এই যেমন হাঁদুর মা। ওর আসল নাম যে মঙ্গলা হাওলাদার তা পুরনো মানুষ ছাড়া জানে ক’জন? সবার কাছে ওর পরিচয় ‘হাঁদুর-মা’ নামে। হাঁদু ওর বড় ছেলে। মঙ্গলারা যখন ওদেশ থেকে চলে আসে, হাঁদু খুব ছোট। একসময় এলাকায় হাঁদুর খুব নাম ডাক ছিল। এই গ্রামের একমাত্র ‘বাঙাল পরিবারের ছেলে’ হিসেবে সে তখনকার দিনের উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করেছিল। গ্রামেও সেটা ছিল প্রথম পাশ। সেটা ‘পিউ’- এর যুগ। সবাই আশা করেছিল সে এবার একটা সরকারি চাকরি পাবে। চাকরি একটা পেল বটে। জুটমিলের ম্যানেজার। কিন্তু সেখানে গিয়ে বনেদি বাড়ির একটি ব্রাহ্মণের মেয়েকে বিয়ে করে বসে।
এর পর সে আর সেখানে চাকুরি চালিয়ে যেতে পারল না। বলা বাহুল্য আর কোন চাকরিই সে করে উঠতে পারল না। গ্রামের ভেতর, প্রাইমারি ইস্কুলের কাছে একটি গুমটি দিল। সেখানে নানান ছেলে ভুলানো জিনিস রাখল। ছোটবেলার ওর দোকান থেকে কত লজেন্স বিস্কুট কিনেছি। এখন হাঁদু ঘরে বসে-বসে বাতাসা বানায়। দোকানে দোকানে সাপ্লাই দেয়।
হাঁদুরা তিন ভাই। বাকি দুই ভাই হল বাদলা আর খুদে হাওলাদার। বাদলা বহুদিন আগে মাঠে কাজ করতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা যায়। সে প্রেম করে বিয়ে করেছিল গ্রামেরই মেয়ে সখিকে। এপাড়া-ওপাড়া বাড়ি। এরা হাওলাদার-ওরা কাঁড়ার। একই গ্রামে বাড়ি হলেও সখি কিন্তু বাপের বাড়ি ফিরে যায়নি। স্বামীর ভিটে আগলে রেখে ছেলে মেয়েকে মানুষ করেছে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে।
ছোট ভাই হল খুদে হাওলাদার। যেমন তাগড়াই চেহেরা তার, তেমনি শক্তি গায়ে। আর গলা কী! শুনলে সাত গাঁয়ের মানুষ জেগে ওঠে। ওদের বাবা সত্যচরণ হাওলাদার যখন মারা যায় তখন আমি গ্রামের প্রাইমারিতে আমি নিচু ক্লাসে পড়ি। টিফিনে বাড়ি এসেছি ভাত খেতে। দাদুর পাশে আসন পেতে বসে ভাত খাচ্ছি; সেই ভর দুপুরে সত্য হাতে একটা ডাঁড়া-কোদাল নিয়ে আমাদের বাড়ি উপস্থিত। কোদালটা আমাদের। সেটা ফেরত দিতে এসেছে। সকালে ওটা হাতে নিয়ে জমিতে গেছিল। কাজ মিটতে ফেরত দিতে এসেছে। দাদু তখন আমার ভাত মেখে দিচ্ছে। দাদু সত্যকে দেখে বলল, কীরে কোদালটা যে কাদামাটিতে একসা — ধুয়ে দিলি নে যে বড়?
সত্য চুপ।
কী রে?
ঠাকুমা আমাদের পরিবেশন করছিল। বলল, ও ঠাকুরপো, কী হল তোমার?
এবার সত্যর গলা দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরল।
দাদু কী বুঝল কে জানে। মুখে ভাতের গরাস তুলে বলল, বাড়ি যা সত্য। সে কোদালটা ডালিম গাছের নিচে রেখে থপথপ করে চলে গেল। বিকেলে শুনি সত্যর শরীর খারাপ। সে উঠতে পারছে না। কথা কইতে পারছে না। পরেরদিন বিকেলে সে মারা যায়। কী থেকে তাঁর কী হল, কেউ জানল না আজও। অনেকে বলে, ‘স্ট্রোক’। আবার অনেকে বলে, ‘চিতি সাপের বিষ গেছিল শরীলে। সে হল সেঁকো বিষ। আজ কামড়ালে কাল মরে।’
উঠোনের কথা যখন উঠল, সেই উঠোনের কাছেই ফিরে যাই আবার। আমাদের ছিল বিরাট উঠোন। সেখানে অন্যান্য গাছের সঙ্গে বাস করত এক ডালিম গাছ। সে গাছে ফি বছর প্রচুর ফুল ফুটত। অজস্র ডালিম ধরত। কিন্তু সবই ছিল ভোয়া। সন্ধেবেলা দাদু চ্যাটাই পেতে বসে গুনগুন করে গাইত, ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিমগাছের তলে’।
রাস্তার ধারেই বাড়ি ছিল আমাদের। তখন গ্রামের কাঁচা রাস্তা। বর্ষায় জঘন্য কাদা। গরমে এই ধুলো। আর হেমন্তে সে মাখামাখি থাকত শিশিরে। একদিন একটা লোক, সঙ্গে চটপটে লোকের দশজনের একটা টিম, যারা ফিতে দিয়ে রাস্তা মাপছিল। যারা সরকারি রাস্তার জায়গা দখল করে বাড়ি করেছে, তাদের বাড়ি ভেঙে রাস্তা বের করে নেবে সরকার। আমাদের মাটির ঘরের অর্ধেকটা ভাঙা পড়বে। কানে পেনসিল গোঁজা লোকটা জানিয়ে দিল। দাদু বলল, একশ বছর আগের এই আমাদের মাটির ঘর। এখন এই তুমি দুদিনের ছোকরা এসে বলছ ভেঙে দেবে? ব্রিটিশ আমলের ঘর কি এখন ভাঙা যায়? সরকারি লোক গম্ভীর মুখে বলে, মাপে যা বেরিয়েছে, সেটা আমি কেবল জানিয়ে গেলুম। এবার প্রশাসন বুঝবে।
দাদু রেগে বলে, যাও দিকিনি বাপু, আমার আর ঘর ভাঙতে এসুনি। কত শীত-গ্রীষ্ম এতে পার করে দিলুম, এখন তুমি এসে অন্য গল্প শোনাও। সাহেবরা ভাঙলে না তোমরা ভাঙবে? স্বাধীনতা এনে তাহলে কী লাভ হল? সাহেবরাই তো ঠিক ছিল।
শুনে সরকারি অফিসারেরা এ-ওর মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগলে। মাপ হল বটে, কিন্তু ভাঙাগড়া কিছু হল না। রাস্তা রইল রাস্তাতেই। ঘরের ভেতরে মানুষ সুখে ঘরকন্না করতে লাগল। একটু বড় হলুম, বড় ইস্কুলে পড়তে যেতে লাগলুম—তখন রাস্তায় মোরাম পড়ল। মাধমিক যখন দিই, ইটপাতা রাস্তা হল। কাদা নেই, জল জমা নেই, শিশিরভেজা নেই। রাস্তা আর আপন হল না, রাস্তা পড়ে রইল রাস্তাতেই।
আমাদের উঠোনে এক ঝাঁক উচ্চিংড়ে বাস করে। তারা সন্ধে থেকে পালা করে ডাকে। কখনো একসঙ্গে তিন-চারটি, আবার কেউ কেউ একা-একা ডেকে চলে ক্রমান্বয়ে। পড়াশুনোয় যেমন ব্যাঘাত ঘটায় তেমনি রান্না ঘরে কথা বলতে ব্যস্ত মা-ঠাকুমার আলাপপর্বে হানি হয়। তাই দিনের বেলা মাঝে মধ্যে আমরা উচ্চিংড়ে শিকারে বেরোতুম। গর্ত দেখলেই জল ঢালতুম। সে যে-কত জল লেগে যেত একটা গর্ত ভরতে তার আর ঠিক নেই। চালাক উচ্চিংড়ে সবসময় গর্তের দুটি মুখ রাখত। একটির থেকে অন্যটির দূরত্ব যেমন বেশি হত তেমনি সেই পালাবার গোপন পথটি বা দ্বিতীয় মুখটি থাকত ঝোপ বা ঘাসের ভেতর। ফলে সে সহজেই আমাদের নাগাল এড়িয়ে যেত। পালানোর পথ পেত না তারা, যারা একটি মুখের গর্তে বাস করত আর পালানোর পথটা প্রথম মুখের খুব কাছেই হত। তাদের কাউকে পিটিয়ে মারা হত, বা তারা এলাকা ছেড়ে কিছুদিনের জন্য হলেও পিঠটান দিত।
উচ্চিংড়ে চুপ করে গেলে একটু রাত গভীরে প্যাঁচারা ডাকে। নদীর পাড়ে শিউলিদের বড়-বড় তিনটি তেঁতুলগাছ। ফল ধরলে তারা গাছ বেচে দেয়। ফলে তেঁতুল পাকলে তাতে আর কারও কোন অধিকার থাকত না। আমরা যা একটু-আধটু লুকিয়ে-চুরিয়ে পাড়তুম—এর বেশি কিছু নয়।
সেই সব তেঁতুলের গাছে থাকে প্যাঁচারা। সব কুটুরে। একবার এক লক্ষ্মী প্যাঁচাকে আমাদের বাড়ির কার্নিসে গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে থাকতে দেখেছিলুম। এই বড় সে। সাদা দুধের মত গায়ের রঙ। এমন গম্ভীর ভাবে বসে ছিল যে-দেখলে সমীহ জাগে, ভয় লাগে। ঠাকুমা শুনে বলে, হবে না—আমাদের ঘরে যে স্বয়ং মা লক্ষ্মীর বাস!
তখন দাদু দুয়ারে বসে সুর করে বলত, ‘প্যাঁচা আর পাঁচানি, খাসা তোর চ্যাঁচ্যানি।’ তখন শুনি বাইরে থেকে গান ভেসে আসছে ভেতরে। সেই অন্ধকার মাটির রাস্তা ধরে হেলেদুলে ঘরে ফিরছে সোনা মান্না। সে প্রতিদিন একটিই গান গাইত, ‘আমি বনফুল গো, ছন্দে-ছন্দে দুলি আনন্দে…’
মাসখানেক পর একদিন মঙ্গলা আমাদের বাড়িতে এসে মাপারজোকের কথা তোলে। সে বলে, তোমাদের ঘর তো ভাঙলুনি দিদি! তবে যে-সিদিন সরকারি লোক এসে অত হম্বিতম্বি করলে? ঠাকুমা পান সাজতে সাজতে বলে, সে তারা জানে। সরকারি কাজ—অমনি হয়। পান মুখে পুরে ঠাকুমা বলে, আমাদের ঘর রাস্তার উপর পড়েছে না রাস্তা আমাদের ঘরের ভেতর ঢুকেছে, সেটা আগে দেখতে হবে নে?
হুম! পান দাও দিকিনি দিদি এট্টা। তোমার তো ঘর ভাঙার প্রশ্ন নেই। পান মুখে পুরে মঙ্গলা বলে, যা বলেছ! আমাদের ঘর পাড়ার মধ্যি; তোমাদের মেন রাস্তার উপর— ভাবনার কথা—তাই না? সেই ভেবে আনন্দে থাকুনি যেনো। বড় রাস্তা যখন ধরেছে, পাড়ার ভেতরের গলি রাস্তাও গরমেন্ট যে বের করে নেবে নে, এর কোনো গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে নে।
কথাটা ন্যায্য। বলে সে পানের বোঁটায় চুন নেয়।
ঠাকুমা বলে, আর তাছাড়া—সত্যিটা কী বল ত—তোমার নিজির কোন ঘরই নেই—এটা আমার শউরের ঘর—এ ঘর আমি গরমেন্টকে দেবো কেন? আমার কী দায় পড়েছে? চাঁদুর মা উঠে পড়ে। উঠোনে ঘুরতে থাকা ছাগলের দড়ি হাতে নিয়ে বলে, যাই দিদি।
দুই
বর্তমান মাগগিগণ্ডার বাজারে মঙ্গলাকে ওর ছেলেরা ও নাতিরা মিলে আলাদা করে দিয়েছে। ও দুয়ার ঘিরে থাকে। পলিথিনের ঘের। তার দুটি ছাগল আছে। তাদের দড়ি ঘরে সে পাড়ায়-পাড়ায় পরিক্রমা করে। পাড়ায় বলে বেড়ায়, ও সরকারি পয়সায় খায়। অন্ত্যোদয়-এর চাল হল ওর খোরাক। অসুখ-বিসুখ হলে ওই হাঁদুই যা-ওর একটু দেখভাল করে।
সরকারি ভাবে আমাদের সে ঘর আর ভাঙা হয়নি। বেশ কয়েক বছর পর মাটির সেই ঘর ভেঙে পাকা ঘর হয়। তখন রাস্তার জায়গা রাস্তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। শতাব্দীপ্রাচীন সেই একটা মাটির ঘর ভেঙে দুটি ঘর হয়। একটি বড় অন্যটি ছোট। ছোট ঘরটি ঠাকুমাকে দেওয়া হয়। দাদু মারা গেছে। একটি চৌকি, একটি ছোট আলনা আর দু’-তিন বস্তা ধান থাকত সেখানে। আলুর সময় আলু। কখনও পাটের গাঁটরি। এখন সেখানে বসে গল্প করে বৃদ্ধা মঙ্গলা আর প্রায় অথর্ব ঠাকুমা।
শিউলিদের তেঁতুলগাছ কেটে বেচা হয়ে গেছে। আগে যেমন বোরো চাষের সময় কারেন্ট থাকত না, হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে হত—এখন আর তেমন হয় না। এখনকার ছেলেরা কারেন্টের আলোয় পড়াশুনো করে। তাদের পায়ে কাদা লাগে না, শিশিরে ভেজে না। গ্রামের লোক বলে, ‘হ্যাঁ, গেরামে শহুরে বাতাস এসে গেল তবে—ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যে।'
এখন ইটপাতা রাস্তার দিন আর নেই। রাস্তা হয়েছে ঢালাই। সেখানে আর কাদা হয় না। মাটির পোকাদেরও দিন শেষ। কেঁচোরাও রাস্তার ধারে বাস করে না। মাটি তুলে রাখে না ঘাসেদের ফাঁকে। উচ্চিংড়ে কমে গেছে কত। বর্ষার ব্যাঙেরা এখন আ র রাস্তা পেরিয়ে আমাদের উঠোনে বাদলপোকা খেতে আসে না। মাটির রাস্তার ধারে-ধারে যে ঘাস, লতাপাতারা থাকত—তারাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে একটু-একটু করে। হারিয়ে গেছে বেনেবউ নামে এক ধরণের লাফানো পোকা।
হ্যাঁ, ঐ দুইজন সে-সব নিয়ে গল্প করে কত! সঙ্গে তাদের কথায় উঠে আসে বর্তমান সময়ের কথা। হাঁদুর মা বলে, এখুন চাদ্দিকে কীসব এন.আর.সি নিয়ে হৈ-চৈ হচ্ছে—শুনেছ দিদি?
হুম! ছেলেরা বাড়ির-জমির পুরানো দলিল খুঁজছে।
আমি তো কিছুই বুঝছি নে!
আমিও কী ছাই বুঝি? কিন্তু বুঝতে হয়।
তা কী বুঝলে আমারে বোঝাও।
ওই—ওখানেই গোল!
মানে?
নামে-নামে কাগজ চাই, নামে-নামে—তবেই মিলবে, নইলে মিলবে না। তুমি দেশে থাকবে কি থাকবে নে, তা ঠিক করে দেবে ঐ কাগজ।
মিলল আবার মিলল না? অবাক হয়ে চাঁদুর মা বলে, এর মানে কী?
আর বলো কেনো—তোর ভাসুরের নামেই তো সব এখনও। তা সে লোক আমাকে ছেড়ে কবেই চলে গেছে। নানা কাগজে তাঁর নানারকম নাম।
মানে?
কোনো কাগজে নামের পর আছে ‘ভূষণ’। তার পর পদবী। আবার কোনো কাগজে আছে ‘নাথ’। কোনো কাগজে আবার সে-সব কিছুই নেই—কেবল নাম।
তবে তো মুশকিলই হল!
কীসের মুশকিল? কোর্টে গিয়ে কাগজ বানালেই সব হয়ে যাবে। সব নাম একই লোকের—ব্যাস।
তা বড়ঠাকুর কীভাবে হাজির হবে কোর্টে? সে-তো সগগে এখন।
সে-সব হয়ে যাবে।
হলেই প্রমাণ হয়ে যাবে, তোমরা দিশি?
আবার কী! পুরনো কাগজ খুঁজতে গিয়ে বাড়ির সিন্দুক থেকে কী বেরিয়েছে জানো?
বলে দুলতে থাকে ঠাকুমা।
মঙ্গলা হুমড়ি খেয়ে পড়ে, কী?
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতার কাগজ—হুঁ-হুঁ।
ও- বাব্বা! ব্রিটিশ আমলের? মঙ্গলা ছিটকে ওঠে।
তবে আর বলছি কী!
তাতে কী লেখা আছে?
সেই কোম্পানীতে তোর বড়ঠাকুর-এর দাদু কাজ করত—সেই কাগজ। সেখানে তাঁর নাম লেখা।
বল কী!
তব্বে!
সেখানেও কি চার-পাঁচখানা নামের ধারা আছে—নাকি একখানি নাম?
একখানাই। এতেই তো কেল্লা মেরে দিয়েছি।
ও বাবা! এ দেশ থেকে তোমাদের তাড়ায় সাধ্যি কার? সরকারি লোক যখন তদন্তে আসবে—সামনে ওই কাগজখানা মেলে দিলেই সব গোল মিটে গেল—ব্রিটিশের কাগজ বলে কথা!
আব্বার কী! আর তাছাড়া আমরা এদেশি লোক—আমাদের তাড়ায় সাধ্যি কার; সে যতই কাগজ থাকুক বা না থাকুক—তাই না? নাও, পান নাও আরো একখানা।
তাই হাঁদুর মা হাত বাড়ায়।
নিজেও একটা পান মুখে দিয়ে ঠাকুমা বলে, গেরামে রটে গেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাগজ-এর কথা। ইস্কুলের মাস্টাররা সিদিন দলবেঁধে এসেছিল—দেখতে।
দেখালে?
হু-তো।
আচ্ছা!
তোমাদের তো সে-সবের পাট নেই। নিজির নামে কোন জমি নাই—সার্টিফিকেট নাই—কোন কাগজপত্র নাই—ওপারে সব ফেলে এসেছ—তোমরা কী দেখাবে গরমেন্টের লোক যখন এসবে?
এবার কি তবে জমি-জমা মাপবে নাকি? কে-কোথা চাকরি-বাকরি করতো—দেখবে সে-সব?
না-না। এবার মানুষ মাপবে। কে খাঁটি কে খাদ।
খাদ হলে?
বাদ।
মানে?
দেশি না হলে দেশ থেকে বাদ—এমনি শুনলুম—।
বাদ দিয়ে কোথা ফেলবে?
যার-যার দেশে ফিরত পাঠাবে।
ওদেশে আমাদের যে-আর কিছুই নেই। সব দখল হয়ে গেছে—কবে চলে এইছি—হাঁদুই তখন তিন বছরের। ল্যাংটা হয়ে এপারে চলে এল। বাদলা কোলে। সারা দিনমান বুকে থাকে আর বুকের দুধ খায়। দুধ খেতে-খেতেই সে সীমান্ত পেরুলে। তাই ওর গায়ে অত তাকত। কতদিনের কথা সে-সব—আর কী মনে রয়? কিন্তু এখন যা অবস্থা, সবই দেখি মনে রাখুতে হয়। মন বড় বিষম বালাই গো দিদি—কোথা ঠাঁই দিই তারে? তারে যে ঠাঁইনাড়া হতে দেওয়া যায় না! খুদে হল এদেশে। তেখন তো আর হাসপাতালে হবার চল ছিলুনি—হল বাড়িতে। ওরও তাই কোনো কাগজ নাই। ওখানে ফেরত পাঠালে কী করব? সবাইকে নে কী তবে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরব? দ্যাখো কারবার!
দূর—ওসব কিছুই হবে নে। তোমাদের ঘর কি ভাঙল গরমেন্ট? কারও ভাঙল? তোমরা ভালো বলে নিজিরা ছেড়ে দিলে—মাটির ঘর ভেঙে তোমার ছেলেরা পাকা দেওল দিলে—রাস্তা ছাড়লে—সবাই কি আর ছেড়েছে? এ-ও তেমনি। কিছুই হবে না। হুজুগ-হুজুগ!
ঠাকুমা দুলে-দুলে বলে, আর যদি হয়? তখন?
হলে আর কী? গরমেন্টের লোক এলে আমি আমার এই ছাগলখানাকে তাদের মুখের সামনে তুলে ধরব। বলব, বাবারা, আমার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে—এখন ওসব কোম্পানির কাগজ কোথা পাবো? আমি না দিশি হতে পারি, এই ছাগলখানা তো দিশি? এই ছাগলের লগে আমারে ছাড়ান দেও।
ঠাকুমা দারুন অবাক হয়ে যায়। বলে, তাই দেখাবে নাকি তুমি?
দেখাবো—আর কী! বলে সে হাত উল্টে দেয়।
আর ওরা দেখবে?
তাই দেখবে।
তাই বলে এই ছাগলটাকে দেখাবে?
গলায় জোর এনে মঙ্গলা বলে, কিছু দিশি জিনিস তো দেখাতে হবে—নাকি? তাই ছাগলখানাই সই।
যা, কী বলো! হয় নাকি এমন!
হাত-মুখ নেড়ে মঙ্গলা বলে, হয়-হয়—দেশ ভাগ হয়, মানুষ ভাগ হয়, ধম্ম ভাগ হয়— হুজুগের দেশে সব হয়।
এই বলে সে পরম মমতায় তার নতুন, ছোট্ট ছাগলটাকে কোলে তুলে নিয়ে গায়ে-মাথায় হাত বুলাতে লাগল।
পান মুখে পুরে ঠাকুমা বলে, আমাদের ঘর রাস্তার উপর পড়েছে না রাস্তা আমাদের ঘরের ভেতর ঢুকেছে, সেটা আগে দেখতে হবে নে?
আহা!!
মূল গল্প যদি ছেড়েও দি তাহলেও ইকোক্রিটিসিজমের দৃষ্টিভঙ্গিতে গল্পটি মূল্যবান।
ভালো লাগলো বেশ। ধন্যবাদ লেখককে।
ধন্যবাদ আপনাকে, রাজীব কুমার ঘোষ।
ভালো লাগলো।
খুব ভালো গল্প। কী অসাধারণ সহজ ও সাধারণ ভঙ্গীতে এগিয়েছে লেখাটি, আর পাঠকের অগোচরে তার মনের মধ্যে গড়ে উঠেছে গল্প। 'দেশ' এর এক চিরায়ত ধারণা।
অনেক ধন্যবাদ শ্রী শৈলেন সরকার ও আশিস বাবুকে।
একটি আন্তরিক আখ্যান। চিরকালের মানুষের গল্প। ভালো লাগলো।
ভালো লাগলো। ভালো থাকবেন।
খুব ভালো লাগলো।সময় অনুযায়ী লেখা।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
খুব ভালো লাগলো।সময় অনুযায়ী লেখা।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
খুব ভালো লাগলো।সময় অনুযায়ী লেখা।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
খুব ভালো লাগলো।সময় অনুযায়ী লেখা।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
ধন্যবাদ
"হয়-হয়—দেশ ভাগ হয়, মানুষ ভাগ হয়, ধম্ম ভাগ হয়— হুজুগের দেশে সব হয়।"
কদম হক কথা। এই গল্পটা খুব ভাল লেগেছে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো লাগলো।
খুব সুন্দর লেখা।
খুব ভালো লাগলো .... ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল ....
কী অসাধারণ লেখার হাত আপনার, সহজ সরল আন্তরিক। তেমনি মনছোঁয়া চমৎকার গল্প। সময়ের আখ্যান, সময়ের অনবদ্য দলিল। আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
কী অসাধারণ লেখার হাত আপনার, সহজ সরল আন্তরিক। তেমনি মনছোঁয়া চমৎকার গল্প। সময়ের আখ্যান, সময়ের অনবদ্য দলিল। আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
গল্পটা পড়ে খুব ভালো লাগলো। অভিনন্দন জানাই।
এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম। সময়োপযোগী অথচ কি সহজ সরল মানুষের কথা