শিউলিদের পুকুরে মাছ খেলা করে। আমি তার পুকুর দেখিনি, মাছও নয়—তবু জানি মাছ খেলা করে জলের ভেতর। পাড়ের যে-গাছ ছায়া ফেলে জলের উপর—তাকেও দেখিনি আমি। যেমন দেখিনি গাছের ডালে-পাতায় যে-পাখি লাফায়—তার ঘর-দোর-বার। আমি শিউলকে চিনি-জানি, তাদের দোতলা মাটিরবাড়ি-র কোণে কোণে যে ইতিহাস গাঁথা—তাও অজানা নয় আমার। তাদের বাড়ির পিছনে আমড়াগাছের যে-পাকা ফল গাছ থেকে খসে টুপ করে ডুবে যায় জলের ভেতর—মাছ তাকে নিয়ে খেলে-তাকে আমি জানি।
শিউল অবাক। বললে, কই! এমন হয় নাতো? এমনি বাড়ি আমাদের নয়। ঐ পুকুর সেই মাছ; মাছের ভেতর জলের সাঁতার; পাখির ভেতর গাছের বাসা—এমনি বাড়ি আমাদের নয়। ও তোমার মনের ভুল। বললাম, এতটা ভুল? হতে পারে? সে বললে, কেন নয়? মানুষ মাত্রই ভুল হয়। তোমারও হয়েছে। নইলে যে তুমি কোনোদিন আমাদের বাড়ি গেলে না সেই তুমি এমন চিত্র দেখবে কী করে? মনের ভুল ছাড়া আর কী!
শিউলিকে বোঝাতে পারি না, যা দেখি তা নয়—সত্য তাই যা আমরা দেখি না। সে তখন হো হো করে হাসে। বলে, তুমি সেই তেমনি রয়ে গেলে—আগের মতই। পাল্টালে না, বদলালে না—এমন লোককে নিয়ে আর পারি না। ওকে বলি, এমন কথা তো ছিল না শিউলি। কথা ছিল, তোমাকে একটি নদী উপহার দেব। সঙ্গে একটি নৌকা। নদীতে ভেসে যাবে নৌকা, জলের উপর সূর্যাস্তের আলো—এমতাবস্থায় কত পাখি উড়ে যেতে পারে আকাশ দিয়ে—কল্পনা করে দ্যাখো একবার।
ও বলে, আমি কল্পনা করতে পারি না। তুমি যা তোমাকে আমি তাই দেখি। দেখি শুনি, একা-একা কথা বলি। তার মধ্যে নদী নেই, সূর্যাস্ত নেই, নৌকা নেই। মাটির দোতলাবাড়ি’র পিছনে আমাদের চাষজমি। আমরা সেখানে মৌরি চাষ করি। ধনে আর জিরে। এই যে চাষজমি, এই যে চাষজন্ম—যেন তা আমাদের হাতে আছে অনন্তকাল। চাষ করতে করতে আমরা যখন সেই মাটির নীচে চলে যাই—দেখি সেখানে প্রাচীন জ্যোৎস্নাসকল পড়ে আছে।
আর আমি অবাক হয়ে যাই শিউলির কথায়। এই তো কী সুন্দর কবিতার মত কথা বলে সে, কবিতার মতন চলন তার—কবিতার মত জীবন। অথচ সে বলে, আমি কবিতা লিখতে পারি না, কারণ আমি তা লিখিনি কখনও। কবিই সত্য আর জগত মিথ্যে—একথা তাকে বোঝাতে পারি না। সে একপাক ঘুরে গিয়ে বলে, ওসব হল তোমার কল্পনা। কবি হয়েই হয়েছে তোমার মুসকিল। জানো তো, কবিরা গজদন্তমিনারে বাস করে? আবোলতাবোল লেখে—আসলে ওসব কোনো কবিতাই নয়! অবাক হয়ে বলি, এসব কী বলছ তুমি শিউলি? জানো আমি কী ঠিক করেছি? এই গোটা ডিসেম্বর মাসটা তোমাকে উপহার দিতে চাই। একী কম কথা হল?
হাত উল্টে শিউলি বলে, ঠিক আছে, দিলে না-হয়—কিন্তু তার পর? এই গোটা ডিসেম্বর নিয়ে আমি কী করব? ডিসেম্বরের সমস্ত শিশির আমার গায়ের উপর ঝরবে। সমস্ত শীত আমাকে কাঁপাবে। প্রজাপতিরা আমার গায়ে বসবে। বলো, তখন আমি কী করব?
মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, উপায় আছে শিউলি—খুব সহজ উপায়। তুমি চলে যাবে তোমাদের সেই গ্রামে। সেখানে এখনও সূর্য ওঠে, চাঁদ অস্ত যায়; একটি দোতলা মাটিরবাড়ি-র পিছনে যখন এইসব চলবে—তুমি ডিসেম্বরকে গায়ে জড়িয়ে নিয়ো। যেমনি করে লোকজন কাঁথামুড়ি দেয়, যেমনি করে লোকজন গায়ে তোলে বালাপোস—এমনি করে ডিসেম্বরকে জড়িয়ে নিয়ো। তুমি তাকে আদর করে বোলো, আসো আমার মন-খারাপ, এসো আমার সূর্যাস্তের আলো; এসো আমার হারিয়ে যাওয়া সোনালি-রূপালি মাছ—ফিরে এসো হারিয়ে যাওয়া টুনটুনি পাখিদের দল। জলের ভেতর যে পাকা-আমড়া খসে পড়ে, সে তো ডোবে না—ডোবার ভান করে মাত্র। তুমি তার কথা ভাব। তুমি এই গোটা ডিসেম্বর উপহার না নিলে, সে কী একলা হয়ে যাবে না? একলা কার্তিকের মতন ডিসেম্বর তখন কোথায় ঘুরবে? কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে?
শিউলি তার গোলাপি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, বেশ, নেব। কিন্তু কথা দিয়ে হবে, ডিসেম্বর-ডিসেম্বর-ই থাকবে—জানুয়ারি হবে না।
তখন বলি, একথা আমি দিতে পারি না শিউলি। কারণ চিরকাল ধরে ডিসেম্বর মাস তোমায় উপহার দিতে পারি না আমি। উপহারের ক্ষয়বয় আছে, তারও ভালো লাগা, না-লাগা আছে। সুতরাং, একটিই উপহার ঘাড়ে করে নিয়ে বইবে কেন তুমি? তাছাড়া অন্য আর উপহার দিতে পারি তোমায়—তুমি চেয়ে নিতে পারো অন্য কিছু। কত প্রেমিক তোমার চারিদিকে ভীড় করে আছে—তারাও দিতে পারো অনেক দামি কিছু—কিন্তু ডিসেম্বর তারা দিতে পারবে না, একথা হলফ করে বলতে পারি তোমায়। তাদের তুলনায় আমার এ-উপহার নিতান্ত মামুলি বলতে পার। কারণ এই উপহারটি দেবার জন্য আমার এক পয়সা খরচা হয়নি। ডিসেম্বরকে আমায় কিনতে হয়নি কোথাও। এই যে একটুকরো রঙিন কাগজ—এতে যদি লিখে দিই ‘এই ডিসেম্বর মাস তোমার—’ তখন মাসটি তোমার হয়ে যাবে। এর চেয়ে অনেক দামি উপহার পাবে তুমি। তোমার একটু ইঙ্গিতে কতশত ছেলেরা ছুটে আসবে বস্তা-বস্তা উপহার নিয়ে—তখন দেখবে অনেকদূরে সরে গেছি আমি; চলে গেছি তোমার জীবন থেকে। হয়ত তখন আমি মুছে ফেলব মাটির বাড়ির রোদ্দুরের রঙ; হয়ত আমার গায়ে থাকবে না মৌরিফুলের সুবাস; তোমার গ্রামের মাটি-জল-আলো-বাতাস—ভুলে যাবে আমায়। কারণ আমি সেখানে কোনোদিন যাইনি, যাবার চেষ্টাও করিনি; যাবার ভান করেছি মাত্র। কিন্তু আমি যেটুকু বুঝি, তা যথেষ্ট নয়। একটি দোতলা মাটির বাড়ির পিছনে যেমন পড়ে থাকে অনেকটা ছেড়ে রাখা আকাশ; আমড়ার ডালে বসে থাকে দুটি ঘুঘু বা চড়াই; তারাও ভুলে যাবে আমায়—কারণ তারা আমাকে দেখেইনি। কী করে তাদের দোষ দিই বলো, দোষ আমার নিজের। আমি মাটির বাড়ির দোতলার মাটির সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাইনি কত অনন্তকাল; আমি কখনও বলিনি, এসো, মাটি-টি একটু কুপিয়ে দিই। আমি কোনোদিনও চেষ্টা করিনি বীজ ছড়ানোর। তাই কীসের অধিকারে, কীসের জোরে আমি থেকে যেতে পারি—আর থাকার তো কথাও নয়। এই দ্যাখো না, এখানে আসার আগে দেখে এলাম, ছেলের কপালে জ্বর—জ্বরের ঘোরে সে আমাকেই খোঁজে! তাকে কোনোদিন দামি কোনো খেলনা কিনে দিতে পারিনি, দিতে পারিনি রিমোটচালিত কার। সায়েন্সসিটি বা নিক্কোপার্ক নিয়ে যেতে পারিনি খরচের ভয়ে। তবে কীসের জন্য এই দাবি করতে পারি যে, এই দোতলা বাড়ির ছোট্ট ঘরয়ায় আমি ছিলাম। সেখানে খড়-মাটির গন্ধ পেয়েছি; তুমি একটি গন্ধরাজ রেখে গেছ বাটির জলে—আহা কী সুবাস তার— তোমার দেহের মতন, মনের মতন গন্ধ তাহার। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম সে-টি একটি নক্ষত্র, যেমন তুমি। যা তুমি আকাশ থেকে পেড়ে এনেছ আমার জন্য। এই ভেবে আমার মন মোহিত ছিল, যেমন আমি। সেই ধারণা ভেঙে দিয়ে তুমি বললে, এবার তবে নৌকা বের করি?
নৌকা? নৌকার কথায় আমি আকাশ থেকে পড়ি। কেননা শিউলি, আমি কেবল তোমাকেই চিনি—তোমার নৌকাকে নয়। আর চেনার কথাও নয়; কারণ তোমাদের ঐ পুকুরে কোনো নৌকা চলে না। পুকুর ঢেকে আছে কচুরিপানার দামে। জলের নীচে তোমাদের এঁটোকাঁটা ভেজা ভাত পড়ে থাকে; অনেক রাতে সেই ভাত খেয়ে যায় কোনো এক জিওল মাছ—বিশেষত ল্যাটা আর কচ্ছপে। তোমার বাড়ির লোক ছিপ ফেলে কুঁচেমাছ ধরেছে। আমি কুঁচেমাছ খাই না—কারণ আমি কখনও কুঁচেমাছ দেখিনি। সাপের মতন প্রাণীটি জলের গভীরে— পাঁকের ভিতর লুক্কায়িত থাকে, কেবল একমুঠো ভেজা ভাতের আশায় তারা উঠে আসে উপরে—এইসব পানাপুকুরেই তাদের বাস; ছিপে কেঁচো গেঁথে ফেললেই সে টোপ খাবেই। কুঁচের টেস্ট নাকি চমৎকার! আমি সাপ খাই না শিউলি। সাপ ও সাপের মত—সেই একই হল। শুনেছি জ্বর-জারিতে কুঁচের মাংস খুব উপাদেয়। কিন্তু আমার ছেলেকে সে-সব খাওয়াতে চাই না। ও ভাত-ডাল-সবজি খাক এই ডিসেম্বরে।
ওকে বলেছি এই শীতেই ওকে একদিন নিয়ে যাব চিড়িয়াখানায়। কিন্তু মুস্কিল কী বলতো? সেখানে ও যেতে চায় না। ও দেখতে চায় সায়েন্সসিটি। শুনেছি ওখানে গেলে নাকি খুব খরচা হয়? হাজার টাকা এক লহমায় গলে যায়? জানা আছে তোমার? গেছো তুমি? কিন্তু আমি ওকে খরচের কথাটা বলতে পারি না। ছোটো বাচ্চাকে কী এসব বলা যায় না বলা উচিত? এই সবে ডিসেম্বর, আজ এক তারিখ—শীত একটু জমিয়ে পড়ুক, তখন না হয়... ।
ছেলে বলে, ডিসেম্বর মানে কী কেবল শীত বাবা—আর কিছু নয়? আমি বলি, তা কেন? নলেন গুড় আছে না? আর কমলালেবু? সেটাই বা বাদ যায় কেন? এছাড়া নানা জায়গায় চড়ুইভাতি আছে—সেটাকেও হিসেবের মধ্যে রাখতে হবে। আর একটা কথা কী বলত? ডিসেম্বর মানে হল অঘ্রাণ। ছেলে বলে, অঘ্রাণ ভালো নয়। অঘ্রাণে কী হয়? ওকে বলি, ওরে, অঘ্রাণ-ই তো আসল। তখন ঘাস ভিজে যায় শিশিরে।
ওকে তখন ঘাসেদের কাছে নিয়ে যাই। সন্ধে হয়ে এসেছে; দূরে দূরে আলো বাসা করে আছে। চাঁদ ওঠার কথা আছে রাতেরবেলায়। তবু নক্ষত্ররা জাগে। ওকে ঘাসের বুকে হাত বোলাতে শেখাই—দূরে কোথাও ব্যাঙ ডাকে, একটি দুটি ঝিঁঝিঁ পোকা; পতঙ্গরা উঁচু লাইট ঘিরে পাক খায়। তখন আমার ছেলে অঘ্রাণ চেনে। বলে, কই বাবা, অঘ্রাণ বলে তো এখানে কিছু নেই!
অঘ্রাণ মানে যে অগ্রহায়ণ—পুরাকালে বাংলা নববর্ষ এই মাস থেকে শুরু হত—ওকে বলি। সে কী বুঝল কে জানে; বললে, আচ্ছা! হাত ভিজে যাচ্ছে কেন বাবা? বলি, অঘ্রাণে এমনি হয়। আর তখন মাঠে-মাঠে ধান কাটা হয়। ধান হল সোনালি ফসল। ছেলে বলে, কী করে ধান কাটা হয়? ধান কেটে শুইয়ে রাখে কেন? আমি অবাক হয়ে ওকে বলি, তুই কী করে জানলি ধান কাটা হয়, মাঠে-মাঠে তাকে শুইয়ে রাখা হয়? সে বলে, জানি বাবা। ধান তো ধান-ই আর কিছু নয়! খুশি হয়ে বলি, এখানেই শেষ নয়, আছে আছে, আরও আছে। কী সেটা? বলি, ইঁদুরেরা ধান কেটে নিয়ে যায় নিজেদের বাসায়—আহা, শিউলি! আমার কথায় রাগ কোরো না। ছেলের কথা উঠলে আমার আর হুঁস থাকে না। কত কথা বলে ফেলি আবোলতাবোল—তার কোনো ঠিক নেই।
তুমি কি সত্যি রেগে গেলে শিউলি? রেগো না। দ্যাখো, আমার কিছু করার নেই। অতটুকু বাচ্চা—যখন অঘ্রাণ বলতে সে তোমাকেই বোঝে; আমি কীভাবে তাকে নিবৃত্ত করতে পারি বলো? সে নাকি একদিন আমাদের দেখেছে; তুমি-আমি হেঁটে যাচ্ছি কোনো এক সড়ক ধরে—তখন। সে বলেছে, ঐ মেয়েটিই কি অঘ্রাণ বাবা? আমি তাকে বোঝাই, ওরে, একটি মেয়ে কখনই অঘ্রাণ হতে পারে না। ওর নাম তো শিউলি। সে তখন বললে, বাবা, আমি সব জানি। অঘ্রাণ মানে একটি মেয়ে একাকী একটি নৌকায় ভেসে যাচ্ছে।
তখন আমার মনে পড়ল সেই নৌকার কথা; সেটি নাকি একদা আমি তোমাকে উপহার দিয়েছিলাম; আমার মনে নেই, কিন্তু তোমার দাবি ছিল তেমনই। আর তুমি সেটি কোথায় রাখবে ভেবে ফেলে এসেছিলে গঙ্গার উপরেই; কেননা তোমাদের পুকুরে নৌকা চলে না। জানি না এখন সেটা কার কাছে, কার সঙ্গে, কোডন ঢেউ-এ দোলে।
তার পর, তোমার মনে আছে শিউলি, একদিন আমরা সেই নৌকার খোঁজ পেতে নৌকা চেপে বসলাম আর নৌকা আমাদের নিয়ে চলল সুদূর। নদীর ওপারে, যেখানে কোনো পাড় নেই—কূল জেগে আছে—পাড়ে হাত রেখে তুমি বললে, আমায় ভালোবাসো তো?
চুপ করে থাকি। তখন তুমি বললে, সব কী তাহলে মিথ্যে, ফাঁকি? আমার বোঝার ভুল? তখন বলি, তা কেন? দিনের সব আলো থাকে রাতের আঁধারের গভীরে। সে তখন চুপ করে যায়। মাথা নীচু করে বসে থাকে আমার সামনে। কপালের উপর থেকে একগুচ্ছ চুল ছুঁয়েছে তার ভ্রূ-পল্লব। তার হাতে হাত রেখে বলি, নীরবতা কী কোনো ভাষা হতে পারে না? কবি নীরব হয়, গাছপালা থাকে নীরব; মাঝে মাঝে এই নদীও স্থির হয়ে যায়; তখন মনে হয়, কেবল ফিরে যাওয়া বাকি। আর যখন ভালোবাসা নীরব থাকে, বুঝতে হয়; এবার মৃত হওয়া বাকি, ঘর বাঁধা বাকি; হোক না সে মাটির কোনো দোতলা; সেখানে নীরবে এসে বসুক কোনো দোয়েল, তার শিসে ভরুক ঘর; তখন আমার পিঠে গুমগুম করে মারতে মারতে তুমি বলবে, কে বলেছিল সাত-তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিতে; বুড়ো বয়সে লোকের বিয়ে হয় না, না?
আমি তার হাত ধরে ফেলি। বলি, আমি মোটেই বুড়ো নই। মাত্র এগারো বছরের তফাত কোনো তফাত নয়। এর চেয়ে কত তফাতে বিয়ে হয়। এসো, আমরা বিবাহ অনুষ্টান সম্পন্ন করি।
শুনে সে খেপে যায়। বলে, তবে যাও, দোতলাবাড়ি’র ছাদ থেকে ঝাঁপ দিগে যাও গে। যাও, ঝাঁপ দেওয়ার অব্যেস করো। আমি হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বলি, ছাদ কোথা? ও হল টালির চাল, মাটির দোতলাবাড়ির ছাদ কি ঢালাই হয়? ওখানে আমি উঠব কীকরে? আর না-উঠলে ঝাঁপ দেব কীভাবে? তুমি সবই বোঝ শিউলি; ঝাঁপ দেওয়াটা আসলে কোনো ব্যাপার নয়; টালির চালে ওঠাটাই সমস্যা। চালের উপর উপর কি শিউলি ফোটে? কবে থেকে বলছি, একটি শিউলিগাছে তোমার নাম লিখে রেখেছি, গাছটিকে তুমি মুঠোর মধ্যে রাখ। তুমি বললে, সেদিন থেকেই তুমি শিউলি হয়ে গেছ, যেদিন স্পটিকের মত এক স্বচ্ছ শিউলি তুমি উপহার পেয়েছিলে। তার গায়ে লেগেছিল অঘ্রাণ-শিশির। এই হেমন্তকাল নিয়ে খুব সমস্যা জানো তো; হেমন্ত মানুষকে প্রেমে পড়ার শিক্ষা দেয়। হেমন্তে মন জাগে, হেমন্তে স্পর্শ হয় স্পর্শতর; হেমন্তে জাগে মনের সীমারেখা।
আমার সব কথাই তুমি মনে দিয়ে শুনলে, কিন্তু এই শেষ কথাটা তুমি তখন মানতে চাইলে না, মনে পড়ে? জানালে, মনের সীমারেখা বলে কোনো কিছু নেই তোমার কাছে। মন হল মন, যেমন অঘ্রাণ; যেমন হেমন্ত, যেমন শিশির; যেমন তোমার আঙ্গুলের ছোঁয়া। এর চেয়ে বেশি কিছু আর ভাবতে পারি না। কারণ হেমন্তকাল আমাকে অতদূর অবধি অধিকার দেয়নি যে তোমাকে একটু ছুঁতে পারি; তার মানে এই নয় যে, ছুঁলেই তুমি শিউরে উঠবে; বরং এতটুকু ছোঁয়ার আমার মনে জেগে উঠবে হাজারো পুলক। তখন যে কথাগুলি শুরু হবে আমার মনে, আমার প্রাণে; আকাশের ঐ গ্রহ-তারার ভেতর; বাতাসের ঝুম-ঝুম প্রবাহের ভেতর; আমি ভেসে যেতে পারি—আমাকে টেনে নিয়ো তোমার নৌকায়।
এখানে কোনো নৌকা নেই, ফুটে আছে মাটির পিদিম। তোমার ওই দোতলাবাড়ি, সেখানে পিদিমের আলো; তোমার ঐ ঘরের পিছনে আমার একলা আকাশ; তোমার কথারা সেই আকাশে তারা হয়ে ঝুলে আছে। এখন আর চিঠি লেখে না কেউ, উঠে গেছে গ্রিটিংস কার্ড-এর জমানা; আমাদের সময়ে ঐ-সব ছিল, জানো। তখন তুমি বললে, জানি না কে বললে? জানি, শুনেছি। কলেজে ভর্তি হলে; পড়াশুনো না করে, ওইসব করে বেড়িয়েছ। তখন একবারও আমার কথা ভাবনি; মনে আননি একবারও; ঘুরে বেড়িয়েছ না-জানি কার না-কার সঙ্গে।
আমি হেসে উঠি। বলি, তখন তুমি কোথায়? হয়ত ফ্রক পড়ো, হয়ত বেলা করে ঘুমাও, দু’বেলা বিনুনি কর; জানোই না মন কী, তাকে কীভাবে ভালোবাসা যায়। হয়ত তখন তোমার প্রেমে পড়া বারণ, ছেলেদের দিকে তাকানো বারণ; ইত্যাদি আরো কিছু—তখন তুমি জানলে কীকরে ভালোবাসা কী বস্তু? একলা থাকো মাটির দোতলায়, নিচে মাঠ-বাউল গান গেয়ে যায়। তুমি তার গান শুনে সেই যে নীচে নামলে না; জেনে রেখো, আমি ছিলাম সেই বাউল; তোমায় সেদিন শুনিয়েছিলাম ধান ভাঙার গীত। তুমি বললে, হ্যাঁ গো হ্যাঁ, এসব হল তোমার কথা ঘোরানোর ছল; কেবল আমাকে দূরে রাখতে চাও এই কথার ছলে; দেখবে, একদিন এত কাছে আসব, সেদিন ফেরাতে পারবে না, ঘোরাতে পারবে না, হারাতে পারবে না; তুমি-আমি রয়ে যাব পাশাপাশি, চিরকালটা।
এর পর কতদিন চলে গেল; গঙ্গানদীর ধারে, বৃহৎ বটের নীচে গালে হাত রেখে চুপ করে একা একা বসে থাকি। দেখি, কত স্রোত ভেসে যায়; ডিসেম্বর যায়, ডিসেম্বর আসে। ছেলে বলে, বাবা, আগেরবারও নিয়ে যাওনি, এবার কিন্তু সায়েন্সসিটি যাবই যাব—আমার ক্লাস ফ্রেন্ড-রা সবাই ঘুরে এসেছে; কেবল আমিই বাদ। এবার না-হলে আমি কিন্তু খুব কাঁদব, আগে-ভাগে বলে দিই।
বলি, সায়েন্সসিটি তো সকলেই যায়। মনে করলে কালই আমি যেতে পারি। তোর ছোটবেলার কথা মনে আছে? তখন ডিসেম্বরে প্রায়দিন তোর গা-গরম থাকত। ফলে তোকে নিয়ে কোথাও যেতে পারতাম না আমরা; ভ্রমণের বাতাসে যদি তোর জ্বর বাড়ে! এখন তুই বড় হয়ে গেছিস, খুব ছোট তুই তখন; মনে করতিস, আমি আর অঘ্রাণমাস একসঙ্গে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি—মনে পড়ে? দ্যাখ, মানুষের জীবনে দু’বার সেই অঘ্রাণ ঘুরে ফিরে আসে। অঘ্রাণ হল হেমন্তকাল, আমাদের ডিসেম্বর। তখন তোর মনে হত, কোথাও ধান কাটা হচ্ছে, কেটে শুইয়ে রাখা হচ্ছে ধান। এবার এই ডিসেম্বরে এবার তোকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাব, দেখলে চমকে যাবি। দেখানে আছে একটি মাটির দোতলাবাড়ি। তার লাগোয়া যে জমি, সেখানে জিরে, ধনে মৌরি চাষ হয়। সেই গ্রামের নাম শিউলিগ্রাম, সেখানের সব গাছের নাম শিউলগাছ, সেখানের নদীর নাম শিউলিনদী, পাখির নাম শিউলিপাখি, সব ফুলের নাম শিউলিফুল, প্রবাহিত সমস্ত বাতাসের নাম শিউলিবাতাস। যাবি তুই?
যাব বাবা, যাব যাব। শুনে খুব ভালো লাগল। সায়েন্সসিটি না-হয় পরেই যাব। এখন চলো, ঘুরে আসে সেই শিউলিগ্রাম। তবে...এই শিউলি নামটা আমার চেনা—হয়ত ছোটবেলায় শুনেছিলাম। এই নামে কী আমার কোনো বন্ধু ছিল? তোমার কোনো বন্ধু ছিল? আমাদের দু’জনের সে-কোনো একজন বন্ধু ছিল? বলে সে নিজেই নিজের মাথায় চাপড় মেরে বলে, ঠিক মনে পড়ে না—যাঃ!
ওকে বলি, চল তবে। দু’জনে মিলে নদীর ধারে যাই। গিয়ে বসি। দেখি কীভাবে স্রোত বয়ে যায়, পাখিরা বাতাসকে পাশ কাটিয়ে নদী পার হয়, ইলিশ লাফায়; ঝরে পড়া পাতারা কীকরে শূনে চলমানভাবে আটকে থাকে।
সে মহা-ভাবিত হয়ে বলে, তোমার কথা শুনে এখুনি যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমরা কীসে যাব?
কেন, নৌকায়। নদী পেরুতে গেলে নৌকাই তো ভরসা।
কার নৌকা? ঘাটে তো কোনো নৌকা বাঁধা নেই। ঢেউ-এর ধাক্কায় সে ছল্লাৎছল দোলেও না। নৌকা নেই, ফলে কোনো মাঝিও নেই। আমাদেরও কোনো নৌকা নেই; কারণ আমাদের কোনো মাঝি নেই।
আসবে নৌকা। জলে ভেসে ভেসে আসবে, একাকী এক নৌকা। তাতে চেপে বসব আমি আর তুই। তুই হাল ধরবি, আমি নৌকা বাইব। নৌকা ভেসে যাবে সমুদ্দূরে। যাবি তো?
যাব, বাবা। গঙ্গা পেরুলেই কি শিউলিপুর?
হ্যাঁ। তবে আমাদের খুঁজে নিতে হবে।
কোনোদিন যাওনি তুমি?
না-রে। কিন্তু না-গেলেই বা, খুব জানি সেখানে উজ্জ্বল রঙ্গের ফসল হয়; আর সেই দোতলা মাটিরবাড়ি একলা থাকে। একা-একাই আকাশের সঙ্গে কথা বলে। আর জলে ভেজা গন্ধরাজ তারা হয়ে ফুটে থাকে আকাশে।
ছেলে বলে, আচ্ছা বাবা, নৌকার নাম কী?
ডিসেম্বর।
আর এই মাসের নাম?
ডিসেম্বর।
তবে আমাদের নাম?
ডিসেম্বর।
আর সেই মেয়েটির নাম? যে একাকী হেঁটে যায় অঘ্রাণের মতন? হয়ত তার নাম ছিল শিউলি?
সে হল ডিসেম্বর।
তবে আমি আর ডিসেম্বর পাশাপাশি হেঁটে যাব—বেশ হবে না?
আমরা দু’জন গঙ্গানদীর ধারে নীরবে পাশাপাশি বসে থাকি, কিন্তু কোনো নৌকা আসে না। কোনো জেলেনৌকাও নেই যে তাকে ধরে পার হয়ে যাব এই শূন্যতার পথটুকু। সেখানে বাতাস নাচে, রোদ নামে; নদীজলের গুঁড়ো স্তূপ সেই শূন্যে স্থিত হয়। তখন আমরা দু’জন বসে বসে নদীর ওপারের সেই শিউলিগ্রাম, মাটির দোতলাবাড়ি; জিরে-ধনে-মৌরির খেত; পুকুরে মাছ খেলা করার দৃশ্য, পাকা আমড়াফল আর ধান কেটে শুইয়ে রাখার দৃশ্য দেখতে থাকি। তখন আমার ছেলে অঘ্রাণ চেনে। অঘ্রাণ-এর জন্য উপহার হিসেবে একটি ঝরাপাতা হাতে নিয়ে সে বসে থাকে।
মতামত লিখতে দ্বিধা হয়। এমননি নির্জন লেখা। বাচালতায় যদি এ লেখার তন্ময়তা ভঙ্গ করি।
হেমন্তের ঝরাপাতা হাতে যে বালক বসে, তার মুখ দেখি নি। হাওয়া বাতাস নদী জল রোদে ভেসে থাকা ধুলি কণা 'বিবাহের মন্থর আয়োজন' মনে হয়।
এ এক অপূর্ব পাঠ। অসম্ভব ভালো লাগা জানাই।
ভাল লাগল। আরও চাই।
কী অদ্ভূত সুন্দর লেখা . খুব জানতে ইচ্ছে করছে কি ভাবনা নিয়ে লিখতে বসেছিলেন . শারদীয়ার মরশুমে এখনো অব্দি পড়া সবথেকে সুন্দর লেখা .