কাহিনির কথক একজন লেখক। নামি লেখক এবং পুরুষ। লিখেছেন এক তরুণীর বিদ্রোহের কাহিনি। বস্তুত কাহিনিটি সকল নারীর জীবনের অসহ্য টানাপড়েন এবং তার থেকে বেরিয়ে আসার যন্ত্রণাদগ্ধ প্রয়াসের লিখিত প্রকাশ-সাধন। আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থায় সুদীর্ঘ সময়কাল ধরে নারী-পুরুষ সম্পর্ককে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সকলেই যে দৃষ্টিতে দেখে তার চলমানতার বিরুদ্ধে কোনোরকম রাখঢাক না রেখে খোলামেলা কথায় ও আচরণে প্রতিবাদ শানিয়েছে এক তরুণী, সমগ্র নারীজাতির প্রতিনিধি হয়ে। কথক-লেখকের ভূমিকা সেখানে কাহিনির প্রথম থেকে কৌতূহল জাগিয়ে রাখে, পাঠক-মনে শেষ পর্যন্ত। তিনি তরুণীটির থেকে বয়সে দু-গুণ বড়ো। তবুও তরুণী তাঁকে বিশ্বাস করে নিজের সব কথা বলে বন্ধুর মতো এবং রাত বাড়লে চলে তাদের কথা বলা ও শোনা আধুনিক প্রযুক্তি-সৃষ্ট যন্ত্রের মাধ্যমে। লেখক মানুষটি তার কথা বা বিশ্বাসের বিরোধিতা করেন না, আবার স্পষ্ট ভাষায় সমর্থন জানান যে, তা-ও না। তরুণীর আস্থা জন্মেছে তাঁর লেখা পড়ে এবং নির্বিরোধী শ্রোতা হিসেবে তাঁকে পেয়ে। সে প্রবল বিদ্রোহী হয়ে ওঠার জমি পেয়ে যায় সেভাবে। লেখার ধরনে লেখক প্রচলিত রীতি-নীতি না মেনে এতটাই আধুনিকতা বরণ করেছেন যে, পাঠককে মাঝে মাঝেই সূত্র হারিয়ে খুঁজে ফিরতে হয় কে, কাকে, কখন কী বলছে এবং তার নিহিতার্থ। তাতে অবশ্য পাঠকের পাঠ-প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পায় এবং লেখকের মনোবাসনাও সাফল্য পায়। শেষ পর্যন্ত পড়ে কাহিনি কোথায় পৌঁছেছে জানার তীব্র আকর্ষণ তৈরি হয়। কাহিনির বিস্তার ঘটেছে সীমিত পরিমণ্ডলে এবং মাত্র কয়েকটি মূল এবং উপ-চরিত্রের মাধ্যমে।
দ্য টোয়াইনিং অফ আদম অ্যান্ড ইভ ইন দ্য গার্ডেন অফ ইডেন। শিল্পী মিরিয়াম শাপিরো (সৌজন্য—উইকি আর্ট)
তরুণীটির নাম জীবন্তিকা। নিঃসন্দেহে নামটি তাৎপর্যবাহক। সে জন্ম থেকেই মেয়ে বলে চূড়ান্ত উপেক্ষার শিকার হয়েছিল। মা-বাবার প্রথম সন্তান মেয়ে এবং তারপর জন্মায় যমজ সন্তান, তাদেরই একজন জীবন্তিকা। বাকিজন পুরুষ সন্তান। অবাঞ্ছিত সন্তান বলে তাকে টাকা দিয়ে অন্যের ঘরে মানুষ করতে পাঠানো হয় এক মহিলার কাছে। জীবন্তিকার বঞ্চনার শুরু এভাবে শিক্ষিত চাকুরিজীবী মা ও বাবার ব্যবস্থাপনা থেকেই। তারপর বালিকা-বয়সে স্কুল-শিক্ষকের বিকৃত কামের শিকার হতে হয় তাকে। কৈশোর পার হওয়া মাত্রই সে প্রেমে পড়ে বিয়ে করে ফেলে মোহাভিভূত হয়ে। মোহভঙ্গ হতে দেরি লাগে না। জোর করে তখন তার বিয়ে দেওয়া হয়। সে বিয়েও তার জীবনে গলায় ফাঁসের মতো মনে হয়। মা-বাবার গঞ্জনা নিয়মিত শুনতে হয়। সে যদি বিয়েটি না মানে তাহলে সমাজে তাদের অর্জিত বিপুল পরিমাণের বা ওজনের ‘মান-সম্মান’ বিসর্জিত হবে। অতএব তার প্রতি তীক্ষ্ণ তর্জনী তোলা চলতেই থাকে। এক তরুণকে সে পাশে পায়। কৃষ্ণবর্ণের যুবক। তাও আবার তাদের মতো অর্থবান নয় তার মা-বাবা। জীবন্তিকার মা-বাবা ক্ষেপে যায়। মা তো যুবকটিকে ‘কালো কাক’ বলে ঘৃণা প্রদর্শন করে। কটাক্ষ করে তাদের অর্থাল্পতাকে। তরুণী নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠে তাতে আরও।
