স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ২০২১ সালের ২৬-শে জানুয়ারির প্রজাতন্ত্র দিবসটা সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। ভারতীয় প্রজাতন্ত্র সেদিন সত্যিকার অর্থে 'প্রজা'দের 'তন্ত্র' হয়ে উঠেছিল। সেনাবাহিনীর প্যারেড, শক্তি প্রদর্শন আর প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের বাইরে সত্যিকারের ভারতবর্ষ এই দিন উঠে দাঁড়ালো। পুলিশের ব্যারিকেড, জলকামান আর লাঠিচার্জ কে অগ্রাহ্য করে চলল কৃষক প্যারেড। রাস্তার দুধারে অপেক্ষারত জনতার পুষ্পবৃষ্টি বনাম পুলিশের লাঠি-বর্ষণ ফ্যাসিবাদী শাসকের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনতার বজ্রঘোষণার প্রতীকী চিত্র হয়ে থাকল। কৃষক নেতারা বলেছিলেন, "আমরা দিল্লি জেতার জন্য মার্চ করছি না, দিল্লির দিল জেতার জন্য মার্চ করছি।" দিল্লিবাসীর দিল যে তাঁরা বহু আগেই জিতে নিয়েছিলেন তা বোধহয় তাঁদের ধারণায় অত স্পষ্ট ছিল না। আসলে এমনই হয়! 'ফুলের মালা, দীপের আলো, ধূপের ধোঁয়ার পিছন হতে' জনমগণমন-এর হৃদয়কে চিনতে পারা তো অত সহজ নয়। বিশেষ করে আজকের এই পোস্ট-ট্রুথ সময়ে, যখন কর্পোরেট মিডিয়ার বিপুল প্রচারের ঝলকানিতে বাস্তবতা আর মায়া-বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করাই কঠিন কাজ৷
অন্যদিকে সরকারপক্ষ তার কৌশল বদলেছে। সামনে থেকে মুখোমুখি, হেড-অন কলিশনে আন্দোলন ভাঙা যাবে না বুঝতে পেরে তারা এখন ভেতর থেকে আন্দোলনকে ভাঙতে চাইছে। শাসকদের এটা পুরনো খেলা। আন্দোলনের মধ্যে থাকা তাদের লোকদের দিয়ে হঠকারী ঘটনা ঘটাও। তারপর তাকেই হাতিয়ার করে রাষ্ট্রীয় আক্রমণ নামিয়ে আনো। ইতিমধ্যেই কৃষক নেতাদের নামে এফ.আই.আর করা হয়েছে এবং লুক আউট নোটিশ জারি করা হয়েছে। গাজিপুর সীমান্তে গতকাল রাতে আদিত্যনাথের পুলিশ প্রবল চাপ প্রয়োগ করেছিল ধর্না তুলে দেওয়ার জন্য। সভাস্থলের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। লঙ্গরের জল সরবরাহ ও পানীয় জলের লাইন কেটে দেওয়া হয়। বজরং দল, আর এস এসের গুন্ডাবাহিনী পুলিশের সাথে একসাথেই জমায়েত হতে শুরু করে। কিন্তু রাকেশ টিকায়েতের ডাকে সাড়া দিয়ে হঠাতই গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসেন হাজারে হাজারে কৃষক। অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা যায় ২৮ জানুয়ারির রাতে। গাঁ-গঞ্জ থেকে রাতেই মানুষের মিছিল চলেছে গাজিপুরের দিকে। কৃষকদের চাপে আপাতত থমকে দাঁড়িয়েছে পুলিশ। সিঙ্ঘু ও টিকরি সীমান্তেও পুলিশ চারদিক থেকে কৃষকদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সেখানে অপেক্ষাকৃত বিরাট জমায়েতের সামনে তারা এখনও সুবিধা করে উঠতে পারে নি। এই অবস্থায় পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর-প্রদেশ থেকে আরও মানুষের ঢল আসতে চলেছে বলে খবর। এক কথায়, সন্মুখ সমরে উভয়পক্ষ।
লড়াইয়ের এই পর্যায়ে সরকারি পক্ষ আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা সুবিধাজনক স্থিতিতে চলে গেছে। পয়লা তারিখের প্রস্তাবিত পার্লামেন্ট মার্চ বাতিল করতে হয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চাকে। গত ৬০ দিনের "দিল্লি ঘেরাও" আন্দোলনে এই প্রথম কর্মসূচি নিয়েও তারপর তা পাল্টাতে হয়েছে কিষাণ মোর্চাকে। এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে স্বতঃস্ফূর্ততা আর সচেতনতার আন্তঃসম্পর্কের জটিল বিষয়টি। এখানে যে কোনো ধরণের একপেশেমিই যে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে তা আবার নতুন করে আমরা দেখলাম। ২৬-এর কিষাণ প্যারেডের সামগ্রিক মূল্যায়ন এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সম্ভবত, এটা তার প্রকৃষ্ট সময়ও নয়। কিন্তু কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি।
প্রজাতন্ত্র দিবসের কিষাণ প্যারেডে অংশ নিয়েছিল ২ লক্ষের উপর ট্র্যাকটর এবং ছিলেন দশ লক্ষের উপর কৃষক। বিজেপি/আর এস এস-এর মত একটা আদ্যন্ত ফ্যাসিবাদী শক্তি যে এই মেগা ইভেন্টের সুযোগ নিয়ে অন্তর্ঘাত চালানোর সমস্ত প্রচেষ্টা চালাবে তা কৃষক নেতাদের কাছে অজানা ছিল না। তাই প্যারেডের দুদিন আগেই মোর্চা একটি বিস্তারিত গাইডলাইন প্রকাশ করেছিল। গাইডলাইনের গুরুত্ব আরও বেশি ছিল কারণ পাঞ্জাব মজদুর-কিষাণ সংঘর্ষ সমিতি ঘোষণা করেছিল যে, গাইডলাইনে যে রুটে মার্চ করার কথা বলা হয়েছিল তা তারা মানবেন না। একটি যৌথ আন্দোলনে, যেখানে পাঁচশো কৃষক সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই লড়াই চালাচ্ছে সেখানে এই ধরণের স্বতন্ত্র পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে সমস্যাজনক। বিশেষ করে এটা বোঝার আছে যে, বর্তমান জমানায় কর্পোরেট বিরোধী এরকম একটি সার্বিক আন্দোলন কিন্তু পুতুল খেলা নয়। আন্দোলনকারীদের সামান্য ভুল সরকারপক্ষের হাতে দমন-পীড়ন ও আক্রমণ নামিয়ে আনার জন্য প্রভূত সুযোগ তুলে দেবে। বর্তমান সময়ে সরকারের চরিত্রও যেখানে ঠিক আগের মত আর নেই। এই ধরণের লড়াইয়ে সরকারপক্ষ, বিশেষ করে, একটি ফ্যাসিবাদী শক্তি পরিচালিত সরকার কিন্তু একেবারে শত্রুর মত আচরণ করে থাকে। এখানে আন্দোলন করা মানে যুদ্ধ করা। সুতরাং, যা খুশি করার সামান্যতম সুযোগও কিন্তু আজকাল বড় একটা নেই।
মজদুর-কিষাণ সংঘর্ষ সমিতিকে নিয়ে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার যথেষ্ট অস্বস্তি এবং খটামটি কিন্তু প্রথম থেকেই রয়েছে। সিঙ্ঘুতে পুলিশ ব্যারিকেডের এক দিকে কৃষকরা, অন্য দিকে পুলিশ। সংঘর্ষ সমিতি ঘেরাও আন্দোলন শুরু হবার ১৩ দিন পর সেখানে এসে হাজির হয় এবং পুলিশের জায়গার কিছুটা অংশ দখল করে নিজেদের আলাদা স্টেজ খাড়া করে। কিষাণ মোর্চার নেতারা এটাকে ভাল চোখে নেন নি। তাঁদের ধারণা হল, পুলিশই তাদের ওখানে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে৷ সরকার তাদের ব্যবহার করছে আন্দোলনের 'ট্রোজান হর্স' হিসাবে। আর সংঘর্ষ সমিতির নেতারা যখন প্যারেডের একদিন আগে ঘোষণা করলেন যে, দিল্লি পুলিশের সাথে কথাবার্তা বলে যে রুট মোর্চা নেতারা তৈরি করেছেন তাঁরা সেই রুটে সীমাবদ্ধ থাকবেন না, তাঁরা রিং রোডে যাবেনই, এবং এমনকি তাঁরা দিল্লির কেন্দ্রস্থলেও যাবেন, লালকেল্লাতেও যাবেন, তখনই মোর্চা নেতারা প্রমাদ গুনেছিলেন এবং প্যারেডের বিস্তারিত গাইডলাইন প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু খুব সম্ভবত যেটা তাঁরা বুঝে উঠতে পারেন নি তা হল দীর্ঘদিন ধরে চলা সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়া এই লড়াইয়ে কৃষকরা বর্তমানে বেশ কিছুটা মরিয়া মনোভাবে উপনীত হয়েছেন। তাঁদের সামনে কিছুটা চড়া কর্মসূচি হাজির হলে তাঁদের একটা অংশ যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাতে সাড়া দিয়ে ফেলবে এই গণনা বোধহয় মোর্চা নেতৃত্বের ছিল না। তাঁরা খুব সম্ভবত নিজেদের ব্যাপারে কিছুটা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন।
এর সঙ্গে যুক্ত হল ঐ দীপ সিধু। এসবের ফলে কিছুটা তাল কাটল কিষাণ প্যারেডের। প্যারেড বেরনোর কথা ছিল এগারোটায়। কিন্তু সংঘর্ষ সমিতি আগেভাগেই মিছিল শুরু করে দেয়। পুলিশও তাদের আটকায় না। কিন্তু কিষাণ মোর্চার অফিশিয়াল প্যারেড বেরনোর সময়ে দেখা যায় পুলিশ নির্ধারিত রুটের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ব্যারিকেড করছে যা তাদের করার কথা নয়। সুতরাং ব্যারিকেড ভেঙেই প্যারেড শুরু হল। স্থানে স্থানে শুরু হল কৃষক-পুলিশ সংঘর্ষ। কিন্তু, কিছু লোক লালকেল্লায় ঢুকল বিনা বাধাতেই। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান তাতে অবশ্যই ছিল। কিন্তু তার পেছনে ছিল একটা সচেতন পরিকল্পনা। আর আশঙ্কামত সেই পরিকল্পনার সূত্র ধরেই নামল এবং নামছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃত্বের তৃতীয় ভুল হল, যখন পরিকল্পনা বহির্ভূত কিছু ঘটনা ঘটেই গেছে তখন জোরেসোরে তার সমর্থনে দাঁড়ানো উচিত ছিল। এভাবে তাঁরা অন্তর্ঘাতকে গিলে হজম করে নিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সহসা তাঁরা কিছুটা ব্যাকফুটে চলে গেলেন। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস সহসা অতিরিক্ত শঙ্কায় বদলে গেল। আর যুদ্ধে যদি মানসিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায়, তাহলে শত্রুপক্ষ আরও চেপে ধরার সুযোগ পেয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তাই ঘটল। বিজেপির এই ধরনের অন্তর্ঘাত বর্তমানে অতি-ব্যবহৃত হবার ফলে যে অনেকটাই ধারহীন এবং ভোঁতা হয়ে পড়েছে এটা সম্ভবত তাঁরা বুঝতে পারেন নি। এই অন্তর্ঘাত করার প্রচেষ্টা যে সরকারের কাছে ব্যুমেরাং হয়ে যেতে পারে, যদি তাঁরা ছন্দপতনের সমস্ত দায়ভার সরকারের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তীব্র আক্রমণে উঠে আসেন, এই গণনাও তাঁরা করেন নি। উলটে ছন্দপতনের বেশ কিছুটা দায়ভার তাঁরা নিজেরাই নিজেদের কাঁধে টেনে নিলেন যা সরকারকে আগ্রাসী করে তুলল।
যাই হোক, ভুল-ভ্রান্তি কাটিয়ে তুলে বর্তমানে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু হয়ে গেছে। কৃষক আন্দোলন দমনের জন্য এই ফ্যাসিবাদী সরকারের সমস্ত অন্তর্ঘাত, মিথ্যা প্রচার, প্রতারণা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, কৃষকহত্যার বিরুদ্ধে আমাদের সবারই তীব্র আক্রমণ গড়ে তুলতে হবে। কৃষক ঐক্যের পক্ষে সজোরে দাঁড়াতে হবে। 'ট্রোজান হর্স'দের গণ-বিচ্ছিন্ন করতে হবে। আন্দোলনে সরকারের এজেন্ট প্রভোকেটিওর সব ক্ষেত্রেই থাকে। কিন্তু লড়াইয়ের বর্শামুখ যদি ঠিক রাখা যায় তাহলে তারা শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারে না। তাই লড়াইকে আরও দুঃসাহসী করে তুলতে হবে। আরও আরও বেশি শক্তিকে আন্দোলনের ময়দানে টেনে আনতে হবে। কৃষকদের বিজয় সুনিশ্চিত।
বাস্তব পরিস্থিতির ভালো বিশ্লেষণ।
ভারতবর্ষ নামক দেশ টাতে ২০ ১৪ 'র আগে পর্যন্ত কোনো প্রধান মন্ত্রীর বা কোনো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নাম ফৌজদারি মামলায় জড়িয়ে ছিল ??না ! এই প্রথম দুজন ক্রিমিনাল আমাদের দেশ কে নাকে দড়ি দিয়ে নাচাচ্ছে !!মানুন বা নাই মানুন ।।.এটা সত্যি !!যদি অতীতের অন্যায় স্বীকার করে নিতো ।..বুঝতাম ।..আরো বেশি অত্যাচারী হয়ে উঠছে এই দুই দানব !!নির্লজ্য ভাবে ।..একটা বর্বর আদর্শ বাদ কে সঙ্গে নিয়ে ।..মাত্রা ৩৭ % জনমত কে পাথেয় করে স্টিমরোলের চালাচ্ছে এই অসভ্য ।..অশিক্ষিত পার্টি টা !! এই সময় কৃষক আন্দোলন এদের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে ।..এটা নিশ্চিত !!!