এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • গান্ধী, দু একটি সিনেমা ও কিং অফ গুড টাইমস

    শ্রাবণী
    আলোচনা | বিবিধ | ০৫ এপ্রিল ২০০৯ | ৮৪৫ বার পঠিত
  • আজ মৃত্যুর প্রায় ষাট বছর পরে তিনি সবার কাছে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে দোসরা অক্টোবরের ছুটির কারণ হয়েই রয়ে যেতেন যদি না বিধুবিনোদ, রাজু হিরানী আর সর্বোপরি সঞ্জয় ডাট থাকত। আমাদের ডিকশনারীর নতুন লব্ধ শব্দ "গান্ধীগিরি" আজকাল টপ ফ্যাশনে। ফুল ও মোমবাতি বিক্রেতাদের পৌষমাস! আজ যে দেশের কোণে কোণে বাচ্চা বাচ্চা জানে গান্ধীর নাম, তার কৃতিত্ব অবশ্যই মুন্নাভাইয়ের। যা ইতিহাসের বই,স্কুলের পাঠ করতে পারেনি তা করে দেখিয়েছে বলিউডের মহারথীর দল। তাতে কি হল যদি আজ গান্ধীজীকে একজন টাডা অপরাধী, প্রাক্তন ড্রাগ অ্যাডিক্ট, তাঁর জীবনদর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর এক লোকের হাত ধরে জনমানসে ফিরতে হয়!

    প্রাক মুন্নাভাই কালে ইদানীং "দেশের জনক" বাপুজীর উল্লেখ বিশেষজ্ঞদের লেখালেখি আর বিতর্কের বাইরে খুব একটা দেখা যেতনা। অবশ্য গুজরাটে, তার নিজের রাজ্যে হয়ত কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। এ ছাড়া সারা দেশে মাঝে মাঝে এর ওর লেখায় কিছু বিতর্কিত প্রসঙ্গ, তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে মুখরোচক চাটনি খবর কিছু অথবা তার রাজনৈতিক আদর্শের, জীবনধারার নির্দয় কাটাচেরা। এই জাতীয় খবর অল্পসময়ের জন্য নিউজে এসেই আবার বুদবুদের মত মিলিয়ে যেত। দেশের আমজনতা এ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে বলে শোনা যায়নি। স্কুল কলেজ ও নানান সরকারী প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালেও অবশ্য ফ্রেমবদ্ধ তাকে দেখা গেছে বা যায় অথবা টাকার নোটে। তবে সেসব আর কে খুঁটিয়ে দেখে! একটা বড় সংখ্যক দেশবাসীর তো আবার এসবকিছু দেখার বিশেষ সৌভাগ্য হয়না।

    কিন্তু "মুন্নাভাই" এর কথা আলাদা! সে তো দেখা যায় টেলিভিশনে, ভিডিও হলে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাঠে পর্দা টাঙিয়ে, শহর থেকে প্রোজেক্টর এনে। বিনোদনের এই শক্তিশালী মাধ্যম দেশের সব প্রান্তে প্রায় সমস্ত দেশবাসীরই ধরাছোঁয়ার মধ্যে।

    পুরনো আমলে, এই ধরুন ষাট সত্তরের দশকে, প্রচলিত হিন্দী সিনেমার ফর্মূলায় প্রায়শই দেখা যেত এক গান্ধীবাদী চরিত্র, হয় গ্রামের স্কুলের মাস্টার বা শহরের বস্তির সমাজসেবী। পরনে খদ্দর, মাথায় গান্ধীটুপি, কাঁধে ঝোলা। এদের মুখে সত্য অহিংসার বাণী, সাথে ফ্রেমে ক্লোজআপে গান্ধীর ফোটো। তবে এরা হীরো হতনা, হীরো গান্ধীবাদী হলে ভিলেনকে মারবে কে! উল্টে এরা অহিংসার কথা বলতে বলতে মার খেত জমিদার বা মালিকের গুন্ডাদের হাতে, কপাল ফেটে রক্তটক্ত পড়ত আর হীরো এসে সেইসব গুন্ডা, জমিদার মালিকদের মেরেধরে ঠান্ডা করত। অর্থাৎ অহিংসা দিয়ে কিস্যু হাসিল হয়না, এটাই সার বোঝানো হত এইসব সিনেমায়। তবু এভাবেও গান্ধীর উল্লেখ করা একটা ফর্মূলার অঙ্গ ছিল। কেন?

    এক শ্রেনীর শিক্ষিত নাকউঁচু আরবান এলিট দর্শকরা যতই দেশী ছকের সিনেমা দেখে ছি ছি করুক না কেন, এটা স্বীকার করতেই হবে কোথাও না কোথাও ফর্মূলার ছবি নিশ্‌চয়ই সফল, নাহলে এত টাকা খরচা করে লোকে এধরণের ছবি বানায় কেন। কোনোখানে অবশ্যই এই ছকের মাস অ্যাপীল আছে বা ছিল।

    সে যুগে সিনেমায়, গান্ধীবাদী চরিত্র, গান্ধীর ছবি, বাণী এসব গল্পের ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেওয়ার রীতি ছিল এই কারণে যে দেশের আমজনতা তখনও গান্ধীর কথা স্মরণ করত। যুগের সাথে সাথে ফর্মূলা পাল্টানোর মানে হল আসলে জনতার পছন্দ অপছন্দও বদলে গেছে। এভাবেই আস্তে আস্তে এধরণের গান্ধী আশ্রিত চরিত্র হারিয়ে যায় প্রচলিত সিনেমার ছক থেকে। ব্যতিক্রম অবশ্যই সেইসব সিনেমা যা কখনো দেশের স্বাধীনতা বা গান্ধীর জীবন কাহিনী নিয়ে তৈরী!

    আশির দশকে এরকমই এক ছবি অ্যাটেনবরোর "গান্ধী", কিছুটা গান্ধী জোয়ার নিয়ে আসতে সক্ষম হয়, যদিও তা দেশের থেকে বিদেশেই বেশী সফল হয়। সে ছবি ছিল শুধুই গান্ধীকে নিয়ে, তার জীবনের ঘটনাবলী নিয়ে কাহিনী। ছবিটির কারণে বিশ্বের জনগণ গান্ধীজিকে নিয়ে নতুন করে ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করেছিল। ব্র্যান্ড গান্ধীর আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছিল এই সিনেমাটির রিলিজের পর। গান্ধী নিজের দেশবাসীর কাছে দোষগুণে একজন বড় নেতা হিসেবেই শ্রদ্ধা বা সমালোচনা পেয়ে আসতেন। এই সিনেমাটির বিষয়বস্তু ও পরিবেশনা তাঁকে প্রাচ্যের এক সন্ত মহাত্মা বানিয়ে ছেড়ে দেয় বিশ্বের বাজারে। এই ছবির সাফল্যের ফলে বিশ্বের কমার্শিয়াল দুনিয়ায় "সেইন্ট অফ দ্য ইস্ট" গান্ধীর পণ্য মূল্য এতটাই হয় যে তা এতবছর পরেও প্রায় অপরিবর্তিত, তাই আজ দোসরা অক্টোবর বিশ্ব অহিংসা দিবস। আজকের যুগেও বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানী তাদের বিজ্ঞাপনে গান্ধীজির ছবি দেখিয়ে বলছে "থিঙ্ক ডিফারেন্ট"। শুধু তাই নয়, হালে গান্ধীজীকে দেখা যাচ্ছে টেলিভিশনের অ্যাডে, তা আবার যে সে অ্যাড নয় বেস্ট সেলিং অ্যাড!