সে সময় কাটাতে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, সোশ্যাল মিডিয়া—এ সবে মগ্ন হয়ে যায়। তার স্বামী অম্তিক বড়ো মাপের চাকুরিজীবী। মাসে বেশ কিছুদিন বাইরে থাকতে হয় তাকে। ঘরেও অফিস তুলে আনে। স্ত্রী রয়েছে। আছে এই মাত্র। শরীরের প্রয়োজনে সে তো তৃপ্তি জোগানোর মাধ্যম মাত্র। এমন করেই ভাবে সে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে। জীবন্তিকা তার শরীরী চাওয়াকে মান্যতা দেয় না। সেকারণে সে প্রশ্ন তোলে কঠিন আওয়াজে—‘সম্পর্ক’? একে বলে ‘সম্পর্ক’? এতকাল ধরে মেনে চলা হয়েছে বলে মেনে নিতে হবে এই ‘সম্পর্ক’-কে! সে পারছে না। পারবে না। জীবন তাকে অনেক সত্য জানতে-বুঝতে শিখিয়েছে। সে সব শোনায় প্রতি রাতে তার অসম-বয়সী লেখক শুভার্থীকে। লেখকের কলমের মুখে রূপ পায় সেসব কথা। পাঠককে ভাবায়। চিরাচরিত ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলা নারী-পুরুষ ‘সম্পর্ক’ কি আদৌ কোনো ‘সম্পর্ক’? সম্পর্কে থাকে মন ভরানো দেওয়া-নেওয়া। অথচ এ যাবৎ মেয়েরা কেবল দিয়েই যাবে এমন ভাবনাকে সুদৃঢ় করা হয়েছে সমাজ-জীবনের বাস্তবতায়। ঘরের আসবাব যেন তারা। ঘরের শোভা তো বটেই এবং সেই সঙ্গে পরিবারের সকলের জন্য সর্বক্ষণ তৎপর হয়ে থাকবে নিজের কথা ভুলে থেকে এই সামাজিক সত্যে কোনো মিথ্যের ঠাঁই নেই।
জীবন্তিকা চায় এই মিথ্যে সম্পর্কের মৃত্যু বা অবসান। সে স্বাধীনচেতা। সে ইচ্ছেমতো কথা বলবে, আলাপে মাতবে যন্ত্র-মাধ্যমে অথবা সাক্ষাতে যার সঙ্গে চায় তার সঙ্গে। সমাজচক্ষু তাতে রাঙা হয়ে ওঠে কেন? সমাজের সৃষ্ট পুরুষ (এবং মেয়েরাও) কেন কেবল মেয়েদের পিছনে লেগে থাকে দোষ ধরার জন্য? তার স্বামীও তার অতীত নিয়ে তাকে ‘অপরাধী’ বানায় এবং নিজেকে মহান ভাবে সেই মেয়েকে বিয়ে করেছে বলে! সে চায় স্ত্রী তার বশংবদ হয়ে থাকুক। সে ক্ষমা করে দিয়েছে তাকে সেকথা সর্বক্ষণ মনে রাখুক। সে ‘সম্পর্ক’ ভাঙতে চায় না। সমাজ-গড়া প্রাণী যে সে। সমাজের সকলে কী ভাববে তাতে? সেই ভাবনায় সে তাড়িত বলেই বিয়ে ভাঙতে চায় না। জীবন্তিকা মেনে নিক এই পারিবারিক সত্যতা। জীবন্তিকা সে পথে চলতে চায় না। সে মুক্তি চায়। সম্পূর্ণ মুক্ত জীবন তার কাম্য। কোনো জবাবদিহি কারও কাছে দিতে সে সম্মত নয়। সে অনেকগুলি প্রশ্ন নিয়ে ছটফট করে। সংগত উত্তর পায় না কোথা থেকেও। লেখক-কথকের স্ত্রী শুভ্রা তাকে স্নেহ-ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধেছেন। নিজেও তারা সমাজের তাড়া খেয়ে, ভালোবেসে নাস্তানাবুদ হয়ে, ঘর বেঁধেও বিদ্ধ হয়েছেন নানাভাবে। কিন্তু শুভ্রা বিদ্রোহের কথা ভাবেননি কখনও। সমাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজেদের ‘সম্পর্ক’কে নষ্ট করতে পারেননি। সমঝোতা করতে হয়েছে। করতেই হয়—এমন শিক্ষাই শুভ্রা গ্রহণ করেছেন নিজে শিক্ষিকা হয়েও। তিনি চান, জীবন্তিকা ও অন্তিক ঘর না ভাঙুক। অন্তিকও তা চায় না। তিনি তাতে তার বিশিষ্টতা খুঁজে পান পুরুষ হিসেবে এবং তার প্রশংসা করে জীবন্তিকাকে বিদ্রোহের পথ থেকে সরে গিয়ে মিলে-মিশে ঘর বাঁচানোর লক্ষ্যকেই আঁকড়ে ধরতে বলেন। তিনি এই তরুণীটিকে মায়ের মতো ভালোবেসেও তার মত সমর্থন করতে পারেন না। ঘর জোড়া লাগাবার পরামর্শ দেন। বলেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক জন্ম-জন্মান্তরের। জীবন্তিকা মানে না সে প্রচলিত বিশ্বাস। সে অনেকগুলি প্রশ্ন তুলে ধরে শুভ্রার স্বামী তথা কথক-লেখকের (নাম জানা যায়নি) কাছে। সেগুলি একত্রে তুলে ধরা যেতে পারে—
১। যমজ সন্তানের মধ্যে মেয়েটিকে অন্যের ঘরে পাঠালেন প্রেম করে বিয়ে করা দম্পতি, শিক্ষিত ও অর্থশালী হওয়া সত্ত্বেও! সেই মেয়ে জীবন্তিকা। সমাজ এমন অপরাধ মেনে নেয় কেবল মেয়েদের জীবনে ঘটলে—কেন?
২। তার শিক্ষক তাকে ‘নষ্ট’ করে প্রথম। আর সমাজ জানতে পারলে তাকেই ‘নষ্ট’ বলে ছাপ মেরে দিত! দিয়েছেও ভুল করে প্রেমের বিয়ে করে ঘর ভেঙেছে বলে। যে ছেলে তাকে ভুলিয়ে বিয়ে করেছে সে অপরাধী বা ‘নষ্ট’ নয় কেন? শিক্ষক গোপনীয়তা মেনেছে। কিন্তু সে যদি তা সকলকে বলে দিত তা হলে কে ‘নষ্ট’ বলে গণ্য হত অন্যায় ভাবে? মেয়ে বলে সে-ই! কেন এই বীভৎস বৈষম্য সমাজে আজও বলবৎ?
৩। তার দিদি প্রেমে পড়ে ঘর ছাড়ার পর সে-ও যখন বিয়ে করে ঘর ছাড়ল, লোকনিন্দায় শহরে কান পাতা দায় হয়েছিল। তার বাবার মন্দ মেয়েভাগ্যের কথায় উত্তাল হয়েছিল সমাজের মানুষজনেরা। কেন? কেন সমাজের এত মাথাব্যথা মেয়েরা স্বাধীন হতে চাইলে?
৪। ‘অসংখ্য অসুখী দম্পতি সারাজীবন ধরে নিজের সাথে নিজের শত্রুতা বয়ে নিয়ে যায়’। কেন? সমাজের ভয়ে?
৫। আমি কি নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে এসেছি?—জীবন্তিকা জানতে চায়।
৬। একটি ছেলেকে সে ভালোবাসে। সে তার বাবার বিপদে তাকে সাহায্য করার পরও (অন্য কোনো সাহায্য যখন মেলেনি) মা তাকে বলে তার সঙ্গে না মিশতে। সে তখন বলে—উপকারটি নেবে আর মেয়ে তার সাথে ঘুরলেই সমাজের চোখরাঙানিতে যাওয়ার ভয়ে যদি তোমরা উতলা হও তাহলে তেমন ‘মান-সম্মান’ মানি না আমি। তা কি যথার্থ মান-সম্মান?
৭। একই বেড পার্টনার (একাধিক জনের) হওয়ার কাজে পুরুষরা গর্ববোধ করে আর মেয়েরা ‘নষ্ট’ বলে গণ্য হয় কেন? তাদের মাথা নত করতে হয় কেন?
৮। বিবাহিত জীবনে মেয়ে বাপের বাড়িতে বেশিদিন থাকলে সমাজের মাথাব্যথা বেড়ে যায় কেন?
৯। সত্যি ভালোবাসলে জীবন্তিকাকে যে তরুণ তার মা এবং জীবন্তিকার মা-বাবা তাদের বিয়েতে আপত্তি জানাল। প্রথমজন মেয়ের আগে বিয়ে হয়েছিল বলে এবং দ্বিতীয়পক্ষ ছেলের পরিবার ধনী শ্রেণিভুক্ত নয় বলে। জীবন্তিকার কথা কেউ ভাবল না কেন? মেয়ে বলে?
১০। ঘটা করে বিয়ে দিয়ে মেয়ের দেহের পবিত্রতা রক্ষার সামাজিক কায়দা-কৌশলে সে বিশ্বাসী নয়। সে প্রশ্ন তোলে— ‘মনের মতো একজন মানুষ চাই যার কাছে আনন্দ পাব।’ মেয়ে বলে সমাজ-সংসার সে অধিকার কেড়ে নেয় অবলীলায়—কেন?
জীবন্তিকা জেনেছে অনেক মূল্য দিয়ে ‘... জীবন এক উপলব্ধি, এক দর্শন, মুক্ত চিন্তার উড়ান। যাপনের প্রতি অনুপলকে স্পর্শ করা’। এর নাম ‘মুক্ত জীবন’। এই মুক্তি, সে বুঝেছে, ‘নিজের কাছে নিজের মুক্তি’। আমাদের সমাজে মেয়েরা সে মুক্তির স্বাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত। সুদীর্ঘকাল ধরে চলছে এই বঞ্চনা। এই বঞ্চনা থেকে মুক্তির গালভরা নাম হয়েছে— ‘নারীমুক্তি’। সে মুক্তি নয়। জীবন্তিকা চায় সেই মুক্তি যার অর্থ নিজের ‘ইচ্ছেডানায় ভর করে’ নিজের পছন্দমতো উড়তে পারা। সমাজ সেখানে নাক গলাবে না! ডানা ভাঙতে চাইবে না ভয়ংকর দৈত্যের মতো! ‘জীবনকে বাজি রেখে প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সে এক নতুন সত্যের জন্ম দিতে চায়’।
শেষে সে তার অসমবয়সী পুরুষবন্ধুটির সঙ্গে স্বেচ্ছায় শরীরী সম্পর্ক গড়ে তোলে। আনন্দ উপভোগ করে। দু-জনেই। তারপর? এই পুরুষবন্ধুটি আত্ম-দহনে দগ্ধ হয়। জীবন্তিকার হেল-দোল বোঝা ভার! শেষে কথক-লেখক তথা পুরুষবন্ধু ও তাঁর পত্নী শুভ্রার আয়োজনে জীবন্তিকা তীব্র অনিচ্ছা প্রকাশ করেও অন্তিকের কাছেই ফিরে যায়।
পাঠকের মনে হবে—শেষ হইয়াও হইল না শেষ! আদি-অন্ত-কালের নারীমুক্তি-কামনা কি তাহলে স্বপ্নের বেলুন মাত্র! বহু বহু দূর পর্যন্ত আকাশে ওড়ার পরও ফেটে যাওয়াই তার নিয়তি?
লেখক ফজলুল হককে ধন্যবাদ। পাঠকদের তিনি চিন্তা করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছেন। তথাপি না বলে পারা যায় না যে কে, কখন, কোথায়, কার সঙ্গে কথা বলছে, পড়তে পড়তে মাঝে মাঝেই কেমন বিভ্রান্তি তৈরি হয়। কাহিনি রচনার এটাই কি আধুনিকতম রীতি বলে তিনি বেছে নিয়েছেন, অথবা এটি তাঁর নিজস্ব সৃজন-ধরন? বর্তমান পাঠকের তা জানা নেই। মুদ্রণ প্রমাদে ঠেকে যেতে হয়েছে বারংবার এবং ‘ড়’ এবং ‘র’-এর ব্যবহারে ভ্রান্তিও বিরক্তির কারণ হয়েছে। এতৎসত্ত্বেও সাধুবাদ জানাই লেখককে, নারীমুক্তির পথানুসন্ধানে পাঠকদের উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছেন বলে। আজও এই প্রক্রিয়া প্রাসঙ্গিক!
মৃতরাত্রিপুরাণ উপন্যাসটির বিষয়ে লেখক ফজলুল হকের ভাবনা এখানে শুনুন
আলোচনা ভাল লাগল
দশটি প্রশ্নই বহুচর্চিত। তবে পুরুষের কলম থেকে বেরোচ্ছে, সেটা ভাল খবর।