চিনি, পঞ্চাশ শর্সের তেল, আট আনার নারকেল তেল, একশো গ্রাম কাপড় কাচার সাবান, একশো সোডা, চার আনার চা-পাতা, পাঁচটা লেরো বিস্কুট, চার আনার পান-সুপুরি-খয়ের, আট আনার ধূপকাঠি, বাতাসা, নকুলদানা, এক টাকার মুড়ি চানাচুর, পাঁচ নয়ার নস্যি, এক প্যাকেট মজদুর বিড়ি, পাঁচ নয়ার দোক্তা পাতা, চার আনার চিরতা‒ এই ছিল তাঁর খদ্দেরদের কেনাকাটা৷ ঘরে ঘরে কৃমি। অব্যর্থ ওষুধ চিরতার জল। মুগ, মুসুর, মটর ডাল খাওয়ার সামর্থ্য ছিল হাতে গোনা ক’জনের। খেসারি, মটর নিয়ে আবার আর এক যন্ত্রণা। দামে সস্তা, সেদ্ধ হতে সময় লাগে বিস্তর। বেজায় জ্বালানি খরচ। এখনই বা ক’টা ঘরে প্রেসার কুকার আছে যে দু’টো সিটি দিয়ে ফুটিয়ে নেবে। দেশে কত কী নিয়েই তো গবেষণা চলে। কত সাফল্যের কাহিনি শুনি। কম সময়ে সেদ্ধ হয়, এমন জাতের খেসারি, মটর তৈরির গবেষণা করার কথা কেউ ভাবলই না। কত জ্বালানি, কত শ্রম সাশ্রয় হত তাতে। ক্লান্তি, বিরক্তি থেকেও কত মানুষকে খানিক মুক্তি দেওয়া যেত।

    খেসারি না-খেয়ে উপায় ছিল না। ডাল-ডালের বরা-ভাত-শুখনো লঙ্কা পোড়া, এই ছিল সবচেয়ে চালু মেনু। সবাই জানত এর পরিণাম। রোজ রোজ খেসারির ডাল খেলে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কথা মুখে মুখে ফিরত। কিন্তু উপায় কী? রোগভোগের থেকে রোজকার খিদের জ্বালা অনেক বেশি যন্ত্রণার।

    পাড়ায় অনেকেরই নার্ভের অসুখ তখন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। জওয়ান বয়সে লাঠি হাতে চলাফেরা। বড় হয়ে জানলাম, অসুখটার নাম ল্যাথারিজম। নিয়মিত খেসারির ডাল খেলে সে রোগ থেকে মুক্তি অসম্ভব। অসুখটা মূলত নার্ভের সমস্যা। পঙ্গু হয়ে যেত মানুষ। ফলে সে ডালও একটা সময় নিষিদ্ধ হয়ে গেল। বহু বছরের চেষ্টায় নতুন জাতের খেসারি তৈরি করা গেছে। কিন্তু খেসারি আর সে ভাবে ফেরেনি।

    সেই সব দিনে গদাধর কর্মকারের দোকানটাই ছিল মহল্লার একমাত্র এসেন্সিয়াল সার্ভিস। সে দোকান একবেলা বন্ধ থাকলে অনেক বাড়িতেই হাঁড়ি চড়ে না৷ দিন আনি দিন খাই পরিবার সব৷ এক পাতে একটা গোটা ডিম ছিল স্বপ্নবিলাশ৷ পায়ের বুড়ো আঙুলে সুতো পেঁচিয়ে মা-কাকিমারা কী নিপুণ দক্ষতায় একটা ডিমকে সমান মাপের, নিখুঁত চারটে টুকরো করতেন। আজও নিখুঁত, নিপুণ শব্দগুলির জন্য আমার ভাণ্ডার জুড়ে আছে সেই একটাই দৃষ্টান্ত, সুতো দিয়ে ডিম কাটা। ভাগ্যিস তখন কম্পিউটার আসেনি। আধুনিক এই যন্ত্রও নিশ্চিত হার মানত সেই নিপুণতার কাছে।

    কানে যেমন আজও দিব্যি বাজে কত দিন না-শোনা সেই মিউজিক। গ্লাসে গরম চা ঢেলে তাতে মুড়ি ভিজিয়ে কানে চেপে ধরে থাকতাম। নরম, মোলায়েম, স্নিগ্ধ কত যে শব্দ ব্যবহার করা চলে সেই মিউজিক্যাল সাউন্ড সম্পর্কে। সেই মিউজিক, মিউজিকের অর্থ বোঝার আগে শোনা মিউজিক আমার। ছেলেবেলা নিয়ে বন্ধুদের এক ঘরোয়া আড্ডায় একবার আলোচনা হয়েছিল, সুতো দিয়ে ডিম কাটা কেন হাতের কাজের শিল্প গন্য হবে না? অনটনে, সঙ্কটেই তো মানুষ সৃষ্টিশীল হয়। সুতো দিয়ে সেদ্ধ ডিম কাটার প্রতিযোগিতা চালু করলে কেমন হয়?
    ডিম ভাগ করে খাওয়ার কথায় মনে পড়ে গেল, কারও বাড়িতে তখন ফলপাকড়, দুধ, হরলিক্স, ভিভা ঢুকতে দেখলে প্রতিবেশীরা উদ্বেগের সঙ্গে জানতে চান, ‘কারও অসুখবিসুখ করল নাকি? কার হয়েছে? কী হয়েছে? কাকু-কাকিমার কী খবর? মাসিমা ভালো আছে? ওষুধ খায় তো ঠিক মতো? মেসোমশাইকে বলিস, আমি একটু ফাঁক পেলেই যাব, ক’দিন বড় ঝঞ্জাটের মধ্যে আছি। তার মধে মায়ের শরীরটা ক’দিন ভালো যাচ্ছে না। তোর কথা বলছিল। পারলে আসিস। ঘুরে যাস এক বার। খুকুদিকে দেখি না বহু দিন। বের হন না? শরীর ভাল তো?’ কথা যেন ফুরোয় না।

    বন্‌ধ, ধর্মঘট, মানে হরতাল, তখন কথায় কথায়৷ যতীন চক্রবর্তী, আরএসপি-র নেতা, পরে বামফ্রন্টের মন্ত্রী, তখন ‘হরতালদা’ নামে খ্যাত৷ দেওয়ালে স্টেনসিলে লেখা, ‘চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান৷’ চারু মজুমদার, জঙ্গল সাঁওতাল, সন্তোষ রানা, কাকা, মানে অসীম চ্যাটার্জিদের নামে যেন বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়৷ তাঁদের নাম প্রকাশ্যে পারতপক্ষে কেউ মুখে আনে না। তবে সব আড্ডাতেই গলা নামিয়ে তাঁরের কথা আলোচনা হয়৷ এখানে-ওখানে গলা কাটা দেহ৷ চারুবাবু নাকি নিদান দিয়েছেন, দূর থেকে গুলি করে নয়, শ্রেণিশত্রুকে ছুরি দিয়ে খতম করে, রক্তে হাত রাঙিয়ে আসাই প্রকৃত বিপ্লবীর কাজ৷ গুপ্তহত্যার প্রকাশ্য রাজনীতি।

    তখন যে দলই হরতাল ডাকুক, দোকান-বাজার সব বন্ধ৷ শুনশান পথঘাট। নিজের পাড়াটিকেও কেমন অচেনা ঠেকে। মনে হয় যেন দূরে নির্জন কোনও জায়গায় বেড়াতে এসেছি। অলিগলি দিয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখে আসি, অবরোধে আটকে আছে দিনের প্রথম ট্রেন। দোকান-বাজার সব বন্ধ, যেন কার্ফু জারি হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু কলোনির সেই একটি দোকান৷ সিপিএম, কংগ্রেস, নকশাল, কেউ পারেনি সে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতে৷ বন্‌ধের দিন অবাক হয়ে দেখতাম, পক্ষ-বিপক্ষ, মিছিলে গলা ফাটিয়ে দু’পক্ষই এসে জড়ো হয়েছে গদাধর কর্মকারের দোকানে। অনুনয়, বিনয়, চোখ রাঙানি, বৃথাই গেল সব। তিনি অবিচল।

    স্কুলে উঁচু ক্লাসে ওঠার পর একটু আধটু গল্প করার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল মানুষটির সঙ্গে। চেহারা, বাচনভঙ্গি, আচার-আচরণে যে কারওরই ভাল লেগে যাওয়ার কথা তাঁকে। পুলিশকে খাটো করে প্রকাশ্যে অমন কথা বলতে পারা, বন্‌ধ, হরতালের দিনে কারও তোয়াক্কা না-করে দোকান খুলে রাখার স্পর্ধা দেখে দল নির্বিশেষে গোটা মহল্লার শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন।
    কথায় কথায় একদিন এল বনধে দোকান বন্ধ না রাখার প্রসঙ্গ। আমি ততদিনে সাংবাদিকতায় চলে এসেছি।বামফ্রন্ট সরকারের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামে বড় পরিবর্তন নিয়ে এল মনমোহনী অর্থনীতি। ১৯৯১-এর আজকের দিনেই ভারতের সংসদে দাঁড়িয়ে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রকে নতুন পথে চালিত করার বাজেট পেশ করেছিলেন মননোহন সিং। গোড়ার কথা ছিল তিনটি, উদারনীতি, বিলগ্নীকরণ এবং বিশ্বায়ন। প্রধানমন্ত্রী তখন নরসিংহ রাও।গত তিন দশকে সবটাই সইয়ে নিয়েছে তামাম ভারত। ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না করে বামপন্থীরাও গ্রহণ করেছে তার ষোলআনা। গোড়ায় যদিও প্রতিবাদের একমাত্র কম্ঠশ্বর ছিল তারাই। প্রতিবাদের জনপ্রিয় অস্ত্রটি ছিল সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পুজোর মুখে ভারত বনধ। সে বনধ সত্যিই অন্যরকম।বাঁচতে হলে লড়তে হবে, লড়াই করে বাঁচতে হবে, এ শুধু আর মেহনতি মানুষের স্লোগান থাকল না।

    সেই সব দিন, বলতে গেলে কাক-পক্ষীরও ডাকা বারণ, এমন বনধেও ঝাপ খোলা থাকল গদাধর কর্মকারের দোকানের। একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, ‘আমি দোকান বন্ধ রাখলে তরা খাবি কী? এই পাড়ায় কয়জন আসে কাইলকের বাজার-সদাই আইজ কইরা রাখতে পারে?’ ব্যবসা-বাণিজ্য-সমাজ-সম্পর্ক ঘিরে অর্থনীতির এমন সহজপাঠ সেই স্কুলে পড়ার সময় মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন গদাদা। এমন মানুষেরা বয়স নির্বিশেষে সকলের কাছেই ‘দাদা।’

    মাঝে-মধ্যে, বিনা নোটিসে তাঁর দোকানের ঝাঁপ বন্ধ থাকলে বোঝা যেত, পাড়ায়, বে-পাড়ায় কেউ গত হয়েছেন। কারও মৃত্যু সংবাদ কানে এলেই রুটিন বদলে যেত মানুষটার। পরিচিত, অপরিচিত, বাড়ির লোক ডাকল কী ডাকল না, এত সব অঙ্ক মেনে চলার মানুষ ছিলেন না। কোমরে গামছা বেঁধে ছুট লাগাতেন৷ শ্মশানের যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম, এমনকি দাহ কাজে ডোমেদের সঙ্গে হাত লাগাতেন। একটা সময় এমন হল, বেপাড়ার অপরিচিত লোকেরাও নিকটজন মারা গেলে গদাধর কর্মকারকে এসে অনুনয়-বিনয় করতেন শ্মশান যাত্রায় তিনি যেন একটু পা মেলান। গদাধর কর্মকার শ্মশানবন্ধু হয়েছেন মানে মৃতের স্বর্গলাভ নিশ্চিত, এমন ধারণা ক্রমে বদ্ধমূল হয়ে গেল৷ পাড়ার বয়স্কদের কত জনকে বলতে শুনেছি, ‘আমি মরলে শ্মশানে যাইয়ো গদাধর। তুমি গেলে ভগবান আমারে আশ্রয় দিব।’ কেউ খানিক মজা করে বলতেন, ‘তুমি কিন্তু কথা দিলা গদাধর। তুমি না গেলে আমি শ্মশান থিক্কা ফিররা আমু। তার পর তোমার ঘাড় মটকামু।’
    আর একটা কাজে খোঁজ পড়ত তাঁর। মৃত্যু মুখে চলে যাওয়া কাউকে বাঁচিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা হিসাবে ডাক্তারকে হাতে-পায়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো হঠাৎই কেউ হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলতেন, ‘আর সময় নাই। শিগগির চলেন। যাওয়ার আগে আপনের হাতে জল খাইয়্যা যাউক।’

