আমার বউ আমার সাথে কোনো কথাই বলে না আজ সাত দিন হল। এমন আর কখনও হয়নি আগে। আমরা প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম। বাচ্চা-কাচ্চা এখনও হয় নি। আমি লেখক, আর আমার বউ চাকরি করে।
একজন লেখককে কিছু অদ্ভুত সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা আপনি হয়তো জেনে থাকবেন। লেখা হচ্ছে একটা অন্য বাস্তবতা তৈরি করা, অন্য অনেক মানুষ ও তাদের জীবন। সেইসব বাস্তবতা যে নেই আসলে, তা কে বলবে? কারণ যা নেই তা কি মানুষ কল্পনা করতে পারে?
ফলে, আমি যা কল্পনা করি তার অস্তিত্ব যে নাই এ ব্যাপারে আমি কখনও নিশ্চিত না। আবার একেবারে আছে, এমন সিদ্ধান্তেও যেতে পারি না, কারণ তাকে তো ছুঁয়ে দেখা যায় না।
বাসার বেইজমেন্টে আমার পড়া ও লেখার ঘর। চারপাশে বইয়ের তাক, একটা ছোটো খাট, টেবিল চেয়ার, ল্যাপটপ। ছোটো ফ্রিজ ইত্যাদি।
বেশিরভাগ সময় আমি এখানে থাকি। কখনো-কখনো দিনরাত এখানে থাকি। কারণ হল যখন আপনি একটা গল্পের ভেতরে থাকেন তখন অন্য একটা বাস্তবতার ভেতরে থাকেন। অন্য অনেক মানুষের মধ্যে থাকেন, যাদের সকল কিছু নির্ভর করছে আপনার উপরে। এই অবস্থায় আপনি কখনও চাইবেন না আরও কোনো কিছু এসে আপনাকে বিরক্ত করুক।
আমার বউ ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিল।
সে আমাকে ভালোবাসে, মানে আমার এমনই মনে হয়। আর আগেই বলেছি আমরা পরস্পরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।
আমি যে মহৎ সাহিত্যকর্ম করে যাচ্ছি, বা দুনিয়ার বড়ো সব লেখকদের মতো কাজ করে যেতে হবে আমার, এর জন্য আমার বউ আমাকে উৎসাহিত করত।
কিন্তু একটা পর্যায়ে আমার আলেকজান্ডার দ্যুমার একটা কথা মনে পড়ত বেশি। নারী তোমাকে দুনিয়ার সব শ্রেষ্ঠ কিছু পেতে অনুপ্রেরণা জোগাবে, আর সেটা যাতে তুমি অর্জন করতে না পার তার সকল ব্যবস্থা করে যাবে।
এই প্যারাডক্স যে কেবল নারীচরিত্রের সমস্যা আমি তা মনে করি না। আমার মনে হয় মানুষমাত্রই এমন সব প্যারাডক্সের নির্মাণ।
আমার বউ তার চাকরি-বাকরির কাজে, এবং আমি আমার লেখালেখির কাজে একটা সময় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম বেশি। আর তখন আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করল বলে আমার মনে হয়।
যেমন, একদিন রাতে আমি খেতে গেছি। টেবিলে আমার স্ত্রী সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে জিজ্ঞেস করল, “শ্রাবন্তী কে?”
আমি অবাক হয়ে গেলাম এই প্রশ্নে। আমিও জিজ্ঞেস করলাম, “শ্রাবন্তী কে?”
এবং এরপরেই আমার মনে পড়ল শ্রাবন্তী কে।
এ নিয়ে আমাদের কথা কাটাকাটি হতে লাগল। আমি আমার বউকে বোঝাতে পারছিলাম না যে শ্রাবন্তী আমার লেখার একটা চরিত্র।
লেখার ড্রাফট দেখিয়েও আমি তাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না।
সে বলল, অনেকবার সে বেইজমেন্টে এসে দেখেছে আমি এই মেয়ের সাথে কথা বলছি।
তার কথা মিথ্যে নয়। আমি এরকম অনেক কথা বলেছি ওই মেয়ের সাথে। এবং সৎ ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, ওই মেয়ের প্রতি আমার বড়ো রকম দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। কারণ সে ঠিক আমার মনের মতো। এটা কি আমার লেখার চরিত্র সেই জন্যে? কেবল লেখার চরিত্র হলে সে কীভাবে উঠে আসবে? এইভাবে হাসবে, আর আমার পাশে বসে আমারই লেখা নিয়ে এমন সব কথা বলবে যা আমি নিজেও কখনও ভাবিনি? এসব নিয়ে আমি নিজেও দ্বিধায় ছিলাম।
এর মধ্যে শুরু হল বউয়ের সাথে ঝামেলা।
এবং এক পর্যায়ে খুবই খারাপ হয়ে গেল পরিস্থিতি। আপনি হয়তো জানেন যারা পরস্পর প্রেম করে তারা পরস্পরের প্রতি হিংস্র হয়েও উঠতে পারে কেবল কিছু জিনিস বদলে গেলে। ফলে প্রেম কি আসলে নির্দিষ্ট কিছু শর্তসাপেক্ষের প্রেমময়তা, এবং সেগুলির অনুপস্থিতিতে বের হয়ে আসা হিংস্রতার উপরের হালকা আবরণ?
আমরা জিনিসপত্র ভাঙাভাঙি করলাম। আমার বউ একদিন কাচের প্লেট ভাঙল, আমি গ্লাস ভাঙলাম।
এরপর থেকে কথা বলাবলি বন্ধ ছিল।
এখনও সে আর আমার সাথে কথা বলছে না। আমাকে দেখলে তাকাচ্ছেও না। এমনভাবে বাস করছে যেন আমার অস্তিত্বই নেই। এবং আমার মনে হচ্ছে হয়তো আমি ওইদিন হিংস্রতা বেশি দেখিয়ে ফেলেছিলাম তাই, হঠাৎ আমি তার কাছাকাছি গেলে সে একরকম আমাকে ভয় পেয়ে দূরে চলে যাচ্ছে। সে কি ভাবছে আমি তার ক্ষতি করব?
আমার অস্বস্থি হচ্ছে। কারণ একটা মানুষ আপনাকে ঘৃণা করছে, বা আপনাকে সহ্য করতে পারছে না, বা ভয় করছে, এমন অনুভব ভালোলাগে না। তা ছাড়া সে আমার বউ, এবং আমরা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। সেই সময়ের অনেক স্মৃতি আমার মনে হতে লাগল। আমরা একসাথে হাতে হাত রেখে রিকশায় ঘুরেছি। কত জায়গায় গিয়েছি।
এইরকম মানসিক অবস্থায় লেখালেখি করা যায় না। আমার লেখা বন্ধ হয়ে গেল।
আমি নিঃসঙ্গ অনুভব করতে লাগলাম।
আমার অনেকদিন পর মনে হল বাইরে বের হই। বাইরের আলো হাওয়ায় হয়ত ভালোলাগবে।
রাস্তায় বের হলাম। চকচকা রোদ উঠেছে। নাম না জানা গাছের পাতাদের ফাঁক দিয়ে সে রোদ যখন পড়ছে, এক সুন্দর দৃশ্য তৈরি হচ্ছে সেখানে। আমার ভালোলাগলো।
কিছুদূর যাবার পেছনে আমি শুনলাম পেছন থেকে কেউ একজন গান গায়,
“একবার দাঁড়াও বন্ধু বহুদিনে ফাইছি তোমার লাগ
দাঁড়াও নইলে প্রেম আগুনে করে দেব খাক
একবার দাঁড়াও বন্ধু বহুদিনে ফাইছি তোমার লাগ…”
আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম একজন লোক, যার মুখে সাদা দাড়ি, মাথায় লম্বা সাদা চুল, তিনি গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছেন। এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন।
আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
ভদ্রলোক গান থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ঘুরতে বের হইছেন নাকি? সুন্দর দিন।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ।”
ভদ্রলোক বললেন, “তাইলে চলেন ওইদিকে যাই, ওইদিকে একটা পার্ক আছে, পার্কে গিয়া বসি।”
আমি রাজি হলাম।
ভালোলাগছিল কথা বলার একজন সঙ্গী পেয়ে। কিছুদূর যাবার পরে একটা গলি দিয়ে ঢুকে পার্কের মতো জায়গায় গেলাম আমরা। গাছগাছালিতে ঘেরা শান্ত জায়গা। কয়েকটা বেঞ্চি পাতা। আমি সামনে তাকিয়ে বুঝলাম এটা খ্রিস্টানদের গোরস্থান, পার্ক না।
ভদ্রলোক বসতে বসতে বললেন, “পার্ক না আসলে, কিন্তু বসার জায়গা ভালো। আমি এইখানে আইসা মাঝে মাঝে বসি। আপনে সিগারেট খাইবেন?”
আমি বসে বললাম, “হ্যাঁ, খাওয়া যায়।”
আমরা দুইজনে সিগারেট ধরিয়ে গল্প করছিলাম।
ভদ্রলোক বললেন, “এইখানে আসলে মন নরম হয় বুঝলেন। কত কিছু যে দুনিয়ায় করছি, কত খারাপ কাজ, ভালো কাজ। সব মিলাইয়া মিশাইয়া একটা হিসাবের খেলা মাথায় আসে এইখানে আসলে। মনে হয় যেন অনেক কিছু না করলেও পারতাম।”
একটু থামলেন ভদ্রলোক। সিগারেটের ধোঁয়া ছেঁড়ে বললেন, “আপনারে দেখে মনে হইতেছে দুখী। কী দুঃখ আপনার?”
আমি বললাম, “তেমন কিছু না। পারিবারিক কিছু সমস্যা যাচ্ছে।”
ভদ্রলোক আবার গলা ছেড়ে গাইলেন,
“এখটা খতা খইরে বন্ধু না খরিও রাগ
এখটা খতা খইরে বন্ধু না খরিও রাগ
আমায় ছেড়ে কাহার সনে এত ইতিবাক”
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “এইটাই কি আপনার সমস্যা?”
আমি বললাম, “না, ওইরকম না। আমার স্ত্রীরে আমি বিশ্বাস করি। সে এরকম কিছু করে না।”
ভদ্রলোক বললেন, “আমিও আপনার মতো ভাবতাম এক টাইমে। সেই দিন আর নাই।”
আমি বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক তাঁর গল্প আমাকে বলতে চান। একজন লেখক হিসেবে আমি জানি এসব ক্ষেত্রে চুপ থাকতে হয়। তখনই ওই ব্যক্তি নিজে থেকেই তার গল্প বলতে শুরু করে। আর এখানে নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করে ফেললে সমস্যা হতে পারে। তখন ব্যক্তি মনে করতে পারে আপনি তার জীবন নিয়ে অহেতুক আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
আমি চুপ করে রইলাম।
ভদ্রলোক বললেন, “অনেকদিন আগে আমি প্রেম করে বিয়ে করছিলাম। আমাদের মধ্যে অনেক প্রেম ছিল। আমাদের এক ছেলে হইল। এরপর একদিন আমি বাসায় গিয়া দেখি আমার ছেলে চেয়ারের সাথে বান্ধা অবস্থায় আছে। আর আমার বউ আমার বন্ধুর সাথে প্রেম করতে গেছে।”
আমার খারাপ লাগল এই কথা শুনে।
ভদ্রলোক পরিবেশ হালকা করতেই সম্ভবত হাসলেন, এবং গান ধরলেন আবার,
“কত নিশি গেল রে বন্ধু থাকিয়া সজাগ
কত নিশি গেল রে বন্ধু থাকিয়া সজাগ
এখন আমার আন্ধার ঘরে জ্বলে না চেরাগ”
তার গানের ভেতরে যে একটা দুঃখ আছে এটা আমি তখন প্রথম টের পেলাম।
ভদ্রলোক যখন গান থামালেন, এবং আমাকে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তখন খাকি পোশাক, হাফ প্যান্ট পরিহিত একটা লোক আমাদের সামনে দিয়ে যেতে যেতে গেয়ে উঠল,
“ওরে, রমিজ পাগল মরে যদি লইয়া প্রেমের আগ
রমিজ পাগল মরে যদি লইয়া প্রেমের আগ
শেষ বিচারে দেখাইব বুকের পুড়া দাগ।”
আমার পাশের ভদ্রলোক ওই লোকটাকে ডেকে বললেন, “আজকের পত্রিকাটা দিয়া যান।”
খাকি পোশাক পরিহিত লোক, পিছনে চটের ব্যাগ ঝোলানো, হাতে বর্শা। সে এগিয়ে এসে তার চটের ব্যাগ থেকে একটা পত্রিকা বের করে দিল। আর বলল, “গান গাইতেছিলেন আপনারা। শেষ দুই লাইন গাইয়া দিলাম। মার্জনা করবেন।”
আমার সাথের ভদ্রলোক বললেন, “আরে না না, কোনো সমস্যা নাই। আমরা গান নিয়াই আলাপ করতেছিলাম।”
খাকি পোশাকধারী লোকটা আমার দিকে তাকাল। তাকিয়ে হেসে বলল, “আপনে তো নতুন। আমাদের আগে সাক্ষাৎ হয় নাই। আমি রানার। এখন যাইতে হবে, পিক টাইম। সবার পত্রিকা দরকার। আবার দেখা হবে অন্যসময়।”
লোকটা প্রায় দৌড়েই চলে গেল।
আমার পাশের লোকটি পত্রিকা খুলেছিলেন। একটা খবর দেখে আমি চমকে উঠলাম।
ভদ্রলোক আমার চমকানো টের পেয়েছিলেন।
আমার দিকে পত্রিকাটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “দেখেন, কীভাবে আপনার স্ত্রী আপনারে খুন করে লাশ সরাইয়া ফেলছে তার বিত্তান্ত। এই ঘটনায় অনুসন্ধানী রিপোর্ট পর্ব আকারে প্রকাশ হইতেছে আমাদের পত্রিকায়। দুনিয়ার মানুষ কিছুই জানে না। হয়তো জানতেই পারবে না কখনও যে আপনার কী হইছিল।”
সন্দেহ
আমার শাশুড়ি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতেন। সাধারণত বৃদ্ধ মহিলারা নামাজ রোজা করেন। কিন্তু আমি তাকে কখনও নামাজ পড়তে দেখি নাই।
তিনি হাঁটতে পারতেন, তবে খুব কমই তার খাট থেকে নামতেন। বেশিরভাগ সময় খাটে বসে থাকতেন, আর হাতে একটা তসবি নিয়ে কী যেন জপতেন।
আমি চেষ্টা করতাম সকাল আটটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে তাঁকে চা দিতে। কখনও দেরি হলে তিনি অদ্ভুত কথাবার্তা বলতেন।
যেমন আমার মনে আছে একবার এমন দেরি হল। আমি চা নিয়ে গিয়েছিলাম সাড়ে নয়টার দিকে।
আমার শাশুড়ি বললেন, “বসো বউ।”
আমি বসলাম।
তিনি বললেন, “তুমি কি তবারকরে চিন?”
—কোন্ তবারক মা?
—ওই যে তবারক আলি, তোমার জামাই মানে আমার পোলার লগে পড়ত যে জামাল তার চাচা।
—না মা, উনারে চিনি না।
—সেই তবারক আলি যখন বিয়া করে, ফ্যামিলির কথা শুনে নাই। বিয়া করছিল চামারের মাইয়া। চামার চিন তো? জুতা সিলাই করে যে চামার, আমার দাদার রাইয়ত ছিল এইরকম চামারেরা কিছু।
—জি।
—চামারদের নিয়ম আর আমাদের নিয়ম কি এক হয়? হয় না। ছোটোলোকের বায়ান্ন বাহানা।
—জি।
—সেই চামারের মাইয়া ঘুম থেকে উঠত এগারোটায়। দেখা যাইত বাড়ির সবাই উইঠা গেছে, কিন্তু চামারের মাইয়া ঘুমে। উনার ঘুম ভাঙে নাই। চুতমারানি মাগি।
এই পর্যন্ত শোনার পর আমি বুঝতে পারছিলাম তিনি কোন্দিকে নিয়ে যাচ্ছেন কথাকে। কিন্তু কিছু বললাম না।
আমার শাশুড়ি বলতে থাকলেন, “হালিমের বিয়ার সময়ে আমরা তো খোঁজখবর নিছিলামই কিছু। আমি তো এইরকম শুনি নাই তোমার পূর্বপুরুষ কেউ চামার ছিল, ছিল নাকি?”
আমি কী উত্তর দিব বুঝতে পারছিলাম না।
তিনি বললেন, “যাও এইখান থেইকা।”
এই একটা উদাহরণ দিলাম। এইরকম কথাবার্তা তিনি বলতেন।
আমার সাথে কথাবার্তায় বাজে আচরণ করে তিনি আনন্দ পেতেন বলেই আমার মনে হত। হয়তো তিনি তাঁর জীবনে তাঁর শাশুড়ির কাছ থেকে এমন আচরণ পেয়েছেন, এবং তাই এখন অবচেতনভাবে একই জিনিস করে যাচ্ছেন, এটা ভেবে আমি নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম।
একদিন আমি শুনলাম তিনি আমার স্বামী আবদুল হালিমের সাথে কথা বলছেন।
—বউরে বিশ্বাস করবি না বাপ। বউরে বিশ্বাস করে চামারে।
আবদুল হালিম বলে, “এইটা কী বলেন আম্মা? আব্বা কি আপনারে বিশ্বাস করত না?”
—না। বিশ্বাস করলে কি সংসার টিকে? তোর বউ তুই কামে চইলা গেলে কী করে জানস তুই?
—কী আর করবে। ঘরের কাজ কাম করে।
—হ করছিল ঘরের কাম। আমি ঘরে থাকি না? আমি দেখি না?
—তাইলে আপনে বলেন কী করে?
—আমি বলব না।
কেন আপনে বলবেন না? আপনে কি চান না আপনার পোলার সংসার টিইকা যাক?
—না।
—আজব মা আপনে। চান না কেন?
—কারণ আমার চাওয়া না চাওয়ায় কিছু যায় আসে না। আর আমি তো কই, এই মাইয়া তর জন্য ভালো না। তর বিয়াতে আমার মত ছিল না। খারাপ মাইয়া আমি দেখলেই চিনতে পারি।
—কিন্তু বিয়া তো হইয়া গেছে আম্মা। আর আপনে যেহেতু ঘরে আছেন, দেখতেছেন সে কী করতেছে, তাইলে আমার আর চিন্তা কী বলেন?
—আমি এইগুলা দেখি না। তুই ক্যামেরা লাগাইয়া রাখ। দেখবি সব।
আমি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে এসব আলাপ শুনলাম।
পরে আবদুল হালিমকে জিজ্ঞেস করলাম, “এসব কী?”
সে হেসে বলে, “আরে আম্মার মাথা ঠিক নাই। কী না কী বলে, সব ধরলে হবে না।”
জিজ্ঞেস করি, “ক্যামেরা লাগাইবা না?”
সে বলে, “ধুর!”
এরপর আমার শাশুড়ি একদিন আমার সাথেও এসব নিয়ে আলাপ করলেন।
আমাকে বললেন, “বউ, তুমি কি আবদুল হালিমরে বিশ্বাস কর?”
আমি বললাম, “জি করি।”
তিনি বললেন, “পুরুষ মানুষরে বিশ্বাস করবা না। এরা কুত্তার জাত। আবদুল হালিমের রক্তে খারাপি আছে। তার বাপের চরিত্র ভালো ছিল না।”
আমি বললাম, “জি।”
উনি বললেন, “আমি অনেক কথা বলি। কিন্তু এই কথা ফালাইও না। আবদুল হালিমের উপরে চোখ দিয়া রাখবা। চোখ সরাইলেই বিপদ। একবারের ঘটনা তোমারে বলি। আমি বাপের বাড়ি গেছিলাম কয়েকদিনের জন্য। এক রাতে আমার মনে হইল কিছু ঠিক নাই। ওই রাতেই আমি বাড়ি ফিইরা আসি আর আবদুল হালিমের বাপরে পাই আরেকটা মাইয়ার সাথে। বেশি কিছু করতে পারে নাই। তার আগেই আমি চইলা আসি। এইসব জিনিস খুব খিয়াল রাখবা। বাপের বাড়ি গেলেও স্বামীর উপর চোখ রাখবা। চোখ সরাইলেই বিপদ। ক্যামেরা লাগাইয়া রাখবা।”
উনি অনেক আজেবাজে কথা বলেন। তাকে আমার অসহ্য লাগত, কিন্তু তার এই কথাটি, তিনি এমনভাবে বললেন যে, আমার ভেতরে ঢুকে গেল।
এরপর আরও নানা সময়ে তিনি এইসব বিষয়ে আমাকে বলতেন।
একবার বললেন, “একদিন দেখবা তোমার জামাই হাসি খুশি। অফিসে বেশি টাইম দেয়, তার কাজের চাপ বেশি। তার কাছে অফিসের কাজের খালি ফোন আসে। ফোন আসলেই সে গুরুত্বপূর্ণ কথার জন্য ছাদে চইলা যায়। এসব লক্ষণ দেখার আগেই সাবধান হইয়া যাও। জামাই হইল পিছলা হাতে মার্বেল পাথরের মতো, হাত ফসকাইয়া একবার গেলে আর ধরতে পারবা না।”
হুট করেই একদিন ভদ্রমহিলা মারা গেলেন।
তিনি মারা যাবার পরে তাঁর কথাগুলি আমার বেশি মনে হত। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আবদুল হালিম ব্যস্ত হয়ে পড়ছে কাজে। তার কাছে অনেক বেশি ফোন আসে এখন, ইত্যাদি।
আমার ভেতরে সন্দেহ বাড়তে থাকে।
আগে তো আমার শাশুড়ি ছিলেন। ফলে আমি যখন বাপের বাড়িতে গিয়ে কয়েকদিন থাকতাম তখন নিশ্চিন্ত ছিলাম। কিন্তু তিনি যখন নেই তখন কেন জানি আমার মনে এই প্রশ্ন আসতে থাকে, আবদুল হালিম যদি রাতে অন্য কোনো মেয়ে নিয়ে আসে?
এই সন্দেহ বাড়তে থাকলে আমি একটা ক্যামেরা লাগাই আমাদের বেডরুমে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা স্মার্টফোনের সাথে যুক্ত করা যায়। এবং লাইভ দেখা যায় যে ঘরে কী হচ্ছে।
আমি বাপের বাড়ি গিয়ে যে ক-দিন থাকতাম, রাতে দেখতাম যে আবদুল হালিম কী করছে। কারণ কোনো মেয়ে নিয়ে আসলে অবশ্যই বেডরুমে নিয়ে আসবে।
শাশুড়ি মারা যাবার কয়েক বছর হয়ে গেল। প্রথম প্রথম আমি বাপের বাড়ি গেলে নিয়মিত ক্যামেরা দেখতাম। কিন্তু আবদুল হালিমের নাক ডাকা ঘুম ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি।
ফলে একসময় এটি দেখা ছেড়ে দেই, একরমক ভুলেই যাই এর কথা।
একজনের মানুষের সাথে দীর্ঘদিন থাকলে তার প্রকৃতি বুঝা যায়। আমার শাশুড়ি যেরকম বলতেন আবদুল হালিম কখনোই তেমন নয়। সে কাজপাগলা লোক। কাজ করে, এবং বাকি সময় ফুটবল খেলার সংশ্লিষ্ট নানা কিছুতে ব্যয় করে ফেলে। অন্যদিকে মন দেবার ইচ্ছা ও সময় কোনোটাই তার নেই।
আমাদের বাচ্চা হচ্ছিল না। এ নিয়ে আমরা চিন্তিত ছিলাম। ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিলাম।
গতকালও ডাক্তার ছিল। সেখান থেকে এসেই আবদুল হালিম জরুরি ব্যাবসার কাজে চট্টগ্রামে গিয়েছে। ফিরে আসবে কাল সকালে।
বাসার কাজের মহিলাও আজ ছুটিতে আছে, পরিবারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।
রাতে আমার ঘুম আসছিল না। ভাবছিলাম যে আবদুল হালিম এখন কী করছে। তখন হঠাৎ মনে পড়লো সেই সন্দেহের কথা। ক্যামেরার কথা।
তখন আমি মোবাইলের ওই অ্যাপটি খুঁজে বের করলাম, যেখানে ক্যামেরা ইন্সটল করা ছিল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে কানেক্ট করে আমি দেখতে চাচ্ছিলাম এই রুমে আমি যে আছি, আমাকে কীরকম দেখায় তা দেখতে, কিংবা এখনও কাজ করে কি না ক্যামেরাটি।
অ্যাপে দেখাচ্ছিল আমার রুমের চিত্র। কিন্তু প্রাথমিক দৃশ্য দেখে আমার ভ্রূ কুচকে গেল। বিছানায় বসে আছেন আমার শাশুড়ি। তিনি বসে তসবি জপছেন, ঠিক আগের মতো।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এসব আমি কী দেখছি!
আমার শাশুড়ি বিছানা থেকে নামলেন। ঘরে হাঁটাহাঁটি করলেন। এরপর এগিয়ে এলেন ঠিক ক্যামেরার কাছাকাছি।
আমার মনে হচ্ছিল মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে তিনি। তিনি বললেন, “কেমন আছ বউমা? কতদিন তোমার সাথে কথা বলতে চাইতেছি। তুমি তো দেখ না।”
এরপর আমি শুনলাম কারও পায়ের শব্দ ক্যামেরায়। কে জানি রুমে আসছে।
আমার শাশুড়ি সতর্ক হয়ে উঠলেন। তিনি দ্রুত খাটের নীচে লুকিয়ে গেলেন।
দেখলাম আমি এসে রুমে প্রবেশ করেছি।
আমি বাথরুমে গেলাম। এরপর বিছানায় উঠলাম।
মানে ক্যামেরা কিছু সময় পেছানো। শুরু থেকেই হয়তো এমন ছিল।
কিন্তু আমার খাটের নীচে এখন…
আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
খাটের নীচ থেকে যেন আমি শুনতে পাচ্ছি নিশ্বাসের শব্দ। আর খসখসে এক আওয়াজ, “বউমা, আছো কেমন?”
ছবি: ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
অবনী, বাড়ি আছো?
দমবন্ধ করা।
দুটোই দারুন। বেশ অভিনব।
অসাধারণ গল্প, দারুণ লাগল
ভালো লাগলো।
ঝরঝরে লেখা, তরতর করে পড়া হয়ে যায়। প্রথম গল্পটি বেশী ভালো লেগেছে।
চমৎকার
দুর্দান্ত!
ড্বিতীয় টাও ভালো দুটৈ . খুব graphic ছমছমে