সুমনা আয়নার দিকে অনেকক্ষন ধরে তাকিয়ে ছিল । বাইরে থেকে কিংশুক এসে চেঁচিয়ে উঠলো,"রমা! রমা!"
বাড়িতে কাজের লোক বলতে রমাই একা। তাকে স্পেশালি রেখেছিল কিংশুক মা সুমনার দেখাশোনার জন্য।
রমা দৌড়ে এসে বলল,"কি হয়েছে দাদা?"
কিংশুক খুব রেগে গিয়ে বলল,"তোর কি কাণ্ডজ্ঞান নেই? কতবার বলেছি আয়না টা ঢেকে রাখবি। মার মন খারাপ হয়ে যায়।"
রমা একটু স্তম্ভিত হয়ে বলল,"ঢাকাই ছিল, হয়তো কোন কারণে খুলে গেছে। আমি এখুনি ঢেকে দিচ্ছি"
রমা প্রায় ছুটে আয়নাটা যেই না ঢাকতে যাবে অমনি সুমনা বলে উঠলো,"ছেড়ে দে রমা। দরকার নেই "
কিংশুক সুমনার হুইলচেয়ারের হ্যান্ডেলটা চেপে ধরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। সুমনা হাতের ইশারায় বাঁধা দিয়ে বলল,"কিংশুক, রিয়ালিটিটা আমাকে একসেপ্ট করতেই হবে। থাক, যাও তোমরা এবার। আমার বিশ্রাম করার সময় হয়েছে"
কিংশুক আর কথা না বাড়িয়ে রমাকে ইশারা করে বেরিয়ে যেতে বলল। তারপর নিজেও বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কিছুক্ষন থাকবে ভেবেছিল মার সঙ্গে, কিন্তু কখন যে সুমনার মুড পাল্টে যায় তা বুঝতে পারেনা কিংশুক। তাই চলে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকেনা। বছর দশেক ধরে এইভাবেই চলছে। হুইল চেয়ারে বসে বসে কোন রকমে দিন কাটাচ্ছে সুমনা।
প্রথম দিকে খুবই ভেঙে পড়েছিল। লোকজন দেখা করতে আসলেই দুরদুর করে তাড়াতো। ভালো লাগতো না কোন কিছুই। কিংশুক অনেকবার মনে উত্তেজনা দেওয়ার জন্য বিখ্যাত সব লোকেদের জীবনী কিনে কিনে রাখতো পড়ার টেবিলে। কিন্তু সেগুলোও সুমনার পায়ের মতো নিরস হয়ে পরে আছে। একই জায়গায় বছরের পর বছর।
লোকে বলতো সুমনা ডাঙায় কম জলে বেশী ভালো থাকতে পছন্দ করে। সে নাকি ভুল করে মানুষ হয়ে গেছে আর সেটা একেবারে বাড়িয়ে বলা নয়। খালি দশ বছর আগের সেই একসিডেন্টতাই সব কেড়ে নিয়েছে সুমনার জীবন থেকে।
একটা একসিডেন্ট মানুষের জীবনে এরকম পরিবর্তন করতে পারে তা ভাবার অতীত। বেশ তো ছিল। কিংশুকের মতো ছেলে , অজিতের মতো বড়কে নিয়ে দিব্বি সংসার করছিল। নিজে এসিয়াদে মেডেল পাওয়া সাঁতারু। দেশ বিদেশে প্রচুর নামডাক। কত বিখ্যাত লোককে সাঁতার শিখিয়েছে একসময় । সাঁতারু মেয়েদের কাছে এক বিশাল ইন্সপিরেসন ছিল।
আর ফিগারটাও সেরকমি। যে কোন পুরুষের মনে দাগ কেটে দিত। মেডেল আসার পর কত সিনেমার ডাইরেক্টর হাতে পায়ে ধরেছিল। নেহাত মা বাধা দিয়েছিল নাহলে বড় তারকা হতে পারতো।
তবে তারকা সে হয়েছিল। অলিম্পিকের জন্য অনেককে ট্রেন করেছে সে। হান্ড্রেড মিটার, টু হান্ড্রেড মিটারে রেকর্ড করেছিল। ব্যাকস্ট্রোক, ফ্রিস্টাইল দুটোতেই এক্সপার্ট ছিল সুমনা। একসময় সিডনি অস্ট্রেলিয়ার বনডাই বিচে সারফরদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সেখানেও গিয়ে সে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। বিয়ে হওয়ার পরও নিজের অনুশীলনে কোন রকম খামতি দেয় নি । তার পিছনে অবশ্য অজিতের যথেষ্ট অনুপ্রেরণা ছিল।
শেষবার লন্ডনে গিয়ে রয়াল একাডেমি অফ আর্টসএ জন ওয়াটারহাউসের মারমেদ ছবিটা দেখে অজিত বলেছিল,"আমার জলপরী এই মারমেদের থেকেও বেশী সুন্দরি"।
খুব লজ্জা পেয়েছিল সেইদিন। মনের আলমারিতে এখনো তাকে তাকে সাজিয়ে রেখেছে সেই স্মৃতিগুলোকে। এগুলোই সম্বল। মাঝে মধ্যে যখন ধুলো পরে, তখন আবার ঝেড়েঝুড়ে তাজা করে নেয় সুমনা।
কি ভালোই না ছিল দিনগুলো। খালি এক মুহূর্তের অভিশাপে সব নষ্ট হয়ে গেল। পাহাড়ের সেই খাদে গাড়িটা পরে যেতেই পা দুটোও পরে গেল ।
হারিয়ে গেল সবকিছু। অজিতের মতো স্বামী আর তার সোনালী সাঁতারু স্বপ্ন। একসাথে দুই দুইখানা ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে এখন বিষণ্ণতাকেই জড়িয়ে ধরে বেঁচে আছে।
কিংশুক চলে যাওয়ার পর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো সুমনা। ভালো লাগছিলো না। আয়না তে নিজেকে দেখে তার একটা ভূত মনে হচ্ছিল। চিনতে কষ্ট হচ্ছিল। চুলগুলো আরো বেশি সাদা হয়ে গেছে। একসময়ের মোলায়েম তকতকে আওয়ারগ্লাসের মতো শরীরটা এখন সিমেন্টের বস্তার মতো হয়ে গেছে। গালগুলো ঝুলে পড়েছে, চোখের তলায় কালি এসে পড়েছে।
এই আয়না দেখেই একদিন চীৎকার করে উঠেছিল সুমনা । সেই সঙ্গে স্ট্রোক হয়ে গিয়ে একটা হাত একেবারে অকেজো হয়ে যায়।
দেওয়ালে থাকা অজিতের ফটোর দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো সমুদ্রের জলের মতো নোনতা হয়ে গেল।
"কোন অপরাধে এরকম শাস্তি হলো? কোন অপরাধে?"
নোনা জল গাল দিয়ে গড়িয়ে মাথার তলার বিছানা ভিজে গেল। হঠাৎ মনে হল অজিত যেন এসে বলছে ," মাছেদের চোখ দিয়ে জল বেরোয়না । তুমি তো মানুষ না, তুমি হলে জলপরী। সমুদ্রের রানী"
(2)
কিংশুক নিজে ব্যস্ত । সুমনার অবর্তমানে সুইমিং পুলের দায়িত্ব ওর ঘাড়ে এসেই পরে। তিনখানা সুইমিং পুল মেন্টেন করা সহজ নয় । সে নিজেও সাঁতারু। মার প্রশিক্ষণের বড় হয়েছে, কিন্তু মার মতো হতে পারেনি। সুমনা নিজে শেখায় না বলে এখন স্টুডেন্ট সংখ্যাও কম। সেই দুর্ঘটনার ছোয়া তার জীবনেও দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে গেছে।
একসাথে দুই অভিভাবককে হারিয়েছে সে।
হয়তো সুমনার থেকেও অনেক বেশি কিছু হারিয়ে ফেলেছে। মায়ের স্নেহ আর বাবার ভালোবাসা। সুমনার ঐরকম অবস্থা হওয়ার পর সে কিংশুকের কথা একেবারে ভুলেই গেছে। ভুলে গেছে তার ছেলের জীবনে নেমে আসা অন্ধকার কে। কিন্তু কিংশুক নিজের সাধ্য মতো চেষ্টা চালিয়ে গেছে । গত দশ বছর ধরে মার পাশে দাঁড়িয়েছে ।
সুমনার ছেলে থেকে কখন যেন সুমনার বাবা হয়ে উঠেছে। মায়ের মন খারাপ, তার চিকিৎসা, তার ব্যর্থতার অভিযোগ সব কিছু নীরব মুখে শুনেছে, দায়িত্ত নিয়েছে।
এত কিছুর মধ্যে কোথায় যেন নিজের ইচ্ছে, ভালোবাসা সব কিছুই যেন কোন এক নদীতে বিসর্জিত হয়ে গেছে । ইচ্ছে ছিল ম্যারাথন রানার হবে। কিন্তু মার ছত্রছায়াতে থেকে কখনো বেরিয়ে আসার সুযোগ হলো না। তাকেও সাঁতার শিখে মার রিপ্লেসমেন্ট হতে হলো। যেদিনকে একসিডেন্ট হয়, সেইদিনই ভেবেছিল মাকে মনের কথা জানাবে। কিন্তু মনের কথা মনেই রয়ে গেল আর সময় সমুদ্রে ভেসে গেল তার ইচ্ছা গুলো। না ,আফসোস এখন সে করে না। আফসোস করার সময়টা অব্দি তার নেই। জীবনযুদ্ধে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবে যুদ্ধে এখন আর একজন সঙ্গীকে কাছে পেয়েছে। ছোটবেলার বন্ধু রঞ্জনাকে।
সেই রঞ্জনার সাথেই মাঝে মধ্যে শেয়ার করে তার মনের কথাগুলো। তার ইচ্ছে, আবেগ, ভালোবাসা সব কিছুরই আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে রঞ্জনা।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার কথাই মনে করছিল কিংশুক।
এমন সময় হঠাৎ করে ফোনটা বেজে উঠল। রঞ্জনারই ফোন।
"তোর কথাই ভাবছিলাম"
"তাই নাকি? তা কি ভাবছিলি?"
"ভাবছিলাম কতদিন তোকে দেখিনি।"
"তো এত ভাবনার কি আছে? চলে আয়।"
"হুম"
"ভালো লাগছেনা রে। খুব ইচ্ছে করছে তোর আদর খেতে"
কিংশুক একটু মুচকি হেসে বলল,"বাবা, বোল্ড এন্ড বিউটিফুল"
"এটাতে বোল্ডের কি আছে? আমার ইচ্ছে করছে তাই বলেছি"
কিংশুক হেসে বলল,"ইচ্ছে তো আমারও করছে"
রঞ্জনা একটু চুপ করে থেকে বলে উঠলো,"এই বলছি দিঘায় যাবি?"
"দিঘায়?"
"হ্যা, চল না। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না ।আর কাকিমার মনটাও ভালো লাগবে। সারাক্ষন ঘরে বসে বসে যেকোন মানুষ বোর হয়ে যায়"
"তা ঠিক। দেখি "
হঠাৎ করে পাসের ঘর থেকে হুইলচেয়ারের আওয়াজ পেল কিংশুক।
"এই ,মনে হয় মা উঠেছে। একটু দেখে আসি।"
"ওকে। জানাস আমায় । আমি বলি শনিবার চল। সারাদিন কাটিয়ে পরের দিন ফিরে আসবো"
"ঠিক আছে দেখছি"
ফোনটা রেখে কিংশুক উঠে একবার দেখতে গেল। ময়লা নীল দেওয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়িটা টিকটিক করছে। কত রাত হয়েছে সেটা দেখার দরকার পড়ে না। যত রাতই হোক, কিংশুক মার হুইলচেয়ারের আওয়াজ পেলেই ছুটে যায়।
ঘরে গিয়ে দেখে সুমনা বাথরুম থেকে বেরোচ্ছে। কিংশুক কে দেখে বলল,"তোকে বলেছি না ,রাতে আসতে হবে না। আমি একা বাথরুমে যেতে পারি।"
কিংশুক একটু হেসে বলল,"জানি । আমি তো তোমার সাথে গল্প করতে এলাম।"
"এত রাতে গল্প?"
কিংশুক মনের কথাটা বলেই ফেলল,"মা, দিঘায় যাবে?"
সুমনা ভুরু তুলে তাকিয়ে রইল। দিঘা শুনেই মনটা কেমন করে উঠলো। সমুদ্র, জল, মারমেদ, মাছ, সিগাল। সবগুলো মিলে মিশে জন উইলিয়াম ওয়াটারহাউসের সেই ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল।
"হঠাৎ?"
কিংশুক বিছানায় বসে মায়ের হাতটা ধরে বলল,"চলনা, অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি"
সুমনা কিংশুকের দিকে তাকিয়ে খালি বলল,"অনেক রাত হয়ে গেছে। যা শুয়ে পর গিয়ে"
কিংশুক নিজের মাকে চেনে। প্রত্যেক মা যেমন তার সন্তানের কথা বোঝে ,সন্তানরাও তাদের মায়ের মনের কথা বোঝে। কিংশুক তার ব্যতিক্রম ছিলনা।
(3)
নিজের গাড়ি করেই চলল কিংশুক আর সুমনা। ব্যাক সিটে হুইলচেয়ারটা ফোল্ড করে রেখেছে। জল ,খাবার সব কিছুই আগে থেকে নিয়ে রেখেছে।
অনেকদিন পরে বেরোনো হলো বাড়ি থেকে। জানালা দিয়ে বয়ে আসা এলোমেলো হওয়াতে মনটা জুড়িয়ে গেল সুমনার। দিঘা অনেকবার গেছে সে। সমুদ্রে সাঁতার কাটার প্রথম এক্সপীড়িয়েন্স এই বাঙালির প্রিয় সৈকতে।
কিংশুক গাড়িটা ঘুরিয়ে নিলো রঞ্জনার বাড়ির দিকে ।
গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল রঞ্জনা। একটা হালকা নীল চুড়িদার পরে । ব্যাকসিটেই উঠে বসলো।
"কিরে ব্যাকবসিটে উঠলি যে?"
রঞ্জনা হেসে বলল,"আজ আমি কাকিমার সাথেই যাবো"
সুমনা রঞ্জনাকে দেখে একটু হাসলো । ছোটবেলায় তাকে সাঁতার শিখিয়েছে সুমনা। নিজের মেয়ের মতোই দেখে এসেছে। কোথাও ঘুরতে গেলে ওকেও টেনে নিয়ে গেছে ।
রঞ্জনা সিটে বসতে বসতে সুমনাকে বলল,"কেমন আছো তুমি?"
সুমনা বলে উঠলো,"এই আছি কোন রকমে"
"ওরকম ভাবে বলছো কেন?"
"কি আর বলবো। আমার সময় শেষ রে। জীবনে আর কিছু পাওয়ার নেই।"
রঞ্জনা সুমনাকে জড়িয়ে ধরে বলল,"সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তো আছি তোমার সঙ্গে"
সুমনা আর কিছু বললনা। তার মনে পড়ে গেল অজিতের কথা। সেও একইভাবে বলতো "আমি তো আছি তোমার সঙ্গে"।
কিন্তু থাকলো আর কৈ? আজ দশ বছর হল তাকে একাকী করে চলে গেছে। এই নশ্বর পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী নয়। নাম, যস ,শরীর, সম্পর্ক ,ভালোবাসা সবই সময়ের ছলনা। সবই মায়া। এই মায়া কাটিয়েই মানুষকে চলে যেতে হয়। যে নগ্ন অবস্থায় মানুষ ভূমিষ্ঠ হয়, সেই নগ্ন অবস্থাতেই তাকে ফিরে যেতে হয়।
গাড়ি চলল নিজের গতিতে । কিংশুক পাকা ড্রাইভার। তাই সময় লাগলো না বেশি। দিঘায় ঢুকতেই সুমনার মনটা একটু ভালো হয়ে গেল। সমুদ্রের গন্ধ তার নাকে লেগেছে,আর কাঁপিয়ে দিয়েছে সারা শরীর।
একটা হোটেল ভাড়া করে তিনজনে চলে গেল নিউ দিঘার সৈকতে।
কিংশুক বলল,"মা একটু জল ছোয়াবে গায়ে?"
জল ছোয়াবে? ইচ্ছে তো খুব করছিল কিন্তু ভয়ও লাগছিল। যদি জলে নেমে উঠতে না পারে?কিন্তু এত কাছে এসে জলে নামবে না?
সুমনা বলল,"আমি বিচে বসবো। তোরা যা আনন্দ কর।"
কিংশুক সুমনাকে কোলে করে নিয়ে ভেজা বালির উপর বসিয়ে দিল । আর সঙ্গে সঙ্গে এক নোনা ঢেউ এসে ছুঁয়ে দিল সুমনাকে।
মনটা আবেগে ভরে গেল। মাছের গায়ে জল লেগেছে। শরীরটা তাজা হয়ে উঠলো । কিংশুক আর রঞ্জনা নিজেদের মতো জলে নেমে পড়েছে । একে অপরের উপর জলের ছিটে দিচ্ছে। ঠিক যেমন ছোটবেলায় দিত। তখন ছিল শিশু সুলভ খেলা আর এখন সেটা হয়ে উঠেছে যৌবনের প্রণয়লীলা।
সুমনার মুখটাতে হাসি ফুটে উঠল এই দৃশ্য দেখে। একসময় এরকম ভাবে অজিতের সাথে সেও আনন্দ করেছে। মনে পড়ে গেল আন্দামানের সাদা বালির উপর হালকা সবুজ জলের ঢেউয়ের কথা। মধুচন্দ্রিমার দিন গুলোর কথা।দুজনে দুজনার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ভেসে ভেসে এলো চোখের সামনে।
সুমনা রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিংশুকের চোখেও রঞ্জনার জন্য ভালোবাসা দেখতে পায়। ঠিক এই রকম ভালোবাসাই অজিতের চোখে নিজের জন্য দেখতে পেত কোন এক সময়।
হঠাৎ করে সমুদ্রের জলের তীব্রতা বেড়ে গেল। জলের স্রোত এতক্ষন যেটা পায়ের কাছে অব্দি আসছিল এখন সেটা সুমনার বুকের ছুঁই ছুঁই। শরীর টা ছলাৎ ছলাৎ করতে লাগলো।
মনে হল শরীরে যেন বল ফিরে পাচ্ছে নতুন করে। সুমনা অবাক ভাবে দেখলো তার হাতটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্ট্রোকের পর থেকে অকেজো হাতটা নতুন করে জীবিত হচ্ছে। মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে বুঝতে পারছে তার শরীরে এক নতুন আমেজ এসেছে। বুঝতে পারছে তার পায়ের পাতাগুলো আবার জেগে উঠেছে। কিন্তু অন্যভাবে। সমুদ্রের ঢেউ ফিরে যেতেই দেখলো তার পায়ের জায়গায় এখন ছলাৎ ছলাৎ করছে মাছের লেজ।
কিংশুক রঞ্জনার সাথে একটু দূরে এগিয়ে গেছিল। জলের তোর বাড়তেই পিছন ফিরে দেখে সুমনা প্রায় অর্ধেক ডুবি ডুবি।
"মা ,আমি আসছি",ভয়ে চীৎকার করে উঠলো কিংশুক।
রঞ্জনাও অস্থির হয়ে পড়েছে। প্রায় দৌড়ে এগিয়ে চলেছে সুমনার দিকে।
পিছন থেকে সমুদ্রে স্নান করা লোকগুলোও চীৎকার করতে লাগলো,"জোয়ার এসেছে।"
কিংশুক দৌড়ে যাচ্ছে। কিন্তু জল যেন তার পায়ে শিকলের মতো আটকে যাচ্ছে। পিছন থেকে আবার একজন চীৎকার করলো,"ডুবে গেল রে, ডুবে গেল"
কিন্তু সুমনার কানে কানে কথা গেল না। সমুদ্রের গভীর থেকে কে যেন তাকে ডাকছে। গাড় নীলাভ রঙে তার চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেছে। সেই চোখগুলো দিয়ে আর ফেলে আসা দিনগুলোর বেদনা ঝড়ে পড়ছেনা। খালি এক রাস আবেগ তার জায়গায় ফুটে উঠেছে।
নীলাভ সেই জলের টানে সুমনা এগিয়ে যেতে লাগল । তার নতুন করে ফিরে পাওয়া হাত দিয়ে ঠেলতে লাগলো নিজেকে সমুদ্রের দিকে। দূরে দিগন্তরেখায় কে যেন উন্মুক্ত দুই হাতে তাকে এগিয়ে আসার অঙ্গীকার করছে।
সুমনা আসতে আসতে মিলিয়ে যেতে লাগলো গভীরে থাকা সেই জগতে। জন ওয়াটারমুলারের ছবিতে থাকা জলপরীর থেকেও সুন্দর হয়ে উঠেছে তার চেহারা ।জলের মধ্যে ডুবে গিয়ে প্রানভরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো । আজ সে আবার পুরানো স্বাধীনতা খুঁজে পেয়েছে।এখন আর শরীরে কোন যন্ত্রনা নেই, কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। আছে এক স্বর্ণালী লেজ । যে লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে সুমনা সুগভীর নীলের সাথে একত্রিত হয়ে যেতে লাগলো। জলের সাথে মিশে গিয়ে সে আজ সত্যিকারের জলপরী হয়ে উঠেছে। সমুদ্র আবার তার রানীকে ফিরে পেয়েছে।