এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ভোটবাক্স  বিধানসভা-২০২১

  • লুচি, দর্শন ও ভোট

    গার্গী ভট্টাচার্য
    ভোটবাক্স | বিধানসভা-২০২১ | ২০ এপ্রিল ২০২১ | ২৫১৫ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • আজও, এই আন্তঃরাষ্ট্রীয় পিৎসা-বার্গার-এর যুগেও বাঙালিরা যাতে যাতে খাঁটি বাঙালি বলে প্রমাণিত হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হল লুচির প্রতি মোহ। পৃথিবী-সদৃশ গোলাকার, মেমসাহেবের মোম-গাত্রের ন্যায় শ্বেতবর্ণা, টিভি চ্যানেলে এক্সক্লুসিভ নিউজের মতো গরমাগরম। চোখের সামনে ঘি-এর মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছিল দিব্য, অমনি ফোনটা এল, স্বপ্নের তারটা গেল কেটে। আমি ফোন কর্তা/কর্ত্রীকে পরজনমে শুকনো মুড়ি খাবার শাপশাপান্ত করে রোববারের বরাদ্দ ঘুম ঘুম গলায় শুধোলাম – কে ভাই?
    - ভাই না, বোন। ওঠ রে দি। এদিকে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আর তুই পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস?
    - কী হল?
    - কী আর হবার বাকি আছে? গাদা গুচ্ছের পয়সা খরচা করে গানের মাস্টার রেখে ক্লাসিকাল শেখাচ্ছি ছেলেকে, এদিকে ছেলে আমার সারাদিন ‘লাভলি’ গাইছে!
    - লাভলি গাইছে? মানে?
    - তুই কোন জগতে থাকিস রে? শুধু বই-এর মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে থাকলেই চলবে? একটু বাইরের দিকে চা?
    - চা নয় রে, লুচি খেতে মনটা বড় আনচান করছে যে।
    - তাহলে আরকী, কুমড়োর ছেঁচকি দিয়ে লুচি খা, খেতে খেতে গানটা শোন। ভোট দিতে যাবি না নাকি?
    কটাং করে ফোনটা কেটে দিল বোন। কী যে সব বলে গেল, ভোট, লাভলি, দূর। সক্কাল সক্কাল মাথাটা এখনো নরম আছে, কিছুই বুঝতে পারলাম না, কেবল একটা কথাই রেশ রেখে গেল। ছোলা দিয়ে বহুদিন কুমড়োর ছেঁচকি খাওয়া হয় নি, সঙ্গে লুচি, আহা, স্বর্গীয়। না, না, লাভলি!
    কিন্তু ফ্রিজে দেখি তিনটে গাজর ছাড়া আর কিচ্ছুটি নেই, আর আমার রাঁধুনি মনে মনে আমার মাথাটা দিয়েই মুড়িঘণ্ট রান্না করা যায় কিনা ভাবছে। তৎক্ষণাৎ নিজ মাথা বাঁচাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে বাজারে রওনা হলুম।
    ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী ঘোর বসন্ত চলছে। কালই আমার এক বন্ধু কবি লিখেছেন, ‘বসন্ত এল গেল, তাতে কার কিবা হল’। সেইরকমই মনে হল, এদিকটাতে শিমূল, পলাশ, ফাগুন বউ কিচ্ছুটি ফোটে নি, কোকিলের ডাকও নেই। অগত্যা কুমড়োতে মন দিলুম। দোকানিকে শুধোলাম - কুমড়ো কত পড়বে? দাও দিকি।
    সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে - কী? কুমড়ো নিচ্ছেন নাকি? তা বেশ। ভালো ভালো। বাজারে এখন কুমড়োই বেশি চলছে।
    তাকিয়ে দেখি অমুক-বাবু, কানে ঝোঝুল্যমান মাস্ক, ঠোঁটে রহস্যময় হাসি, চোখে ততোধিক রহস্যময় দৃষ্টি। ইনি আমার প্রতিবেশী, বহুদিন দেখা-সাক্ষাত নেই।