    সে কথায় কোনও প্রতিবেশীর মৃত্যু সংবাদের অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু হয় গোটা পাড়ার। হাতের কাজ ফেলে কেউ ছুটত শেষ দেখা দেখতে। দু’-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া জন্ম-মৃত্যু দুই-ই তখন বাড়িতে। মৃত্যু-মুহূর্ত আজকাল অনেকেই পাঁচজনের সঙ্গে শেয়ার করে। ফেসবুকে লাইভ সুইসাইড, চোখ সয়ে যাওয়া দৃশ্য। দারিদ্রপীড়িত মহল্লায় মৃত্যু তখন একটা ইভেন্ট। মৃত্যু পথযাত্রীর শিয়রে দাঁড়িয়ে মরতে দেখা, মৃত্যুযন্ত্রণা চাক্ষুষ করাই ছিল ভবিতব্য। কোথায় ডাক্তার, কোথায় হাসপাতাল। খাবি খেতে খেতে একটা সময় থেমে যেত দেহ। কেউ কেউ ছিলেন ডিগ্রিধারী ডাক্তারের থেকেও বেশি অভিজ্ঞ। অন্তিম ক্ষণ আসন্ন, বুঝতে পারতেন। ইশারায় বলতেন, ‘এ বার শুরু করো।’ নিকটজনেরা একে একে মৃত্যু পথযাত্রীর মুখে জলের ফোঁটা দেন। পরিজনেরা আত্মীয়, প্রতিবেশীকে তাঁর পারলৌকিক কাজের খবর দিতে গেলে বয়স্করা জানতে চান, ‘যাওয়ার সময় তরা মুখে জল দিতে পারসিলি? গদাধররে ডাকসিলি? সে জল দিসিলো?’

    এক-দু’টি পরিবার হয়তো ডাক্তার ডাকত। সেটাও ছিল মুখরক্ষার আয়োজন। হাসপাতাল নেওয়ার কথা বললে যেন মাথায় বাজ পড়ত। বেশির ভাগ সময়ই ডাক্তারবাবু পরিজনের কাঙ্ক্ষিত কথাটাই পেশাদারিত্ব বজায় রেখে বলে যেতেন। গলা নামিয়ে নিকটজনকে বলতেন ‘সময় ফুরিয়ে এসেছে। হাসপাতালে নেওয়া না-নেওয়া সমান।’ কী বললেন, ডাক্তারবাবু, শোনার দরকার পড়ত না। তাঁর চোখ-মুখ দেখে, তাঁর নীচু স্বরে কথা বলা থেকেই বাকিরা বুঝে যেতেন কী বলেছেন। সে সব দেখে বুঝেছি, আসল কথা, কাজের কথা মুখ ফুটে বলার আগে মানুষ বুঝে যা। অনুচ্চারিত বার্তাই মানুষ দ্রুত বোঝে, ভাল বোঝে। বলাই যায়, বোঝাবুঝির বোঝাপড়া।

    অনেক সময়ই ডাক্তারের কথা মিলত না। সময় ফুরোত না। মৃত্যু যেন চৌকাঠে এসে ভিড়ে ঠেলে আসতে পারছে না। পাড়ায় এক জন এ ভাবেই দিন সাত-দশ টিকে ছিলেন। এ সব ক্ষেত্রে, বলাই বাহুল্য, বড় কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠত সেই প্রিয়জন বা পরিজনের মৃত্যুসংবাদটি। তর সইত না। অপেক্ষা বিরক্তি বয়ে আনত। এখন মেশিন বাঁচিয়ে রাখে মাসের পর মাস। মেশিনে বেঁচে থাকা মানুষটির মৃত্যু একটা ডিসিশন।

    ডাক্তারের পরামর্শে পরিজনকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অনেকটা রাষ্ট্র নির্ধারিত মৃত্যুদণ্ডের মতো।

    অনেক মৃত্যুতে আবার এত কিছুর বালাই ছিল না। আচমকাই কোনও বাড়ি থেকে ভেসে আসত মরাকান্নার সুর। সঙ্গীত বিজ্ঞানের কোনও শাখায় নিশ্চয়ই সেই সুরেলা কান্নার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মিলবে। কান্না শুনে ছুটে গিয়ে গোটা পাড়া বিস্ময়ে আবিষ্কার করে, লোকচক্ষুর আড়ালে মানুষটা বেঁচে ছিলেন।

    ও দিকে, সকাল-দুপুর-রাত, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে শেষযাত্রায় গদাধর কর্মকার ক্লান্তিহীন। এক জীবনে একটা মানুষ কত জনের শেষ যাত্রায় সঙ্গী হতে পারেন? গদাদা হিসাব রাখতেন না৷ খবরের কাগজে তখন এই সব চরিত্র নিয়ে লেখালেখির চল থাকলে নিশ্চই লেখা হত, ‘মরা পোড়ানোয় সেঞ্চুরি করলেন গদাধর’৷ একশোতম যাত্রার প্রসঙ্গ উঠলে বলতেন, ‘আমি যে দিন খাটিয়ায় চাপব, সে দিন...’

    উচ্চতায় ছিলেন বড়জোর চার ফুট চার-পাঁচ ইঞ্চি৷ একমাথা সাদা বাবরি চুল৷ শীত-বর্ষা বারো মাস স্নানের আগে নিয়ম করে গোটা শরীরে তেল মাখা চাই৷ নাভিতে জলের ঝাঁপটা মেরে দু-কানে আঙুল গুঁজে ‘বোম বোলে’ হাঁক পেড়ে পুকুরে ডুব দিতেন শিব ঠাকুরের ভক্ত৷ তিন্নাথ, মানে ত্রিনাথ ঠাকুরের পালা গানের দল চালাতেন।

    ঘড়ি পরতেন না। তবু এক চুল এ-ধার ও-ধার হয়নি কোনও দিন৷ সন্ধে সাড়ে সাতটায় দোকানের ঝাঁপ ফেলে ছুটতেন বড় রাস্তায়। কালীবাবুর দেশি মদের দোকান খুব জনপ্রিয়৷ সেখানে দু্’টি বোতল শেষ করে এক ঠোঙা ছোলা ভাজা কিনে ফিরে আসতেন৷ দু’-আড়াই কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফেরার সেই পর্বটি ছিল রঙিন ও ঘটনাবহুল৷ পথচলতি মানুষ, দোকানি, বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, যাত্রী, ছেলেছোকরা, শিক্ষক-ছাত্র, মেয়ে-বউ থেকে শুরু করে, চোর-গুন্ডা-মস্তান মায় পুলিশ, তাঁকে দেখে এগিয়ে এসে ‘বোম বোলে’ বলে হাত পাততেন৷ তিনিও ‘বোম বোলে’ বলে ছোলা ভাজা এগিয়ে দিলে তা কপালে ঠেকিয়ে মুখে পুড়তেন সকলে৷ প্রসাদ!

    এক দিন জানা গেল, শরীর বিগড়েছে গদাদার। তা নিয়ে কথায় কথায় বললেন, ‘ডাক্তার বলসে, ছাড়বেন না। ছাড়লেই বরং বিপদ৷’ ডাক্তারের কথা ব্যাখ্যা-সহ শুনিয়েছিলেন গদাদা। বললেন, ‘ডাক্তার বলসে, এত দিন টানা খাওয়ার পর এখন ছাইড়া দিলে শরীর মানব না। তাতে বিপদ আরও বেশি৷’

    গদাধর কর্মকারের জীবনে মদ ছিল। মাতলামো ছিল না৷ দোকান-পরিবার নিয়ে আর পাঁচজনের মতো সহজ জীবন। গল্পগুজবে ঠাওর করতে পেরেছিলাম বাংলা মদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আড়াই দশক পেরোতে চলল৷ খবরের কাগজে একটা খবর হতেই পারত, ‘মদ আছে, মাতোলামো নেই, মদ্যপানে গদাধরের আড়াই দশক’৷

    চরিত্রটার টুকরো টুকরো কথা নানা সময়ে আমার মুখে শুনে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মনে ধরে গেল৷ শ্যামলদা আর আমি তখন এক কাগজে কাজ করি৷ তিনি সাহিত্যিক৷ তাঁর গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে আমার তেমন একটা পরিচয় নেই তখন৷ কিন্তু সাংবাদিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে কাছ থেকে দেখি৷ আমার চোখে তিনি সাংবাদিকতার প্রথমসারির সার্জেন৷ গল্পে গল্পে পেটের কথা টেনে বের করে আনতে পারতেন৷

    এক দিন কথায় কথায় শ্যামলদা বললেন, ‘চল যাই, গদাধর কর্মকারের সঙ্গে দেখা করে আসি৷’ মদ আছে, মাতলামো নেই, চরিত্রটা বেশ মনে ধরেছিল শ্যামলদার৷ পর দিন সাতসকালে গদাদার দোকানে হাজির হলাম শ্যামলদার ইচ্ছার কথা জানাতে৷ দেখি, চায়ের কাপে পাতি লেবু নিংড়ে রস বের করে এক চুমুকে রস মুখে পুড়ে পাড়া কাঁপিয়ে বললেন, ‘বোম বোলে’৷ শ্যামলদা তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে চাওয়ার হেতু শুনে বললেন, ‘কিন্তু আমি তো মদ ছেড়ে দিয়েছি৷’ বললাম, সে কী! কবে ছাড়লেন! বললেন, ‘দিনক্ষণ কি মনে থাকে৷ স্বপ্নে বাবা (মানে ত্রিনাথ ঠাকুর) কইল, অনেক খাইসস, আর না৷ এ বার ছাড়৷ ব্যাস, ছাইড়া দিলাম৷ নতুন নেশা লেবুর রস। রোজ সকালে একটা।’ বললাম, ‘আপনি যে বলেছিলেন, ডাক্তার বলেছেন, মদ ছাড়লেই বিপদ৷’ সহাস্যে বললেন, ‘ডাক্তার কি বাবার থিকাও বড় পণ্ডিত?’

    মদ ছেড়ে দেওয়ার সেই সিদ্ধান্ত দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল তাঁর পরিবারকে। পাড়ায় বহু পরিবারই মদ্যপ স্বামী-সন্তানকে নিয়ে বিব্রত। গোপনে মদ ছাড়ানোর টোটকা তখনও বাজারে আসেনি। নেশা ছাড়ানোর ক্লিনিক দূর অস্ত্। মদ খাওয়া নিয়ে নিত্য অশান্তি। ব্যতিক্রম ওই একটি পরিবার। ডাক্তারের পরামর্শ উপেক্ষা করার পরিনতি কী হয়, তা ভেবে বিচলিত তারা। ডাক্তারবাবু যে বলেছিলেন, এত দিন ধরে খাচ্ছে, এখন আচমকা ছেড়ে দিলে শরীর বিগড়োতে পারে। ভালর চেয়ে মন্দ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

    গদাধর কর্মকার মদ ছাড়লেও তাঁকে নিয়ে শ্যামলদার আগ্রহে ভাটা পড়েনি। এক দিন তাঁর সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে গিয়ে শ্যামলদা লিখলেন, ‘নিজেতে মজে থাকা এক রসখ্যাপা৷’


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৪ জুলাই ২০২১ | ২০৮১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | 14.139.***.*** | ২৮ জুলাই ২০২১ ১৯:৪৪496166
  • এটা সম্পাদিত  লেখা তো ? তাহলে " তা কপালে ঠেকিয়ে মুখে পুড়তেন সকলে৷ !" এটা সম্পাদক ​​​​​​​একটু ​​​​​​​শুধরে ​​​​​​​দেবেন? 


    ডিম অনেক ভাবে ভাগ হওয়া আমাদের বাবাদের মুখে শুনেছি। তবে বাবাদের বাড়ি(তিন দাদুর জয়েন্ট ফ্যামিলি, মর্নিং অ্যান্ড  ইভিনিঙ্গ ফর্টি লিভ্স ফল ) সম্ভবতঃ একটু স্বচ্ছল ছিলো, তাই বাড়ির ছোটোদের পাতে পড়ত তিন ভাগে ভাগ করা ডিম, ঐ সুতো দিয়ে কাটা।  ম্যাট্রিকপাশের ট্রীট হিসেবে এক দিদির সুবাদে প্রথম আস্ত ডিম মেলে। 

  • কৃশানু ভট্টাচার্য | 115.187.***.*** | ০২ আগস্ট ২০২১ ০৯:১৪496293
  • অসাধারণ স্মৃতি চিত্রণ। গদাধর এর দোকানে র মত দোকান অনেক পাড়া তে আগে ছিল। চার নম্বর দেশবন্ধু নগরে এমন একটি দোকান ছিল সুধীরের দোকান । আমরা বনধ বা আপৎকালীন দিনে কোয়ার্টার থেকে ঐ দোকানে যেতাম । তখনও দু পাড়া র পাঁচিল এত পোক্ত ছিল না। মাঝে ছিল একটা ড্রেন। বেশ চ ওড়া। যাবার আগে মা সাবধান করে দিতেন। 


    কলোনি জীবন এর জীবন্ত চিত্র।


    তবে একবার কলোনি র তাসের আড্ডা নিয়ে কিছু হোক

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন