21 টা চেয়ার পাতা, ওরা 20 জন বসে আছে ৷ একটা চেয়ার ফাঁকা ৷ কলেজের রি-ইউনিয়ন। 15 বছর পর আবার একসঙ্গে পুরনো বন্ধুরা। কত গল্প, স্মৃতি, কত ঝগড়া, অমীমাংসিত আবেগ আর পুরনো প্রেম ৷ রাত বাড়ছে, সেই সঙ্গে স্মৃতি-মেদুর আচ্ছন্নতা বাড়ছে সবারই।
সবাই ব্যস্ত, কথায়। গত ১৫ বছরের ঘটনাক্রম অল্প সময়, বিস্তারিত ভাবে পাশের একদা খুব কাছের মানুষের সঙ্গে ভাগাভাগি করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। মৃদু গুঞ্জন, হালকা হাঁসি, সীমাহীন অভিমান সব আছে।
স্মৃতি, শেষ পর্যন্ত শুধু স্মৃতিটুকু রয়ে যায়। বইয়ের ভেতর থেকে হঠাৎ পাওয়া বিবর্ণ গোলাপের মূল্য সেই বোঝে, যিনি বহু যত্নে সেটিকে সেখানে গচ্ছিত রেখেছিলেন। বাকিদের কাছে ওটা আবর্জনা।
একটা হাহাকার মেশানো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেয়েটি পাশের ফাঁকা চেয়ারে হাত রাখে। এখানে আসা পর্যন্ত মেয়েটি খুব চুপচাপ ৷ সামান্য কিছু কথা বাকিটা নীরবতা ৷ অথচ তখন কত হাসিখুশিই না ছিল সে ৷ প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, উদ্যাম জীবনীশক্তিতে পরিপূর্ণ একটি মেয়ে ৷ আজকের নারীটি খুব শান্ত ৷ সমুদ্রের খুনসুটি, তার ঢেউ ভেঙে লুটিয়ে পড়া, সব বালুতটের বুকে। কিনারা থেকে যত সে দূরে গেছে, যত বিচ্ছিন্ন হয়েছে তত সে শান্ত হয়েছে।
ফাল্গুণী বাতাস আলতো করে মেয়েটির কানের লতি ছুঁয়ে গেল। সে পেছনে তাকালো, আলোয় আলোয় ঝকঝক করছে কলেজের মাঠ। বিস্তৃতি মাঝে মাঝে শূণ্যতাকে অপরিহার্য করে তোলে। অপরিমেয় শূন্যতা।
বন্ধুরা প্রশ্নোত্তরের খেলায় মাতলো ৷ সবাইকে একই প্রশ্ন করা হচ্ছে, এবং সবাই তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন উত্তর দিচ্ছে ৷
যেমন , যদি কোন ভাবে 15 বছর আগেকার কলেজ জীবনে আবার ফিরে যাওয়া যায়, তবে সে তার জীবনে কি কি পরিবর্তন করতে চাইবে ৷
একেক জন একেক রকম উত্তর দিচ্ছে ৷ কেউ বলছে পড়াশোনা করতাম মন দিয়ে ৷ কেউ বলছে অন্য প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে প্রেম করতাম ৷ কেউ বলে, একটার বদলে 10টা প্রেম করতাম৷ কেউ বললো, অন্য বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে খুব ভালো একটা কেরিয়ার তৈরি করতাম ৷ এমন অনেক উত্তর পাওয়া গেল ৷
শেষে প্রশ্নটা মেয়েটার কাছে এলো। সেই মেয়েটা যার প্রেম কলেজে খুব বিতর্কিত ছিলো।
একজন হেসে বলল,- "জানি তুই কি বলবি, তুই তখন হয়ত অন্য কোন পুরুষকে বাছতি কিম্বা কেরিয়ারের দিকে অনেক বেশি মনোযোগী হতি ৷ আমাদের মধ্যে তুই সব থেকে ব্রাইট ছিলি, কিন্তু আজ দেখ ৷ তুই মাঝ পথে থমকে গেলি ৷ হারিয়ে গেলি "।
মেয়েটা হাল্কা করে হাসল ৷ এই ছেলেটা কখনো তাকে ভালোবাসতো ৷ তাকে পাওয়ার জন্য একসময় কত পাগলামী করেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে ৷ আকাশে চাঁদ নেই, তাই হয়তো তারাগুলো আজ এত স্পষ্ট ৷
থেমে থেমে আস্তে আস্তে মেয়েটা বলল, "যদি সত্যি ফিরে যেতে পারতাম সেই সময় তবে, ব্যাগ থেকে রুমালটা বের করতাম না ৷"
সবাই অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো৷ নিজের মনে হেসে মেয়েটা বললো, _" তখন, আমি মাঝে মাঝে রুমাল আনতে ভুলে যেতাম , আমি ঘামিয়ে গেলে ও নিজের রুমাল দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দিত৷ বড্ড আরাম লাগতো আমার।"
মেয়েটির চোখে তখন লক্ষহীরকদ্যুতি। সে বলে চলে, "যদি ফিরে যেতে পারি তবে, ওর ওপর অভিমান বা রাগ করে যে সময়টা নষ্ট করেছি সেটা আর করতাম না ৷ আমার যে ব্যবহারে ও কষ্ট পেয়েছে সেগুলো সব শুধরে নিতাম ৷ কলেজের সেকেন্ড ইয়ার থেকে আমাদের সম্পর্ক, এবার ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম দিন থেকেই প্রেমটা শুরু করতাম ৷ ওকে এমন ভাবে হারাতে হবে জানলে,ওকে পাওয়ার প্রতিটা মুহূর্ত দ্বিগুণ ভাবে বাঁচতাম৷"
একটি মেয়ে প্রশ্ন করে, "এই যে লাভ জিহাদ এই জিনিসটা সম্পর্কে তোর কি মতামত?"
মেয়েটি একটি কবিতা গুনগুন করল,
_"সে যদি তোমাকে পিষে করে ধুলোবালি?’
পথ থেকে পথে উড়ে উড়ে যাব খালি
উড়বে?– আচ্ছা, ছিঁড়ে দেয় যদি পাখা?
পড়তে পড়তে ধরে নেব ওর শাখা
যদি শাখা থেকে নীচে ফেলে দেয় তোকে?’
কী আর করব? জড়িয়ে ধরব ওকেই"
তারপর বললো ,
_ " লাভ জিহাদ এর মানে আমি জানি না। এই শব্দগুলো পাশাপাশি বসতে পারে বলে মনে হয় না। আর প্রেম.... আগুনের মতো প্রেম ও সর্বগ্রাসী। ছাইয়ের কোন অহংকার থাকে না, থাকতে পারে না। যারা ভালোবাসতে জানে, তারা জানে প্রেম ঈশ্বরের প্রতি হোক বা মানুষের প্রতি, সে নিজে দাহ্য, অন্যকে জ্বালায় না।"
দীঘল চোখ দুটো দিয়ে মেয়েটি অতীত দেখে। জীবনে সব থেকে সুন্দর দিনগুলো।
অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেম গুটি গুটি ঠিক সেখানেই বাসা বাঁধে, যেখানে তার থাকার কোনো কথা ছিল না। তারপর একদিন হঠাৎ করে যখন শিকড় সুদ্ধ টান মেরে নিজেকে জাহির করে, তখন হতবাক মন নিজেকেই প্রশ্ন করে, এটা কি করে সম্ভব।
নদীর ভাঙন সব সময় বাইরে থেকে দেখা যায় না। হুড়মুড় শব্দের উৎস সন্ধানে হঠাৎ আবিষ্কার হয়, জমির একটা বিশাল অংশ নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। সেই রকমই, যাকে ভালবাসার কোন কথাই ছিল না, প্রেম যখন সেখানে আত্মসমর্পণ করে, চিরায়ত ধারনাকে নস্যাৎ করে নিজেকে ভাঙে, আমিত্বকে বিসর্জন দেয় তখন শুধু ছাইটুকুই অবশিষ্ট রয়ে যায়। .....
মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে চোখ আড়াল করে জলটা মুছল ৷ বহু দূরে কবরে ছেলেটা পাশ ফিরে শুলো ৷ যে পাশ থেকে নক্ষত্রের আলোতে মেয়েটার মুখটা স্পষ্ট দেখা যায় ৷
আপনার ছোটগল্পের হাত চমৎকার,
সাবলীল লেখা। সুন্দর।
ভীষণ ভালোলেগেছে গল্পটা...
সুন্দর লেখা।বিন্দুমাত্র চড়া রঙ ব্যবহার না করেও যে সমস্যাটায় অন্যরকম আলো ফেলা যায়,সেটা বড়ো সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন।