এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  অর্থনীতি  বুলবুলভাজা

  • বাজেট ২০২১: অভূতপূর্বই বটে

    রাজেশ ভট্টাচার্য
    আলোচনা | অর্থনীতি | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ২৬৬৪ বার পঠিত
  • এবারের বাজেটে যেসব কথা উপর উপর পড়া গেল, জানা গেল, তার অন্তঃসারশূন্যতা উঠে এসেছে অর্থনীতিবিদ রাজেশ ভট্টাচার্যের এই নাতিসংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটিতে।

    অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করার আগেই বলেছিলেন যে এবারের বাজেট ‘অভূতপূর্ব’ এবং ‘গত একশ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজেট’। এবারের ‘পেপারলেস’ বাজেট পড়ার পর অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে একমত না হয়ে পারছি না। গত একশ বছরে ভারতবর্ষে গণতন্ত্র প্রসারের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় এবারের বাজেট এক অর্থে ছেদ টানল বলা যায়। এক অপ্রত্যাশিত এবং দুনিয়াব্যাপী অতিমারীর ধাক্কায় যখন সাধারণ মানুষ বিপন্ন, রুটিরুজির যোগাড়ে বেসামাল, তখন সমাজের প্রায় সমস্ত স্তরের মানুষের প্রত্যাশা এবং চাহিদাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ১৩০ কোটি মানুষের দেশে গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকার কীভাবে তার নীতি নির্ধারণ করতে পারে তার উদাহরণ হয়ে থাকবে এবারের বাজেট। আগের বাক্যে ‘প্রায়’ শব্দটা ব্যাবহার করলাম কারণ বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থা এবং উচ্চ/উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ছাড়া আর কারও এই বাজেট নিয়ে খুশি হওয়ার কোন কারণ দেখছি না। দালাল স্ট্রিট এর বিকট উল্লাস তারই প্রমাণ দেয়। সাধারণ ভাবে ছোট বা মাঝারি উদ্যোগপতি বা ব্যবসায়ীদেরও এই বাজেট থেকে কিছু পাওয়ার নেই। মধবিত্ত, গরিব এবং প্রান্তিক মানুষ — কৃষক, সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষ, ছাত্রছাত্রী, মহিলা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ—এরা তো সবাই বাজেটে ‘ফালতু’। শুধু তাই নয়, এ বছর যে চার রাজ্যে ভোট আসন্ন —প শ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু, আসাম এবং কেরলে — সেখানে শাসক দলের নির্বাচনী স্বার্থ মাথায় রেখে প্রায় দু লক্ষ কোটি টাকার সড়ক ও মেট্রো রেল প্রকল্প ঘোষিত হল। এই চার রাজ্যের বাসিন্দাদের উল্লসিত না হয়ে বা কোন রাজ্য বেশি পেল সেই তুলনামূলক বিচারে না গিয়ে, বরং গভীর বিষাদের সঙ্গে উপলব্ধি করা উচিত যে ভারতবর্ষের অধিকাংশ রাজ্যের প্রতীক্ষমান সাধারণ মানুষকে কিভাবে শাসকগোষ্ঠী নিজের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সশব্দে থাপ্পড় মেরে তাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। অর্থমন্ত্রী ঠিক-ই বলেছেন —গণতন্ত্রের ইতিহাসে এই বাজেট অভূতপূর্বই বটে।

    তাহলে, কী করা যেতে পারত— যদি জনকল্যাণ সরকারের লক্ষ হত? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরও তো জানা এবং বিশ্ব জুড়ে বেশ কিছু দেশে তার উদাহরণও পাওয়া যায় এই মুহূর্তে। অতিমারীর আগেই ভারতবর্ষের অর্থনীতি নিম্নমুখী – ২০১৬-১৭ পর থেকেই দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কমেছে; গত ৪৫ বছরে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি; সরকারের বাতিল করে দেওয়া কিন্তু মিডিয়া তে “লিক” হয়ে যাওয়া দেশব্যাপী সমীক্ষার ২০১৭-১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী গত চার দশকে প্রথমবার মাথা পিছু মাসিক ভোগব্যায় কমেছে; বেসরকারি বিনিয়োগ থমকে এবং ব্যাঙ্কগুলো অনুৎপাদক সম্পদের ভারে ন্যুব্জ। এক কথায় নড়বড় করেই চলছিল, অতিমারীর ধাক্কায় অর্থনীতির রথের চাকা একেবারে বসে গেছে। হঠাৎ করে চাকরি গেছে, ছোট ছোট ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সিনেমা হল, পর্যটন এবং পরিবহণ শিল্প বিপন্ন এবং এই সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘিরে যে বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষের জীবিকার বন্দোবস্ত হয়, তা রাতারাতি উধাও। এর ফলে কর্মসংস্থান বা জীবিকার সঙ্কট, রোজগার নেই, ফলে সাধারন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেই, ফলে বাজারে চাহিদা নেই, ফলে বেসরকারি উৎপাদন এবং বিনিয়োগ ঝিমিয়ে আছে। তাহলে, এই ধ্বস্ত অর্থনীতি তো এমনিতে উঠে দাঁড়াবে না, তাকে টেনে তুলতে হবে—বিশেষত যেখানে অতিমারীর আগেই অর্থনৈতিক সঙ্কটের পরিষ্কার আভাস পাওয়া গেছিল। অর্থনীতির সাধারণ যুক্তি বলে এ অবস্থায় সরকারের খরচ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান করতে হবে যাতে মুষ্টিমেয় নয়, ব্যাপক মানুষের হাতে টাকা আসে — তারা যখন সেই টাকা খরচা করবে, তখনই বাজার চাঙ্গা হবে। এটা বিশেষ ভাবে সত্যি ক্ষুদ্র, ছোট আর মাঝারী শিল্পের ক্ষেত্রে—যেখানে ভারতবর্ষে বহুদিন ধরেই সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষ জীবিকা অর্জন করেন। এক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগের দিকে মুখে চেয়ে বসে থেকে লাভ নেই। বাজার যেখানে ঝিমিয়ে এবং চাহিদা অপ্রতুল, সেখানে বেসরকারি বিনিয়োগের আশা করাটা ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছু না। অতিমারীর প্রেক্ষিতে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত মানুষদের আশু ‘রিলিফ’ দেওয়া। ২০২০-২১ সালে এই ‘রিলিফ’ দেওয়া হয়েছিল মুলত MNGRES বা একশ দিনের কাজের প্রোগ্রাম এবং রেশন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে। যদি ২০২১ সালের অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ ভারতবর্ষ এড়াতেও পারে, এমন ভাবার কোন কারণ নেই যে রাতারাতি অর্থনীতি এমন লাফ দিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে যে মানুষের আর রেশন বা একশ দিনের কাজের কর্মসূচির প্রয়োজন থাকবে না। তাহলে দাঁড়াল এই যে, সাধারণ মানুষের জন্য জরুরি বন্দোবস্তই হোক, বা বেশ কয়েক বছর ধরে মন্দামুখী অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করাই হোক, বিপুল সরকারি বিনিয়োগ আর তার মধ্যে দিয়ে কর্মসংস্থান এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া আর বিকল্প নেই। এবং এর ফলে রাজকোষ ঘাটতি বাড়বেই, তা নিয়ে চিন্তা করার সময় এটা নয়। দক্ষিণপন্থী বা বামপন্থী যে সরকারই হোক না কেন, এবং যে কোনো স্বাধীনচেতা অর্থনীতিবিদকে জিজ্ঞাসা করলে এই মুল কথাটিতে সবাই একমত হবেন।

    এই সহজ কথাটি বহু দেশের সরকার এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার বুঝতে পারলেও, কেন্দ্রীয় সরকার তার উলটো দিকে হাঁটছে। অতিমারীর সময় উপরোক্ত সহজবোধ্য ব্যবস্থাগুলো না নিয়ে (২০২০-২১ সালে রেশন এবং একশ দিনের কাজে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ ছাড়া) একের পর এক বাজার-মুখী, বেসরকারি উদ্যোগ-নির্ভর ‘অর্থনৈতিক সংস্কার’ করে চলেছে এই সরকার। যেখানে চাহিদার অভাবে বেসরকারি বিনিয়োগ বেশ কয়েক বছর ধরেই স্তিমিত, সেখানে বেসরকারিকরণ, শ্রম আইন বদল, তিনটে কৃষি আইন, বিদেশি বিনিয়োগে ঊর্ধ্বসীমা শিথিল করা সহ এক গুচ্ছ সংস্কার নিশ্চয়ই অর্থনৈতিক সমাস্যার সমাধানের কাথা ভেবে করা হচ্ছে না। তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে অতিমারীর সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে সরকার বেশ কয়েকটা বিতর্কিত অর্থনৈতিক সংস্কার — যা সাধারণ সময়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক বিরোধিতার সম্মুখীন হত — সেগুলোকে কার্যকর করল।

    বাজেটে চোখ বোলালেই সরকারের এই দুরভিসন্ধি স্পষ্ট হয়। যেহেতু একটা অভূতপূর্ব স্বাস্থ্যসঙ্কটের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, দেখা যাক স্বাস্থ্য নিয়ে বাজেট কী বলছে। বাজেটের আগে প্রকাশিত অর্থনৈতিক সমীক্ষায় স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে ভারতবর্ষে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থা সঙ্গীন — স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুযোগ এবং গুণগত মানের দিক থেকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতবর্ষের স্থান ১৪৫ নম্বরে। স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় অন্তত জিডিপি-র ২.৫ থেকে ৩ শতাংশে নিয়ে গেলে তবেই মানুষের পকেট থেকে খরচা মোট স্বাস্থ্য খাতে খরচার ৬৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে। এই পরিস্থিতে বাজেটে নজর কাড়া ঘোষণা — স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় ৯৪৪৫২ কোটি থেকে ১৩৭% বেড়ে ২.২৩ লাখ কোটিতে দাঁড়িয়েছে (যা জিডিপি- র ১.৮% বলে বাজেটে দাবি করা হয়েছে)। বিষয়টা আসলে কী? এর মধ্যে ধরা আছে কোভিড-১৯ এর টিকাকরণের জন্য এককালীন বরাদ্দ ৩৫০০০ কোটি টাকা, জল সরবরাহ ও স্যানিটেশন খাতে ৬০০০০ কোটি টাকা (দ্বিতীয়টি স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত এবং জরুরি, কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় নয়) এবং স্বাস্থ্য গবেষণা, আয়ুশ এবং পুষ্টি - এই তিনটে বিষয়ের মন্ত্রকের বাজেট। এছাড়াও ধরা আছে ফাইনান্স কমিশন এর নিয়ম অনুযায়ী পানীয় জল ও স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যখাতে রাজ্য সরকারগুলোর কেন্দ্রীয় অনুদান হিসেবে প্রাপ্য ৪৯২১৪ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে পাকাপোক্ত করতে “আত্মনির্ভর সুস্থ ভারত যোজনা” ঘোষিত হয়েছে, যার জন্য ৬ বছরে ৬৪১৮০ কোটি টাকা, অর্থাৎ বছরে প্রায় ১০,৭০০ কোটি টাকা, বরাদ্দ হয়েছে। বোঝা খুব কঠিন আসলে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ টাকা কতটা বেড়েছে—অর্থমন্ত্রী বলেছেন স্বাস্থ্যকে সামগ্রিক ভাবে (holistic) দেখতে চেয়েছেন এই বাজেটে—তাই বোধ হয় সাবকিছু যোগ করে ১৩৭% বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করেছেন। আমরা যারা অতটা বিস্তীর্ণ প্রান্তরে চরতে অক্ষম, বাজেটে নীচের সংখ্যাগুলো পেলাম।



    অর্থাৎ, এই বছরে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ গত বছরের সংশোধিত আনুমানিক খরচের চেয়ে ৭৮৪৩ কোটি টাকা কম।
    এই তো গেল স্বাস্থ্য। এখন দেখা যাক, ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আগেই বলেছি, বিপুল সরকারি খরচ করার মধ্যে দিয়েই এই অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। ২০২০-২১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে সংশোধিত মোট আনুমানিক খরচ ৩৪.৫ লাখ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল আর এ বছরের, অর্থাৎ ২০২১-২২ এ মোট আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪.৮৩ লাখ কোটি টাকা। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করার বিষয় গত বছরে, কোভিড-১৯ এর আক্রমণের আগে তৈরি বাজেটে মোট খরচ ৩০.৪২ লাখ কোটি ধরা হয়েছিল। অতিমারীর ধাক্কায় ৪.০৮০৭৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে—মূলত ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে এবং খাদ্য এবং সারের ভর্তুকিতে। তাহলে গত বছরে বিভিন্ন সময় ঘোষিত এবং বাজেটেও উল্লিখিত “আত্মনির্ভর ভারত“ নামে ২৭ লাখ কোটি টাকার অর্থনৈতিক প্যাকেজের কি হল? উত্তর খুঁজে লাভ নেই। এই বছরে গত বছরের সংশোধিত মোট খরচের থেকে মাত্র ৩৩ হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ হয়েছে। যদি মুদ্রাস্ফীতির হার কম করে ৩% ধরি, তাহলে গত বছরের কেন্দ্রীয় সরকারের মোট খরচের পরিমাণ বজায় রাখতে গেলে এ বছর মোট খরচ ধরা উচিত ৩৫.৫ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ, প্রকৃত অর্থে কেন্দ্রীয় সরকার তার মোট খরচ কমিয়েছে। অন্য দিক থেকে যদি দেখি, কোভিড-পূর্ববর্তী একটি স্বাভাবিক বছরে, অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে, বাজেটে বরাদ্দ কেন্দ্রীয় সরকারের মোট খরচ পূর্ববর্তী বছরের, অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের, সংশোধিত আনুমানিক মোট খরচের তুলনায় ১৩.৩% বেশি ছিল, অথচ কোভিডের ধাক্কায় যখন অর্থনীতি বেসামাল, সেই ২০২১-২২ অর্থবর্ষে, বাজেট বরাদ্দ আগের বছরের সংশোধিত আনুমানিক মোট খরচের থেকে মাত্র ০.৯৫% বেড়েছে। শুধু তাই নয়, অতিমারীর বছরেই — যখন শুধু মানুষকে রিলিফ দেওয়া নয়, অর্থনীতির একমাত্র চালু ইঞ্জিন হিসেবে সরকারি খরচের মধ্যে দিয়ে বাজারে চাহিদা বজায় রাখাটা ভীষণ জরুরি—সেই ২০২০-২১ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) আগের বছরের ওই একই ত্রৈমাসিকের তুলনায় সরকারি চূড়ান্ত ভোগ ব্যয়(Government Final Consumption Expenditure) ২০% বাড়লেও, তার পরের ত্রৈমাসিকেই (জুলাই–সেপ্টেম্বর) তা আগের ‘স্বাভাবিক’ বছরের তুলনায় ১৮% হ্রাস পায়। সরকার যে কীরকম জোর ধাক্কা দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চাইছে তা বোঝাই যাচ্ছে। আত্মনির্ভর ভারত বলতে বোধহয় বোঝানো হয়েছে ভারতবাসীদের নিজের জীবন–জীবিকা বাঁচাতে নিজের উপরেই স্বনির্ভর হতে হবে, সরকারের কাছে কিছু পাওয়ার নেই।
    যে একশ দিনের কাজের প্রকল্পের দৌলতে কাজ হারানো এবং গ্রামে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকরা বেঁচে ছিল লকডাউন এবং গোটা বছরটা জুড়েই, সেই প্রকল্পে ২০১৯-২০ সালে বাস্তবিক খরচ হয়েছিল ৭১৬৮৬ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে বাজেটে প্রাথমিক বরাদ্দ ৬১৫০০ কোটি টাকা হলেও, অতিমারীর ধাক্কায় সেটা বছরের শেষে ১১১৫০০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে অনুমান করা হচ্ছে। দাবী ছিল সরকার যেন অতিমারীর ধাক্কায় বিপর্যস্ত মানুষের জন্য এই প্রকল্পে ১০০ দিনের বদলে পরিবার পিছু বছরে অন্তত ১৫০ দিন কাজের সুযোগ দিক এবং/অথবা ১০০ দিনের প্রকল্পে দৈনিক মজুরি বাড়াক। দাবি ছিল শহরাঞ্চলে MNGRES-এর অনুরূপ প্রকল্প ঘোষণা করা হোক। বাস্তবে, ২০২১-২২ সালের বাজেটে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছে ৭৩০০০ কোটি টাকা — যা শুধু গত বছরের সংশোধিত আনুমানিক ব্যয়ের থেকে ৩৪.৫% কম নয়, মুদ্রাস্ফীতির হার ৩% ধরলে, অতিমারীর আগের বছরের বাস্তবিক ব্যয়ের থেকে প্রকৃত অর্থে কম। ভারতবর্ষের কয়েক বছর ধরে নিম্নগামী অর্থনীতির নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা সম্পর্কে সরকার এতটাই নিঃসন্দেহ যে কাজ হারানো এবং গ্রামে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকের বিশেষ সাহায্যের আর কোনও প্রয়োজন এই বছরে থাকবে না বলেই মনে করেছে। খাদ্য- ভর্তুকিতে একই ব্যাপার। অতিমারীর সময় বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণের ফলে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে খাদ্যে ভর্তুকি সংশোধিত আনুমানিক হিসাবে ৪২২৬১৮ কোটিতে পৌঁছবে, যা ওই বছরের বাজেটে বরাদ্দ ১১৫৫৭০ কোটি টাকা এবং কোভিড–পূর্ববর্তী ২০১৯-২০ সালের বাস্তবিক ১০৮৬৮৮ কোটি খরচের থেকে অনেকটাই বেশি। এবারের বাজেটে খাদ্য-ভর্তুকিতে বরাদ্দ ২৪২৬১৬ কোটি টাকা — অর্থাৎ, ধরে নেওয়া হয়েছে যে খাদ্য সুরক্ষা খাতে সরকারকে আর আগের বছরের মত খরচা করতে হবে না। দেশ জোড়া ভয়ানক বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থান ও আয়- সঙ্কোচনের সামনে দাঁড়িয়ে এই অনুমান দুর্বোধ্য।

    এমনকি, পি এম কিষান নিধি প্রকল্পে --যা ২০১৮ সালের পয়লা ডিসেম্বর থেকে চালু হয়েছে, এবং যার সঙ্গে অতিমারীর কোন যোগ নেই—২০১৯-২০র বাজেটে বরাদ্দ ৪৮৭১৩.৮৪ কোটি টাকা থেকে অনেকটা বাড়িয়ে ২০২০-২১ সালের বাজেটে ৭৫০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, যদিও এই খাতে এই বছরে সংশোধিত আনুমানিক খরচ ৬৫০০০ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, ২০২১-২২ সালের বাজেটে এই প্রকল্পে বরাদ্দ আগের বছরের বরাদ্দ থেকে কমে দাঁড়াল ৬৫০০০ কোটি টাকা। মনে রাখা দরকার এই প্রকল্পে প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ১৪.৫ কোটি কৃষক পরিবারকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা, গত বছর অবধি ৯ কোটি কৃষক পরিবার এর সুবিধে পেয়েছে—অর্থাৎ, ৫ কোটিরও বেশি কৃষকের কাছে এখনও এই প্রকল্পের সুবিধে পৌঁছয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতি করে এই রাজ্যের কৃষকদের এই কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে বঞ্চিত করছেন বলে বিজেপি প্রচার করেছে, অথচ বাজেট পাশের আগে ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি মমতা বন্দপাধ্যায় এই প্রকল্পে রাজ্য অংশগ্রহণ করবে ঘোষণা করবেন, সে কথা জানিয়ে দেন। তাহলে ভোটমুখী পশ্চিমবঙ্গের ৭২ লক্ষ কৃষক পরিবারের জন্য অতিরিক্ত খরচের সংস্থান বাজেটে কেন করা হল না? মনে রাখতে হবে এই প্রকল্প — যার ফলে কৃষক পরিবারগুলি (যাঁরা প্রকল্পের শর্তপূরণ করছেন) বছরে ৬০০০ টাকা সারাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে পাবেন - ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের প্রক্কালে এটাই বিজেপির সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘোষণা ছিল। বিজেপির বহু-বিজ্ঞাপিত এই প্রকল্পেরই যখন এই অবস্থা তখন কৃষি বা গ্রামীণক্ষেত্রে আর কতটাই বা সরকারি সাহায্য বা উদ্যোগ আশা করা যায়? কৃষি, সমবায় অর কৃষক কল্যাণ বিভাগের মোট বাজেট অতিমারীর আগে, অর্থাৎ ২০২০-২০২১ সালে, তার আগের বছরের বাজেটের তুলনায় ৩ % বেড়েছিল, আর অতিমারীর মাঝে দাঁড়িয়ে ২০২১-২২ সালে বাজেটে বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় ৮.৫ % কমেছে। পি এম গ্রাম সড়ক যোজনায় বরাদ্দ কমেছে এবং পি এম আওয়াস যোজনায় বরাদ্দ একই রয়েছে (অর্থাৎ, মুদ্রাস্ফীতি ধরলে প্রকৃত অর্থে কমেছে)—আরও উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু নিষ্প্রয়োজন।

    গ্রামীণ পরিকাঠামো এবং ক্ষুদ্র-সেচ খাতে বরাদ্দ মোট ২০০০০ কোটি টাকা বেড়েছে বটে, কিন্তু কৃষকরা উৎপাদিত শস্যের যাতে লাভজনক দাম পায় তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের যে প্রকল্পগুলি রয়েছে তাতে বরাদ্দ কমেছে। বাজেটের আগেই, ২০২০ সালে ঘোষণা হয়েছিল যে ১ লক্ষ কোটি টাকার “কৃষি পরিকাঠামো তহবিল’ তৈরি করা হবে এবং এবারের বাজেটে বলা হয়েছে কৃষিপণ্য বিপণন কমিটিগুলো (Agricultural Produce Marketing Committee--APMC) এই তহবিল থেকে ঋণ পেতে পারে (ভর্তুকিতে) এবং এই তহবিলে টাকার যোগানের জন্য পেট্রোল-ডিজেল-মদের ওপর সেস চাপানো হয়েছে। একদিকে কৃষি বাজার সংস্কারের নামে এতদিন কৃষক মান্ডি এবং সেখানে কৃষিপন্য বিপনন কমিটিগুলোর যে ভূমিকা ছিল সেটাকে দুর্বল করা হচ্ছে, অন্যদিকে বলা হচ্ছে এই কমিটিগুলো ‘কৃষি পরিকাঠামো তহবিল’ থেকে ঋণ পেতে পারে। কেন এই কমিটিগুলো আর ঋণ নিয়ে পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ করবে? সরকারও জানে করবে না। তাই এখন অবধি এই তহবিলে মাত্র ২৯৯১ কোটি টাকার ঋণের আবেদন “নীতিগত ভাবে” অনুমোদিত হয়েছে। আর এবারের বাজেটে বরাদ্দ — ৯০০ কোটি টাকা!

    আগেই বলেছি, প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের কোন সরকারি উদ্যোগ এই বাজেটে নেই—পুরোটাই বেসরকারি ক্ষেত্রের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে ভারতবর্ষে ৮৫% শ্রমজীবী মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত। সংগঠিত ক্ষেত্রে --সরকারি এবং বেসরকারি, দু ক্ষেত্রেই, এবং সরকারি ক্ষেত্রে ক্রমশ আরও বেশি বেশি করে — নিযুক্ত কর্মীদের মধ্যে অনেককেই ন্যুনতম আইনি এবং সামাজিক সুরক্ষা ছাড়া কাজ করতে হয়; তাঁদের ধরলে, ভারতবর্ষে মোট ৯০-৯৩% শ্রমজীবী মানুষের কোনও সামাজিক সুরক্ষা বা চাকরির নিশ্চয়তা নেই। কোভিড অতিমারীর ফলে বলা বাহুল্য এই অংশটাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রথমত মাথায় রাখতে হবে, যে অসংগঠিত গত কয়েক বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের একের পর এক সারজিকাল স্ট্রাইকে অতিমারীর আগেই ধুঁকছিল — ভাইরাসের আক্রমণে তার নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। প্রথমত, অসংগঠিত ক্ষেত্র প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে নগদ-নির্ভর অর্থনীতি। ফলে বিমুদ্রাকরণের ফলে যখন অর্থনীতি থেকে ৮৬% নগদ শুষে নেওয়া হল, তখন অসংগঠিত ক্ষেত্র সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হল। দ্বিতীয়ত, জিএসটি চালু হওয়াতে অসংগঠিত থেকে সংগঠিত ক্ষেত্রের দিকে চাহিদা ঘুরে যায় কারণ অসংগঠিত ক্ষেত্রের অনেক ব্যবসায়ীর পক্ষে জিএসটি র নিয়ম মেনে ব্যাবসা চালানোর খরচা বহন করা সম্ভব হয় নি। তৃতীয়ত, অতিমারীর সময় লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব জনিত বিধিনিষেধের ফলে উৎপাদন এবং পরিষেবা ক্ষেত্রের অসংখ্য অসংগঠিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যবসা এবং জীবিকা ধ্বংস হয়। শুধু তাই নয়, অতিমারীর ফলেও চাহিদা অসংগঠিত থেকে সংগঠিত ক্ষেত্রের দিকে ঘুরে গেল। কারণ, পাড়ার ছোট দোকানে খাওয়ার বদলে হয়ত Swiggy বা Zomato থেকে কোন দামি রেস্টুরেন্ট থেকে খাওয়ার অর্ডার করলাম, অটো- টোটো তে না চড়ে Uber বা Ola ট্যাক্সি বুক করলাম বা নিজের ব্যাক্তিগত গাড়ি বেশি ব্যবহার করলাম, অফিস পাড়ায় কোন দোকানে না খেয়ে বাড়ি থেকে তৈরি করা টিফিন নিয়ে গেলাম, পাড়ার বাজারে না গিয়ে অনলাইনে সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনলাম ইত্যাদি ইত্যাদি — যা ভাইরাস আক্রমণ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতেই মানুষ করেছে এবং আরও বেশ কিছু দিন করবেও।

    উপুর্যুপরি এই ধাক্কায় ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের এবং অসংগঠিত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের কী হাল? কেউ জানে না। জিডিপির হিসেব কষার সময় অসংগঠিত ক্ষেত্রের সরাসরি কোন পরিমাপ হয় না, কারণ সেই তথ্যই নেই। অসংগঠিত ক্ষেত্রর তথ্য নির্দিষ্ট কয়েক বছর অন্তর সংগ্রহ করা হয় এবং তাদের মাঝের বছরগুলোয় ধরে নেওয়া হয় সংঘটিত ক্ষেত্রের (যা প্রতিবছর মাপা হয়) এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের অর্থনীতিক বৃদ্ধির হার একই। আগের আলোচনা থেকেই বোঝা যায় এই অনুমান কিছুতেই অন্তত গত কয়েক বছরের সরকারি নীতির ধাক্কার পর গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সাধারণ ভাবে মানা হয় যে, মোট জাতীয় আয়ের প্রায় ৫০% অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে আসে। অর্থাৎ, ভারতের অর্থনীতির যে ছবিটা অতিমারীর আগে এবং এখনসরকারি তথ্য থেকে পাওয়া যাচ্ছে, আসল অবস্থা তার থেকে অনেক করুণ – কারণ, গত কয়েক বছরে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ওপর কোন তথ্য সংগৃহীত হয় নি। তো, এই বাজেটে অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য কি কোনও ঘোষণা আছে? না। ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ করা হয়েছে বটে — কিন্তু, বাজেটে বরাদ্দ মোট ১৫৭০০ কোটি টাকা দিয়ে প্রায় ৬.৩ কোটি ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি সংস্থার কতটা উপকার হবে সহজেই অনুমেয়।

    এখানে একটা বক্তব্য উঠতেই পারে যে সরকারের কাছে টাকা না থাকলে কী করবে? উচ্চবিত্ত এবং কর্পোরেট সংস্থার (অতিমারীর সময় রেকর্ড মুনাফা করার পরও) ওপর কর বাড়ানো যে সম্ভব – এবং অতিমারী এবং আর্থিক সঙ্কটের সময় যে সেটা সরকারের কর্তব্য — এই ধারণাটাই সমস্ত আলোচনা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। অগত্যা, সরকারি সংস্থাগুলোর বেসরকারিকরণ ছাড়া উপায় কি? সরকার নিরুপায় — গরিবের ভাল করার জন্য ঘরের সোনারূপো বেচলে কি সেটা দোষের? আমি এইখানে বেসরকারিকরণের সমালোচনার মধ্যে ঢুকছি না— পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তিগুলো আমরা সবাই জানি। আমি অন্য একটা কথা বলব, বেচতে চাইলেই তো হল না, কিনবে কে এবং বিশেষ করে যে দামে বেচে সরকার বিপুল টাকা যোগাড়ের স্বপ্ন দেখছে, সেই দামে? যে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা বেশ কয়েক বছর ধরেই নিজেদের সংস্থাসহ দেশে যে কোনও নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহী, তারা কেন হঠাৎ হামলে পড়ে সরকারি সংস্থায় সম্পূর্ণ বা আংশিক শেয়ার কিনতে আগ্রহী হবে? এবং, হচ্ছেও না। তাহলে, এই সরকারের গত ৭ বছরে কারা কিনছে সরকারি সংস্থাগুলোর শেয়ার? —অন্য সরকারি সংস্থা। এটাকে বেসরকারিকরণ ঠিক বলা যায় না, বিলগ্নীকরণ বা সরকারের প্রত্যক্ষ মালিকানা কমিয়ে আনা বলা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, গত কয়েক বছর ধরেই সরকার তার রাজকোষ ঘাটতি লোকানোর চেষ্টা করেছে — নিজের ধারের বোঝা সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থাগুলোর উপর চাপিয়ে দিয়ে বা সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আরও বেশি লভ্যাংশ দাবি করে। যেমন খাদ্য- ভর্তুকির ক্ষেত্রে Food Corporation of India, সার- ভর্তুকির ক্ষেত্রে IOCL, BPCL, HPCL, ONGC, OIL, সেচ প্রকল্পের ক্ষেত্রে NABARD ইত্যাদি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাগুলো অনেকটাই ধার করে সরকারি প্রকল্পগুলো চালু রাখতে সাহায্য করেছে। অর্থাৎ, দাঁড়ালো এই যে, যে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো বেঁচে দেবে বলে গত কয়েক বছর ধরেই উঠে পড়ে লেগেছে এই সরকার, তাদের ওপরেই আরও বেশি বেশি করে নির্ভর করতে হচ্ছে সরকারকে তার অর্থসংস্থানের জন্য—ট্যাক্স বাড়ানো যাবে না যে উচ্চবিত্ত আর বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থার ওপর!

    বাজেটের অসংখ্য খুঁটিনাটি ব্যাপার থাকে — সব বিষয় এই লেখাটায় আলোচনা করা সম্ভব নয়, জরুরিও নয়। শুরুর কথা দিয়ে শেষ করব। অতিমারী-জনিত স্বাস্থ্য সঙ্কট, অতিমারী-জনিত কর্মসংস্থান বা জীবিকার এবং তার ফলশ্রুতিতে বাজারে চাহিদার সঙ্কট বা অতিমারীর আগে থেকেই প্রতীয়মান এবং অতিমারীর ফলে আরও ঘোরালো হয়ে ওঠা অর্থনৈতিক সঙ্কট — এই বাজেট এবং গত বছরে ঘোষিত বিভন্ন আর্থিক নীতি এবং প্রকল্পের অধিকাংশেরই কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক যেটা আছে সেটা হল ১৯৯১ সালে অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তনের ফলে যে বেসরকারিকরণ এবং উদারীকরণের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল, তার সঙ্গে। ১৯৯১ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংস্কারের কিছু মূল কাজ প্রায় তিরিশ বছর নানা রাজনৈতিক বিরোধিতায় অসম্পূর্ণ থেকে গেছিল—যেমন শ্রম আইন সংস্কার, কৃষিবাজার সংক্রান্ত সংস্কার, বিদেশী বিনিয়োগের রাস্তা পুরোপুরি খুলে দেওয়া, বেসরকারিকরণ — এই অসম্পূর্ণ কাজগুলোই খোলাখুলি ভাবে অতিমারী-জনিত স্বাস্থ্য, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে সম্পূর্ণ করার চেষ্টা হল গত বছরের বিভিন্ন নীতি- পরিবর্তন এবং এ বছরের বাজেটের মধ্যে দিয়ে। অতিমারীতে বিপর্যস্ত ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের আশা-প্রত্যাশাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যেভাবে এবারের বাজেট পাশ হল, তা আসলে গনতন্ত্রেরই সঙ্কট। কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘সে বড়ো সুখের সময় নয়’।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ২৬৬৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন