#ছোটগল্প
#জীৎ_ভট্টাচার্য্য
কুয়াশা ভরা সকালের বুক চিড়ে প্রথম লঞ্চটা এগিয়ে যাচ্ছে নৈহাটির দিকে। রেডিওতে একটা গান ভাসছে গঙ্গার জলের সাথে সাথে "মেঘ বলেছে যাবো যাবো। .."
মহিরুল ঘড়িটা দেখলো ,সকাল পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ। সূর্য লাজুক চোখে নৈহাটির দিক থেকে উঁকি মারছে। হালকা শীতের বাতাসে গা সিড়সিড় করছে। নতুন এসাইনমেন্ট এসেছে তার হাতে। নজর রাখতে হবে একটা চায়ের দোকানের উপরে। তাই এই সাত সকালে রওনা দিয়েছে কাকিনাড়ার উদ্দেশ্যে। নৈহাটির পাশেই কাকিনাড়া। সাথে এক বস্তা ফুলকপি ,বেগুন ,টমেটো। মনে মনে একটু হেসে ফেলল। কি ভেবেছিল আর কি করছে ?
ছোটবেলা থেকেই ইয়ান ফ্লেমিং , ফ্রেডরিক ফোরসিথের স্পাই থ্রিলার পড়ে সেরকম জীবনেরই কল্পনা করতো। দামি গাড়ি , হাইফাই গ্যাজেট , স্যুট ,স্টাইল ও আরো কত কিছু। সেই জন্যই তো সি বি আই তে জয়েন করেছিল। মন মুগ্ধকর রূপসীদের সঙ্গী করে পৃথিবীকে রক্ষা করবে টেরোরিস্টদের হাত থেকে। কিন্তু আসল স্পাইয়ের জীবন স্বপ্নালু ঐ রঙিন দুনিয়ার মতো নয় , সিনেমার ঝগঝগে আলোতে অতিরঞ্জিত একশান সিনের থেকে অনেক, অনেক বেশী কিছু।
দাড়িটা চুলকাতে চুলকাতে একটা বিড়ি ধরালো মহিরুল। এক সময়ের সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে ছিল , কিন্তু এখন প্রতিদিন এক নতুন পরিচয়ে ,এক নতুন নাম নিয়ে জীবন যাপন করে। তার ট্রেনার মিত্রবরুন বলতেন ,"স্পাইয়ের কোন জাত নেই , কোন পরিচয় নেই। সে কেবল আকাশে উড়ে বেড়ানো কাক। ভিড়ের মধ্যে থাকে আর ভিড়ের মধ্যেই হারিয়ে যায়। খালি নজর সব জায়গাতেই থাকে "।
লঞ্চটা ভট ভট করে এসে দাঁড়ালো জেটিতে। আঁধপোড়া বিড়িটাকে গঙ্গা বক্ষে বিসর্জন দিয়ে বস্তাতাকে মাথায় তুলে চলল সে কাকিনাড়ার বাজারের দিকে। কিছুদিন ওখানেই ঘর সংসার পাতবে। লঞ্চ থেকে নেমে একটা রিকশা ধরতে যাবে অমনি এক ভদ্রলোক এসে মহিরুলের হাতটা চেপে ধরলো ,"দাদা , আপনি চুঁচুড়া থেকে আসছেন তো ?"
মহিরুল একটু অবাক হয়ে বলল ," হ্যা , কেন বলুন তো ?"
ভদ্রলোক একটা ছবি বার করে মহিরুলের সামনে ধরলো ,"এটা...এটা আমার ছেলের ছবি। কিছুদিন ধরে পাচ্ছিনা। শেষ নাকি চুঁচুড়ার দিকেই গিয়েছিল। আপনি কি দেখেছেন ?"
ফুটফুটে একটা উনিশ বছরের ছেলের ছবি দেখে মায়া হলো মহিরুলের। চেনা চেনা লাগছে কি ? না , চেনা নয় একেবারে। সে ভদ্রলোকের দিকে কাচুমাচু মুখ করে বলল ," না দাদা। দেখিনি "
ভদ্রলোক আর কিছু বললনা। এক মুখ ব্যর্থতা নিয়ে আবার অন্য একজন যাত্রীর দিকে চলে গেল।
মহিরুল একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ছয়টা বাজে। না, দেরী করা যাবেনা। এই ভোর সকাল আর রাতের সময়টাই হচ্ছে আসল। তাই চটপট একটা রিকশাতে উঠে চলল বাজারের দিকে।
(২)
বেলা এগারোটার সময় প্রথম দানা পেটে পড়লো মহিরুলের। গরম গরম কচুরি আর ঝাল ঝাল আলুর তরকারি। পিঁয়াজ চেয়েছিল তিরিশ পঁয়তিরিশ বছরের শ্যামলা রঙের মহিলা দোকানির কাছে ।
"অনেক দাম ,বুঝলে ? দশ টাকার কচুরির মধ্যে পঞ্চাশ টাকার পেঁয়াজ দেওয়া যায় না ", দোকানের মালকিন বলে উঠলো।
মহিরুল একটু নরম ভাবে তাকিয়ে বলল ," আপনার দয়াতেই চারদিন পর পেটে পেঁয়াজ পড়বে। পেটের সাথে সাথে মনটাও ভোরে যাবে "
মহিরুলের কথাটা দোকানির মনটা যেন ছুঁয়ে গেল । একটা পেঁয়াজকে চার ভাগ করে একভাগ দিয়ে দিল মহিরুলের পাতে,"আপনি খাঁটি ব্যবসায়ী "
"বুঝলেন কি করে ?"
"মিষ্টি কথা বলে পেঁয়াজের দাম ভুলিয়ে দিলেন "
"মনের কথা বললাম খালি। মনের কথা বেশিরভাগ সময়ই মিষ্টি হয় "
"তাই নাকি ? সব সময়ে ?"
"সব সময় না হলেও , বেশিরভাগ সময় তো হয়। তারপর এরকম রান্না খেলে মুখ এমনি মিষ্টি হয়ে যায়"
দোকানি একটু লজ্জা পেল। সামান্য প্রশংসা যেকোন মানুষকে গলিয়ে দিতে পারে। সাইকোলজি ভালো করে পড়েছে মহিরুল। একটা গরম কচুরি মুখে পুড়ে চোখ চলে গেল সামনের চায়ের দোকানটার দিকে। টিনের ছাউনি দেওয়া দোকানের সামনে মাটির উনুনে একটা তেরো বছরের ছেলে বসে চা বানাচ্ছে। এলাচ আর মালাই দেওয়া চা। সকালেই খেয়েছে। বেশ ভিড়।
কচুরির দোকানটা সেই তুলনায় ফাঁকা। মহিরুল সেখানে একাই খাচ্ছে। শীতের দিনে কচুরি বেশ লাগে।
"আপনি কি এই বাজারে নতুন ?", দোকানি জিজ্ঞেস করে উঠলো।
"আজ্ঞে হ্যা। এই আজই এসেছি। নতুন ব্যবসা শুরু করেছি "
"ওহ , আগে কি করতেন ?"
"কেরলে ছিলাম , রাজমিস্ত্রির কাজ করতাম। অনেক দিন করেছি , ভালো লাগছিলো না। তাই চলে এলাম। এখন এইখানেই থাকবো বছরখানেক "
"আচ্ছা। ", দোকানি একটু চুপ করে থেকে আবার বলল ," কেরল খুব সুন্দর , তাই না ?"
মহিরুলের মুখে জবাব একেবারে তৈরী। আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিল। দীর্ঘ বছর গোয়েন্দার কাজ করে আর কিছু শিখুক চাই না শিখুক , মিথ্যে বলাটা শিখেছে। একেবারে ঠোঁট কাঁপেনা , নেতাদের মতো অনর্গল বলে যেতে পারে।
"অসাধারণ। খালি ভাষাটা শিখতে পারিনি। "
মহিলা গোলগোল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর বলে উঠলো ,"জানেন আমারো ঘোরার খুব শখ। কিন্তু এই ব্যবসা ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই কোথাও। আপনি কি কাল আসবেন ?"
"হ্যা , এই তো বাজার পেরোলে যে আবাসন আছে সেইখানেই উঠেছি। মাস কয়েক তো এই বাজারেই। ইউনিয়নে কথাও হয়ে গেছে "
"তাহলে তো দেখা হবেই রোজ। ভালোই হয়েছে , আপনার কাছে গল্প শুনবো কেরলের। আপনার নামটা জানা হলো না। "
"মৃদুল"
"আমার নাম লক্ষী। এই বাজারে সবাই চেনে আমায় "
মহিরুল খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লো ," আসি তাহলে ? কাল দেখা হবে "
লক্ষী একটু হালকা মাথা নেড়ে পয়সাটা বুঝে নিলো।
মহিরুল তার বস্তাটা তুলে আবাসনের দিকে চলতে লাগলো। আবাসন মানে গুদাম ঘর। বাজারের কাঁচা মালের ব্যবসায়ীরা কখনো হোটেলে থাকেনা। কোন একটা গুদাম ঘরে শরীর রাখতে পারলেই হলো। এক টাকা , দু টাকা নিয়ে যারা মারামারি করে তাদের কাছে হোটেল স্বপ্নের সমান।
সেই গুদাম ঘরেই গিয়ে বস্তাটা রাখলো। তারপর একটু দুপুর দুপুর করে আবার চলল বাজারের দিকে। যে কোন ছুতো নিয়েই যেতে হবে দোকানের সামনে। চব্বিশ ঘন্টা ওয়াচের প্রয়োজন। সন্দেহজনক অনেক একটিভিটি হয় এই বাজারে। হিরোইনের সেল অনেক বেড়ে গেছে। তারউপর এলাকাতে বোমা পড়ছে কথায় কথায়। আগের এজেন্টের খবর অনুযায়ী এই চায়ের দোকানেই সব লেনদেন হয়।
সূর্য মাথা ছাড়িয়ে পশ্চিমদিকে হেলেছে। মহিরুল আসে পাশের এলাকাটা ভালো করে দেখতে লাগলো। কোন মানুষ কি করছে তা জানা দরকার। সামনে একটা মসজিদ চোখে পড়লো। আজানের ডাক আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। মাথার উপর সবুজ রঙের পতাকাটা উড়ছে। মহিরুল এক নিমেষের জন্য চোখ বন্ধ করে আবার বাজারের দিকে ঢুকে পড়লো। কতদিন নামাজ পড়া হয়না। আল্লাকে না ডাকতে ডাকতে আল্লাও হয়তো তাকে ভুলে গেছে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল আর বিকেল ভেঙে সন্ধে নেমে এলো এই ভরা বাজারে। কাতারে কাতারে লোক। বোঝা মুশকিল কোথায় কি হচ্ছে। এই জন সমুদ্রে প্রতিটা মানুষই আলাদা। সবার আলাদা আলাদা চেহারা , আলাদা পরিচয় , আলাদা মন , আলাদা জীবন,আলাদা গল্প । এখানে কোন মানুষটা যে ভালো আর কোনটা যে খারাপ তা সাধারণ লোকেরা এক দৃষ্টিতে বলতে পারবেনা। কিন্তু মহিরুলের মতো প্রফেশনালদের কাছে সেটা খুব একটা বড় ব্যাপার নয়।
আজ প্রথম দিন তাই বেশী ঘোরাঘুরি ঠিক না । সুন্দরী নারীর শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে যেমন অনেক গোপন কথা লুকিয়ে থাকে ,ঠিক তেমনি যেকোন জনপদেরই অনেক গোপন কাহিনী থাকে। আর সেই কাহিনী জানতে হলে তার সাথে মিশতে হবে , তাকে বুঝতে হবে , একটু আধটু খুনশুটি করতে হবে। অন্ধকারে তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে তাকে আলোর স্বপ্ন দেখতে হবে। আর শেষে সেই আলোতেই তাকে নিজের করে নিতে হবে ।
(৩)
দিন সাতেক এইভাবেই চলে গেল। বাজারের লুকানো গলি গুলোর টুকরো টুকরো স্বাদ নিয়ে একটা ম্যাপ নিজের মাথায় বানিয়ে নিয়েছে। চায়ের দোকানের ছেলেটার নাম জয়ন্ত। সবাই ছোটু বলে ডাকে। ছোটু নাইট স্কুলে যায় , দিনের বেলাতে দোকান চালায় তার ঠুঁটো বাপ্ সাধনের সাথে।
এর মধ্যেই মহিরুল দোকানের ভেতরে আড্ডা দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। বিকেলবেলা হলেই আড্ডা জমে যায় দোকানের মধ্যে। স্টেশনের খুব কাছে থাকায় নানা ধরণের মানুষের ভিড় হয়। লোকাল ছেলেদের একটা আড্ডার ঠেক তো বটেই। এর মধ্যেই সে রেগুলারদের চিনে নিয়েছে। কে কখন মদ খায় , কার গাঁজার নেশা আছে ,কার নাম পুলিশ কেস সবই বুঝে গিয়েছিল। কিন্তু যে জিনিসের খোঁজে সে এসেছে সেই জিনিসের গন্ধ এখনো তার নাকে আসেনি। কুকুরের মতো চেয়ে আছে হেরোইন খোরদের সন্ধানে। কে যে আসল ব্যবসাটা চালাচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছিল না।
আঠ দিনের দিন একটা কান্ড ঘটলো গুদাম ঘরের পাশে। গভীর রাতে বাথরুমে যেতে গিয়ে মহিরুল দেখতে পেল একটা ছেলে রাস্তার এক কোনায় শুয়ে আছে। প্রথমে ভেবেছিল কোন মাতাল হবে। কিন্তু একটু সামনে যেতেই দেখতে পেলো ইঞ্জেকশান। হিরোইন খোর।
ছেলেটাকে একটু নেড়ে চেড়ে দেখলো সে ভালো করে। না ,হুস নেই।
কি মনে হলো আর একটু এগিয়ে গেল স্টেশন চত্তরের দিকে। রেল লাইনের ধারে যেতেই আবার চমক লাগলো। ওভারব্রিজের ঠিক নিচে তিন চারটে ছেলে একসাথে ভিড় করে আছে অন্ধকারের মধ্যে। ধিকিধিকি বিড়ির আলো জোনাকির মতো জ্বলে উঠছে।
দূর থেকেই নজর রাখলো মহিরুল। এইখানেই তবে আড্ডা হয়। দু একটা রেলের পুলিশ এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। এমন সময় একটা মালগাড়ি ভোঁ আওয়াজ করে লাইনের উপর দিয়ে রাতের নিস্তব্ধতাকে চুড়মার করে এগিয়ে যেতে লাগলো। মহিরুল কোন কথা শুনতে পেলোনা আর। রেলের পুলিশ গুলোর সাথে নিশ্চয়ই কোন বচসা হচ্ছে।
কিছুক্ষন পরে ছেলেগুলো উঠে রেল লাইন ছেড়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মহিরুল একেবারে তক্কে তক্কে। এই ট্রেলটাই ফলো করতে হবে তাকে। সে ছায়ার মতো রাতের অন্ধকারে তাদের পিছন ধরলো। দু একটা কুকুর রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেগুলোকে দেখে "ঘেউ ঘেউ " করে চীৎকার করতেই মহিরুল একটা দোকানের ঝাপে আত্মগোপন করলো।