    - হ্যাঁ, মানে ওই আর কী। তা আপনিও কি বাজার করতে?
    এহ্‌, প্রশ্নটা বড় বোকা বোকা হয়ে গেল। এখন যদি উনি বলেন, না, আমি সাঁতার কাটতে এসেছি, সেক্ষেত্রে আমার কিছু বলার থাকবে না। তা দেখা গেল, ইনি প্রকৃত ভদ্রলোক। আমার অবান্তর প্রশ্নে বিরক্ত তো হলেনই না, বরং কেমন ভাবুক গলায় বললেন - হ্যাঁ বাজারে, আসলে আমরা তো সকলে বাজারই করতে বেরিয়েছি। এই দুনিয়া বাজারময়, কেউ কেনে, কেউ বেচে দেয়।
    - কুমড়ো কিনবেন? – ইশশ্‌, আবার বাজে প্রশ্ন করলাম।
    - না, না, আমার আবার কুমড়ো খেলে গ্যাস হয়, বাঙালি কিনা, আমি ডালিমের সন্ধানে বেরিয়েছি। - ভদ্রলোকের রহস্যময় হাসি চওড়া হল।
    - ওহ্‌। ডালিম ভালো পাওয়া যাচ্ছে? – এমন করে বললুম, যেন আমি ডালিমের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছি।
    - আরে সে তো কবে থেকেই। তবে কিনা, ওপরটা দেখলেই চলবে না, ভেতরের লাল রঙটা দেখে কিনতে হয়। হাসি আরো বৃহত্তর ও তীক্ষ্ণ হল, আমি নেহাত মহিলা বলেই বোধহয় চোখ টিপলেন না। - তা আপনি কুমড়োই কিনুন। - বলেই এদিক ওদিক দেখে হাসিটা কপাত করে গিলে ফেলে অমুকবাবু সড়াত করে অদৃশ্য হলেন।
    - ও দিদি, তাহলে পুরোটাই দি?
    তাকিয়ে দেখি আমাদের কথোপকথনে উৎসাহিত দোকানি সেই আস্ত কুমড়ো কোলে করে বসে আছে। আমি আঁতকে উঠলুম – আরে না না, পাগল নাকি? চারশো-পাঁচশো মতো করে দাও।

    ব্যাপারটা ঠিক কী হল ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলুম। আমি ছোটবেলা থেকেই টিউবলাইট গোছের। এই দিব্যি জ্বলছে, এই মোক্ষম সময়ে একঘর অতিথির সামনে গৃহস্বামীর সম্মান সিলিং-এ তুলে দপদপ করতে শুরু করল। তারপর তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জ্বালাও। তা, আমাকে এরকম কসরত করে জ্বালানোর কাজটি করেন যিনি, তিনি আমার গৃহ-পরিচারিকা। বুদ্ধি অতি ধারালো, পাড়ার গুজব থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের হাঁড়ির খবর সব তিনি জানেন। বাজারের ব্যাগটা তার হাতে দিতেই সে চোখ পাকিয়ে খাস রাঢ়-বঙ্গীয় ভাষা-ছাঁদে বলল – বাজারে যেছিলে, মাস্ক পরো নে? করুণা আবার ফিইরে এয়েছে যে?

    পাঠকবর্গ হতাশ হতে পারেন, এখানে করুণা নামক কোন তন্বীর পরিচয় লাভের সম্ভাবনা নেই। করুণা মানে সেই গতবছরের পুরোনো পরিচিত হাড়-জ্বালানো করোনা। আন্তঃরাষ্ট্রীয় খ্যাতিসম্পন্ন অতিমারির এহেন বাঙালিসুলভ নামকরণের কৃতিত্ব যার, তাকে আমি রসিকতা করে আড়ালে ‘করুণাধারা’ বলে উল্লেখ করি। এক্ষণে আমি করুণাধারার কথায় আঁতকে উঠে বললুম - সেকি ফিরে এসেছে মানে? সে কি পাগলা দাশু যে, ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’?

    এসব সাহিত্য-কীর্তি তার জ্ঞানের আওতায় আসে না, সে সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল - টিবি-তে বলছে, ফেসবুকে বলেছে। তুমি তো কোন খপর রাকো না। হুঁ। - বলে সে তার নিজস্ব ভঙ্গীতে ঝাঁড়পোছ করেও কীকরে ধুলো রেখে দেওয়া যায় – সেই অতি বিস্ময়কর কর্মে মনোনিবেশ করল। আমি সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলুম, সব দিকে দৃষ্টি দিলে দৃষ্টি ও সৃষ্টি দুইই নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে। তবে কিনা একথা ঠিক যে, বাইরের ‘খপর’-এর থেকে আমি কণ্বমুনির আশ্রমে ক’টি আমগাছ ছিল, বা দুষ্যন্ত সত্যিই তেঁতুল খেত কিনা – সেবিষয়ে মনোযোগ দিতে বেশি পছন্দ করি। আর তদ্ভিন্ন জগত-সংসার সম্বন্ধে আমি শঙ্করাচার্যের সাথে ঘোরতর একমত – ‘মিথ্যা, মায়াময়, একটি ভ্রমমাত্র’। কিন্তু ‘করুণা’ যে অতি সত্য, অগত্যা বহুদিন চুপচাপ বসে থাকা টিভিখানি খুললুম।

    ওমা, করোনার খবর কোথায়? অতি কষ্টে দেখি, টিভি স্ক্রিনের একেবারে নিচের দিকে সরু একফালি জায়গা সে অধিকার করেছে। বাবা, কে সেই মহাশক্তিশালী যা অমন নাছোড়বান্দা করোনাকে সরিয়ে জায়গা দখল করে নিয়েছে?

    - এখন টিবি-তে কিচ্ছু পাবে না। সন্দ্যের খপর দেখো’খন। এখন তো সারাদিন ভোট দেখাচ্ছে। - ন্যাতা-বালতি হাতে তাঁর প্রবেশ।
    - ওহ্‌, সত্যি তো, ভোট এসে গেল বুঝি?
    আমার অজ্ঞতায় একটি অতি উচ্চাঙ্গের হাসি ফেরত এল – এয়ে গেলই তো। ওদিকপানে হতে হতে এয়েছে।
    - ওদিকপানে? মানে?
    - দিল্লী থেকে শুরু হয়েছে, রাজস্থান, বিহার হয়ে আসছে যে? আমাদের একানে সব্বার শেষে আসবে।
    হক কথা, টিভিতে দেখাচ্ছে আট দফা ভোটে আমরাই শেষ দানটা দেব। আর যে মার্গদর্শন হল, তাতে আমার রাজনৈতিক অশিক্ষা খানিক অপসারিত হল। তখনো জানি না যে, আজ সারাদিনে এরূপ আরো অনেক আলোকপ্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে। আপাতত আমি কৌতূহলী হলাম –
    - তা, কাকে দেবে ভোট? কিছু ঠিক করলে?
    - ‘গ’কে। প্রতি বছর ‘ন’কে দি।
    - কেন দেবে?
    - কেনে দেব না? কত কিছু দিছে।
    - কে কী দিয়েছে?
    স্মৃতি হাতড়াতে সময় লাগল, তারপর খানিক ধন্দে পড়ে বলল – সে বলতে পারবুনি, মোটকথা, এবছর নতুন কিচু করি।
    - বলো না, বলো না, এক্কেবারে বলো না, কাকে ভোট দেবে। - জলখাবারের থালা হাতে রাঁধুনীর ক্ষিপ্র প্রবেশ। - এসব বলতে নেই। আমরা না ইসে বাস করি? মানে কী যেন? ও, গণতন্ত্রে?

    থালাখান আমার হাতে ধরিয়ে সহকর্মীকে আরেকবার সাবধান করে তার আরো দ্রুত প্রস্থান। ন্যাতা-বালতিও তৎক্ষণাৎ মুখে আগল লাগিয়ে নিজ-কর্মে মন দিল। আমি কুমড়োর ছেঁচকি সহযোগে লুচি মুখে পুরে দার্শনিক হয়ে গেলুম, সদ্যোত্থিত প্রশ্নটি অতি জটিল।

    করুণাধারা ও তার সহকর্মিণী প্রস্থান করলে গৃহে অপরিসীম শান্তি বিরাজ করতে লাগল। তা শান্তির যা ধর্ম, বেশিক্ষণ একজায়গায় থাকে না, আজও তাই হল। আর মোবাইল বলে বস্তুটি তো বর্তমানে সাক্ষাৎ শনির বাহন হয়েছে। সেপথে আমার এক সহকর্মী প্রবেশ করে রাগ, রঙ্গ, হতাশা, আবেগ মিশ্রিত বিচিত্র গলায় বলল –
    - খবর পেয়েছ?
    আবার খবর? আমি যত খবরকে ত্যাগ করতে চাই, সে দেখি তত বিরহিনী রাধার মতো আমার পেছু পেছু আসে। কী মুস্কিল!
    - না পাই নি। কীরকম খবর?
    - কীরকমটা চাই? ভালো-মন্দ দুইই আছে ঝোলায়।
    - তা, ভালোটাই বের করো আগে। খারাপটা তো ফ্রিতে আসবে।
    - চমৎকার বলেছ। ভালো খবর – তোমার আমার সকলের ভ্যাকসিন নেবার ডাক পড়েছে।
    - বা বা, অতি উত্তম। তা এতো তাড়াতাড়ি? আমরা তো আট-ও নই, অষ্ট-আশীও নই।
    - আরে, সেখানেই তো মোক্ষম প্যাঁচ। খারাপ খবরটা হল - ভোটের ডিউটি আসবে। ভ্যাকসিনেশানের লিস্টে জ্বল-জ্বল করছে – ফ্রন্ট লাইন ওয়ার্কার পোলিং অফিসিয়ালস। বুইলে?
    সে কী? আমরা না নারীকুল? মাত্তর দুটি তো জায়গা বেঁচে ছিল, একটি বাসের লেডিস সিট, আরেকটি ভোটের ডিউটি থেকে মুক্তি। আরো কমে গেল?
    - সেকথা বললে চলবে না ভাই। এবারে পিঙ্ক বুথ হচ্ছে প্রচুর।

    পিঙ্ক তো সিনেমা অবধি ঠিক ছিল। ওরে বাবা। কথাবার্তা আর এগলো না। ফোন রেখে ভাবতে বসলুম। মানসচক্ষে ভেসে উঠল রুক্ষ প্রান্তর, মাথার ওপর গনগনে সূর্য, প্রচুর মানুষ, কিছু রক্তচক্ষু, কিছু নোয়ানো মাথা, কিছু উদ্ধত হৃদয়। মন ভারী হয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে আরো ছবি ভেসে উঠল, যেন জীবন্ত চলচ্চিত্র, তার মুখ্য চরিত্রে আদি ও অকৃত্রিম আমি, বিভিন্ন রূপে আমি। গলদ্ঘর্ম নাজেহাল আমি থেকে শুরু করে ভয়ে ও আশঙ্কায় শুকিয়ে আমসি হয়ে যাওয়া আমি, বাথরুম খুঁজে না পাওয়া আমি, ভোট করিয়ে যানবাহনের সন্ধানে ছুটে বেড়ানো আমি, সবশেষে শহীদ আমি, আমার মর্মর মূর্তিতে মালা দিতে এসেছে…। উফফ্‌, গলা শুকিয়ে কাঠ।

    উঠে গিয়ে জল খেলুম। কলিং বেল বাজল - টং। কেবল-এর ছেলেটি। অনলাইন ক্লাশ নিতে হাইস্পিড ইন্টারনেট চাই। প্রস্তাবটা দিলে সে বলে – একদম চিন্তা করবেন না দিদি। এক্ষুনি মালটাকে চালু করিয়ে দিচ্ছি। পয়সাটা শুধু দিয়ে দিন।
    - সে তো দিচ্ছিই। কিন্তু তাও যদি না হয়? মানে ইন্টারনেট আর টিভি একসাথে ঠিকঠাক চলবে তো?
    - চলবে না মানে? সব চলবে, সব হবে। টিভি হবে, নেট হবে, খেলা হবে।
    - না, না, খেলার চ্যানেল দরকার নেই।

    ছেলেটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সেও একটি অতি উচ্চাঙ্গের হাসি উপহার দিয়ে বলল - এ খেলা সে খেলা নয় দিদি। আমি বলছি খেলা হবে, এবার খেলা হবে।
    অমনি পেছন থেকে আরেকজন মুখ বাড়িয়ে বলল – এবার খেলা শেষ হবে।

    আরে, এ তো দেখছি পাড়ার অন্য কেবল-ওয়ালা, নতুন ব্যবসা শুরু করেছে। আমি ইন্টারনেটের খোঁজ করছি শুনে ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি ডেকে এনেছে। দেখতে দেখতে গজকচ্ছপের লড়াই শুরু হয়ে গেল, তবে সবটাই মুখেন মারিতং আর কী। গলা উঁচু করে এ বলে, বলছি খেলা হবে, ও চোখ রাঙিয়ে বলে, খেলা শেষ হবে। দূরছাই, আমি খেলবই না। দিলাম দুম করে মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।

    দুপুরে পেটে কিছু পড়তে মাথাটা ঠাণ্ডা হল। ভেবে দেখলুম, আমি অনেক পিছিয়ে পড়েছি। সোস্যাল মিডিয়াতে আমার প্রবেশ সীমিত, তবু এদিক ওদিক থেকে জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করলুম, কিন্তু এ যে দেখছি বিচিত্র সব পরিভাষা। হরিচরণ বন্দ্যো বা মনিয়ার উইলিয়ামস থেকে শুরু করে চলন্তিকা বা শব্দকল্পদ্রুম – কেউই এইসব নতুন নতুন পরিভাষার সন্ধান দিতে পারবে না। অথচ ঘর করি আমি এদের নিয়েই। অনেক ভেবে আমার আর এক বন্ধুর শরণাপন্ন হলুম। রাজনৈতিক সিধু-জ্যাঠা টাইপের। তার বর্তমানের গবেষণার বিষয় – ‘ভাষা, পরিভাষা ও সামাজিক পরিস্থিতি’। দেখা যাক, যদি কিছু সুরাহা হয়।

    ফোনের ওপাশ থেকে একটি অতিমাত্রায় খিঁচড়ানো গলা ভেসে এল – হ্যালোহহহ।
    - কী রে, কী হল? মেজাজ গরম নাকি?
    - আরে, মেজাজের তো …বিপ বিপ।
    - যাহ্‌ বাবা, হল কী?
    - হবে আর কী, বলি ভোট, নাকি ‘অমর প্রেম’ ২০২১ ভার্সান?
    - আহা, বসন্তকাল চলছে। খেপছিস কেন? তোর জীবন শুকিয়ে সাহারা হয়েছে বলে কি সকলেরই তাই? অত পরশ্রী-কাতরতা ভালো নয়।
    - শ্রী বললি, না স্ত্রী বললি?
    - বলছি ঈর্ষা ভালো নয়।
    - ঈর্ষা, হুহ্‌। বাকি খবর শুনেছিস? ভোটের সম্ভাব্য রেজাল্ট যা বলছে, মাথা কি আর ঠিক থাকে…বিপ, বিপ, বিপ। মনে হচ্ছে, পুরোনো দলে আবার নাম লেখাই। একটা ন্যারেটিভকে কাউণ্টার করার জন্য আরেকটা ন্যারেটিভেরই দরকার হয়।
    - তা বেশ তো। সকালে তো একবার টিভি খুলেই দেখলাম দল বদলের মেলা বসেছে। তা তুইও যা।
    - যাব যাব, দাঁড়া, সামনে পরপর দুটো প্রমোশান। হয়ে যেতে দে, তারপর দেখবি।
    - সেকি? আর তোর ন্যারেটিভ? তোর আদর্শ?

    - কী রে? ব…ল…ছি… তোর ন্যারেটিভ?
    - কিছু শুনতে পাচ্ছি না। হ্যালো? হ্যালো???
    - হ্যালো…হ্যালোওওও…
    যাহ্‌, ফোনটা সশব্দে কেটে গেল। পরিভাষাগুলো জানা হল না যে?

    সন্ধ্যা হয়ে গেছে কখন। মাইকে হনুমান চালিশা গোছের একটা কিছু ভেসে আসছে। গলির মোড়ে এই মন্দিরটার বয়স সবে পাঁচ। নতুন করে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়েছে বছর দুই। রাস্তার ওপাশে খানিক দূরে একটা শনি মন্দির ছিল, আগে ভক্ত সমাগম প্রচুর হত ফি শনিবারে, এখন তিনি তাঁর রাজ্যপাট হারিয়েছেন, অঞ্জনপুত্র পবনসুতনামার পাল্লা ভারি হয়েছে। শনিমহারাজ চুপচাপ অপমান হজম করে করুণদৃষ্টিতে রাস্তার এপারে তাকিয়ে থাকেন।
    রক্তে চিনির পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় ডাক্তার হুমকি দিয়েছেন, বেশি রাত করে খাওয়া, জাগা দুইই বারণ। খেতে বসলুম। ক্যাসারোল খুলে দেখি, আবারও লুচি। সেই সকালেরটাই। তবে এবারে তার বার্ধক্য দশা এসেছে, বিকশিত যৌবন গায়েব। গায়ের চামড়া কুঞ্চিত, শ্বেতবর্ণ ম্রিয়মান, ন্যাতানো, শুকনো এবং ভয়ানক রকমের বিরক্তি ও অম্বল উৎপাদনকারিনী। কী আর করা যাবে, যা আছে কপালে তাই সই।

    কোথায় যেন শুনেছিলাম, ঠাণ্ডা লুচিকে নাকি ‘নুচি’ বলে। তা সেই নুচি চিবোতে চিবোতে আবার দার্শনিক হলাম – জগত সংসারও কি এরূপ লুচি থেকে নুচি হয়ে যাওয়া নয়? এই যে ভোটযুদ্ধ, বা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, এতো সাজসরঞ্জাম, এতো ফুলকো ফুলকো চেহারা, গরম গরম ভাপ, কড়াই থেকে উঠছে আর হাপিস হয়ে যাচ্ছে, সবই কি শেষ পর্যন্ত নেতিয়ে যাবে না? সিংহাসনে বসল কে, তাই নিয়ে অঙ্ক যতই কষা হোক, আমাদের রোজকার খাতায় তার হিসেব কতটুকু? জীবনে তার প্রভাবই বা কতটা? আমি তো সেই আমিই থাকব। কাল সকালেই তো আবার কণ্বমুনির আশ্রমের আমগাছ গুনতে বসব।

    বিধাতা লোকটি বড় রসিক। তবে তার রসবোধটি যে জিলিপির মধ্যে পোরা থাকে তা আর বলতে? প্যাঁচের পর প্যাঁচ। এই যে আমি এত ভেবে জীবন, ভোট ও লুচি সম্বন্ধে গুরুগম্ভীর একখান উপসংহারে পৌঁছলাম এবং পা নাচাতে নাচাতে নিজের উচ্চ চিন্তাভাবনায় নিজেই আপ্লুত হবার তাল করছিলাম, সেটা ভদ্রলোকের সহ্য হল না। তক্ষুনি আমাকে ভুল প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগলেন। আবার কলিং বেল বাজল – টং।
    খুলে দেখি আবার করুণাধারা। কী হল এত রাতে?

    - তোমায় জানাতে এলুম। কাল আসতে পারবুনি। পার্টির মিটিং আছে।
    - কোন পার্টি?
    - ‘জ’।
    - সেকি, তুমি যে বললে, ‘গ’ কে ভোট দেবে?
    - তাতে কী? ‘জ’ বলেছে, গেলে দুপুরের খাওয়া দিবে।
    তারপরই শেষ মিসাইলটা ধেয়ে এল আমার দিকে।
    - আর শোনো, তোমার রান্নার লোকও বলচে আসবে না। তাই খপর দিয়ে গেলুম।
    - কী আশ্চর্য। এরকম হঠাৎ কামাই করলে চলবে কেন?
    - সে কী করা যাবে। ভোট পর্যন্ত এরকমই চলবে গো। একটু মানিয়ে-গুচিয়ে নেও। বলেচে, ফিরজে ময়দা মাখা আছে, কাল লুচি করে নিও।
    - ওহ্‌, আবার? লুচি আর নয়, প্লিজ।
    - আমাদের হপ্তাহে একদিন, মানে হল গিয়ে মাসে চারদিন ছুটি চাই। বেগার খাটনি, আর নয়।

    বলে তিনি সদর্পে বিদায় নিলেন। আর আমি বুঝলাম আমি ভুল, আদ্যন্ত ভুল, আমার গণনা, থিওরি, দর্শন সব ভুল। শঙ্করাচার্য ভোট দেখেন নি। দেখলে নিশ্চয় বলতেন, ‘ভোটই সত্য, বাকি সব মিথ্যা’।

    [গপ্পোটা গপ্পোই]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ভোটবাক্স | ২০ এপ্রিল ২০২১ | ২৫১৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • নুচি | 165.225.***.*** | ২০ এপ্রিল ২০২১ ২০:৫৯104962
  • উত্তর কলকাতার ( মানে শ্যামবাজারের নিকটস্থ আদি জনতা) পৃথিবী-সদৃশ গোলাকার, মেমসাহেবের মোম-গাত্রের ন্যায় শ্বেতবর্ণা, টিভি চ্যানেলে এক্সক্লুসিভ নিউজের মতো গরমাগরম বস্তুকে 'নুচি' নামে ডেকে থাকেন। 


    তাহার সাথে বিগতযৌবনের কোন যোগ নাই। অর্থাত "নুচি" বিগতযৌবনেও "নুচি"। 


    বি দ্রঃ এ প্রসঙ্গে " ও গো নুচি, তোমার মান্য ত্রিভুবনে" গান স্মর্তব্য। 

  • Ranjan Roy | ২১ এপ্রিল ২০২১ ০০:৫৩104966
  • নুচি নেবু নুন নেকু সব উত্তর কলকাতার ঘটিদের কম্ম।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন