ছোট ছোট রুমালের ডাই নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লো সাবিত্রী। আজকাল ট্রেন থেকে ওঠা নামা করতে বড় কষ্ট হয়। হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে। বয়স তো আর কম হলো না। কিন্তু উপায় আর কি আছে ? ট্রেনে উঠেও বসার জো নেই।
না ভিড়ের জন্য নয় , বেলার দিকে নামখানা লোকাল একটু ফাঁকাই থাকে। বসলে পরে মাল বিক্রি করবে কাকে ? সংসার চালাবে কি দিয়ে ?
জানলার সিট্ গুলো একেবারে ফাঁকা। আর দুএকদিন গেলেই ঋতু পাল্টাবে। হেমন্ত ঘুমালে শীত জাগবে। সবাই বলছে এবার নাকি কাঁপিয়ে দেবে। তা দিলেই ভালো , দু চারটে মাফলার তুলবে তাহলে। রুমাল , মোজা এখন আর কেউ কিনতে চায় না।
পা গুলো টনটন করছে। একটু জানলার ধারেই গিয়ে বসলো সাবিত্রী। শুনেছে এইভাবে জানলার ধারে বসেই নাকি অনেক শিল্পীরা গান বাধে। কি দেখে কে জানে ? তার তো আলাদা কিছু মনে হয় না। খালি একটু হাওয়া লাগে বুকের ভেতরে, ঠান্ডার দিনে বুক ঠান্ডা হলে সর্দি লাগবে। আবার ওষুধে টাকা যাবে।
ট্রেন "ভোঁ " আওয়াজ করে স্টেশন ছেড়ে বেরোতে লাগলো। হালকা দুলুনিতে সাবিত্রীর চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো। ছোটবেলায় এভাবেই তার বাপ্ মা ঘুম পাড়াতো।
"দোল দোল দুলুনি , রাঙা মাথায় চিরুনী "
ঘুমালে হবেনা। ঘুমানোর সময় নেই। দু চারটে লোক উঠেছে , মাল বেচতে হবে তো। সিট্ থেকে উঠতেই পায়ে কিছু একটা ঠেকলো। সাপের মতো শরীর বেকিয়ে সিটের তলায় দেখলো একটা বোজকা পরে আছে। টেনে বার করতেই বুঝতে পারে মেয়েদের জামা কাপড় ভরা ।
"এরকম সুন্দর জিনিস কে ফেলে গেল ?"
লাল রঙের চুরিডারগুলো দেখে নিজের যৌবনের কথা মনে পরে গেল। ঋতুর বাবা আষাঢ় মাসের মেলাতে নিয়ে গিয়ে হাত ভরিয়ে দিত লাল চুড়িতে। মাথায় লাল সিঁদুর , হাতে লাল পলা ,পরনে লালের আবরণ। ঢেকে যেত লালের সোহাগে। আদরে আদরে শরীর লাল হয়ে যেত, উষ্ণ হয়ে উঠতো টিনের চাল গুলো। আর সেই উদ্দম উষ্ণতাকে ঠান্ডা করতে নেমে আসতো শ্রাবনের ধারা । আষাঢ় থেকে আষাঢ় ,সতেরো থেকে পঞ্চাশ এক নিঃশ্বাসে যেন কেটে গেল , হই হই করে।
কিন্তু সেই সব দিনগুলো এখন বৃদ্ধ পৌষের মতোই রসহীন , ঠান্ডা হয়ে গেছে। লাল রঙ এখন দিগন্তের গায়েই ভালো লাগে ,নিজের জন্য পৌষ দু বাটি সাদা মেঘের রঙ দিয়ে গেছে । থানই ভাগ্য আর এই থানই জীবন ।
তবে এখন সমস্যা একটাই , ব্যাগটার কি করা যায় ? পুলিশ কে দিয়ে দেবে ? অন্যের জিনিস নিলে কেমন যেন চোর চোর মনে হয়। কিন্তু পুলিশও বা নিয়ে করবে কি ? ঘরে মেয়েটার জন্য নিয়ে গেলে হয় না ? এতো সুন্দর জিনিসগুলোতে বেশ মানাবে। কতদিন হয়ে গেছে মেয়েটাকে একটা নতুন কিছু কিনে দিতে পারেনি।
ব্যাগটাকে বগল দাবাই করে অন্য কম্পার্টমেন্টের দিকে চলল সাবিত্রী।
"রুমাল লাগবে ?মোজা লাগবে ?", দু একবার উচ্চস্বরে বলে উঠলো ফাঁকা কম্পার্টমেন্টে। দু একজন লোক একবার দেখলো , তার পর মুখ ঘুরিয়ে আবার জানলার দিকে তাকিয়ে রইলো।
সাবিত্রী মনে মনে মিনতি করে। ভগবানকেও তার অনুরোধ জানায় । ছোটবেলায় মা বলতেন ভগবান সব ঠিক করে দেয় , সব আশা পূরণ করে। সরল মনে বিশ্বাস করতো সে।
যেদিন রুমাল বিক্রি হয় না , সেইদিন খুব ডাকে ভগবানকে। দয়ার সাগরে থেকে যদি ভগবানের একটু দয়া হয় তার প্রতি। দু একটা রুমাল তো সেও কিনতে পারে। সেতো কোনোদিন বেশী কিছু চাইনি। না চেয়েছে বড় অট্টালিকা , না চেয়েছে বিরাট গাড়ি। খালি মেয়েটাকে নিয়ে সৎ ভাবে জীবন যাপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু তা আর হলো কোথায় ?
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল ভগবান শাস্তি দিয়েছে। যে সৎ পথে চলেছিল সারাজীবন, আজ সেই পথ থেকেই বিচ্যুত হয়েছে। ব্যাগটা তার নেওয়া উচিত হয়নি। সামনে ঢাকুরিয়া স্টেশনে নেমে গেল সাবিত্রী।
দুচারটে ছোট ছোট বস্তির মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাদেরকে ডেকে দিয়ে দিল সেই ব্যাগ ভর্তি জামাকাপড়। যাক , একটু বোঝা কমলো তার হৃদয় থেকে। সব ধরে দিলো ঠিকই খালি একটা লাল চুড়িদার রেখে দিল। ঋতুকে সাজাবে সে। কিন্তু বিনা পয়সায় সে নেবে না। স্টেশনের বাইরে থাকা মন্দিরে গিয়ে দশ টাকা দিয়ে দিল আর মনে মনে বলল ," ভগবান , ক্ষমা করো। লোভী হয়ে গেছি "
একটু শান্তি পেলো। আবার পরের ট্রেন ধরে উঠে পড়লো গাড়িতে। বারুইপুর লোকাল। বেশ ভিড় হয়েছে। যাক দু একটা হলেও হতে পারে।
"ও মাসি ,একটা রুমাল দিয়ে যাও তো ", একজন পুলিশের পোশাক পরিহিত মিষ্টি দেখতে যুবক হাঁক দিল।
তাকে দেখাদেখি আরো কয়েকজন চাইতে লাগলো। সাবিত্রীর ঠোঁটের কোনায় একটা গোপন হাঁসি ফুটে উঠলো।
বারুইপুর যেতে যেতে অনেকগুলোই বিক্রি হয়ে যাবে। বেশী সে কোনোদিন চায় নি। খালি চেয়েছে সারাদিনের খরচ উঠে যাওয়ার মতো একটা রোজগার ।
(২)
"বউদি এতো দেরী করলে কিন্তু আমার হবে না। তুমি তো জানো এখনো এক বাড়িতে আমায় রান্না করতে হবে ", একটু রেগেই কথাগুলো শোনালো পাপড়ি।
সাবিত্রী মুখ বন্ধ করে খালি শুনে গেলো। ব্লাউজের ফাঁক থেকে ছোট মানি পার্স বার করে দেড়শো টাকা হাতে গুঁজে দিল পাপড়ির।
পাপড়ি টাকাগুলো নিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে বলল ," আর পঞ্চাশ ?"
সাবিত্রী কিছু বললনা। চুপ করে তাকিয়ে রইলো পাপড়ির দিকে। আর পঞ্চাশ দিলে মেয়ের ওষুধের টাকা থাকবেনা যে।
পাপড়িও আর জোর করলোনা। সে জানে সাবিত্রীর অবস্থা। কিন্তু তারও যে হাত বাধা। অভাব তার সংসারেও দাঁত বসিয়েছে। কুবের ছাড়া এমন কেউ নেই যার টাকার দরকার নেই। এমনিতে তার রেট দিনে দুশো। কিন্তু সাবিত্রীর জন্য সেটা একশো। তাও দুদিন বাকি পরে গেছে।
পাপড়ি বেরিয়ে যেতেই সাবিত্রীর যেন নিঃশ্বাস পড়লো। রোজ রোজ এই একই ঝামেলা আর ভালো লাগেনা। হাত মুখ ধুয়ে সে ঘরে গিয়ে ঋতুকে দেখে এলো। চোখ বন্ধ করে আছে বিছানায়।
সাবিত্রীর মনে হল হয়তো ঘুমোচ্ছে। বিছানার তলায় বেডপ্যানটা পড়েছিল। আজকেও পাপড়ি ভুলে গেছে। জানে মেয়ের হুশ থাকেনা , তারপরেও সেই একই কান্ড। গত দেড় বছর ধরে বলে যাচ্ছে তাও কি করে মানুষের ভুল হতে পারে ? মনে মনে গর্জে ওঠে সাবিত্রী।
আলতো আলতো পায়ে সে রান্নাঘরে ঢোকে। খুব কাঁচা ঘুম ঋতুর। অন্তত তাই জানতো সাবিত্রী। আগে তো তাই ছিল , এখনো তাই হবে হয়তো। মেয়ের তো চোখ খোলে না ,হাত পা নড়ে না , কথা বেরোয়না মুখ দিয়ে। খালি কখনো কখনো স্বপ্ন দেখলে তেড়ে ওঠে। কাঁপতে থাকে।
কি দরকার আর স্বপ্ন দেখার ? ভগবানকে রোজ বলে সাবিত্রী ," ঠাকুর মেয়েকে স্বপ্ন দেখিয়ো না "
স্বপ্ন দেখলেই যে শরীর আরো খারাপ হয়ে যায়। এমন কাঁপুনি যেন তার সারা শরীরে ভূমিকম্প হচ্ছে , এমন জ্বালা যেন রক্ত মাংশ গুলো অঙ্গারের আগুনে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। বোঝে সাবিত্রী সব। মা তো , তাই মেয়ের কষ্ট সবই বোঝে। না বুঝে যে উপায় নেই। স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে এখন যেন নিজেই দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে। কি দরকার ছিল ওতো উড়বার ?
বারবার ব্যারন করা সত্ত্বেও চাকরি করতে ঢুকেছিল। রাত বেড়াতে অফিস থেকে ফিরতো। কতবার সাবিত্রী বুঝিয়েছিল যে দিনকাল ভালো না , এতো রাত করে ফেরা একা মেয়ের জন্য ঠিক না।
কিন্তু মেয়ে কি শুনেছিল সেই কথা ? কক্ষনো না। ছেলেরা যা পারে মেয়ে হয়ে কি তা করা সম্ভব ? তারা থাকবে ঘরের মধ্যে , রান্না করবে , ছেলে মানুষ করবে , ঘর সাজাবে। বাইরে গিয়ে পয়সা উপার্জন করা তো মেয়েদের কাজ নয়। আত্মীয় স্বজন পই পই করে বলতো ,মেয়েদের ওতো স্বাধীনতা ঠিক নয়। বেশী পড়াশুনাও করা উচিত নয়। কিন্তু মেয়ে কি শুনেছে সেই কথা ? সে সাবলম্বী হতে চেয়েছিল বাপের মতো। মা খালি পেটেই ধরেছিল ,বাকি সব কিছুই বাপের মতো। জেদি।
আত্বীয় স্বজন জোর করে একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। দেখতে শুনতে ভালো ইঞ্জিনিয়ার ছেলে, বড় চাকরি , বড় বাড়ি। বিয়ের দিনটা অব্দি ঠিক হয়ে গেছিল। অনেক সখ ছিল লাল শাড়ি , লাল সিঁদুর মাথায় নিয়ে বিশাল ধুমধাম করে মেয়ে যাবে শ্বশুরবাড়ি। সাজিয়ে গুছিয়ে সংসার পাতবে নতুন করে। কিন্তু তা আর সহ্য হলোনা।
সব দোষ ঋতুরই। কি দরকার ছিল চাকরি করার। না করলে ওতো রাত করে ফিরতে হতো না। আর সেই কুকুর গুলোর সাথেও দেখা হতো না। এক রাতের মধ্যেই তার স্বাধীনতাকে , তার আত্মাকে , তার সাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নকে গলা টিপে খুন করা হয়। যে শরীরে কখনো রোগ হতো না আজ তা বেডসোলে ভর্তি হওয়া এক জড় বস্তু । যে ঠোঁটদুটোতে সারাক্ষন জীবন জড়িয়ে থাকতো আজ তা শুকনো পাতার মতো নিথর , প্রাণহীন হয়ে পরে আছে।
সবই ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছিল সাবিত্রী। এছাড়া তো আর কিছুই করার ছিল না। থানা , পুলিশ , কোর্ট , কাচারী করেও কিছু লাভ হলো না। লাভ হলো না জমানো সব টাকা দিয়ে চিকিৎসা করে। দেড় বছর আগে সেই যে বিছানা নিয়েছে , সেখানেই মেয়ের না হওয়া সংসার গড়ে উঠেছে। খাওয়া , নাওয়া সবই ওই বিছানাতে। মেয়ের বাপের চোখে বেশী দিন সহ্য হলো না এই দৃশ্য। তাই আগে ভাগেই চোখ বন্ধ করেছে। স্বার্থপর বলে অনেক গাল দিয়েছিল সাবিত্রী মুখাগ্নির দিন। তার যে সব টুকুই চলে গেল। এখন খালি ভাবে আর যে রুমাল দিয়ে সংসার চালায়, সেই রুমাল দিয়েই চোখের জল মোছে।
তবে সেই নেকড়েগুলো কিন্তু দিব্বি আছে। বুক চিতিয়ে দলের পান্ডা এখন দেশের পান্ডা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার মেরেছে।
"আগুন চিহ্নে ভোট দিন , মাফ হবে সবার ঋণ "
সাবিত্রী খালি দেখে আর ভগবানের কাছে বিচার চায়। সামান্য তো একটা জিনিস, পয়সা দিয়ে কিনতেও হয়না। এইটুকু তো তার ভগবান করতে পারে। সামান্য একটু বিচার।
(৩)
রাত বাড়তেই রান্না শেষ করে সাবিত্রী মেয়ের ঘরে ঢোকে। হয়তো জেগে গেছে এখন। ট্রেনে কুড়িয়ে পাওয়া লাল চুড়িদারটা নিয়ে মেয়ের সামনে ধরে ," দেখ মা , কি সুন্দর চুড়িদার এনেছি তোর জন্য। তোকে খুব মানাবে "
মেয়ে মায়ের কথা শুনে হয়তো হেসেছে । নতুন জিনিস পেয়ে হয়তো আনন্দে আত্মহারা হয়েছে, যেমন ভাবে ছোটবেলায় হতো।
সাবিত্রীর মনে হলো একবার পরিয়ে দেখা যাক কেমন লাগে। শরীর থেকে আসতে আসতে সমস্ত জামা কাপড় খুলে চুড়িদারটা নিজের হাতেই পরিয়ে দিল। মেয়েও কোন রকম বাধা দিলো না। শেষবার যখন বাধা দিয়েছিল তখন কেউ শোনেনি। তারপর থেকে বাধা দেওয়াই ছেড়ে দিয়েছে।
"বেশ লাগছে তোকে , যেন একেবারে চাঁদপরি ", হেসে ফেলল একটু সাবিত্রী।
রাতের খাবারটাও বেশ সুস্বাদু লাগছিল সাবিত্রীর। বেশি কিছু না , ডাল ভাত আর আলু সেদ্ধ। কিন্তু সেটাই যেন অনেক।
খাওয়া দাওয়া সেরে মেয়ের পাশেই শুয়ে পড়লো। কি সুন্দর দেখতে লাগছে আজকে ঋতুকে । একবার যদি মুখ ফুটে মেয়ে কিছু বলতো তাহলে হয়তো আরো ভালো লাগতো। সারাদিনের শরীরের যন্ত্রনা এক নিমেশে কুন্ডলি পাকিয়ে উড়ে যেত। সেও একদিন হবে। আশা ছাড়েনি সাবিত্রী।
রাতে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলো। ঋতুর বাবার সাথে বাবুঘাটে বসে নৌকাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে দুজনে। সূর্য নিভু নিভু আর শহরের বাতিগুলো জোনাকির মতো পিট্ পিট্ করছে। আহা যৌবনের সেই মিষ্টি দিন গুলো স্বপ্ন হয়ে এখনো বেঁচে আছে। সাবিত্রীর মনে হল এই স্বপ্নই যেন সারাক্ষন থাকে। কক্ষনো যেন আর শেষ না হয়। কক্ষনো যেন তার চোখ না খোলে। চোখ খুললেই বাস্তব ঘরের দরজায় ধাক্কা মারবে। ধাক্কা মারবে আর আগেরদিনের না দেওয়া পঞ্চাশ টাকার হিসেবে নেবে।
হঠাৎ করে সেই স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য আর এক স্বপ্নতে ঢুকে পড়লো। এই স্বপ্নে সে ট্রেনে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সামনে সকালের সেই সুঠাম পুলিশ ছেলেটার পাশে ঋতুকে দেখতে পাচ্ছে । লাল রঙের একটা বেনারসি পরে বরের সাথে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। কাঁধে মুখ গুঁজে গুঁজে কত কি গল্প করছে। এরকমই তো চেয়েছিল সে। সোনার সংসার করবে মেয়ে। একবার মনে হল হয়তো সে মারা গেছে। আর এই যে মেয়ে স্বামীর সাথে ঘর করছে সেটাই আসল সত্যি। ভূত হয়ে দেখছে সব কিছু।
কিন্তু সত্যি সবসময় স্বপ্নের মতো সুন্দর হয় না। ভেঙে যাওয়া কাঁচের জানলা দিয়ে এক পোয়া রোদ এসে ভিজিয়ে দিল তার শুকনো মুখটাকে। ঘুম ভেঙে গেল। আবার সেই নিত্য নৈমিত্তিক জীবনে ফিরে এসেছে সাবিত্রী। আবার এক লড়াইয়ের জন্য তৈরী হতে হবে। বেঁচে থাকার লড়াই।
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মায়া হলো। গালে হাত বোলাতেই বুকের ভেতরটা "ধক" করে উঠলো।
"ঋতু , এই ঋতু !!"
উত্তর না পেয়ে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়লো সাবিত্রী।
"এই ঋতু !!!! মা আমার !!! ঋতু !!!!!"
(৪)
বেলা এগারোটা বেজে গেছে। ঘাটে দশজন মতো শ্মশান যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে কখন ভেতর থেকে ডাক আসবে। সাবিত্রী এক কোনায় মাথায় হাত দিয়ে "দ" হয়ে বসে আছে। এই জীবন সংসারে সে এখন একেবারে একা।
পাপড়িও সাবিত্রীর পাশে চুপ করে বসে আছে। তার ছাপা শাড়ির আঁচলটা আজ ভিজে। অন্য বাড়ির রান্নার কাজে আজ সে যাবেনা। আজ থাকবে সাবিত্রীর সাথে। হাজার হোক , সারাদিন তো সেই চোখে চোখে রাখতো ঋতুকে।
শ্মশান যাত্রীরা নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করছিল ," আহারে ,মেয়েটা গেছে ভালোই হয়েছে। এরকম জীবন যেন কারুর না হয় "
"বেঁচেছে তো সাবিত্রী দি। কত কষ্টই না করতো "
সাবিত্রীর কানে সেইসব কোন কথাই ঢুকছেনা। সে খালি চুপ করে আছে। দূরে কোথায় যেন শুনতে পেল "আগুন চিহ্নে ভোট দিন , মাফ হবে সবার ঋণ "
এমন সময় "ভোঁ " শব্দে চুল্লিঘর জানান দিল যে তার কাজ শেষ। যে মানুষকে গড়তে চল্লিশ সপ্তাহ সময় লেগেছে তাকে চল্লিশ মিনিটে ধুলো করে দিয়েছে। গর্বে তার বুক উঁচু হয়ে গেছে। স্টেট্ অফ আর্ট মেশিন বলে কথা। তারপরে সব মেশিনের মতোই বাকি কাজগুলো হতে থাকলো। গঙ্গা থেকে জল এনে ছাই ঠান্ডা হলো। ডোম অস্থি খুঁজে মালসায় ভোরে একজন শ্মশান যাত্রীকে দিয়ে গেল।
সাবিত্রী সব টুকুই দেখলো। এটা সে আগেও দেখেছে ঋতুর বাবার সময়। তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে একবার করে দেখতো মেয়ের পাশে শুয়ে শুয়ে আর টপ টপ করে নোনা জল ফেলতো তার না পোড়া অস্থিতে।
একজন প্রতিবেশী একটা কাস্তে সাবিত্রীর হাতে দিয়ে বলল ,"দিদি , পুরুতের মন্ত্র উচ্চারণ শেষ হতেই এই কাস্তে দিয়ে মালসা ভেঙে দেবে। তারপরে আর পিছু দেখা যাবে না "
সাবিত্রী আবার সেই স্লোগান শুনতে পেল ,"আগুন চিহ্নে ভোট দিন ,মাফ হবে সবার ঋণ" ।
এবার সকলেই শুনতে পেল সেই স্লোগান। শ্মশানের পাশ দিয়েই যাচ্ছে একটা মিছিল।
পুরুত মন্ত্র উচ্চারণ করে গেল আর সাবিত্রী স্লোগান শুনে গেল ," আগুন চিহ্নে ভোট দিন , মাফ হবে সবার ঋণ "
"নিন , এবার মালসাটাকে না দেখেই ফাটিয়ে ফেলুন। "
সাবিত্রী পুরুতের কথা শুনতে পেলনা। পাবার কথাও না। সে এখন অন্য এক স্বপ্ন জগতে বিচরণ করছে। যেই জগতে তার মেয়ে হয়তো সঠিক বিচার পেয়েছে।
সে কাস্তে নিয়ে এক পা , দুপা করে এগিয়ে গেল মিছিলের দিকে। সে বুঝতে পারলো তার পায়ের বাতের ব্যথাটা যেন একেবারে কমে গেছে । পাখির মতো হালকা লাগছে তার সারা শরীর।
পিছন থেকে পাপড়ি একবার ডেকে উঠলো ,"দিদি! দাড়াও !!"
কিন্তু সাবিত্রী এখন ছুটতে শুরু করেছে। কাস্তে হাতে নিয়ে এগিয়ে চলেছে তার না পাওয়া বিচারের খোঁজে। শহরের এই রাস্তাটাকে ভরা হেমন্তের রোদে লাল রঙে সাজাতে।