বেশ ঝগড়া লেগেছে মানুষে কুকুরে। কিন্তু ছেলেগুলো যেন পরোয়া না করেই এগিয়ে গেল বাজারের দিকে। ঝিম মেরে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলোতে দেখতে পেল একজন লোক বাজারের মুখের সামনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। আর এই ছেলেগুলো সেই লোকটার খুব কাছে এগিয়ে গেল। খোঁড়া লোকটাই কি সাধন? সেই কি তাহলে এই রাতজাগা বাদুরগুলোকে নেশার জগতে পাচার করে? কনফার্ম নয়। কিছু একশান নেওয়ার আগে চোখে দেখাটা জরুরি। খোঁড়া লোকটার সাথেই ছেলেগুলো বাজারের মধ্যে ঢুকে পড়তেই মহিরুলের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
ট্রেলটা নষ্ট হবে ভয়ে সে দ্রুত পায়ে বাজারের কাছে ছুটে গেল। কিন্তু গেলে কি হবে? সেই খোঁড়া লোকটা বা ছেলেগুলোর টিকিটিও আর খুঁজে পেল না। অন্ধকারে মিশে গেছে। মহিরুল বিড়ালের মতো চুপিসারে সেই চায়ের দোকানের কাছে চলে গেল। না, কিছুই নেই। বন্ধ সব কিছু। কয়েকটা মাছি ছাড়া আর কোন জনপ্রাণী নেই।
"সিট্!", নিজের অজান্তেই অদৃষ্টকে গালি দিয়ে উঠলো। নিশ্চয়ই এদের এখন আরো হিরোইনের দরকার। পুলিশ এসে এদের নেশাটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু আর কোথায় পাওয়া যাবে এদের? রাত বাজে দুটো। শীতে একবার ঠকঠক করে কেঁপে উঠলো তার সারা শরীর। ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই তার কাছে।
গুদামে ফিরে এসে সে আবার শুয়ে পড়লো নিজের জায়গায়। ঠান্ডাটা বেশ পড়েছে। দু একবার কাঁপুনিও দিয়েছে। কোন ক্রমে চোখ বন্ধ করলো।
(৪)
বাজারের গুদাম ঘরে ঘুম ভালো হয়না। সকাল চারটে থেকেই শোরগোল শুরু হয়ে যায়। ট্রাক ভর্তি সবজি , মাছ চলে আসে এই সময়েই। নানা রকম মানুষের কথা বার্তাতে আর শুয়ে থাকা যায় না। গত সাতদিন তার এইভাবেই কেটেছে। কুলি মজুরের জীবন যে কতটা কস্টকর তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে এর মধ্যেই।
কিন্তু আজকে সে আর উঠে দাঁড়াতে পারছেনা। অন্যরকম এক কাঁপুনি দিচ্ছে তার সারা শরীরে। নিজের জায়গাতেই শুয়ে রইলো। এর মধ্যে রাতের অন্ধকার কমে গিয়ে দিনের আলো ফুটে উঠলো ঘরের কোনায়। হাত ঘড়িতে দেখতে পেলো সকাল আটটা বেজে গেছে। আজ আর বাজারে যাওয়া হলো না তার। সঙ্গে তার একটা ছোট ব্যাগ ছিল। সেটা থেকেই অনেক কষ্টে একটা প্যারাসিটামল বার করে খেয়ে নিলো। আর তারপরেই চোখ বুজে এলো।
"মৃদুল!,মৃদুল!", একটা হালকা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো তার কানে।
"কে ? কে আপনি ?", ধড়পড়িয়ে উঠতে গেল মহিরুল।
"আমি লক্ষী গো। কি হয়েছে তোমার ?", বলেই মহিরুলের হাতটা চেপে ধরলো।
মহিরুল একটু শান্তভাবে "ওহ , লক্ষী " বলেই আবার শুয়ে পড়লো।
"ও মা গো ! কি জ্বর এসেছে। এতো ডাক্তার দেখতে হবে। ", চিন্তান্বিত ভাবে লক্ষী বলে উঠলো।
"না , না। ...ডাক্তার দেখানোর। ...", আর কথা বলতে পারলোনা মহিরুল।
"তুমি চল , তুমি চল আমার সঙ্গে ", বলেই লক্ষী মহিরুলকে ধরে ধরে উঠালো। তারপর এক কাঁধে ভর দিয়ে গুদাম ঘর থেকে বেরিয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে থাকলো মহিরুল।
"রাত !"
"হ্যা ,রাত হয়ে গেছে অনেক। তুমি নিশ্চয়ই সারাদিন ঘুমিয়েছিলে। এই মানুষটাকে নিয়ে যে কি করি আমি। এই মন্টু একটু ধর তো ",শেষ এই কথাগুলোই মহিরুলের কানে এসেছিলো। তারপরে যে কি ঘটেছে তার বিন্দু বিসর্গ ও তার মনে নেই।
মাঝে মাঝে দু একবার চোখ খুলে দেখে সামনে রাস্তা। আর সে টলছে। একবার এদিক ,একবার ওদিক, ঠিক যেমনভাবে গঙ্গার বুকে ভেসে থাকা লঞ্চটা টোলছিল । একটু পরে আবার যখন চোখ খুললো তখন সামনে একটা মন্দির মতো। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে।
আবার একটা "ধর ধর " শব্দ। কোথায় যাচ্ছে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেনা। মনে হচ্ছে যেন সে নিজেও হিরোইনের নেশায় ডুবে আছে। হঠাৎ করে লঞ্চ ঘাটের সামনে সেই লোকটার কথা মনে পড়লো। সেই ছবিতে দেখা ছেলেটার মুখ ভেসে এলো। সেই ছেলেটাই কি গুদাম ঘরের সামনে পড়েছিল ? তা হবে হয়তো। প্রচুর ছেলেপিলে এই বিষাক্ত নেশায় মত্ত হয়ে ঘর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছে। নতুন প্রজন্মকে শেষ করে দিয়েছে এই মারাত্মক নেশা। ছেলেটার বাবার কাতর মুখটা বাড়ে বাড়ে ভেসে এলো তার চোখের সামনে। তারপর মনে হলো সে তলিয়ে যাচ্ছে। লঞ্চ ভেঙে সে গঙ্গার বুকে ডুবে যাচ্ছে। অতল জল , চারিদিকে অন্ধকার। সে চীৎকার করে উঠলো , কিন্তু জল এখন তার মুখের ভেতরে ঢুকে গেছে। কথা বলতে পারছেনা। দম বন্ধ হয়ে আসছে। সামনে ছয় ছয় খানা বস্তা ভর্তি দেহ দেখতে পারছে। একটা স্করপিও গাড়ি ঘ্যা আওয়াজ করে দাঁড়ালো। দুটো লোক বেরিয়ে এসে একটা বস্তার দিকে বন্দুক বার করে তাক করে আছে। দেশী কাট্টা। এক শটেই বন্দুক শেষ আর জীবনও । একজন বলে উঠলো "এগোবে না,মেরে দেব"। অন্যদিকে কে যেন দৌড়ে এলো। আর সেই সঙ্গেই "ঠাঁই"করে বন্দুক গর্জে উঠলো।
"না !, না! না !", ছিটকে উঠে পড়লো মহিরুল। দরদর করে ঘামছে সে বিছানায় বসে।
সামনে টিমটিম করছে একটা আলো। আর তার বা দিকে জলের বাটিতে হাত ডুবিয়ে বসে আছে লক্ষী।
"সব ঠিক আছে ,সব ঠিক আছে", কাতর সুরে লক্ষী বলে উঠল।
মহিরুলের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। একটা ছোট চারপায়ের উপর শুয়েছিল সে। আশেপাশে একবার চোখ ঘুরিয়ে বুঝতে পারলো সে গুদাম ঘরে নেই। এটা অন্য কারুর ঘর। উল্টোদিকের দেওয়ালে কৃষ্ণর একটা ক্যালেন্ডার টাঙানো। তার পাশে একটা আলমারি।স্টিলের হবে মনে হচ্ছে। চোখ তখনও তার ঝাপসা।
"যাক, জ্বর কমেছে তাহলে। কি ভয় যে পাইয়ে দিয়েছিলে তুমি?"
মহিরুল একবার লক্ষীর দিকে তাকালো। হালকা একটা সবুজ রঙের ম্যাক্সি পরে আছে। অন্তর্বাস না পরে থাকায় বিপদজনক ভাজগুলো ভালোভাবে ফুটে উঠেছে লক্ষীর । এই বেসে তাকে কখনো দেখেনি আগে। বাজারে সারাক্ষণই শাড়ি পরে থাকতে দেখেছে। আর দশটা কচুরির দোকানের মহিলার মতো। সাধারণ ,খেটে খাওয়া চেহারা। কিন্তু এখন তার খোলা চুল আর টিকলো নাক যেন বেশ ভালোই লাগছিল।
"আমি কোথায়?"
লক্ষী জলের বাটিটা পাশে রেখে বিছানায় উঠে বসলো।
"আমার বাড়িতে"
মহিরুল আর একবার দেখলো আসে পাশে। বেশ গোছানো এক কামরার বাড়ি। দেওয়ালের ওদিকে সম্ভবত একটা রান্নাঘর আছে। জানালা দেখতে পারছে। খাটের সামনে টিভি আর তার পাশে বাথরুম মনে হল।
"তুমি যা খেল দেখালে তা আর বলার নয়।"
মহিরুলের কিছুটা মনে পড়ছে। রিকশায় উঠেছিল সম্ভবত।
"আমি কদিন অজ্ঞান ছিলাম?"
"পাক্কা দুদিন। ডাক্তার এসে ইনজেকশন দিতেই জ্বর নেমেছে।"
মহিরুল একটু যেন লজ্জা পেল,"দু দিন আমি এখানেই ছিলাম?ইস কি যে হয়ে গেল আমার? "
লক্ষী একটু হেসে বলল,"চিন্তা নেই। তুমি যে বেঁচে গেছো এই যথেষ্ট। আমি ভাবলাম হাসপাতাল নিয়ে যাই। কিন্তু সেখানে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। তাই বাড়ি নিয়ে এলাম। বেঁচে গেছো এই যথেষ্ট।"
মহিরুল লক্ষীর দিকে তাকিয়ে বলল,"তুমি বলেই আমি বাঁচিয়ে নিয়ে এলে। নাহলে হয়তো মরেই যেতাম। ইস, তোমার বাড়ির লোকেরও আমার জন্য কষ্ট হল। কিভাবে যে আমি এই ঋণ শোধ করবো"
লক্ষী বাধা দিয়ে বলল,"শোন ,ওইসব বলতে হবেনা। এই বাড়িতে আমি একাই থাকি। তাই ওতো চাপ নেই। বর অনেক আগেই আমাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করেছে। নিজের বাপ মাও দেখেনি। আর এই ঘর দেখছো, এ আমার নিজের টাকাতে করা। তাই তোমার চিন্তার কিছু নেই। আর ওইসব ঋনের কথা শোনাবে না আমাকে।"
"কিন্তু?"
"আর বেশি কথা বলতে হবেনা। এখন শুয়ে পর। রাতে খাবারের সময় ডাকবো।"
মহিরুল আর কথা বাড়ালো না। অনেকদিন পরে তাকে এরকমভাবে কেউ বকাবকি করছে। ভালো লাগছিলো তার। জীবনে স্পাই হওয়ার চক্করে বিয়ে করা হয়নি। সারাজীবন খালি এই শহর ,ওই শহর করে বেরিয়েছে। এখন কেউ একটু যত্ন করছে দেখে ভালোই লাগছিলো তার। বিছানায় শুয়ে চোখ বুঝলো একটু। শরীর তা সত্যি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
(৫)
রাতে খেয়েছিল কিনা মনে নেই। সকালে উঠে বেশ ছিমছাম লাগছিল। ডাক্তার ওষুধ ভালোই দিয়েছে। সুস্থ হয়ে উঠেছে একেবারে। বাথরুমে যাওয়ার জন্য নামতে গিয়ে দেখে মেঝেতে বিছানা করা ।
মনটা কেমন করে উঠলো তার লক্ষ্মীর জন্য। এই ঠাণ্ডাতেও তাকে মেঝেতে শুতে হয়েছে। সত্যি, লক্ষ্মীর মতো মানুষ হয়না। নিজের এত প্রতিকূলতা থাকতেও এই কদিনের পরিচয়ে তাকে যেভাবে আপন করে সেবা শুশ্রূষা করেছে তা আর কজন পারে?
"ঘুম ভাঙল?",লক্ষ্মী সেই মাক্সির উপর একটা সোয়েটার জড়াতে জড়াতে ঘরে ঢুকলো।
মহিরুল একটু লজ্জা পেয়ে গেল।
"চা খাবে?"
"চিনি ছাড়া"
লক্ষী হাসি মুখে রান্নার দিকে চলে যেতেই মহিরুল বাথরুমে ঢুকে পড়ল। পরিষ্কার হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখে গমগমে ধোঁয়া উঠছে চয়ের কাপ থেকে।
"আজকে বাজারে যাবেনা? আমার জন্য তো অনেক ক্ষতি হয়ে গেল তোমার"
লক্ষী চা খেতে খেতে বলল,"কিসের ক্ষতি?আজ তো বাজার বন্ধ। আর তাছাড়া আজ তোমার কাছে কেরলের গল্প শুনবো।"
মহিরুল হাসি মুখে চা নিয়ে বসে পড়লো। লক্ষীর মুখটা সকালের আলোতে অন্য ধরনের লাগছিল। একেবারে অন্য রকম। সদ্য ফোটা চন্দ্রমল্লিকার গন্ধে ম ম করছিল ঘরটা।
"কি গল্প শুনবে?",বলে বিছানায় একটু হেলান দিল মহিরুল।
"যা শোনাবে"
মহিরুলের স্টকে এমনিতে প্রচুর গল্প থাকে। নানা পরিস্থিতে তাকে নানা গল্প শোনাতে হয়। কিন্তু এখন লক্ষীকে দেখে তার মুখে কোন কথা আসছেনা। চিন্তা ভাবনাগুলো সব গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। যা হোক করে আলেপির জঙ্গল নিয়ে একটা গল্প শুরু করলো।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার গল্পও বেড়ে যেতে লাগলো। জঙ্গল থেকে পাহাড়,পাহাড় থেকে সমুদ্রে পৌঁছতে বেশীক্ষন লাগলো না। আর লক্ষীও প্রানভরে মহিরুলের গল্প শুনতে লাগলো।
মহিরুল তার সুদক্ষ বর্ণনায় লক্ষীকে যেন সত্যি সত্যি সেই সমস্ত জায়গায় নিয়ে চলে গেল। নিজের বোনা রূপকথার রাজ্যে তাকে ভাসিয়ে চলল। একসময় লক্ষী মহিরুলের হাতটা চেপে ধরে বলল,"আমাকে নিয়ে যাবে সেই দেশে?"
লক্ষীর এই শিশুসুলভ আবদারে মহিরুল আর না করতে পারলোনা।
"হ্যা নিয়ে যাবো। তুমি যাবে আমার সঙ্গে?"
লক্ষী বাচ্চা মেয়ের মতো তার খুব কাছে এসে বলে উঠলো,"হ্যা যাবো। যেখানে নিয়ে যাবে যাবো।"
ইতিমধ্যে লক্ষী নিজের সোয়েটারটা খুলে রেখেছিল। ম্যাক্সির পাতলা কাপড়ে তার শরীরের উষ্ণতা টের পাচ্ছিল মহিরুল। এলোমেলো বস্ত্রে লক্ষী যেন ধরা দিচ্ছে তার মৃদুলের কাছে।
মহিরুল আর নিজেকে আটকাতে না পেরে জড়িয়ে ধরলো লক্ষীকে। তার চুল,গলা বুকের মধ্যে খুঁজতে লাগলো সেই চন্দ্রমল্লিকার গন্ধ। আর লক্ষীও নিজের সর্বস্য উন্মোচন করে বুকে জড়িয়ে ধরলো মহিরুলকে।
দুপুর থেকে বিকেল, বিকেল থেকে রাত অব্দি মহিরুলের ঘড়ির কাটাটা একলাই ঘুরে গেল। অবশেষে রাত আটটা নাগাদ লক্ষীর উন্মুক্ত বক্ষে মাথা রেখে আর একবার ঘুমিয়ে পড়লো মহিরুল। অনেকদিন পরে আবার সে আদর পেয়েছে, আবার সে ভালোবাসা পেয়েছে।
–-------------
গভীর রাতে হঠাৎ করেই মহিরুলের পেটটা মোচড় দিয়ে উঠল। খিদে পেয়েছে। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি।
বিছানা থেকে উঠতে গিয়েই দেখে লক্ষী নেই। শুন্য বিছানায় কম্বলটা খালি পড়ে আছে। কোথায় গেল সে? বাথরুমেও নেই। তাহলে ?
মহিরুল সেই একই বিড়ালের মতো এগিয়ে গেল বাইরের দিকে। একটা হালকা কথা ভেসে আসছে। এতো রাতে কে এসেছে ?
অন্ধকারের মধ্যে বাইরে দরজার সামনে দেখতে পেলো লক্ষীকে। কয়েকটা লোককে দেখা যাচ্ছে। এরা কারা ? নিকষ কালো অন্ধকারে আত্মগোপন করে আছে।
হঠাৎ একটা জিনিস দেখে চমকে উঠলো মহিরুল। লক্ষী একটা ব্যাগ থেকে ইঞ্জেকশান এগিয়ে দিচ্ছে সেই লোকগুলোর দিকে। তারমানে কি , লক্ষী এইসব ব্যবসা করছে ? ভাবতে পারছিলোনা মহিরুল। এই কি সেই লক্ষী যাকে নিয়ে এতো স্বপ্ন দেখছিল মহিরুল ?
লোকগুলো চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে দিল লক্ষী। মহিরুল আর দেরি না করে সোজা বিছানাতে গিয়ে শুয়ে পড়লো। মাথাটাতে কেমন যন্ত্রনা শুরু হয়েছে। প্রথমবার সে কর্তব্য করতে গিয়ে ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েছে। তার চোখের সামনে এক ঘন কালো মেঘ এসে অন্ধকার করে দিয়েছে। একটু পরেই লক্ষী এসে আবার এমনবাবে শুয়ে পড়লো যেন কিছুই হয়নি।
কিন্তু মহিরুলের চোখে আর ঘুম এলো না। সে এখন কি করবে ? কি জবাব দেবে তার সিনিয়র কে ? একই মানুষের কত বিচিত্র রূপ। কখনো সে মায়ের মতো যত্ন করে , কখনো প্রেমিকার মতো আদর তো কখনো রাক্ষসীর মতো নেশা ছড়ায়। এ কেমন মায়া ?
(৫)
ঘড়ির ডায়ালে সাতটা বাজতেই উঠে পড়লো মহিরুল। কালপ্রীতকে সে খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু কিভাবে তাকে ধরিয়ে দেবে। বুকের পাঁজর ভেঙে যাকে নিজের করতে চেয়েছিল তাকে কি পারবে জেলের গরাদের পিছনে ঠেলে দিতে ?
লক্ষীও উঠে পড়েছে। সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে মহিরুলের দিকে একটা নিটোল প্রেমের হাসি হেসে বলল ," বাজারে যাবে আজকে ?"
"হ্যা , চলো "
লক্ষী মহিরুলের খুব কাছে ঝুকে তার ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে বলল ,"তুমি যবে আবার কেরলে যাবে , আমিও যাবো তোমার সঙ্গে "
মহিরুল একফালি হাসি নিজের ঠোঁটে সাজিয়ে রাখলো। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলোনা।
লক্ষী তার সামনেই জামা কাপড় পাল্টে নিলো। আর কোন দ্বিধা নেই লক্ষীর ভেতরে। এখন সব দ্বিধা যেন মহিরুলের মাথায় মৌমাছির মতো ভিনভিন করছে।
দুজনে একসাথে বেরোলো বাড়ি থেকে। যেন নতুন প্রেমিক প্রেমিকা একসাথে ঘুরতে বেরিয়েছে। সকালের মিঠেল হওয়াতে হাটতে হাটতে তারা এগিয়ে চলল বাজারের দিকে। বাজারের খুব কাছে এসে হঠাৎ মহিরুল একটা প্রশ্ন করে বসলো ," কাল বাজার বন্ধ কেন ছিল ?"
লক্ষী একটু চমকে উঠলো প্রশ্নটা শুনে। তারপর একটা ঢোক গিলে বলল ," অরে , ঐ যে সাধন দা ছিল না ? চায়ের দোকানের সাধন দা। সে খুন হয়েছে। তাই গতকাল বাজার কতৃপক্ষ বন্দের ডাক দিয়েছিল। "
শেষের এই কথাটা শুনে কেমন যেন থমকে গেল মহিরুল। সাধন দা মারা গেছে ? তার মানে কি লক্ষী ? না , না এ হতে পারেনা। লক্ষী খুনি হতে পারে না। কিন্তু নিজের ব্যবসা বাঁচানোর জন্য মানুষ অনেক নিচে নামতে পারে। তার স্পাই ক্যারিয়ারে অনেকবার এই একই ঘটনা ঘটেছে। তবে এইবার একটু পার্থক্য আছে। এতদিন শুধু যুক্তি আর প্রমান দিয়ে সব কিছু বিচার করতো মহিরুল। এইবার সেখানে আবেগ এসে জড়িয়ে পড়েছে। কর্তব্য আর ভালোবাসা , কোন দিকে সে যাবে ?
লক্ষীকে এই ব্যবসা ছাড়িয়ে কেরলে সত্যি নিয়ে যেতে পারবে কোনদিন ? সত্যি তার সাথে ঘর সংসার বাঁধতে পারবে ? সব কিছু সত্যি সত্যি বলে দেবে কি লক্ষীকে ?
নিজের মনের কাছেই সে জবাব খুঁজে পাচ্ছিল না। বাজারের মধ্যে চায়ের দোকান টার কাছে গিয়ে চোখে পড়লো ছোটু চা বানাচ্ছে। একটা সাদা খান পরে সে এলাচ পিসছে। খুব বুকে লাগলো ব্যাপারটা। আজগে লক্ষীর জন্য এই ছোট ছেলেটা অনাথ হয়ে গেছে। অনাথ হওয়ার জ্বালা সে বোঝে। বাপ্ মা তারও হারিয়ে গেছে। বয়স যতই হোক , পৃথিবীতে সে এখন একা। ঠিক ছোটুর মতো।
তার চোখ ভিজে এলো। খুব বাজে চাকরি করে। গল্প ,উপন্যাসের স্পাইয়ের জীবনের সাথে তার কিছুই মেলে না। ধীরে ধীরে বাজার থেকে বেরিয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করলো। সারাক্ষন অফ করে রাখে যাতে শত্রূ পক্ষ কোনোরকম টের না পায়। খালি দরকারের সময়ই ফোন অন হয়। আজগে সেই দরকারের দিন। ফোনটা ওন হতেই তার সামনে দিয়ে গত কয়েকদিনের ঘটনাগুলো নদীর জলের মতো বয়ে যেতে লাগলো। সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মনে পড়তে লাগলো।
কিন্তু একটা ডিসিশানে আসতেই হবে তাকে। এমন সময় মসজিদ থেকে আজানের আহ্বান ভেসে এলো। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বুঝলো। আজ আল্লাকে ডাকার দিন। সবুজ পতাকাটা এলোমেলো ভাবে উড়তে লাগলো।