

(১) ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল সে।
চোখের সামনে আকাশ ধীরে ধীরে বেগুনি হয়ে ওঠে। আলতা রঙের পোঁচ পড়ে তার উপর। শুধু জনারণ্যে কিছু ঘুড়ি, পাখিদের প্রতিনিধি। গঠন নয়, ঘুড়ি চেনা যায় তার উড্ডয়ন-কৌশলে। উদ্বাস্তু কলোনি থেকে চাক চাক ধোঁয়া, যেন নোয়াঠাকুমার আর্তি, খুঁজে নেয় আলপথ—ফরিদপুর। তাদের গতিপথ বিভ্রান্ত সরল, অর্থাৎ বক্র।
গুলের আঁচ ওঠা উনুন—খানিক উপরে বুড়ির দু'টো চোখ আর ফুলে ওঠা টিকোলো নাক এক প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে, যা আকারে ক্রমশ বড় হতে থাকে।
মাথার ভিতর শৃঙ্খলিত ধ্বনি, রঙ আর হঠাতই কালো হয়ে ওঠে আকাশ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যা কিছু, সব সত্যি। সবচেয়ে বড় সত্য এই রাত, তার বেদনা, যা কেবল অনুবাদে সাবলীল...
কুকুরেরা জেনে গেছে সব। সন্ধ্যার আজান আর মিলিটারি রুট মার্চ পরপর শুনে নমনীয় করে তোলে নিজেদের। স্থির হয়। সঙ্গম স্থগিত রাখে আজ।
(২) উদ্বাস্তু শিবিরগুলো ধরা পড়ে চোখে। গন্ডারমার্কা চিমনির কাছে বসে নোয়াঠাকুমা। কৈবর্তপুরাণের প্রণেতা চেয়েছিলেন এমনই এক সমর্থ পাঠিকা, ঝিঁঝির ডাক ও সহস্র বিপন্নতার মধ্যে যে পুঁথি পড়ে, স্নায়ু-পরবশ নয়, হলুদ আলোর সম্মুখে নিজের জরা ও বয়স অস্বীকার করে রোজ।
(৩) সেদিন বিকেলে কলুটোলা যাওয়ার পথে অগুনতি ফলের দোকান ও শ্রম দপ্তরের পুরনো অফিসের পাশে একটা কড়াই গাছ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হেরফের রৌদ্রের ভিতর তাকে জিরাফ বলে মনে হয়। সে গাছটাকে স্পর্শ করে। মনে পড়ে, স্নেহলতা নামে তার এক বোনের কথা—রোদ্দুর বেয়ে উঠে যেত ছাদে।
—এই আপেলের দাম দশ টাকা?
—এর কমে কিছু হয় না, দাদা! আসুন।
—কেন?
—হয় না, তাই...
যেখানেই যায়, সে কেবল উটের কাফিলা দেখে
চারিদিকে বালি আর প্রান্তরের শূন্য ছাঁদ
শান্ত মরূদ্যান—কখনো-বা জলের আশয় ঘিরে থাকে
আঁধারে আলোর কারুকাজ, প্রায়শই
বিষণ্ণ পুরুষ উট যোনি বুঝে চেটে নেয় অপরূপ বালি...
(৪) ভোরবেলা, অথবা ভোরেরও খানিক আগে সে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। শহরের খুদে ধূসর পাখিগুলো তখনো ঘুম ছেড়ে ওঠেনি। তার সাদা স্যান্ডো গেঞ্জির উপর সারিবাঁধা লাল ফৌজের মতো পান ও সিঁদুরের উপর্যুপরি দাগ।
শ্মশান থেকে যূথবদ্ধ ধোঁয়ার শ্রেণি আজ নোয়াঠাকুমার শেষকৃত্য হয়ে ফিরে আসে। সে ঠিক করে, আগামী ক'দিন দাড়ি কামাবে না, নিরামিষ খাবে, মাগীপাড়া এড়িয়ে চলবে অন্তত ছ'মাস।
আকাশ পরিষ্কার করে দেওয়ার পণ করে ভ্রূণ সূর্য ভেসে উঠবে মেঘে মেঘে অন্তরিন জলে। সহ্যাতীত ঘ্রাণে গোটা শহর ফের চলমান আঁতুড়ঘর হয়ে উঠবে। ইতস্তত জল ভাঙা—সশব্দ, সচল।
এখন নীরবতা তার চোখে বিবর্ণ হয়ে ওঠে।
অতুলন লেখা!
শাশ্বতী সরকার | 157.4.***.*** | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ১২:২৯98494অসম্ভব সুসংহত গদ্য, সন্দেহ নাই। এর কাব্যিক সৌন্দর্য-ও প্রশ্নাতীত।
'হলুদ আলোর সম্মুখে নিজের জরা ও বয়স অস্বীকার করে রোজ।'
—আমিও, চোখ পরিস্কার করে নিই।
Shibsagar Debnath | 223.233.***.*** | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ১৪:১৩98500টুকরো টুকরো সন্ধর্ব
পুরোটা যেন বলা হচ্ছে না [কনরাড মনে পড়ছে]
আর বর্ণনা কাব্যিক লালিমায় আচ্ছন্ন।
খুব ভালো পড়লাম
Shibsagar Debnath | 223.233.***.*** | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ১৪:১৯98501সন্দর্ভ*
রঘু জাগুলীয়া | 2401:4900:1224:6811:7033:9cd7:d9b3:***:*** | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ১৫:৪৯98502যেন অমোঘ রৌদ্র, জল ও পাতায় মাখামাখি উচ্ছল প্রতীতি।
বাঃ! ভালো লাগল।
বাঃ কুণাল, বড় ভালো লাগলো !
পঙ্কজ চক্রবর্তী | 2409:4060:29a:90dd:ad26:1a0b:1d27:***:*** | ১৬ অক্টোবর ২০২০ ০০:৩৮98518অসামান্য গদ্য । অনবদ্য কবিতার মতো সংকেত প্রবণ। শুধু জেগে আছে একটুকরো সংলাপ রক্তমাংসের মতো। এই লেখা দেশহীন। দূরবর্তী চরাচরের সীমাহীন শিকড়ের গন্ধ বিজড়িত। মুগ্ধতা কুণাল। শুধুই মুগ্ধতা।
Shamsul Choudhury | ১৬ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৫৩98539কবিতার মত গদ্য। অপূর্ব রচনা। সল্প কথায় নিদারুন এক সমাজচিত্র। লেখককে সাধুবাদ
অরূপরতন হালদার | 182.66.***.*** | ১৬ অক্টোবর ২০২০ ১৯:৪৮98544গদ্য আর কবিতার মাঝখানের ধূসর রেখা ছুঁয়ে জেগে আছে শব্দরা, ঘুমিয়েও পড়ে কখনো, স্বপ্নে দেখে একটা মনোবিকলন ছেঁড়া ছেঁড়া শরীর নিয়ে আসে।
কুণাল বিশ্বাস | 2409:4060:188:fcbb::2970:***:*** | ১৮ অক্টোবর ২০২০ ১৩:১৮98601প্রত্যেক পাঠককে ধন্যবাদ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।
রুখসানা কাজল | 27.147.***.*** | ২৪ অক্টোবর ২০২০ ১১:২৯98851মনের ভেতর স্মৃতির ঘর-- ফরিদপুর সেই ফরিদপুর--
Soma mukherjee | 42.***.*** | ০১ নভেম্বর ২০২০ ২০:৫৩99533অসাধারণ লেখনী
Soma mukherjee | 42.***.*** | ০১ নভেম্বর ২০২০ ২০:৫৪99534অসাধারণ লেখনী