সাওারের উষ্ণ গরম জল অমিতের সারা শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে । এক অন্যরকম চিন্তা জগতে নিয়ে যায় তাকে । বাইরে গরম যতই হোক , কিন্তু স্নানের জন্য তার উষ্ণ গরম জল লাগে । হোটেল রুম থেকে একটা আলতো করে চেকভস্কির সোয়ান লেক ভেসে আসছে । সেইবার ইটালিতে থাকতে শুনেছিল । সেই থেকেই ভালো লেগে গেছে । শুধু চেকভস্কি নয় , তার সাথে তস্কা , স্ত্রাউস এর বেহালাও খুব ভালো লাগে । পঞ্চাশটা এইরকম সিম্ফনির রেকর্ড কিনেছিল একেবারে । এখন যেখানেই যায় সেইখানেই ওর সাথে থাকে । স্নানের সময় এই সিম্ফনিগুলো চললে আজে বাজে চিন্তা কম হয় , আর তার উপর গরম জল মাথায় পরলেও ঠাণ্ডা হয়ে যায় তার শিরা উপশিরা ।
বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে । খুব বাজে রাত । মাঝে মাঝে আকাশ ভেঙ্গে পড়ার শব্দে বুকটা কেঁপে ওঠে অমিতের । এইরকম রাত শুভ নয় , অনেক অঘটন এই ধরনের রাতে তার দরজার কড়া নেড়েছে ।
সাওার বন্ধ করে অমিত একটা তওালে জড়িয়ে বাথ্রুম থেকে বেড়িয়ে এলো । হোটেলের ঘরগুল একটু ছোট হলেও বেশ মনরম । বাইরের দিকে ব্যল্কনিতা বন্ধ করা । বৃষ্টির বাস্প জমেছে সেই ব্যল্কনির কাঁচে । হোটেল পেড়িয়ে রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া এক আধটা গাড়ির ঝাপসা আলো আলতো বুলিয়ে যাচ্ছে জানালার কাঁচগুলোকে । এমন সময় হঠাৎ করে বিছানার পাশে থাকা ফোন টা বেজে উঠল ।
“ক্রিং ক্রিং ", অনেকদিন এই টেলিফোনের আওয়াজ শোনে নি অমিত। এই জমানায় আর কোথায় বা ব্যবহার হয় ? একমাত্র এই হোটেল আর কয়েকটা অফিস ছাড়া এই ফোনের ব্যবহার নেই । অবশ্য দুটোর কোনটাতেই তার যাওয়ার দরকার পরে না। নেহাত এখন একটু পালিয়ে বেরাতে হচ্ছে বলে হোটেলে আসা ।
ফোনটা তুলে "হ্যালো " বলতেই উল্টোদিক থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এলো । কণ্ঠটা খানিকটা রিয়ার মতো । সরল , মার্জিত আর রসে ভরা ।
“স্যার, রিসেপ্সান থেকে বলছি "
“হ্যাঁ বলুন"
“আপনাকে অসময়ে ডিস্টার্ব করবার জন্য ক্ষমা চাইছি"
“কোন ব্যপার না । বলুন " , মাথাটা একটু হাল্কা দপদপ করছে ।
“একটা খুব দুঃখজনক ব্যপার ঘটেছে , তাই আমরা ফোন করলাম । আপনার পাশে রুমে যে ভদ্রলোক ছিলেন তিনি মারা গেছেন ।"
“ওঃ , কিভাবে মারা গেলেন ? সুইসাইড ?”
“না স্যার , ন্যাচারাল ডেথ বলেই মনে হচ্ছে । কিন্তু আবার অন্য কিছুও হতে পারে । সঠিক জানিনা।"
“বয়স কত হয়েছিল অনার ?”
“এই তিরিশ বত্তিরিস হবে । "
“ন্যাচারাল ডেথ তিরিশ বছরের ছেলের ? খুব সন্দেহজনক ", বলার পরেই অমিতের চোখে একটা ঝিলিক খেলে গেল ।
“আমি ওত জানিনা স্যার । পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে । আপনার কাছে রিকোয়েস্ট পুলিশ আসা অব্দি আপনি ঘরেই থাকুন । উনাদের অর্ডার ও তাই "
“ওকে ফাইন, আমার কফিটা কি হল "
“পাঠাচ্ছি স্যার “
“ওকে”, বলে ফোনটা কেটে দিল অমিত । মৃত্যু সংবাদ আর সে শুনতে পারছেনা । এই মৃত্যুর হাতছানি থেকেই তো পালিয়ে এসে এখানে উঠেছে । খালি আসতে পারলনা রিয়া । অকালেই চলে যেতে হল । কত কি ভেবেছিল ও রিয়াকে নিয়ে । এই তো ছয়মাস ধরে দেখা শুনা করেছিল । মাঝে দুতিনবার ঘনিষ্ঠ অব্ধি হয়েছিল । কম বয়সি মেয়েটার মধ্যে এক অন্য ধরনের জাদু ছিল । এইরকম সচরাচর হয় না । অন্তত আগে তার সাথে হয়নি কখনও । কত মহিলার রঙ্গ তামাশা দেখেছে সে , কিন্তু এখন আর সেই আগুন নেই । নিভে গেছে সময়ের সাথে সাথে , বৃষ্টি ভেজা রাতে কাদা হয়ে মিশে গেছে । কে যে মারল তার কিনারা করতে পারেনি এখনও অমিত । রবার্টের লোকজন নয়ত ? বাড়ি থেকে সেই দুষ্প্রাপ্য পাথর টাও চুড়ি গেছে । সুম্যানের ফোক স্টাইলের তৃতীয় রেকর্ডটা চলতে শুরু করেছে । ভেঙ্গে পড়া কবিদের গানে যেরকম নেশা হয় ঠিক সেইরকমই একটা নেশা লেগে গেছিল এই হোটেল রুমের লাইটগুলোতে । ঝিমিয়ে পড়েছে আবেশে ।
“ঠক ঠক ", দরজার গোঁড়ায় দুবার আওয়াজ হল ।
“কে?”
কোন উত্তর এলো না সেইদিক থেকে । অমিত চেয়ারে পরে থাকা একটা বাথরব গায়ে জড়াতে গিয়ে দেখল পকেটটা একটু ভারি । হাত ঢুকিয়ে একটু শান্তি পেল । জিনিসটা এখনও আছে ।
দরজাটা আবার কেঁপে উঠল ,” ঠক , ঠক "
অমিত বিছানার উপর পরে থাকা খোলা ব্রিফকেস থেকে নাইন মিলিমিটার পিস্তল টা বার করে এগিয়ে গেল দরজার দিকে । কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছে । রিয়ার মৃত্যুর পর থেকে সে সারাক্ষণ সজাগ থাকে ।
“কে ?”
“রুম সার্ভিস । আপনি কফি অর্ডার করেছিলেন ", একটা ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে এলো দরজার ওপার থেকে ।
অমিত মনে মনে ভাবল বেকার সন্দেহ করছিল এতক্ষণ । স্নানে যাওয়ার আগে কফিটা তো অর্ডার দিয়েছিল । দরজায় কোন পিপহোল নেই । নতুন হোটেলগুলোতে সচরাচর থাকে । এই হোটেল টা একটু পুরানো কায়দায় । চপিনের নকটার্ন শুরু হয়েছে এবার ।
অমিত দরজাটার হাতল ঘুড়িয়ে যেই না খুলতে যাবে ওমনি সজোরে দরজাটা এসে তার মুখে লাগলো । আচমকা এরকম একটা ধাক্কার জন্য অমিত প্রস্তুত ছিল না । ছিটকে মাটিতে পরে যেতেই তার হাত থেকে রিভলভারটা কোথায় যেন ভ্যানিস হয়ে গেল ।
একটা বছর চল্লিশের লোক হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে ঘরের মধ্যে। হাতে একটা রিভলভার , চোখ দুটোতে আগুন জ্বলছে । ঘরে ঢুকেই সবার আগে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল ।
“আজ পেয়েছি তোকে ", লোকটা চীৎকার করে উঠল । তার শরীরে এক বন্য উত্তেজনা ।
অমিতের নাকটা তখনও টনটন করছে । মুখে হাল্কা হাল্কা নোনতা - মিষ্টি স্বাদ পাচ্ছে। ভেজা ভেজা গন্ধ ।
লোকটার বন্দুকের নল একেবারে তাক হয়ে আছে অমিতের দিকে । যেকোনো সময়ে গর্জে উঠতে পারে । অমিত একভাবে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে । স্মৃতির গভিরে এতক্ষণে ডুব দিয়ে ফেলেছে। কোন কালে কি দেখেছিল এই ব্যক্তিকে ?
“কি চাই ?”, অমিত আসতে আসতে বলে উঠল ।
“তোকে চাই শয়তান । একমাত্র তোকে চাই । চিন্তে পারছিস ?”
অমিত চিন্তে পারলনা । বন্দুক আর লোকটা দুজনেই খুব বেশী উত্তেজিত । পাশের ঘরে একটা সদ্য মৃত ব্যক্তির ডেড বডি পরে আছে । এই ঘরে হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যে আরও একটা পরে থাকবে । মনে মনে ভাবছিল হোটেল মালিকের কথা । কি খারাপ দিন ই না যাচ্ছে লোকটার ।
“উঠে বস , কোন চালাকি করবিনা "
অমিত আসতে আসতে উঠল । লোকটা অমিতকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ঈসারা করলো ।
ঘুরে দাড়াতেই অমিতের হাতদুটো একটা প্লাস্তিক লকার দিয়ে বেধে দিল আগন্তুক ।
“আপনি কি বলবেন কিছু ?”
“চুপ সালা "
হাতগুল বেধে দিয়ে ধাক্কা দিয়ে অমিতকে বসিয়ে দিল সামনের চেয়ারের উপর । অমিতের গায়ের বাথরব প্রায় খুলে এসেছে । কোনরকমে সে বসে আগুন্তুকের দিকে তাকিয়ে আছে । আগন্তুক এবার পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে মুখে পুড়ল । চোখে সেই ভয়াবহ দৃষ্টি । অন্য সময় হলে হয়ত অমিত তোয়াক্কা করতো না । কতবার এরকম হয়েছে । কত বিপদ যে পার করে এসেছে , কিন্তু এখন ...এখন কেমন যেন বুক কাঁপছে । এইটা শুরু হয়েছিল রিয়ার থেকেই । তার চলে যাওয়ার পর থেকেই এরকম অবস্থা হয়েছে ।
সিগারেটে দুএকটা টান মেরে আগন্তুক বলল ,” সালা , ফাইনালি তোকে পেয়েছি । কত নাম , কত রুপ পাল্টে শেষে আজ ধরা পরলি তুই আমার হাতে "
অমিত আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে ।
“চিন্তে পারছিস না ?”
“না, আপনি কি রবার্টের লোক ?"
“না,আমি রামমোহন "
অমিত কোন উত্তর দিলনা । চুপচাপ বসে রইল ।
“মনে পরছেনা না ? তোকে মনে করতেই হবে শয়তানের বাচ্চা । আজ তোর জন্যই এই অভিশপ্ত জীবন আমার । "
অমিত শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো ,” যা করার করে ফেলো । গুলি মাড়ার হলে মেরে দাও । বেঁচে থাকার আর ইচ্ছা নেই "
রামমোহন সিগারেট টা তুরি মেরে ছুরে দিয়ে বলল ,” ওত সহজে তোকে মারবনা । তোকে আমার প্রত্যেক মৃত্যুর হিসেব দিতে হবে । মনে পরে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন মেরেছিলি আমায় ।"
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ?”
রামমোহনের চোখে আবার সেই ঝলসানো রক্ততা ।
“হ্যাঁ হ্যাঁ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে । আমি একটা জিউএর শরীরে ছিলাম । সব ভুলে গেছিস তুই ? প্রাগ শহর থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে একটা আলুর খেতে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথা থেতলে দিলি ।
লজ্জা হয় না তোর ? একই মানুষকে বারবার মারিস কি করে ?”
অমিত অদ্ভুত ভাবে দেখে যাচ্ছে । কোন কথা নেই ওর মুখে । খালি টপটপ করে নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে ।
“মনে পরে না তোর ? সেই ফ্রেঞ্চ রেভলিউসানের আগে ? একটা মহিলার শরীরে ছিলাম আমি । ডাইনি বলে কথা ছড়িয়ে দিয়েছিলিস । জ্যন্ত জ্বালিয়েছে আমাকে লোকে , জ্যন্ত । প্রত্যেকটা মাংস পেশীর জ্বলুনি কি হয় তা জানিস তুই ? কেন করেছিলি এরকম ? কেন আমার এই সর্বনাশ করেছিস তুই । আজ তোকে বলতেই হবে । আজ তোকে বলতেই হবে !!”
রামমোহনের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে , কিন্তু তার উত্তেজনা কোনভাবে কমছে না । শত শত বছরের ভয়ার্ত মৃত্যুর ব্যথা সহ্য করে এসেছে । তার গলা ধরেছে । সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে আবার বলে উঠল ,” কি কুক্ষনে যে আমি তোর সাথে সেইদিন গেছিলাম । এতো বছর ধরে এই ...এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হয়েছে আমাকে । একবার তো মিশরে সদ্য মরে যাওয়া একটা বাচ্চার শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল নিয়তি । তার মা বাবা কবর দিতেই যাবে সেই সময় আমার চোখ খোলে । ভয়ে সবাই ফেলে দিয়ে গেল আমায় গর্তে । মিশরের মরুভুমিতে তৃষার্ত হয়ে আবার মরেছি । তুই কেন আমার এই সর্বনাশ করলি ?”
অমিত এতক্ষণ চুপ করে রামমোহনের সব কথা শুনছিল । চোখের সামনে লোকটাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখে মায়া লাগছিল ওর ।
“তোমার যখন এতই কষ্ট হয়েছে তাহলে সুইসাইড করে নাও নি কেন ?”
রামমোহন বিতিশ্না ভরা চোখে অমিতের দিকে তাকিয়ে বলল ,” চেষ্টা করিনি ? সেইবার এক সমুদ্রে ভেসে যাওয়া মরার ভেতরে টেনে নিয়ে গেল আমাকে অদৃষ্ট । দেহটা খুব একটা সবল ছিলনা । কিন্তু জানিনা কিভাবে জেগে উঠলাম তার মধ্যে । একটা ছোট মানুষ বর্জিত দ্বীপে একা রইলাম তিরিশ বছর । তিরিশ বছর প্রতিদিন দগ্ধে দগ্ধে মরছিলাম । সহ্য হচ্ছিল না । তাই শেষে গাছের ডাল থেকে ঝুলে পরলাম । কিন্তু অদৃষ্টের এই কি হেয়ালি ? আমি এভাবে অমর হতে চাইনি । প্রত্যেকবার মৃত্যুর পর এক অন্য সদ্য মৃত দেহের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে । নিজেকে আয়নায় দেখলে চিন্তে পারিনা। কখনও কচি বাচ্চা তো কখনও বয়স্ক বুড়ি । কখনও আবার সদ্য বিবাহিত যুবক তো কখনও কন্সেন্ত্রেসান ক্যম্পের জিউ । প্রতিবার অদৃষ্ট আমাকে ঢুকিয়ে দিচ্ছে এই সমস্ত দেহের মধ্যে । আমি স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে মরতে চাই ঈশ্বরী , স্বাভাবিক ভাবে"
অমিত একটু অবাক হয়ে বলল ,” আমার নাম অমিত, ঈশ্বরী নয়"
রামমোহন বাঘের মতো এগিয়ে এসে অমিতের থুতনি চেপে ধরে বলল ,“সে তুই নিজেকে এখন যা বোঝাস না কেন । আমি তো জানি তোর আসল সত্য । "
বাইরে বৃষ্টি আরও জোরে পড়তে লাগলো । কাঁচের জানলা ভেদ করে আওয়াজ আসছে তার কানে । মোবাইলের রেকর্ডারটা তখনও বেজে চলছে । এবার রসিনির বারবার অফ সেভিল । আসতে আসতে শুরু হয়েছিল , ধিরে ধিরে সুরগুল উঠছে । আর সেই সঙ্গে রামমোহনের উত্তেজনাও ।
অমিত এবার মুখ খুলল ,”যতদূর মনে হচ্ছে আপনি একটা বদ্ধ উন্মাদ । পাগল । লুনাতিক। আমি অমিত , কোন ঈশ্বরী নই । আর এই যে গল্প শোনাচ্ছেন , এতো বাজে ভুতের গল্প কোনদিন শুনিনি । ভুত নাকি বছরের পর বছর ধরে এক দেহ ছেড়ে অন্য দেহতে ঘুরে বেড়াচ্ছে । কে বিশ্বাস করবে...”
অমিতের কথা শেষ হতে না হতেই রামমোহন সজোরে একটা চর কসাল অমিতের গালে । তারপর আর একটা । মাথাটা ঝিম ধরে গেল অমিতের । কানের পাশে কে যেন একটা বড় চকলেট বোমা ফাটিয়ে দিয়েছে । "বোঁ" করে একটা শব্দ হচ্ছে ।
রামমোহন বলে গেল ,” মনে পরছেনা তোর কিছু । আমি উন্মাদ? তুই বানিয়েছিস উন্মাদ । সব ভুলে গেলেও আমি এখন মনে করাবো তোকে । মনে করাবো সেইদিনের কথা , যেইদিন আমরা দুজনে প্রথম পেয়েছিলাম সেই পাথরটা । সেই সঞ্জীবনী পাথর । মনে পরে তোর? হ্যাঁ , তিব্বতের গুম্ফার ভেতরে সঞ্জীবনী পাথরটা আমি পেয়েছিলাম প্রথম । তুই ছল করে পেছনে ছুড়ি ধুকিয়েছিলিস । তারপর সেই পাথর নিয়ে পালিয়েছিস। সেই দিন থেকে আমি এরকম দেহে দেহে ঘুরে বেরাচ্ছি । কেন যে ধরেছিলাম আমি ঐ পাথরটা ? “
অমিত আবার বলে উঠল ,” এই সব আজগুপি গল্প শোনাবেন না । মারার হলে মারুন । এইসব ভালো লাগছেনা । "
রামমোহন একটু হাঁসতে লাগলো , “তা ভালো লাগবে কেন ? আমি তো এইটাই চেয়েছিলাম । তুই মৃত্যুর জন্য কাঁদবি । তোর সমস্ত ভালোবাসা জীবন থেকে কেড়ে নেব । তারপর ধিরে ধিরে তোকে মারবো । যেমন আজ করেছি "
অমিতের মুখটা শক্ত হয়ে গেল । রামমোহন আবার হাঁসতে লাগলো ।
“হ্যাঁ তোর প্রেমিকাকে আমিই মেরেছি "
কথাটা শোনা মাত্রই অমিতের মনে যে একটু মায়া জন্ম নিয়েছিল সেটা রাগে পরিণত হল । তার প্রাণের রিয়া , তার ভালোবাসা
“ইউ বাস্টার্ড । ", অমিত পিছনে হাত বাধা অবস্থাতেই লাফিয়ে উঠতে গেল । কিন্তু রাম মোহন প্রস্তুত ছিল । সে অমিতের পেটে এক লাথি মেরে বসিয়ে দিল ।
“সীট দাউন !!!!”
অমিতের পেটে জোরে লেগেছে । একেতে হাত বাধা তার উপর পেটে অসহ্য যন্ত্রণা । আহত বাঘের মতো ফুসছে । ওর চোখ দুটোও লাল হয়ে গেছে । চীৎকার করে বলল ,” তুই মেরে ফেল আমাকে । আমি বেঁচে থাকলে কোনদিন তোকে বাঁচতে দেবনা। প্রতি মুহূর্ত মৃত্যু দেখবি "
রাম মোহন হেঁসে বলল ,” আমি প্রতি মুহূর্ত মৃত্যু দেখেছি । তাই এখন শেষ করতে এসেছি । ঐ পবিত্র গুম্ফা থেকে পাথর আমরা দুজনে চুড়ি করেছিলাম । এখন তার সাজা ভুগছি । ঐ পাথর যতক্ষণ না পৌঁছবে ওখানে ততখন আমরা দুজনেই অমর থাকবো । তাই তোর বাড়ি থেকে পাথরটা চুড়ি করে আমি রেখে এসেছি সেই গুম্ফাতে । এখন খালি মৃত্যুর পালা । আগে তুই মরবি , তারপর আমি সারাজীবন শান্তিতে কাটিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে ইহলোক ত্যাগ করবো । তুই যতক্ষণ বেঁচে আছিস ততখন আমি শান্তিতে থাকতে পারবোনা । তোকে মরতেই হবে ঈশ্বরী, তোকে মরতেই হবে।"
অমিতের গা দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে । সে চীৎকার করে বলল ,” তুই মেরে ফেলেও পার পাবিনা । রিয়ার মৃত্যুর ফল তোকে ভুগতে হবে "
রামমোহন এবার এদিক অদিক ঘুরতে লাগলো । ঘরটা ব্রামের সিম্ফনির আওয়াজে গমগম করছে । রক্তের তীব্রতা বেড়ে গেছে দুজনের মধ্যেই । আলোগুলো যেন আরও ঝিমিয়ে পড়েছে ।
“তাহলে ঈশ্বরী , এবার ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও ", বলেই রামমোহন বন্দুকের নলতা অমিতের মাথায় ঠেকাল ।
অমিত আসতে আসতে বলে উঠল ,” কাজ টা ঠিক করলিনা। রিয়াকে মারা তোর উচিত হয় নি "
রামমোহন একটু হেঁসে বলল ,” গুদ বাই "
“ঠাই" করে একটা শব্দ হতেই অমিতের দেহটা একবার কেঁপে উঠল । মাথার পাশ দিয়ে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে । অমিতের দেহটা একটা "ঠক" শব্দ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ।
রামমোহনের বন্দুকের নলটা দিয়ে একটা পোড়া বারুদের গন্ধ । মনে মনে এক বিশাল শান্তি অনুভব করছে । এই দিনটার জন্য কত শতাব্দী সে অপেক্ষা করেছে । কত জন্মের শত্রু ছিল এই লোকটা । এর জন্য কোনদিন ভালো করে জীবন উপভোগ করতে পারেনি । তবে এবার সে করবে । প্রতিবার মৃত্যু ভয়ে থেকেছে । অস্বাভাবিক , কঠিন মৃত্যু দেখেছে । খালি ভয় হতো কখন আবার কার মৃতদেহে গিয়ে হাজির হবে । কিন্তু এখন আর সেই ভয় নেই ।
সে বন্দুকটা কোমরে ঢুকিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল । বাইরে গিয়ে হঠাৎ কি একটা মাথায় খতকা লাগলো । ও কি ঠিক শুনেছে ? আওয়াজটা কি শুধু অমিতের দেহ পরে যাবার ? ছুটে আবার ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল । বাইরে বিকট বিদ্যুতের ডাক ।
রামমোহন অমিতের পরে থাকা দেহটাকে একটু খুঁজে দেখল । অর্ধনগ্ন দেহটাতে সেরকম কিছুই ছিল না । কিন্তু রামমোহন পুরো সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই যাবেনা । বাথরবের পকেটে হাত ঢোকাতেই কি একটা যেন ঠেকল । শক্ত মতো ।
চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল রামমোহনের । হাত টা যখন পকেট থেকে বার করলো তখন বুঝতে পারল ঘরে সে আর একা নেই । কে একজন খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে ।
কানের পাশ দিয়ে বিন্দু বিন্দু করে ঘাম ঝরতে লাগলো । মনে মনে চীৎকার করে উঠল ,” না , না !!!”
একটা বন্দুকের নল তার মাথার পিছনে এসে ঠেকল । সামনে অমিতের মৃতদেহ আর পিছনে ঈশ্বরী দাড়িয়ে । এক নতুন দেহে, নতুন পরিচয়ে ।
“বলেছিলাম না , কাজটা ঠিক করিস নি । আসল পাথর সবসময় আমার কাছেই ছিল । শত বছর পর দেখা করতে আসিস। কারন আমাকে কারুর দেহে ঢোকার জন্য অদৃষ্টের উপর নির্ভর করতে হয় না "
বাইরে বীভৎস এক বিদ্যুতের ঝলকানি দিল । আর তার সাথে সাথে ঘরের লাইটগুলোও চলে গেল । মুষলধারে বৃষ্টির মাঝে অন্ধকারের বুক চিঁরে বেড়িয়ে এলো এক চিলতে আলো যার প্রতিফলন হোটেল ঘরের জানলাতেও পরেছিল । শব্দ হয়নি কোন । খালি বারুদের গন্ধ বেরচ্ছিল ।
শেষটা অপ্রত্যাশিত! আমি বেড়ানোর গল্প ভেবে শুরু করেছিলাম!
কিছু টাইপো, বানান অল্প চোখে লাগলো।