ছবিসৌজন্য: https://www.arkansasonline.com
একুশ শতকে টেকনোলজির দৌড়ে যখন আমার মতো অনেকেই ক্লান্ত… যখন সবথেকে দামি মোবাইল ফোন কী বেরল তার চর্চাতেই বেঁচে থাকার রসদ খুঁজতে ব্যস্ত অনেক মানুষ, যখন অনড়ারম্বর জীবনযাপনকে অনেকেই আধুনিক সভ্যতা থেকে পিছিয়ে পড়া মনে করেন, ঠিক তেমনই দিনকালে আমিশ নামক একটি জনগোষ্ঠীর জীবনধারা দেখে আমি একেবারে চমকে উঠেছিলাম—এ যুগেও এমন ভাবে, এত সরল ভাবে বেঁচে থাকা যায়?!
জানুয়ারি মাসের এক কনকনে ঠান্ডা দিনে আলো-না-ফোটা ভোর পাঁচটায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া প্রদেশের ফল্স চার্চে আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাস ধরলাম ওয়াশিংটন ডি.সি. থেকে। আড়াই ঘণ্টার পথ। সোজা নামলাম যে জায়গাটায় সেটা পেনসিলভানিয়া প্রদেশের ল্যাঙ্কেস্টার। এখানে মার্কিন মুলুকের আমিশ গোষ্ঠীর সবথেকে প্রাচীন জনপদ। আর সেই জনপদেরই একটা অংশে পনেরো একর জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে ‘দি আমিশ ফার্ম অ্যান্ড হাউস’ মিউজিয়াম। সেই বাস নামিয়ে দিল একটা দোতলা সাদা বাড়ির সামনে।
এ মিউজিয়ামে ঢুকতে গেলে টিকিট লাগে, নানা দামের টিকিট আছে। মোটামুটি ভালো করে ঘুরে দেখার ঘণ্টা দেড়েকের গাইড সহ ট্যুরটি হল ‘প্রাইম প্যাকেজ’ মাথাপিছু ৩০ ডলারের মতো দাম। আমার অবশ্য সেসব লাগল না, এবং ঘোরাফেরার স্বাধীনতাও অবাধ, কারণ আমি তখন মার্কিন দেশের সবথেকে বড়ো মিউজিয়াম স্মিথসোনিয়ান-এ ফুলব্রাইট ফেলো, এবং এই আমিশদের জনপদে এসেছি সরকারি অতিথি হয়ে।
বাস থেকে নামতেই অভ্যর্থনা করল ট্রে-হাতে দুটি কিশোরকিশোরী। প্রথমেই চোখ আটকে গেল বাচ্চাগুলোর পোশাকে—এমনটা আমি আগে কখনও কোনো দেশের কোনো বাচ্চার গায়ে দেখিনি। মেয়েটির মাথায় সাদা কাপড়ের বনেট টুপি। টুপির তলায় তার লাল চুল, কিন্তু একটিও অগোছালো ভাবে বেরিয়ে নেই। পরে জানলাম এটাই আমিশদের রীতি, কোনো চুল বাইরে বেরিয়ে থাকবে না। মাঝাঘষা পরিষ্কার মুখে একচিলতে কোনো মেক-আপ নেই। এক অদ্ভুত সরল সৌন্দর্য। গায়ে কারুকাজহীন হালকা আকাশি পা-অবধি টানা গাউনের ওপর ধবধবে সাদা এপ্রন। ছেলেটির পরনে সাদা শার্ট আর গ্যালিস দেওয়া কালো প্যান্ট, মাথায় ছোট্টো কালো টুপি। আমিশ কায়দায় দিল প্রেটজ়েল—একধরনের পেস্ট্রি—আর লেমনেড, বাংলা লেবুর শরবৎ। প্রেটজ়েল দুনিয়ার অনেক দেশেই খেয়েছি। কিন্তু সেদিন আমিশ গ্রামে যেটা খেয়েছিলাম তার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে—মিঠে-নোনতা, মাখনে ভরপুর আর তুলতুলে নরম। জানলাম, এ প্রেটজ়েল আমিশরা বাড়িতে বানান।
খাবার নিয়ে ভিতের ঢোকা যাবে না, তাই হাতে প্রেটজ়েল আর লেমনেডের কাগজ-গ্লাস নিয়ে আশপাশটা ঘুরে আগে পরিবেশটা একটু বুঝে নিতে থাকলাম। আর এই মওকাতেই একটু বলে নিই আমিশ জনগোষ্ঠীর কথা। ১৫২৫ সালে ইওরোপের জার্মানি আর সুইৎজ়ারল্যান্ডে ঘটে ইওরোপিয়ান প্রটেস্টান্ট রিফরমেশন মুভমেন্ট। এই আন্দোলন, এককথায় বলতে গেলে, খ্রিশ্চান ধর্মীয় আচার-আচরণের ওপর রোমান ক্যাথলিক চার্চের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ। এর ফলেই তৈরি খ্রিশ্চানদের প্রোটেস্টান্ট গোষ্ঠী। এর কিছুদিনের মধ্যেই, ওই ষোড়শ শতকেই আবার প্রোটেস্ট্যান্টদের থেকে ভেঙে বার হলেন অ্যানাব্যাপটিস্ট-রা। খুব জটিলতায় না গিয়ে বলতে পারি, এই অ্যানাব্যাপটিস্টরা বিশ্বাস করতেন, পরম্পরার জোরে নয়, স্বাধীন ভাবে কেউ আবেদন জানালে তবেই তিনি খ্রিশ্চান ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, যাকে ব্যাপটিজম বলে। সেই জন্যই অ্যানাব্যাপটিস্টরা শিশুদের ব্যাপটাইজ করার বিরোধী ছিলেন। পরবর্তীকালে এঁরা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েন, যেমন মেননাইট, জার্মান ব্যাপটিস্ট ব্রিদরেন এবং আমিশ। ১৬৯০-এর দশকে জেকব আম্মান (১৬৪৪ – ১৭১২) নামে এক অ্যানাব্যাপটিস্ট ধর্মগুরু বাইবেল-কথিত অতিসাধারণ জীবনধারায় বিশ্বাসের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে যে মত প্রচার করেন তা থেকেই তৈরি হয় খ্রিশ্চান আমিশ গোষ্ঠী।
অষ্টাদশ শতকে এঁরা ছড়িয়ে পড়েন মার্কিন দেশ ও কানাডার নানা প্রান্তে। পরে উনিশ শতকে আবার এই আমিশরা বিভাজিত হয়ে দুটি গোষ্ঠী তৈরি হয়—ওল্ড অর্ডার আমিশ এবং আমিশ মেননাইট্স। আমরা যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি সেটা এই ওল্ড অর্ডার আমিশদের জনপদ। ১৭১৫ সাল নাগাদ এই জনপদ প্রথম তৈরি হয়। এর আশেপাশেও পেনসিলভানিয়া প্রদেশে আমিশদের বসবাস রয়েছে, তাঁদের মোট সংখ্যাই এখন তিন লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। পরে জেনেছিলাম বড়ো বড়ো একান্নবর্তী যৌথ পরিবারগুলির এই জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে ভূমিকা আছে। আমিশরা আজকের ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’ সংস্কৃতিতে একেবারেই বিশ্বাসী নন।
ঘুরে ঘুরে দেখি স্থানীয় বাড়িগুলো সব পাথর আর কাঠের তৈরি, রং সাদা আর ধূসর, এবং অধিকাংশই দোতলা। কাছেপিঠে কিছু খেতখামার, এখন সব বরফে ঢাকা, তবুও কিছু মানুষ কীসব কাজ করছেন। হঠাৎ আমাদের সামনে দিয়ে টগবগিয়ে জোরে চলে গেল এক-ঘোড়ায় টানা একটা কালো চৌকো গাড়ি, যাকে বোধহয় বাগ্গি বলে।
ভার্জিনিয়ায় পরিবেশ খুবই পরিষ্কার, অন্তত আমাদের কলকাতা থেকে গিয়ে তো তাই মনে হয়েছিল, একেবারে দূষণমুক্ত। কিন্তু সেদিন ল্যাঙ্কেস্টারে জানুয়ারি মাসের ওই ঝলমলে সকালে ঠান্ডা মুচমুচে বাতাস বুক ভরে নিয়ে বুঝেছিলাম, সত্যিই দূষণহীন বাতাস কাকে বলে। লেমনেডে সবে শেষ চুমুক দিয়েছি, হঠাৎ পিছন থেকে এক নারীকণ্ঠ ভেসে এল—গুডার মারিয়ে। ঘুরে দেখি মাঝবয়সী গোলগাল এক আমিশ মহিলা। পরিচয় দিয়ে বললেন, তাঁর নাম হ্যানা। জানালেন এঁরা নিজেদের মধ্যে পেনসিলভানিয়ান ডাচ ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে বললেন ভাঙা ভাঙা ইংরেজি। জানলাম গুডার মারিয়ে মানে সুপ্রভাত। আর জানলাম, যে বাড়িতে এই মিউজিয়ামের মূল সংগ্রহশালা সেটি এলাকার একটি প্রাচীনতম বাড়ি। হ্যানার সঙ্গে ঢুকে পড়লাম।
বড়ো পরিবার থাকত, কাজেই বাড়িগুলোও বেশ বড়োসড়ো হত। প্রায় প্রতি বাড়িতেই একটা করে ঢাউস ‘পার্লাররুম’ থাকে যেটা ‘লিভিংরুম’-এর সঙ্গে একটা বিশাল ভাঁজ করা যায় এমন দরজা দিয়ে যুক্ত। দরজাটা খুলে দিলে বেশ একটা হলঘরের মতো তৈরি হয়। সেখানে হয় আমিশদের নানা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, আবার স্কুলের পড়াশোনাও। সেখান থেকে ঢুকলাম খাবারঘরে। আসবাব খুবই সাদামাটা এবং সবই কাঠের—ছ-টা কাঠের সোজা-পিঠ চেয়ার একটা সাদা লেস্ দিয়ে ঢাকা খাবারটেবিলকে ঘিরে রেখেছে। টেবিলের ওপর ঝুলছে একটা কেরোসিন লন্ঠন। তার পাশেই আবার একটা আদ্দিকালের ফ্রিজ… কিন্তু এই যে শুনলাম এঁরা ইলেকট্রিসিটি ব্যবহার করেন না?! হ্যানা জানাল এ ফ্রিজ চলে প্রাকৃতিক গ্যাসে। একটি কুড়ি পাউন্ডের প্রোপেন গ্যাস ট্যাংক ব্যবহার করে ওই ফ্রিজ দিন দশেক চালানো যায়। একপাশে একটা ছোটো আলমারি। তার মাথায় একটা স্ট্যান্ডিং ল্যাম্প। আলমারি খুলে হ্যানা দেখাল ভেতরে একটা প্রোপেন ট্যাংক রাখা আছে, তাতেই জ্বলছে ওই আলো। ঘরের ডানদিকে একটা প্রকাণ্ড কালো গ্যাস-আভেন, তাতেই সারা পরিবারের রান্না হয়।
আমি ভাবছিলাম, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যখন এঁদের যোগাযোগ সামান্যই, এঁরা খান কী, রাঁধেন কী? হ্যানার কাছে জানলাম, তাঁদের খানাদানার অধিকাংশই আসে নিজেদের খেত বা সবজিবাগান আর ফলের বাগান থেকে। আলু, গাজর, টোম্যাটো, কড়াইশুঁটি, ভুট্টা ইত্যাদি তাঁরা নিজেদের সবজিবাগানেই উৎপাদন করে নেন। গবাদি পশু-পাখি রাখাও তাঁদের সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ। যেমন, আমি বিশেষ করে দেখলাম অজস্র মোরগ আর মুরগি। শুনলাম, তাদের পাড়া ডিমেই এ গ্রামের কাজ চলে যায়। ছাগল, গোরু আর শুয়োরের খোঁয়াড়ও দেখলাম। এ থেকে যেমন দুধ হয়, তেমনই হয় মাংস, যা ওঁরা নিজেরাই জবাই করে নেন। আমিশ গ্রামের বিশেষ খাদ্যের মধ্যে রয়েছে বাড়িতে তৈরি জেলি আর সালসা। এ ছাড়া বাড়িতে চলে মুরগির মাংস, শুয়োরের মাংস, আলুর নানা রান্না আর কোল-স্ল, মানে নানারকমের সবজি, বিশেষ করে বাঁধাকপি আর সিদ্ধ মুরগির মাংস কুচি করে মেয়োনিজ দিয়ে ভালো করে মাখা। আবার আমিশরা বাড়িতেই তৈরি করেন নানাধরনের মাখন, ‘আমিশ বাটার’ এতই বিখ্যাত যে সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই তা বিক্রি হয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডে। যেমন শ্মিয়ের পিনাট বাটার বিশেষ বিখ্যাত। তেমনই আছে পিকল্স—আচার। একটা খাবারের কথা আলাদা করে বলতেই হবে, খাস আমিশ খানা—পনহাউস! আমিশদের ব্রেকফাস্টের নিত্যসঙ্গী। ইংরেজিতে একে বলে আমিশ স্ক্রেপল বা পেনসিলভানিয়া ডাচ স্ক্রেপল।
রেসিপিটা এরকম —
চর্বি ছাড়া পোর্ক — ১ পাউন্ড
পেঁয়াজ — বড়ো মাপের ১টা
জল — ৩ লিটার
সেজ — গুঁড়ো ১ চা-চামচ
কর্নমিল (মোটা করে পেষাই করা ভুট্টার ছাতু) — তিন কাপ
নুন ও গোলমরিচ — স্বাদমতো
মাংসের টুকরোগুলো একটা বড়ো প্যানে রেখে পেঁয়াজগুলো গোটা গোটা দিয়ে দিন, জল ঢালুন। ধিমে আঁচে দু-ঘণ্টার মতো রান্না করুন। ছেঁকে মাংস ও ঝোলটা রেখে দিন। পেঁয়াজ বাদ দিয়ে দিন। মাংস ঠান্ডা হলে হাড় থেকে ছাড়িয়ে কুচি করে নিন। একটা পাত্রে সেই মাংস নুন, গোলমরিচ আৱ সেজ গুঁড়ো দিয়ে দু-লিটার মতো ঝোল ঢেলে দিন। ফোটান। বাকি এক লিটার ঝোলে কর্নমিল গুলে ভালো করে নাড়তে নাড়তে ফোটাতে থাকুন, যতক্ষণ না তরল গাঢ় হয়ে ওঠে। দুটোকে মিশিয়ে ২০ মিনিট ফোটান। ৯ ইঞ্চি X ৫ ইঞ্চি X ৩ ইঞ্চি বেকিং প্যানে ঢালুন। সারারাত রেখে ঠান্ডা করুন। পরের দিন জমে যাওয়া স্ক্রেপল পাতলা পাতলা করে কেটে হালকা ময়দা মাখিয়ে খয়েরি করে মাখনে বা বেকনের চর্বিতে ভেজে নিন। অমলেট দিয়ে পরিবেশন করুন।
এরপর ভারী মোটা বুট-পরা হ্যানা উঠে পড়ল দোতলায়, আমিশদের শোয়ার ঘর দেখাতে। একেবারে নিরাড়ম্বর। সুদৃশ্য লেপ ঢাকা ঢালাও বিছানা বড়ো খাটের ওপর। দেখি খাটের পাশেই মেয়েদের গাউন ঝোলান আছে? এগুলো কী? হ্যানা জানাল এটা মেয়েদের শোবার ঘর, তাদেরই এসব। গাউনগুলো খুবই সাধারণ। চড়া রঙের ব্যবহার বারণ। তাই সেগুলো গাঢ় নীল, খয়েরি, গাঢ় সবুজ আর কালো। বাড়িতে তৈরি, মূলত সুতির পোশাকই ব্যবহার করেন আমিশরা। তবে আজকাল পলিয়েস্টারও চলছে, কারণ চট করে কেচে শুকিয়ে নেওয়া যায়, এবং ইস্তিরি না করলেও বেশ ধোপ-দুরুস্ত লাগে। প্যাটার্ন থাকলেও, খুবই হালকা। শুনলাম বাচ্চাদের একটু হালকা রং পরতে দেওয়া হয়। গাউনগুলোর লম্বা হাতা, একেবারে গোড়ালি অবধি লম্বা স্কার্ট আর একটা কেপ এমন করে দেওয়া যাতে নারীশরীরের ঢেউ বোঝা না যায়। আমিশ নারীদের চুল কাটা বারণ। তাঁরা চুল বেঁধে বনেটের তলায় গুঁজে রাখেন। বাইরে গেলে তার ওপর চাপিয়ে নেন সাদাটুপি। বিবাহিতরা পরেন কালো বনেট। সারা জামায় কোনো বোতাম বা জ়িপের ব্যবহার নেই। শুধু পিন দিয়ে আটকানো থাকে। সর্বদাই আমিশ মহিলা ও পুরুষ উভয়েরই চেষ্টা থাকে নিজেদের যাতে খুব সাধারণ দেখায়।
খেলনা হিসেবে খাটের ওপর রাখা আছে কিছু কাপড়ের পুতুল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কোনো পুতুলের নাক, চোখ, মুখ নেই। শুনলাম দ্বিতীয় কমান্ডমেন্ট অনুযায়ী আমিশ শিশুদের শেখানো হয় মুখ সম্পূর্ণ অভিব্যক্তিহীন হওয়া উচিত। তাই ছবি তোলার ওপরেও এদের আছে নানা বিধি-নিষেধ। হ্যানা গোড়াতেই বলে দিয়েছিল, খেত-খামার, বাড়িঘর এ সবের ছবি তুললেও মানুষের ছবি যেন না তুলি।
পাশের ঘরটা বাড়ির পুত্রসন্তানদের। একই শোবার ব্যবস্থা। গাউনের জায়গায় ঝুলছে ছোটো ছোটো স্যুট আর কোট। এদের কোটগুলোর কলার বা লেপল নেই, অনেকটা নেহরু জ্যাকেটের মতো। ট্রাউজারও প্লেন, এবং সামনে কোনো ইস্তিরর ভাঁজ নেই, গ্যালিস দিয়ে ঝোলানো। পুরুষদের বেল্ট ও টাই পরা মানা। গরমকালে তাঁরা মাথায় পরেন খড়ের টুপি—স্ট্র হ্যাট, শীতে ফেল্ট। টুপির ডিজাইন থেকে বোঝা যায় কে কোন্ জনগোষ্ঠীর আমিশ। বিবাহিত পুরষদের দাড়ি কামানো মানা, আবার গোঁফও রাখা মানা। শোনা যায় সেই মধ্যযুগে ইউরোপে সৈনিকমাত্রেই গোঁফ রাখত। আমিশরা সব যুদ্ধের বিরোধী, তাই সেই থেকেই নাকি তাঁরা গোঁফ রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছেন!
বাড়ি ঘুরে দেখা শেষ হলে হ্যানা বিদায় জানিয়ে তুলে দিল রেমন্ড নামের একজনের হাতে। তিনি বাস ড্রাইভার-কাম-গাইড। তিনিই নিয়ে গেলেন আমিশ খামারে। রেমন্ড অবশ্য নিজে আমিশ নন। ভালো কথা, এখানে বলে রাখি, শুধু ছবি তোলাই নয়, আমিশদের সঙ্গে বাইরের মানুষের কথা বলাও বারণ। রেমন্ডের কাছে অনেক কিছু জানা গেল, আমিশ নন বলেই তিনি অনেক বেশি খোলামেলা। যদিও, এই বাস একেবারেই পর্যটকদের জন্য। কারণ আমিশরা কোনো যান্ত্রিক যান, মানে মোটরগাড়ি, বাস, ট্রাক, ট্রেন, প্লেন ইত্যাদিতে চড়েন না।
পথে পড়ল এককামরার একটা স্কুলবাড়ি। আমিশদের সেই অর্থে কোনো স্কুল নেই। বাচ্চারা ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে। একটি ঘরে সবাই বসে। এবং ক্লাস হয় পালটে পালটে এক-একজনের বাড়িতে। মূলত পড়তে হয় সামান্য ভূগোল, অঙ্ক, ইংরেজি ও জার্মান। গতানুগতিক স্কুলশিক্ষার থেকে তাঁরা অনেক বেশি গুরুত্ব দেন ছেলেদের কৃষিকাজ ও খামার চালানোয় এবং মেয়েদের ঘর-গেরস্থ সামলানো এবং আদর্শ মা হওয়ায় পারদর্শী করে তোলার ওপর। রেমন্ডের কাছে শুনলাম, এর প্রতিবাদে কিছু কিছু আমিশ তরুণতরুণী ঘর ও জনগোষ্ঠী পরিত্যাগ করে। যদিও তারা জানে ফেরার সব দরজা তাদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে।
আপাতত খেতগুলো বরফে ঢাকা, তবে মরশুমে এঁরা ভুট্টা, গম, তামাক, সয়বিন, বার্লি ইত্যাদি চাষ করেন। চোখে পড়ল বারান্দায় ঝুলছে শুকনো তামাকপাতা। এঁরা প্রচুর গোপালন করেন, এবং দুধ দোয়া হচ্ছে দেখলাম কলের সাহায্যে, যে কল চলছে উইন্ডমিল দিয়ে। আমাদের দেশের খামারে যেমন বিদ্যুৎচালিত মেশিন, তেমন নয়।
দি আমিশ ফার্ম অ্যান্ড হাউস মিউজামটি যে আমিশ জনগোষ্ঠীর এই অদ্ভুত জীবনযাপনের কথা বলে তাঁরা মার্কিনদেশে তিনশো বছর ধরে বসবাস করলেও, এ মিউজিয়ামটি খোলা হয়েছে ১৯৫৫ সালে, সাধারণ ভাবে মার্কিনিদের এ বিষয়ে আগ্রহ বাড়ার পর।
সবশেষে গেলাম একটা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা টুরিস্ট গ্রামে—কিচেন কেট্ল ভিলেজ। রয়েছে নানারকমের দোকান, প্রায় চল্লিশটা। বিক্রি হচ্ছে নানা আমিশ দ্রব্য—খাবারদাবার ও স্যুভেনির। এই গ্রামের রাস্তার নামগুলো চমৎকার—ব্লুবেরি বুলভার্ড, পিচ পাথ, পেপার লেন বা রুবার্ব রোড। দু-ধারে দোকানে মিলছে বাড়িতে তৈরি খাবার, মাখন, আচার এইসব। চাইলে চেখেও দেখা যায়। বেশ কয়েকটা আচার চেখে দেখেছিলাম আমি। আর স্যুভেনির হিসেবে কিনলাম ঘোড়ার একটা নাল। বিক্রি করছিল ভারী মিষ্টি একটি বাচ্চা, সামনে সাজানো নানারকমের নাল।
কিচেন কেট্ল ভিলেজ-এর পেপার লেন
কিন্তু শুধু আমিশদের দোকানদারিই নয়, এই মিউজিয়ামের খামারের পাশেই দেখলাম চক্ষুশূলের মতো তৈরি হয়ে গিয়েছে এক দৈত্যাকার শপিংমল—টার্গেট। শুনলাম আমিশদের জমি দখল করেই নাকি তা বানানো হয়েছে। তবে আমিশ জনগোষ্ঠীর মানুষ সে মলের সঙ্গে খুব একটা বিবাদে যাননি। বরং মাঝে সাঝে টুকিটাকি জিনিসও কিনে আনা শুরু হয়েছে সেখান থেকে। শপিংমলটি আমিশদের খুশি রাখতে বিশালকার পার্কিংয়ে এক অংশ সংরক্ষিত রাখতে তৈরি করে দিয়েছে বাগ্গি পার্কিং লট! রেমন্ডের কাছে এও শুনলাম, আমিশদের বাড়িতে টেলিফোন না থাকলেও তৈরি হচ্ছে দু-একটা পাবলিক বুথ, যেখান থেকে ফোন করা যায়। সত্য মিথ্যা জানি না, তবে রেমন্ড জানালেন, নবীন প্রজন্মের কারও কারও কাছে ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডও তিনি দেখেছেন।
ফিরতি পথে ভাবছিলাম, এ জনগোষ্ঠী এ ভাবে আর কত দিন চালাতে পারবে?
গ্রামটা এতই মনোরম যে, ইচ্ছে হলে ক-দিন থেকেও যেতে পারেন পর্যটকরা—আমিশ হোটেলে। সেখানের মালিকরা আমিশ হলেও, চাকরি করেন যাঁরা তাঁরা অবশ্য সবাই ‘নিরামিশ’!
সুন্দর এবং প্রাণবন্ত বিবরণ আমাদের এই যাদুঘরে নিয়ে যায়
অপূর্ব সুন্দর ছবির মোত বর্ণনা I অনেক অজানা
তথ্য জানতে পারলাম I অসংখ্য ধন্যবাদ I
কেমন মনে হচ্ছে অমন গোঁড়া ক্লোজড সোসাইটির ক্ষয় শুরু হয়েছে।
প্রযুক্তিতাড়িত একবিংশ শতাব্দীর ইঁদুরদৌড়?? দাও ফিরে সে অরণ্য লহো এ নগর? কিন্তু আমিশরা চাষবাষ করে কেন? চাকা ব্যবহার করে কেন? এসব প্রযুক্তি তাড়িত ইঁদুর দৌড় বর্জন করা উচিত তো!
এই রন্জনদার মতই ভাবছিলাম। রক্ষণশীলতা আর ঐতিহ্যকে বহন করে এগিয়ে চলা এক জিনিস নয় তো।