১
চিদানন্দ দাশগুপ্ত মহাশয় একটি বই লিখেছিলেন তার নাম ছিল ‘বই নয় ছবি’। অর্থাৎ সিনেমাকে বই বলব না ছবি বলব? ঠিক এই রকমই বাংলা প্রকাশনা জগতে বইকে বই বলব না মাল বলব সে কথা বুঝে উঠতেই দুই শতকের বেশি কেটে গেল। ‘মাল’ কী রে বাবা – এ কি বড় বাজারের মুটের মাথায় ঝাঁকায় করে ফিরি হবে না মা সরস্বতীর পায়ের তলায় আসন নেবে! ছ্যা! ছ্যা! বলে কী? এসব ভাবাও অন্যায়, বিদ্যা বলে কথা।
কিন্তু বই না মাল ঠিক করবে কে? পেট চলে কাদের? তারা কি বই পড়ে না মাল বেচে?
আরও পড়ুন, বাংলা সংবাদমাধ্যমে সম্পাদনার হাল নিয়ে তাপস দাশের লেখা
তাহলে সেই মালটি কে, বা কী?
২
ছাপাছাপি, প্রকাশনায় কী হয়, কী কী হয়? বই খবরের কাগজ, মোড়ক সবই তো ছাপা হচ্ছে। বই নিয়ে একটু মাথা ঘামানো যাক। বই মূলত দুরকমের; এক, ‘পড়ার বই’, দুই, ‘না-পড়ার বই’ (অপাঠ্য নয় কিন্তু!), অর্থাৎ অ্যাকাডেমিক বইয়ের নন অ্যাকাডেমিক বই। বই ছাপতে গেলে প্রথমে কী লাগে? বা কী কী লাগে? মাল মানে অর্থ লাগে, লগ্নি লাগে – তার পর তো অন্য কথা। অর্থাৎ একজন ইনভেস্টর চাই – কিন্তু তাঁকে তো ইনভেস্ট করিয়ে ডুবিয়ে দেওয়া যায় না – সুতরাং…। তাহলে দাঁড়াচ্ছে, একজন গাইড করার লোক চাই, এবং সেই মালটিই আসল মাল যে মাল এনে দেওয়ার রাস্তা দেখাবে। হ্যাঁ, ইনিই হলেন এডিটর বা সম্পাদক – আসলে দুকান কাটা এবং চার অক্ষর।
দৈনিক খবরের কাগজের এডিটর/সম্পাদক আছেন – তাঁর কাজও আছে। এ লেখার উদ্দেশ্য তাঁদের কাজের থেকে বাইরে - এখানে বই প্রকাশনার সম্পাদনা নিয়ে কিছু কথা থাকবে।
আরও পড়ুন, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার গতি ও প্রকৃতি নিয়ে সুস্নাত চৌধুরীর লেখা
বই প্রকাশনার, সে বাংলাই হোক বা যেকোন ভাষাতেই হোক তার শুরু থেকে শেষ বা একটা ফ্লো চার্ট তৈরি করা যায়। অর্থাৎ, একটি প্রকাশনা সংস্থা মনস্থির করেছে যে কিছু অর্থলগ্নি করবে ছাপাছাপিতে। এর পর কী? প্রকাশকের কাজ কী? এ ব্যাপারে একটা মডেল দেখা যাক – যার নাম দেওয়া হ’ল ‘প্রকাশনা চক্র’।
একটি পণ্যকে এই চক্রে ফেলে ঠিকঠাক ফল পেতে গেলে – এই চক্র ঘোরাবারও ঠিক ঠাক চালক দরকার। সেই চালকই হল সম্পাদক বা সম্পাদকমণ্ডলী। একটি প্রকাশনার সব থেকে প্রয়োজনীয় মেরুদণ্ড হলেন এই সম্পাদক। শুধুমাত্র প্রকাশনাকে লাভের পথ দেখানো সম্পাদকের কাজ নয় – রয়েছে আর একটা বড় কাজও। পাঠকের কাছে নির্ভুল এবং অত্যন্ত সুচারুভাবে প্রোডাক্টটিকে তুলে ধরা, যাতে পাঠক কখনোই না ভাবেন যে তিনি প্রতারিত হচ্ছেন। এই দুটো গুণের সমাহার সম্পাদকের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তৈরি করে দেয় প্রকাশনা বা পাবলিসিং হাউসের ব্র্যান্ড নেম। যে ‘ব্র্যান্ড নেম’ এক ডাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঐতিহ্যের ছাপ রেখে যায়। এই ব্র্যান্ড নেম-ই পরবর্তী কালে হাউসের প্রধান মূল ধনের অংশ হয়ে ওঠে। এই সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে প্রকাশনা সংস্থার অন্যান্য বিভাগের কীরকম যোগাযোগ থাকা দরকার সেটা দেখা যাক আগে। ম্যানেজমেন্ট হায়ারার্কি ফ্লো যদি ভালোভাবে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ককে ঠিক রাখে তাহলে সমগ্র প্রকাশনা সংস্থার এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম থাকে। দেখা যাক একটা প্রকাশনা সংস্থার ‘অরগানাইজেশনাল স্ট্রাকচার’ কী হয়।
সাধারণ প্রকাশনা সংস্থা (ছবি: ২)
এই ছবিতে প্রথমে লক্ষ্য করা যায় কিছু দুমুখো তির আর কিছু একমুখো তির। দুমুখো সংযোগকারী তির বোঝাচ্ছে দুটো বিভাগের মধ্যেই তথ্য আদানপ্রদান সরাসরি করতে হবে। সম্পাদকীয় বিভাগের যেমন সরাসরি সেলস বিভাগকে কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই – সে যাবে প্রচার বা প্রমোশন/মার্কেটিং বিভাগের মাধ্যমে বা প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্টের এর মাধ্যমে। তবে অ্যাকাউন্টস, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, এসব বিভাগের সঙ্গে অবশ্যই শীর্ষ পরিচালকদের মাধ্যমে সকলেরর যোগাযোগ থাকতেই হবে। সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে শীর্ষ কর্তৃপক্ষ, প্রমোশন, প্রোডাকশন, অ্যাকাউন্টসের যোগ থাকতেই হবে। অর্থাৎ সম্পাদনার সঙ্গে যাঁরা যু্ক্ত হবেন, তাঁদের এই বিভাগগুলির সঙ্গে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করে নিতে হবে।
৩
এইবার আসা যাক মূল সম্পাদনায়। বই তৈরি করতে গেলে আগে ভাবতেই হবে যে কী বিষয়ে বই হবে। বিষয়টি ওই প্রকাশন সংস্থার মাপকাঠি, ‘ব্র্যান্ড নেম’-এর সঙ্গে খাপ খায় কিনা – তা বিবেচনা করা সম্পাদকের মূল দায়িত্ব। অর্থাৎ ‘চুপচাপ ফুলে ছাপ’ থেকে ‘ঢপের চপ’ সবই এক হাউসের পক্ষে যথাযথ কি না – তা স্থির করা সম্পাদকের প্রধান এবং প্রথম কাজ। বিভিন্ন ‘প্রোপোজাল’ খুব মার্জিতভাবে খারিজ করার দায়িত্বও সম্পাদকের – সেখানে শীর্ষ পরিচালকগোষ্ঠী বা লেখক কেউই মনঃক্ষুণ্ণ হবেন না - উভয়পক্ষকেই যথাযথভাবে, প্রয়োজনে তথ্য সহকারে বিষয়টি বোঝানো সম্পাদকের অন্যতম কাজ। পাণ্ডুলিপি নির্বাচন সম্পাদকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এখানে মূল সম্পাদক ছাড়াও, স্পনসরিং এডিটর-এর প্রয়োজন হয় – যাঁর কাজ কে কী ধরনের বই লিখতে পারেন সে ব্যাপারে খোঁজখবর রাখা, একই সঙ্গে কে কী ধরনের বই ছাপতে পারেন, বা কে কী ধরনের বই বেচতে পারেন, সে সম্পর্কেও তাঁকে ওয়াকিফহাল হয়ে উঠতে হয়। স্পনসরিং এডিটর-এর কাজ এই পক্ষগুলিকে একজোট করে দেওয়া, লেখককে প্রমোট করা। অনেক ক্ষেত্রেই এই সম্পাদকদের মূল কাজটিই হয় অফিসের বাইরে।
পড়ুন, ইংরেজি সংবাদমাধ্যমের বাঙালি সম্পাদক নিয়ে প্রতীকের লেখা
এর পরের মূল কাজ করেন ডেস্ক এডিটর – যাঁরা সরাসরি পাণ্ডুলিপি প’ড়ে সেটিকে ছাপার উপযুক্ত করে দেবেন। এখানে মনে রাখতে হবে লেখক যেমন তাঁর নিজের বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন, তেমনই ডেস্ক এডিটরকে জানতে হবে এই বই কতটা বাজারসই হয়ে উঠবে। এর পরে কপি এডিটরের কাজ শুরু। এর মধ্যে আবার কাজ থাকে সাবজেক্ট এডিটরেরও। এখানে পাণ্ডুলিপির প্রতিটি লাইন ধরে তার তথ্য, স্টাইল বা ভাষা, বানান, ব্যাকরণ, টীকা, ‘উক্তি’-র ব্যবহার (মূলের সঙ্গে মিলিয়ে) ঠিক করা হয়। কপি এডিটরদের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রমোশন বা মার্কেটিং বিভাগের সঙ্গে বসে আলোচনা করে ঠিক করতে হয় বইয়ের সাইজ, রঙ, ছবি, টেক্সটের পয়েন্ট সাইজ, কাগজ, দাম, এসব নির্দিষ্ট বইয়ের ক্ষেত্রে কী কী হতে পারে – বিশেষ করে টেরিটোরিয়াল রাইটস যেসব বইয়ের ক্ষেত্রে থাকে। কপি রাইটসের প্রতিটি এগ্রিমেন্ট যাতে ঠিক মত করা হয়, মানা হয় তার মূল দায়িত্ব সম্পাদকের। স্পনসরিং এডিটরের মাধ্যমে লেখকের সঙ্গে আলোচনা ক’রে ঠিকমত এগ্রিমেন্ট করা একটা মূল কাজ। লিটারারি এজেন্টের সঙ্গে আলোচনা করে তার মাধ্যমে লেখককে প্রকাশনা সংস্থার মত করে লিখিয়ে নেওয়া মূল সম্পাদকের কাজ। কপি এডিটর এবং ডেস্ক এডিটর এই দুই পক্ষের কাজ শেষ হওয়ার পর পাণ্ডুলিপি চলে যাবে প্রোডাকশন/টাইপ সেটিং/প্রুফ চেকিং বিভাগে - অর্থাৎ প্রোডাকশন শুরু, সম্পাদনার শেষ।
একটা সত্যিকারের মজার ঘটনা উল্লেখ করা যাক, যেখানে সম্পাদকের গুরুত্ব অনুধাবন করা যাবে। দুবাই ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ারে, পশ্চিমবঙ্গের এক প্রকাশকের ইংরেজিতে করা একটি অ্যাকাউন্টেন্সির বইয়ের বাল্ক অর্ডার সিলেকশন হয় – সাধারণত আন্তর্জাতিক বই মেলাতে যা হয়ে থাকে (ক:পু: মেলায় যা হয়না - উৎসব ব’লে)। অর্ডার নিশ্চিত হওয়ার পরের দিনই সামান্য এক কারণে সমস্ত অর্ডার বাতিল হওয়ার নির্দেশ আসে। কেন? কারণ বইয়ের লেখক উৎসর্গ পত্রে মা কালীর ছবি দিয়ে বইটি তাঁকেই উৎসর্গ করেছেন – যাঁরা অর্ডার দিয়েছিলেন তাঁদের হিসেবে বই যতই ভালো হোক, তা বিক্রি হবে না। পরে অবশ্য সেই পৃষ্ঠাটি বদলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক স্তরে বই ব্যবসা করতে গেলে সম্পাদককে বহু ব্যাপারে ওয়াকিফহাল থাকতে হয়। যেমন মলাটে কী ছবি যাবে, বাইন্ডিং কী হবে, কী রঙ যাবে এমনকি বইয়ের নামও যে সামান্য অদল বদল করার প্রয়োজন হতে পারে – সে ধারণা সম্পাদকের থাকতে হবে। টেরিটোরিয়াল রাইটসের প্রতিটি খুঁটিনাটি প্রমোশনাল ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলে সম্পাদককে সেসব ঠিকমত প্রয়োগ করতে হবে, যার মূল উদ্দেশ্য ব্যবসাকে উঁচুর দিকে তুলে ধরা। অর্থাৎ মাল বেচার মূল মসৃণ রাস্তা তৈরি করে দেওয়া - তা সে কাজ যতই হোক না কেন চার অক্ষরের।
খুব ভালো লাগল আলোচনাটা। বইয়ের সম্পাদক না হই, পত্রপত্রিকার সম্পাদনায় দীর্ঘদিন কাটিয়ে তোমার লেখার সঙ্গে অনেক মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম নিজের অভিজ্ঞতার।
- দময়ন্তী
এই লেখা বাংলা বইপাড়ায় প্রাসঙ্গিক করা যাবে?
A B C D একটু জেনে ভেবেছি প্রচুর জেনেফেলেছি! ক খ গ ঘ টাই বোঝা হয় নি ঠিক ঠাক! যদিও সম্পাদনা করেছি! ধন্যবাদ সৌম্যেনদা!
ভালো লাগল লেখাটা। আমি তো খুবই উপকৃত হলাম। বইয়ের জগতের মানুষেরা পড়ে অনুধাবন করলে ভালো হতো। কিন্তু বাংলাদেশে তা যে হবার নয়! পশ্চিমবঙ্গেও কি বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে দু-একটার বেশি দৃষ্টান্ত আছে?
চমৎকার লিখেছেন। একটি প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদনা বিভাগের যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সেটি সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। প্রকাশনার কর্নধার দের বিশেষ করে পড়া উচিত। জানা উচিত। বস্তুত একটি প্রকাশনা সংস্থায় এইসব গুণগত মান অনুপস্থিত থাকলে তাদের প্রকাশনা জগতে কাজ করতে দেওয়া উচিত নয়। প্রকাশনায় শুধু ব্যবসাকেই গুরুত্ব দিলে হবে না । অন্যান্য criteria গুলির দিকে ধ্যান দিতে হবে-- সেটা বুঝতে হবে!
খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তথ্যবহুল লেখা। মনের মতো হওয়াটা উপরি পাওনা।