প্রতিটি দেশের যেমন একটা ল্যান্ডস্কেপ থাকে, তেমনই একটা সাউন্ডস্কেপও থাকে। কথাটা কবীর সুমনের। আমি তার সাথে জুড়তে চাই, আরেকটি শব্দ এ আলোচনার সূত্রে। তা হল, মাইন্ডস্কেপ। প্রত্যেক শিল্পীর যেমন নিজের একটা ভাষা থাকে, তেমনই থাকে নিজের শহর। বুড়ো আঙুলের ছাপ। শিরার ভেতর কানাগলি। কেন বিলাসবহুল শহরের হাতছানি পেরিয়ে, নিজের ভাঙা শহরে থেকে যান শিল্পীরা? হাজার অসুবিধের পরেও? কারণ, তা না করলে, মনে ভেসে উঠবে না আদত ইমেজারি। দৃশ্যকল্প। নুয়ানসেস। মেঝের লাল রং। জানলার গরাদের জং। স্যঁতস্যাঁতে কলতলা। আসন্ন হেমন্তের কুয়াশা। মায়াবি ছাতিমের গন্ধ। সমস্ত স্বর-সুর-গন্ধ, যা অনুবাদ হয় না। অনুবাদ করা যায় না। আর, তাই পরবাসে যখন নানা রাজনৈতিক-সামাজিক কারণে বাধ্য হতে হয়েছে শিল্পীদের থাকতে, তখন সে হতাশা ধরা দিয়েছে ঋত্বিক ঘটকের ফ্রেমে দেশভাগের ট্রমায়। লোরকার কবিতায় ড্র্যাগনের মত গিলতে আসা নিউ ইয়র্কের রক্তের ছিটেতে। উলফ বিয়ারমানের গানে, জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। বদলে গেছে সুর। বদলে গেছে শব্দের মানে। ধরতে চেয়েও ধরতে পারেননি ইমেজারি শিল্পীরা। কারণ তাঁর সমাজের মন থেকে তিনি বিচ্যুত। ডিপ্লেসড। বাস্তুহারা। আর শুধু নিজের মন থেকে শিল্প তৈরি হয় না। সমাজের আত্মা এসে শিল্পীর আত্মায় মিশলে, অনেকের না-বলা কথা বলেন শিল্পী। তখন তা শিল্প হয়ে ওঠে বলে মনে করেন কমলকুমার মজুমদার। সেভাবেই মার্কস ও বুদ্ধ। সেভাবেই কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো থেকে ওয়ান্টার বেঞ্জামিনের আর্কেড প্রোজেক্ট।
কথাগুলো লিখতে হল, কারণ আমার প্রজন্ম নতুন করে দেশভাগ-মন্বন্তর-মহামারী দেখছে। নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হচ্ছে আবার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়ের পর। আমার ঘরে এসে আমাকেই ভাড়াটে বানাতে যায় আগন্তুক! বাংলাদেশের বরিশালের বাসিন্দা ছিলেন আমার দাদামশাই। মুকুন্দ দাসের দলে গান করতেন। ব্রিটিশ বিরোধী গান করে জেলে গেছেন। এপারে এসে দক্ষিণ কলকাতার এই কলোনির বাসিন্দা হন তিনি। এই উদ্বাস্তু কলোনি তখন দিকে-দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে আমরা দেখেছি আজাদগড় কলোনি। ঋত্বিক ছাড়াও বিজন-দেবব্রত-জ্যোতিরিন্দ্র-সলিলদের কাজে বারবার ধরা দিয়েছে এই যন্ত্রণা। এই প্রজন্মকে আজীবন স্ট্রাগলার হয়েই অনন্য কাজের নজির রাখতে হয়েছে। বারবার ঘর ভেঙে গেছে বিজন-ঋত্বিকদের। তবু তাঁদের কাজে অটোগ্রাফ খোদাই করে দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু ফিরে ফিরে এসেছে সেই প্রশ্নই তাঁদের কাজে, ঘর কোনটা? ঘর?
'র/ড়' লেখার সময় বুঝি আমি ওপার বাংলার মানুষ। 'স' উচ্চারণের সময়েও বুঝি। ভালোবাসার উপর কোনও কাটা দাগ দেওয়া যাবে না। মানচিত্রেই দেওয়া যাবে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখায় বা অমর একুশে আমার চেতনায়। সে চেতনায় লালন থেকে রুদ্র মহম্মদ আছেন। আছে আজকের প্রজন্মের অর্ণব-আনুশের গান। শাহবাগ আন্দোলন। এসবই তো আমার আত্মার অনিবার্য এক্সটেনশান। আমার স্বাভাবিক উচ্চারণ। আমার এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায়ের কথা। মুক্তিযুদ্ধর পর এক ভাষণে তিনি প্রকাশ্যেই জানান, সারা দুনিয়ার ডাক সত্বেও তিনি এই বাংলাতেই থেকে যাবেন। কারণ তাঁর শেকড়গুলি এখানে। বাইরে কাজে অবশ্যই যাবেন তিনি। কিন্তু এই বিন্দুতেই তাঁর সিন্ধু। এর বাইরে গেলে তাঁর পা 'নড়ে যাবে।' কতকটা একই কথা বলছেন, মৃণাল সেন। আর তাই কান-বার্লিন ঘুরে এসেও তাঁরা কেউ সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। তো, কেউ রাসবেহারী মোড়ে দাঁড়িয়ে ফ্রন্টিয়ার পড়ছেন। বা ক্যামেরার এঙ্গেল ঠিক করছেন রেড রোডে শুয়ে পড়ে। বাদল সরকার তাই মৌলালি মোড়কেই করে তোলেন তাঁর মঞ্চ। মধ্যবিত্ত বাঙালির আধুনিতায় ছিল ভবানীপুর; ম্যাটিনির সস্তা টিকিটে স্বপ্নের ঔদ্ধত্য। তার বদলে আজ রাজারহাটের পয়সা হলেও সে ভিখিরি। আজকের বং উইকেন্ডে সিঙ্গাপুর যেতেই পারে কিন্তু সে চাঁদের পাহাড় লিখতে পারত এককালে ঘাটশিলায় বসেই। আফ্রিকায় গিয়ে তা ফ্রেমবন্দি করতে গিয়ে ছড়াতো না।
মানুষের অবচেতনে থাকে তার স্মৃতি। বহু মানুষের স্মৃতি জমেই হয় গণস্মৃতি। মানুষের ইতিহাস। লেভি স্ত্রস প্রমুখ তাত্বিকরা বলছেন, এর পাশেই থাকে, মিথ। দেশভাগের মত যন্ত্রণা একটা জাতির গণস্মৃতিতে ছেদ বসায়। ঋত্বিক ঘটকের ফ্রেমে তাই রেললাইনে রাপচারের অন্ধাকার নেমে আসে। আমাদের বাঙাল পরিবারের ঠাকুমা-দাদুদের অনেকেরই স্মৃতি কাজ করত না। থমকে যেত। সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলনে শহিদ বহু সন্তানের বাবা-মায়েরা যেমন। কাশীপুর-বরানগরে আজও ভীত-সন্ত্রস্ত। স্মৃতি নেই। কিছুটা প্যারানইয়া। কিছুটা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত। ট্রমাটাইজড। ধারাবাহিক ইতিহাসের বদলে তাই মিথ অনেকটাই তাঁদের স্মৃতিজুড়ে। কিন্তু মায়েরা যেভাবে সন্তানের মুখ দেখে বলে দিতে পারে সব, সেভাবেই, অনুভূতির একটা ইনটেলিজেন্সও অবচেতনে কাজ করে। তাই কিছু কিছু প্রবণতা বা প্যাটার্ন অজান্তে ফুটে বেরোয় পরের প্রজন্মে, যেমন গান না শিখেও গলায় সুর থাকা বা ভালো রাঁধতে পারা অজান্তেই। স্বয়ংক্রিয় এসব প্রবণতা থেকেও একটা জাতি বেঁচে যায়। মধ্যবিত্ত সাধারণ লোকেদের মধ্যেও থাকে এসব প্রবণতা। কেউ কেউ সে গুণকে শানিত করেন। তাঁরাই উত্তম কুমার থেকে লেনিন। তাঁরাই কফি হাউস থেকে লিটল ম্যাগাজিন। একটা জাতির প্রাণভোমরা। যারা 'কেউ না' হয়তো,কিন্তু তারাই বাঁচিয়ে দেয় একটা জাতিকে শেষবেশ।
আজকের গণস্মৃতি অবশ্য ডিজিটালে রেস্টোরড। সেখানে গুগল ক্লাউডেই সবাই রেখে দিচ্ছে যা কিছু সব। অর্কুট উড়ে গেলেও, এখন একাধিক মাধ্যম মারফত চালাচালি হয় সমস্ত তথ্য। স্নোডেন সরকারের নজরদারি করা বেআইনি তথ্য প্রকাশ্যে এনে কি কান্ডই না বাঁধালেন ক দিন আগে। এভাবেই একটা পোস্ট-ট্রুথ কালচার তৈরি হচ্ছে। যেখানে সবাই সবকিছু জানতে পারছে, অনধিকার সত্ত্বেও। কাজেই কার্যকারণহীন একটা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জায়গা তৈরি হয়ে গেছে বিগত বছরগুলোয়। বিজেপি যার একটা রাজনৈতিক এক্সপ্রেশান মাত্র আজ। এ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র ইতিহাস। গোটা দুনিয়াটাকে এক রকম বানানোর এই রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে ইতিহাস। তাই আমার প্রজন্ম প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ইতিহাসের কথা বলছে নতুন ভাবে। সেখানেই নিউ মিডিয়ার ধরে আসছে নিউ লেফট। জিজেক-ব্যংক্সি-ওয়ালস্ট্রিট-ইয়োলো ওয়েস্ট আরও কত নাম করা যায় এ প্রসঙ্গে।
আমিও তাই মরিয়া হয়ে খুঁজে বেড়াই বাংলার ইতিহাস এ শহরেও। খুঁজতে খুঁজতে..খুঁড়তে খুঁড়তে..দেখতে পাই গত তিন দশকে, সত্তর দশকের পর থেকেই ক্রমেই বাংলার প্রতি ঔদাসীন্য ফাটকা বেনিয়াদের। সেই চেতনায় রাঙিয়ে সন্তানদের বিশ্বায়িতভাবে বাজারসফল করে তুলেছেন 'বাম' মনোভাবাপন্ন বাবা-মা'রা। বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তাঁরা পরের প্রজন্মের সাথে। বাংলা ভাষা বাঁচাও আন্দোলন করে নিজের সন্তানদের এলিট ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো দিয়ে যে বিশ্বাসঘাতকতার শুরু। তারপর জয়েন্ট-জয়েন্ট করে এবং পরবর্তীতে জয়েন্টের বাজার মরে গেলে ব্যাঙ্কের পরীক্ষা দিয়ে কোনও রকমে কেরিয়ার নির্ধারণ করতে বাধ্য করায় যার শেষ। আজ একটা আস্ত প্রজন্ম ইতিহাস-বঞ্চিত, ছিন্নমূল, ডিপ্রেসড, সেপারেটেড, সাইকোটিক। এরাই আচ্ছে দিন, এরাই বিজেপি। এদের হাতে লেট ক্যাপিটালিজমের সস্তা টাকা। এরা ঘুরতে যায় মেক মাই ট্রিপে, খায় সুইগিতে, থাকে ওয়োরুমে, চাপে ওলা-উবরে। অন্য দিকে দুনিয়ার বড় বড় কর্পোরেটরা আজ শেকড়ে ফিরে যাচ্ছে চাকরি ছেড়ে। চাষবাস করছে গ্রামে গিয়ে৷ গো ব্যাক টু দ্য রুটস। শেকড়ে ফিরে যাওয়ারই নানা ফিকির দেখা দিচ্ছে আবার নানা ভাবে। আমি তাই স্বপ্ন দেখি, একদিন সত্যি ভেঙে যাবে বার্লিন দেওয়ালের মতোই আমাদের পদ্মার বুক ভেদ করে চলে যাওয়া ব্যবধান। দুই বাংলা এক হয়ে যাবে আবার। কোনও উগ্রপন্থার হাত ধরে না। স্বাভাবিক ভাবেই। বরিশালের মাটিতে দাদুর সুরে আমার গলা দিয়ে বেরবে আবার মুকুন্দ দাসের গান..সেদিন...আমার অজানা পূর্বপুরুষের বহু কিছু জানিয়ে দেবে বরিশালের আকাশ-বাতাস আমায়....
আমি মানুষ হিসেবে পূর্ণ হয়ে উঠব।।
এতো অনুভবী ও প্রাঞ্জল লেখা ! খুব দ্রুত শেষ হল। এর পরের পর্ব আসুক।
আহা কি লিখলেন দেবর্ষি। অদূর অতিত থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই মায়াময় লেখা কোথায় যেন মন মগজ ছুঁয়ে যায়। লেখায় যেমন ভবিষ্যতের হাহাকার গুঞ্জরিত হয় তেমনি পরিত্রাণের ইঙ্গিতও বহন করে।