অমর্ত্য কালো অন্ধকার চারদিকে, আলো নেই কোথাও। আসমানেও কোন তারা ফোটেনি।বিশ্ব চরাচর জুড়ে এক নিবিড় তমসাচ্ছন্নতা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে সবকিছু। আঞ্জুমান বুঝতে পারে না, সে চোখ বন্ধ করে আছে, না তাকিয়ে আছে। কোন তারা বা কোন নক্ষত্র নেই আকাশে যে তাকে নিজের অস্তিত্ব দিয়ে আশ্বস্ত করবে। পথ দেখাবে। দাদাজান বলতো, "যখন খুব একা লাগবে, তখন কালো আসমানের দিকে তাকাবি। দেখবি অন্ধকারের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট আলোরা টুকরো টুকরো অনেক শরীরে ভাগ হয়ে মিটমিট করে রাতের শোভা বাড়াচ্ছে। তখন তোর আর একা লাগবে না"।
নিজেকে খোঁজে আঞ্জুমান। টুকরো টুকরো হয়ে বিখরে যাওয়া নিজেকে খোঁজে সে। ওই... ওই আবার শুরু হল। হায় আল্লাহ, এই দোজখ যন্ত্রণার কি কোন শেষ নেই। কত পাপ, কার পাপ ? সামনেই শাদি। কত স্বপ্ন কত আশা এক-একটা অমানুষিক মোচড়ে পেটের নাড়িভুঁড়ির সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্নগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে। চেতন আর অবচেতনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে সে।
দাদাজান খুব ভালো রান্না করতে পারে। আর দাদাজানের হাতের কলিজা ভুনা যারা খেয়েছে তারা জানে কি অপূর্ব স্বাদ। সে আবদার করেছিল কলিজা ভুনা খাবে। একমাত্র নাতনীর আবদার মেটাতে পাঠার কলিজা এনেছিলেন তিনি। সংসারে এই দুটি মানুষের আপন বলতে আর কেউ নেই। সন্ধ্যায় কতগুলো লোক জোর করে বাড়িতে ঢুকলো। কেউ চেনা, কেউ অচেনা। ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে লোকগুলো চিৎকার করে বললো, এগুলো গরুর মাংস। রান্নাঘরের দরজার আড়ালে ভয়ে তখন কাঁপছিল আঞ্জুমান। তার বৃদ্ধ দাদাজান অনেক বার বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু দাদাজানের কথা কেউ শুনল না। আঞ্জুমান শুনেছিল দাদাজানের শেষ চিৎকার, "পালিয়ে যা বেটি, পালিয়ে যা"।
পেছনের দরজা দিয়ে ছুটল সে। খালি পায়ে, যেদিকে দু'চোখ যায়। কিছুটা যাওয়ার পর কতগুলো লোক তাকে ধরে ফেলল। তার মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে টানতে টানতে নিয়ে গেল কোথাও। আর তারপর...
উষ্ণ গরম জলের ছিটে লাগলো মুখে। দুর্গন্ধময় লবণাক্ত জল। পেচ্ছাপ করছে কেউ ওর মুখে। ভেজা নরম মাটি আর ভেজা বাতাসে মাছের গন্ধ। নদীর ধারে আছে সে। পালাতে হবে, যে করেই হোক এখান থেকে পালাতে হবে। হাতের বাঁধনটা আলগা ছিল। সেটা কোন মতে খুলে আস্তে আস্তে দাঁড়াতে চেষ্টা করলো অঞ্জুমান। কিন্তু কোমরের নিচে কোন সাড় নেই।
নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল সে। সরীসৃপের মত। খপ করে পা'টা টেনে ধরলো কেউ। -"শালী এখনো খুব তেজ তোর"।
দেখতে পাচ্ছে আঞ্জুমান অন্ধকারটা ফিকে হয়ে আসছে। লোকটা চুলের মুঠি ধরে শোয়া থেকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল তাকে। অনেকেই শুয়ে আছে এদিক ওদিক। হয়তো মদ খেয়ে বেহুশ তারা। বাঁচতে হবে এই সুযোগ। তার শতছিন্ন শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ার মুহূর্তে লোকটার গলায় কামড় দিলো আঞ্জুমান। মরণ কামড়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। লোকটা অনেক চেষ্টা করল নিজেকে ছাড়াতে কিন্তু পারলো না। কামড় একটুও আলগা হলো না, ধস্তাধস্তির পর নেতিয়ে পরলো লোকটা। আঞ্জুমানের মুখে রক্তের স্রোত। তার শরীরে আর শক্তি নেই। কামড় আলগা করতেই লোকটা কাটা কলাগাছের মত পরে গেল। আঞ্জুমান একবার লাথি মেরে দেখল, লোকটা নড়লো না। কাদার উপর দিয়ে এগিয়ে চলল আঞ্জুমান। ওরা যে কোন সময় ধরে ফেলতে পারে।
নদীর তীরে অনেক বিসর্জিত প্রতিমা পড়ে রয়েছে। সামনে ছোট্ট মন্দির। আঞ্জুমান ওখানে আশ্রয় নিল। মন্দিরে কোন প্রতিমা নেই। বেদির ওপর শুধু একটা কাঠাম দাঁড় করানো। বাঁশের কঞ্চির হালকা পলকা কাঠাম। পাশে তেল ফুরিয়ে যাওয়া প্রদীপটার বুক জ্বলছে। লুকোনোর কোন জায়গা নেই এখানে। দরজার ওপরে একটা লোহার খড়্গ টাঙ্গানো ছিল। সেটাই হাতে নিল আত্মরক্ষার জন্য।
পুরোহিত মশাই অভ্যাস মতো ভোরে মন্দিরে এলেন। সঙ্গে তিন বছরের নাতনী। নাতনীর হাতে একটা সাদা জবা। দাদু বললেন, "এখনতো ঠাকুর নেই, তুমি কাকে ফুল দেবে মা" ? নাতনী হেসে দৌড়ে মন্দির ঢুকে গেল। মন্দিরের দরজা খোলা দেখে অবাক হলেন পুরোহিত মশাই, এত সকালে তো কেউ আসে না।
বাইরে কিসের যেন শব্দ হচ্ছে। আঞ্জুমান ভাবলো ওরা এসেছে। সে কাঠাম এর সামনে দাঁড়িয়ে খড়্গশুদ্ধ হাতটা ওপরে তুললো। নাতনী দৌড়ে এসে থমকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
সে ভিতর থেকে বলল , "দাদু এখানে একটা কালী ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছে"।
দাদু ভাবলেন দুর্গামন্দিরে কালী। হেসে বললেন, "কালী, দুর্গা সবাই সমান, কোন তফাৎ নেই"।
কাদায় আঞ্জুমানের সারা শরীর কালো হয়ে আছে। বুকে কামড়ের ক্ষতগুলো রক্ত জবার মতো রক্তরঞ্জিত হয়ে ফুটে আছে। কোমর ছোপানো চুল, রক্ত আর কাদায় মাখামাখি হয়ে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। মুখময় কাঁচা রক্ত। হঠাৎই তার খেয়াল হল সে বিবস্ত্রা। আদিম অনুভূতি ফিরে এলো এক লহমায়। সে লজ্জায় শিঁউরে উঠে জিভ কাটলো।
নাতনী এতক্ষণ পর চেনা প্রতিমা দেখে ফুলটা তার পায়ের কাছে রেখে এক গাল হেসে বলল, "কোন তফাৎ নাই"।
গল্পটি বাক সাহিত্য পত্র -এ পূর্বে প্রকাশিত
দারুন , এগিয়ে যা .. র ও সুন্দর লেখা chai. চাই
অসাধারণ লাগলো , আরো লিখুন .
besh