চাঁদের স্তিমিত আলোয় বিশ্বচরাচর ভেসে যাচ্ছে। একমুঠো বিষন্ন অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে, বিরহিণী।
শূন্য দৃষ্টিতে সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আসলে সে মনে মনে চাঁদের সঙ্গে কথা বলে। চাঁদ জিজ্ঞেস করে, _ 'কেমন কাটছে দিন? '
সে নীরব হেসে উত্তর দেয়, 'প্রত্যেকটা দিন আরেকটি দিনের পুনরাবৃত্তি। '
_ 'এই কোয়ারেন্টাইন কেটে গেলে কার সঙ্গে দেখা করবে প্রথমে?'
মেয়েটি ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, 'কারও সঙ্গে দেখা করার নেই আমার।'
_'সেকি ! সবাই কোয়ারেন্টাইনের পর, তাঁদের প্রিয় মানুষের সঙ্গে মিলিত হবার দিন গুনছে। তুমি বলছো, তোমার কারো সঙ্গে দেখা করার নেই।'
_'দিন গোনা আর দিন কাটানোর মধ্যে তফাৎ আছে, আমি দিন গুনেছি না। আমি দিন কাটাচ্ছি ।'
এক দুর্বোধ্য অভিমানে চোখের পাতা ভিজে যায়। মাথা নিচু করে নিজের পায়ের দিকে তাকায় সে। এখানে এত অন্ধকার, নিজের পায়ের পাতাও দেখা যায় না। চাঁদ বোঝে। কোনও শেষ না হওয়া অপেক্ষা, অনিবার্য নিয়তির মত বহন করছে মেয়েটি। বহু যুগ-যুগ ধরে, এমনই কত বিরহিণীর অশ্রুসিক্ত নত মুখ চাঁদ দেখেছে।
চাঁদ তো তাঁকেও দেখেছে। বৃন্দাবনের সেই একদা রাখাল সোহাগিনী, অনন্ত বিরহে উন্মাদ প্রায় রাই কলঙ্কিনী। কত প্রতিশ্রুতি ধুলায় মিশে যায়, কত আশা নীলকণ্ঠ পাখি হয়ে উড়ে যায়। চঞ্চলা সরলা বালিকা, আস্তে আস্তে পাষাণী অহল্যা মত পাথুরিয়া হয়ে যায়।
জন্ম থেকে মৃত্যু দূরত্ব কমতে কমতে এক বৃত্ত সম্পন্ন করে আর তার ব্যস জুড়ে বিরাজ করে শুধুই বিরহ। অভিমানের স্তুপে বিদ্যুৎ চমকায়, মুষলধারে বৃষ্টি নামে চোখে, কিন্তু সে আসে না যাঁর জন্য এত অপেক্ষা।
ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চাঁদ তাকায় পৃথিবীর দিকে। তাঁর তো আজন্ম কোয়ারেন্টাইন।
কতগ যুগান্তর ধরে সেও তো পৃথিবী থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখছে। কিন্তু কই, এত দূরত্বেও, আকর্ষণ তো কমেনি বিন্দুমাত্র। এত দূর থেকেও চাঁদ তাঁর সমস্ত ভালবাসা জোছনায় ভরে ছড়িয়ে দেয় পৃথিবীতে। চাঁদ জানে, পৃথিবীরা আছে বলেই পাগলপারা প্রেমও আছে। সুখ জাগানিয়া স্বপ্নরা আছে। বিরহিণীরা তো এক ধরণের বিদ্রোহিনীই বটে। প্রেমের থেকে বড় বিদ্রোহ কে কবে আর করেছে?