    অথচ এদেশে "গান্ধী" ছবিটি করমুক্ত হওয়া সত্ত্বেও একদল এলিট ক্লাস ও স্কুলের ছাত্রদের শিক্ষামূলক সিনেমা হিসেবেই চলেছিল। হিন্দী ডাবিং করা সত্ত্বেও সেই অর্থে সাধারণ জনতাকে বিশেষ আকর্ষিত করতে পারেনি। তাদের কাছে তা ছিল, "ক্যা বেকার গান্ধীবাবা কি সনিমা, কোই নাচা গানা কুছ নহী হ্যায়!" সোজা কথায় তখনও স্বদেশে,পুরনো চেনা অবতারেই তার আবছা উপস্থিতি।

    প্রায় দুই যুগ পরে একেবারে অন্যরকম "মুন্নাভাই" ছবিটা পাল্টে দিল। নাচাগানা মারধাড় আর সর্বোপরি "গান্ধীগিরি" নিয়ে এ দেশের ভিন্নরুচির দর্শকদের হদৃয়ের খুব কাছে চলে আসে মুন্নাভাই, সেইসঙ্গে বাপুও। তাই দেখে দেশের হাল আমলের সংবাদমাধ্যম আর অন্যান্য মিডিয়াও মুন্নাভাইয়ের কাঁধে চড়ে লেগে যায় গান্ধী ব্র্যান্ডকে এদেশে প্রতিষ্ঠা করতে। গান্ধীগিরিকে হিপহপ বানিয়ে জেনারেশন এক্সের যোগ্য করে তুলেছে সঞ্জয় মুন্নাভাই। সুযোগ বুঝে দ্বিগুণ উৎসাহে গান্ধীগিরি নিয়ে মাতামাতি করতে লাগল মিডিয়া ও অ্যাড দুনিয়া। এখন গান্ধীগিরি শব্দ ছোট বড় সবার মুখে লেগে আছে। ছোটোরা শিখছে কম্যান্ডোর বিপরীত হল গান্ধীগিরি। এও জানছে গান্ধীর আদর্শ হল প্রতিবাদে মোমবাতির মিছিল করা বা শত্রুকে শায়েস্তা করতে ফুল পাঠানো। সত্য, অহিংসা,স্বদেশী এসব যা আগেকার দিনে গান্ধীর ইউ এস পি ছিল তা উঠে গিয়ে আজ হাতে আছে ফুল আর মোমবাতি!

    মুন্নাভাই পরবর্তীতে গান্ধী হাওয়া কিছুটা গতি হারিয়ে গতানুগতিকে প্রায় ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় আবার টিভির পর্দায় স্ক্রোল করতে দেখা গেল ব্রেকিং নিউজ! এবারে শিরোনামে তাঁর চশমা, চটি, পকেটঘড়ি ও থালা বাটি। একজন মানুষ যিনি দেশের অন্যতম প্রধান নামীদামী ব্যক্তিত্ব হয়েও সারাজীবন অত্যন্ত সাদাসিধে আড়ম্বরহীন জীবন যাপন করেছেন, তাঁর কিছু নিত্য ব্যবহার্য জিনিস। এখানে বলে রাখা ভাল যে গান্ধীর এই সরল জীবন যাত্রার পোস্টমর্টেম করে যেসব তথ্য প্রমাণ দেয় বিশেষজ্ঞরা তা এই লেখার বিষয় নয়। তার গরিবী রহনসহন কে অত্যন্ত দামী ও মূল্যবান গরিবী বলে বর্ণনা করেছে অনেকেই। সেসব বিতর্কিত প্রশ্নে না গিয়ে কোটি কোটি সাধারণ দেশবাসীর কাছে গান্ধীজির যে ছবি তাকেই আমরা মেনে নেব এই আলোচনায়। সবরমতী আশ্রমের এক সাদামাটা গৃহী সন্ন্যাসীর জীবনের ছবি।

    মহাত্মা হয়ত তার ইহজীবনে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেননি যে তার এই ব্যক্তিগত নিত্য ব্যবহারের সামান্য জিনিস কটি একদিন এক আধ নয় প্রায় দশ কোটি টাকায় বিক্রি হবে। প্রথমে সঞ্জয় দত্ত, এখন বিজয় মালিয়া! গান্ধীর ও গান্ধীবাদীদের মদ্যপানের বিরুদ্ধে লড়াই সর্বজনবিদিত। তারই ফলস্বরূপ গান্ধীর দেশ গুজরাট ভারতের একমাত্র ড্রাই স্টেট, সেখানে মদ্য পান আজও নিষিদ্ধ (হালে মুখ্যমন্ত্রী এস ই জেড কে এই ব্যানের আওতার বাইরে বলে ঘোষণা করেছে)। আজ গান্ধীর জিনিস নীলামে কিনে নিয়ে দেশের বাহবা কুড়োচ্ছে এক মদ্যব্যবসায়ী, লিকিওর ব্যারন!

    কট্টর গান্ধীপ্রেমীরা প্রাথমিক ভাবে গান্ধীর জিনিসের এরকম বাণিজ্যিক করণে আপত্তি জানাচ্ছে এই বলে যে এ ধরণের বস্তুবাদ গান্ধীর ধ্যানধারনার, আদর্শের বিপরীত। এ নিয়ে পাতার পর পাতা তর্ক বিতর্ক করা যায়। সে প্রসঙ্গে না গিয়ে শুধু এই নীলামী প্রসঙ্গে কথা বলা যাক।
    নীলামীকে কেন্দ্র করে তার আগে ও পরে বিভিন্ন মহলের যে নাটক, ও মিডিয়ায় যে ধরণের কভারেজ পায় এই ঘটনা তা সত্যই খুব মনোরঞ্জক। প্রথমে শোনা যায় সরকার এই নীলামী বন্ধ করার জন্যে সবরকম চেষ্টা চালাচ্ছে। আমেদাবাদের নবজীবন ট্রাস্ট, আইনত যাদের দায়িত্বে আছে গান্ধীজির যাবতীয় জিনিস, তারা দিল্লী হাইকোর্টে পিটিশন করে নীলামীর বিরুদ্ধে। কোর্টও অন্তর্বর্তী নিষেধাজ্ঞা জারি করে অকশন হাউসের ওপর। চারিদিকে একটা "গেল গেল" রব ওঠে, দেশের মান সম্মান বুঝি আর থাকেনা। জাতির জনকের জিনিস দেশের বাইরে কোন খেয়ালী ধনীর সংগ্রহশালা আলো করবে এই ভেবে অনেকেই অশ্রুপাত করতে থাকেন।

    মিডিয়ায় বিরোধী, সরকারপক্ষ ও গান্ধীর পরিবারের লোকেদের বক্তব্যের চাপানউতোরে সরগরম হয়ে উঠল চারধার। এরই মাঝে সযতনে যে ব্যাপার এড়িয়ে গেল সবাই তা হল জিনিসগুলো এতদিন আছে একজনের ব্যক্তিগত সংগ্রহে, এবং সেই মানুষটি বিদেশী। নীলামী না হলেও সে ওগুলো ভারতে ফিরিয়ে দিতে নাও পারে। ধরে নেওয়া যায় অত্যন্ত ব্যক্তিগত এই জিনিসগুলি গান্ধীজির মৃত্যুর পরে তার কাছের লোকজনের হাতেই আসে। হয় তারা গান্ধীজির ভক্ত ছিল নয় আত্মীয় পরিবার পরিজন। তাদের হাতছাড়া হয়ে কিভাবে এই স্মারকগুলো বিদেশী সংগ্রাহকের হাতে পৌঁছল তা সম্বন্ধে প্রায় সব রিপোর্ট ই নীরব। সে ব্যাপারে কথা না বলে তাঁর বংশধরেরা প্রথমে মিডিয়ার সামনে চোখের জল ফেলেন, দেশবাসী ও সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করেন জিনিসগুলি দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। পরে নীলামী শেষে এরা দু হাত তুলে বিজয় মালিয়ার জয়জয়কার করে, তার জন্য গর্ব প্রকাশ করে, সবই মিডিয়ার সামনে!

    সরকার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যে মালিয়া তাদেরই একান্ত আপন, সরকারের হয়েই সে একাজ করেছে। যদিও মালিয়া নিজের পকেট থেকে দশ কোটি খরচ করে সরকারের জন্য এরকম কাজ করবে কেন সে ব্যাপারেও কেউ কথা বলছেনা! মালিয়াকে কি কোনোভাবেই দুর দুর অবধি গান্ধীভক্ত বলা যায় বা মহান দেশপ্রেমী? সাধারণ দেশবাসী ও গান্ধীপ্রেমীদের কাছে গান্ধীজি আত্মত্যাগ ও বলিদানের প্রতীক। মালিয়া তার বিশাল বিত্ত বা তার মানানসই জীবনধারা নিয়ে সেই আদর্শের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বিপরীতধর্মী এক চরিত্র! এর আগে কোনো ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে তার দেশকে নিয়ে বা গান্ধীকে নিয়ে মাথাব্যথা নজরে পড়েছে কি?

    যখন আমরা গান্ধীর মতাদর্শের থেকে এত দুরে সরে গেছি, তখন তাঁর কিছু স্মারক নিয়ে আমাদের এত চিন্তা, এত হৈচৈ কেন? এর পুরোটাই কি মিডিয়ার তৈরী অথবা পলিটিশিয়ানদের নন ইস্যুকে ইস্যু বানানোর খেলা? গান্ধীজির যেসব জিনিস আমাদের দেশে আছে, তাদের নিয়ে কেউ কি কোনো আগ্রহ দেখায়। গান্ধীজির কয়েকটা জিনিস এদেশে রইল কি বিদেশে রইল তাতে কি খুব বেশী তফাত কোথাও হবে সত্যিকারের গান্ধীপ্রেমীদের মনে?
    আসলে এদেশের অনেক কিছুর মতই এখানেও মূল প্রতিমাটা গৌণ। ঢাক, ঢোল, আলো,বাজনা, আতসবাজি ও সবশেষে বিসর্জন এগুলো মুখ্য ছিল। নীলাম মানেই কোটি কোটি টাকার হাঁকডাক, বুক ধুকপুক উত্তেজনা, কে জেতে কে হারে! পুরো বলিউডি ক্লাইম্যাক্সে এসে দেশী হীরো জিতে যায় বাকী সবাইকে হারিয়ে দিয়ে। অত:পর জোর হাততালির মধ্যে দিয়ে পর্দা নামে,দর্শকের পুরো পয়সা উসুল! গান্ধী নয় আসলে মালিয়াই আমাদের হীরো, আদর্শ। মুখে গান্ধীর নাম নিয়ে আমরা মনে মনে পূজা করছি মালিয়ার মানি পাওয়ারকে। এর চেয়ে বড় ট্র্যাজিক পরিণাম আর কি হতে পারে গান্ধীজির স্মৃতির?

    সরকার বলছে মালিয়া তাদের হয়ে এ কাজ করেছে যদিও মালিয়া একাধিকবার তা অস্বীকার করেছে। তার বক্তব্য সে দেশের কথা ও গান্ধীর নামের সঙ্গে জড়িত দেশবাসীর ভাবপ্রবণতার কথা ভেবে এই নীলামীতে অংশগ্রহণ করেছে। নি:স্বার্থভাবে সে দেশকে এসব জিনিস ফিরিয়ে দেবে বলে। তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম এ সরকারেরই জিত। তা যদি হয় তাহলে দেশের জনগণের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ এভাবে ব্যয় করার অধিকার তাদের হয় কি করে? এর আগে ২০০৭ এ গান্ধীর চিঠিও নীলামে কিনেছিল সরকার, কত দিয়ে তা জানানো হয়নি। দেশের সরকার যখন মালিয়ার মত লোকের সাহায্য নেয় গান্ধীজির জিনিস দেশে ফিরিয়ে আনতে তখন তাদের মুখে গান্ধীর সিদ্ধান্ত, মতবাদের কথা অর্থহীন হয়ে ওঠে! সেক্ষেত্রে তাঁর স্মারকেরও কোনো মূল্যই থাকেনা।

    অনেকে এও মনে করে যে নীলামীর আগে সরকারের বিভিন্ন মহলের নানা ধরনের বিবৃতি, নীলামী ঠেকানোর চেষ্টা ইত্যাদি ও তাই নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ার কভারেজ, নীলামীর মূল্য অযথা বাড়িয়ে তুলেছিল। আরও শোনা গেছে স্মারক গুলির মালিক জেমস ওটিস নীলামীর ঠিক আগের মুহুর্তেই নীলামী বন্ধ করতে চায় ও ভারত সরকারকে জানায় যে জিনিসগুলি সে ভারতে ফিরিয়ে দিতে রাজী যদি সরকার তার শর্ত মানে। অবশ্যই সরকার রাজী হয়নি, কারণ শর্ত ছিল সরকার দেশে গরীবদের হেলথকেয়ার খাতে খরচ বাড়াবে। তবে এ তথ্য কতটা সত্যি আর কতটা মিডিয়া কল্পনাপ্রসূত তা যাচাই করার উপায় নেই!

    এখানেই শেষ নয়, পিকচার আভি বাকী হ্যায়! মালিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগে তার নীলামীতে অংশগ্রহণের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করলেও স্মারকগুলি নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহে না রেখে দেশকে দান করার কথা ঘোষণা করেছে। মালিয়ার দেশের জন্য এই কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের মহানুভবতা অবশ্যই চারিদিকে সাড়া ফেলে দিয়েছে। মালিয়া এই কোটি কোটি টাকা গরিবী কমাতে বা শিক্ষাখাতে খরচা করলে নিশ্‌চয়ই তার মহানতা সম্পর্কে এত প্রশংসা, আলোচনা হত না। এরকম তো অনেক বিজনেস হাউসই করে থাকে চ্যারিটি ট্যারিটি, ও আর নতুন কি? উল্টে দুর্জনে এর মধ্যে অন্য কিছু কারচুপির সম্ভাবনাও দেখে ফেলত।

    প্রাথমিকভাবে প্রচুর পরস্পরবিরোধী অসংগত বিবৃতির পর সরকারপক্ষ এই সংক্রান্ত ব্যাপারে মন্তব্য করা বন্ধ করে দিয়েছে পাছে ইলেকশনের সময় বেফাঁস কিছু বলা হয়ে যায়। নীলামের সামগ্রী গুলিও এখনো মালিয়ার হাতে এসে পৌঁছয়নি। যতদিন না ইউ এস জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট এখানকার হাই কোর্টের পিটিশনের ওপরে কোনো মতামত দিচ্ছে, ততদিন তা আসবেওনা। এমনও হতে পারে যে ভারত জিনিসগুলো বিনামূল্যেই পেয়ে গেল, নীলামী বাতিল হয়ে গেল। তা হলে আবার নানামহলের বিবৃতির ও কৃতিত্ব নেওয়ার পালা শুরু হয়ে যাবে। আর তা না হলে বিজয় মালিয়াই ওগুলির মালিকানা পেয়ে যাবে, এবং সম্ভবত কোনো নাটকীয় উৎসবের মাঝখানে ঘটা করে দেশকে তা দান করবে। হয়ত কিং অফ গুড টাইমসের সব কিছুর মত সেই ঐতিহাসিক দিনকে সেলিব্রেট করতে জমকালো পার্টিও থাকবে পানভোজন ও সেলিব্রিটি সহকারে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট গান্ধী আর চরকার সিল্যুট, "রঘুপতি রাঘবে" র সুরে ডান্স ফ্লোর মাতাবে নামী দামী তৃতীয় পাতার তারকারা!

    মৃত্যুর এতবছর পরে আজ নানা মহলে গান্ধীর উল্লেখ হয় শুধু নানা বিষয়ে তাঁকে নিয়ে নানান বিতর্কে। হয়ত ভবিষ্যতে তাও হবেনা, গান্ধীজির নাম নেওয়া হবে শুধু সঞ্জয় দত্ত বা বিজয় মালিয়া প্রসঙ্গে! যতই হোক এদের মত লোকেদের জন্যই তো বাপু ফিরে ফিরে নিউজে আসে। নাহলে এই ফাস্ট ফরওয়ার্ড যুগে কে আর ওরকম প্রাচীন নেতাটেতাদের মনে রাখে যদি না দোসরা অক্টোবর উইকডেজে পড়ে!

    এপ্রিল ৫, ২০০৯
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৫ এপ্রিল ২০০৯ | ৮৪৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন