গণতন্ত্রে শেষ কথা বলে জনতাই। একুশের বাংলার নির্বাচন এই সত্যিটাই আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল। ঝুড়ি ঝুড়ি টাকা ওড়ালে বা ধর্মের চোনা দিয়ে গোমূত্র খেলে বাংলাকে জেতা যায় না। যাঁরা খেলতে জানে, তাঁরা যে ভাঙা পায়েও প্রতিপক্ষকে ২১৬ গোলে হারাতে পারে, সেটা সারা দেশ দেখল। মাছ প্রিয় বাঙালি ধোকলাকে ডাবল ইঞ্জিনে চাপিয়ে সোজা পগারপার করিয়ে তবে ছেড়েছে। বাঙালির সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া কী এতই সহজ!
একুশের নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন অলৌকিক উত্থান একটা ঐতিহাসিক জয়। পশ্চিমবঙ্গের এই বিধানসভা নির্বাচনে লড়াইটা ছিল মমতা-মোদীর মধ্যে। এখানে দল নয়, খেলাটা আসলে খেলেছিলেন এই দু’জন। মমতা নিজেই দাঁড়িয়েছিলেন ২৯৪টা কেন্দ্রে। এবং মমতাই জিতেছেন ২১৬টি আসনে। এখানে তৃণমূল সুপ্রিমো নিজেই কোচ, নিজেই খেলোয়াড়। বাকিরা নিমিত্ত মাত্র।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার পেছনে সব থেকে বড় কারণ কিন্তু বাংলার মহিলা বাহিনী। বাঙালি পুরুষদের ভোট এদিক-ওদিক হলেও মহিলারা কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ভোট দিয়েছেন। নেত্রী যে শুধু একজন লড়াকু নারী তার জন্য নয়। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথীতে মেয়েদের নামে কার্ড-- এগুলোর সুফল EVM-এ আশীর্বাদের মতো ঝরেছে।
এর সঙ্গে ছিল একটা ভয়। বিজেপির অন্যান্য রাজ্যে মেয়েদের নিরাপত্তা বা নারীর সামাজিক সুরক্ষার যে ক্রম অবনতি, তা বুঝতে অনেক লেখাপড়া না-করলেও চলে। এমনিতেই বাঙালি মেয়েরা স্বাধীনচেতা হয়। কাজেই 'জয় শ্রীরাম' কেন 'সীতা-রাম' নয়, এটা বুঝতে বাংলার মেয়েরা দেরি করেনি। বাংলার মেয়েদের মতো সারা দেশের মেয়েরা যদি নিজের ভোটটা স্বাধীন ভাবে দিতে পারে, তবে বিজেপি কোনও রাজ্যেই দাঁত ফোটাতে পারবে না। কারণ ভারতের মোট জনসখ্যার প্রায় অর্ধেক কিন্তু এই মহিলা ভোটার।
সংখ্যালঘু ভোট বরাবরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ট্রাম্প কার্ডের মতো। মমতার ভোটে ভাগ বসাতে আব্বাস সিদ্দিকীকে দলে টেনে সংযুক্ত মোর্চা তৈরি করেও বাম-কংগ্রেস কিছু করতে পারেনি। সংখ্যালঘু ভোট কিন্তু মমতার ঝুলিতেই গেছে। মাঝখান থেকে বাম-কংগ্রেস ভ্যানিশ! এ ক্ষেত্রে বিজেপিরও একটা অবদান আছে। বিজেপি যত মমতাকে মুসলিম তোষণ, হিন্দু বিরোধী এসব আখ্যা দিচ্ছিল, সংখ্যালঘু মানুষেরা ততবেশি মমতাকে আপনজন ভেবে কাছে টেনে নিয়েছে। বিজেপির ভয় যত ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলেছে, মমতাকে তাঁরা ততবেশি ভরসা করেছেন। ফলে অধীর চৌধুরীর কংগ্রেস দুর্গও এ বার একদম ধূলিস্যাৎ।
শহুরে বাঙালির সমস্যা ছিল আবার একটু আলাদা। বিজেপির আগ্রাসন আসলে যে অবাঙালিদের আগ্রাসন সেটা বাঙালি আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিল। কলকাতার কেন্ত্রীয় দফতরগুলিতে হিন্দি ভাষায় সরকারি কাজ করার নির্দেশ থেকে শুরু করে রাস্তায় ঘাটে বাংলাভাষী বলে অপমানিত হওয়া। বাংলা ভাষায় কথা বলা বা খাদ্যাভাসে চিড়ে থাকা মানেই বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দেওয়া... বাঙালির শিরদাঁড়াকে শক্ত করেছে। এর সঙ্গে সিএএ, এনআরসি-র মতো বিজেপি-র অস্ত্রগুলো বাঙালির সেরা খেলা ফুটবলের আত্মঘাতী গোলের মতো কাজ করেছে। বাঙালি ভাষাগত, জাতিগত প্রবল বিপদের আঁচ পেয়ে এক হয়েছে।
এই বিধানসভা নির্বাচনে বাঙালি সিপিএম,কংগ্রেস বা তৃণমূলকে ভোট দেয়নি। বাঙালি বিজেপিকে হারাতে একাট্টা হয়ে ভোট দিয়েছে। আসলে বাঙালি বাংলাকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ফ্যাসিস্ট, হিটলারীয়, মেরুকরণ যার প্রধান অবলম্বন, নারী বিরোধী, স্বৈরাচারী মানসিকতার চরম ক্ষমতা লোভী একটা দলকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে। দাঁড়ি রাখলেই যে রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না, সেটা গুজ্জু মাসতুতোরা বুঝবে কী করে! গুজ্জুরা টাকা গুনতে জানে কিন্তু মগজাস্ত্র, সে তো বাঙালির সিক্রেট অস্ত্র।
'দিদি ও দিদি'... এমন অশালীন সম্বোধন করে যে প্রধানমন্ত্রী দিনের পর দিন একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে টিজ করতে পারে, বাংলা সত্যি তাঁকে চায় না। কাজেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালির একমাত্র অপশন। সিপিএমের শেষ ব্রিগেডে যে ভীড়, উন্মাদনা নজরে এসেছিল, বলা বাহুল্য সেটা EVM পর্যন্ত পৌঁছায়নি, নয়তো একটা আসনে ভরাডুবি হতো না।
কিন্তু চিন্তা অন্য জায়গায়। ভোটের ফলাফলের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এবার প্রধান বিরোধী দল ও দ্বিতীয় বৃহত রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভাব ঘটলো । তার মানে পায়ের নিচে শক্ত মাটি। বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো এরপর রাজ্যের ক্ষমতা দখলে আরো আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হবে। বারবার আর মোদী-অমিত শাহকে উড়ে আসতে হবে না। আগামীতে ফ্যাসিস্ট বিরোধী বাঙালির সামনে ভীষণ যুদ্ধ। কেন্দ্র থেকে সরাতে হবে এদের। কাজেই যাঁরা ভাবছেন, বলছেন 'খেলা শেষ', তাঁরা একটু সামলে। খেলা কিন্তু সবে শুরু।
ঠিক বলেছেন, আগামীতে আরও অনেক খেলা আছে!
বিজেপি হেরেছে বলে উল্লাসের খুব প্রয়োজন আছে কি? বিজেপি কোথায় হারল! ওরা একটা বেলুন তৈরি করেছিল। যা দেখিয়ে বলছিল পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ২০০-র বেশি সিট ওরা পেয়ে সরকার গড়ছে। এটা ওদের ভোট স্ট্র্যাটেজি। এর ফলে ওরা পাবলিকের কাছে প্রোডাক্টের প্যাকেজিং আকর্ষণীয় করে ফেলল। মিডিয়া সাহায্য করল। বাংলা দখলের লড়াইয়ে সব কাজ ছেড়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াল। ওরা তো এসব করে জিতেই গেল। ওরা ছিল তিন। হয়ে গেল সাতাত্তর। তাহলে হারল কোথায়? ওরা তো জিতেই গেল। ছিল রুমালের মতো ছিট কাপড়। হয়ে গেল বেড়ালের মতো সতেজ।
খাল দিয়ে কুমীর এল বাংলায়। একটা অসভ্য বর্বর দল এবার বিধানসভা কালো করে বসবে। তৃণমূল আর বিজেপি ছাড়া বিধানসভায় কেউ তো থাকলনা। তাহলে 'বিজেমূল' হল কই! এমনিতে দুই দলই সমান ধাঁচের। এরা সবাই মানুষকে কাজ ছাড়া সব কিছু দেবে বলেছে। সরকার এবার পাঁচ টাকায় ভরপেট খাবার দেবে। কাউকে দেবে টাকা। কাউকে আবার চাল ডাল চানাচুর। তাও বিনে পয়সায়। গাড়ি বাড়ি হাতি সব দেবে। শুধু বাপু কাজ চাইতে যেওনা। বেঘোরে মারা পড়বে। খবরও হবেনা। ছবি হয়ে নিজের বাড়ির দেওয়ালেই থেকে যাবে।
এইরকম ছিলনা বাংলার হাল। গত পাঁচ বছর ধরে বাংলার নামী মিডিয়াগুলো 'যুযুধান' বলে একটা শব্দের আওয়াজ তুলেছিল। তাতে তারা তৃণমূল আর বিজেপিকেই বোঝাত। মানুষের মনে এই দুই সখাসখি ছাড়া আর কেউ যে আছে তার আঁচ পর্যন্ত আসতে দেয়নি। মানুষ বুদ্ধিমান জাত হলেও রাজনীতি বোঝে কম। অনেকে তো বলেই ফেলে, রাজনীতি খুব খারাপ। ওসবের মধ্যে আমি নেই।
যাক গে। বিজেপি হেরে গেছে একথা বলা মানে বাংলায় বিজেপির এই অভূতপূর্ব উত্থানকে গুরুত্ব না দেওয়া। আর গুরুত্ব না দেওয়া মানে বাংলাকে অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দিতে সাহায্য করা। তাই বলছি বিজেপি হেরেছে বলে উল্লাসের কি খুব প্রয়োজন আছে! বিজেপি হারল কই!
এক
ফার্স্ট রাউন্ডে হেরেছে বৈকি। ৩ থেকে ৭৪) ওটা মোটাভাইদের যুক্তি। উত্থান তো ২০১৯শে হয়েছে। ১৮ সীট, প্রায় ৪০% ভোট। এবার সর্বভারতীয় শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর 24 গৃহমন্ত্রীথ 60 জনসভা। সেখানে ওদের ভোট প্রতিলত বৃদ্ধির জায়গায় 3% কমল, সীট মাত্র 74।
আটকে গেল বিজেপির পূর্ব ভারত জয়ের অশ্বমেধের ঘোড়া। এখানেই খুশি হওয়ার প্রশ্ন। বিজেপির এই জয়ের অখিল ভারতীয় গুরুত্ব অপরিসীম। আন্দোলনরত কৃষকেরা এখানে এসে প্রচার করে গেছেন। ঝিমিয়ে পড়া বিরোধীরা অক্সিজেন পেয়ে মূখর হচ্ছে। সামনে ইউপি নির্বাচন। এখন বিজেপীর অপরাজেয় ইমেজ ভাঙা দরকার ছিল।
অধিকাংশ বাম জনতা বিজেমূল থিওরি প্রত্যাখ্যান করে নো ভোট টু বিজেপি শ্লোগানে সায় দিয়েছেন।
কিন্তু লেখিকা ঠিক বলেছেন। লড়াই মাত্র শুরু।
বাংলার মেয়েদের মতো সারা দেশের মেয়েরা যদি নিজের ভোটটা স্বাধীন ভাবে দিতে পারে, তবে বিজেপি কোনও রাজ্যেই দাঁত ফোটাতে পারবে না।
ভীষণ ঠিক কথা। উত্তর ভারতের মহিলারা যে কতখানি সংরক্ষণশীল , পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ধ্বজাধারী , ধর্মীয়ভাবে গোঁড়া , তার পরিচয় প্রতিদিন পাই। জিন্স পরে আর গাড়ি চালিয়ে যে সুন্দরীরা ঘুরে বেড়ান রাজধানীর রাস্তায় তারা অনেকেই যে কী ভয়ঙ্কর প্রাচীনপন্থী তা অবিশ্বাস্য। শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে যে তার বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই সেটা আমার সহকর্মী অধ্যাপকদের মধ্যে চাক্ষুষ দেখতে পাই। আমরা বাঙালী মহিলারা লড়াকু আর প্রতিবাদী বলে কুখ্যাত আর এঁরা বিজেপির প্রতি সমর্থনে সোচ্চার ও গর্বিত।
লেখিকা যথার্থ বলেছেন |BJP এর সবচেয়ে বড়ো শক্তি হলো আরএসএস এবং তার তৃণমূল স্তর পর্যন্ত ছড়ানো সংঘটন |eei আরএসএস সমস্যার প্রকৃত চুড়ান্ত সমাধান কিসে হবে কে জানে ?
অনিন্দিতাদির সাথে ভীষণ ভীষণ ভাবে সহমত।
আর রঞ্জনদার সাথেও।
দক্ষিণ ভারতের অভিজ্ঞতা কি বলে? ব্যক্তিগত অভিমত, সেও খুব আলাদা নয়!