সঞ্জয় দে মূলত নন-ফিকশন ধারার লেখক। এই পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ—‘রিগা থেকে সারায়েভো’, ‘ভিয়েনার ক্যাফে সেন্ট্রাল’, ‘বলকানের বারুদ’, ‘স্তালিনের বাস্তুভিটায়’ আর ‘আমেরিকার টুকরো গপ্পো’। বইয়ের নাম থেকে পাঠক আঁচ করতে পারেন যে সঞ্জয় দে ভ্রমণকাহিনি লেখক। কিন্তু শুধু এইটুকু ভাবলে তাঁর প্রতি অন্যায় করা হয়। তিনি নিছক ভ্রমণকাহিনি লেখেন না। সাধারণ ভ্রমণকাহিনিগুলোতে একটা জায়গায় কেন গেলাম, কী করে গেলাম, কোথায় থাকলাম, কী কী দেখলাম, কী কী করলাম, কী কী খেলাম ইত্যাদি থাকে। সঞ্জয় দে-র ভ্রমণকাহিনিতে সেগুলোর বেশিরভাগই অনুপস্থিত। বরং সেখানে আছে একটা স্থানের সাধারণ মানুষের গল্প, সেই গল্পের ভেতর দিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে চোখ রাখা, সেই স্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিখ্যাত-কুখ্যাত মানুষদের কথা, সাধারণ মানুষের স্বপ্ন ও সেই স্বপ্নে শ্বাপদের ছায়ার কথা, প্রকৃতি, স্থাপনা, শিল্প, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা প্রভৃতির কথা। সঞ্জয় দে অনলাইন মাধ্যমের পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকা আর সাময়িকীগুলোতে নিয়মিতভাবে এই বিষয়ে লিখে যাচ্ছেন।
‘রিগা থেকে সারায়েভো’ বইটিতে পূর্ব ইউরোপের আটটি দেশ ভ্রমণ নিয়ে মোট পনেরোটি অধ্যায় আছে। পোল্যান্ড ভ্রমণ নিয়ে পাঁচটি অধ্যায় ‘কোপার্নিকাসের দেশে’, ‘আউসভিতযের আতঙ্ক’, ‘ক্রাকভের ঈগল ফার্মেসী’, ‘লবণ খনির পাতালপুরী’, ‘মায়দানেক ক্যাম্পে’। এখানে পোল্যন্ডের এখনকার জীবনযাত্রার সঙ্গে সাম্প্রতিক ইতিহাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা, ভয়াবহ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প আর গণহত্যা, সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ, প্রচলিত গল্প আর তার সঙ্গে পোল্যান্ডের প্রকৃতি, স্থাপত্য ও মানুষের গল্প বলা হয়েছে। পোল্যান্ড নিয়ে বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর বাইরে কিছু অজানা অধ্যায়ের উপরেও আলোকপাত করা হয়েছে।
লিথুয়ানিয়া ভ্রমণ নিয়ে দুটি অধ্যায় ‘ভালোলাগার ভিলনুস’, ‘ভিলনুসের যমালয়’। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে লিথুয়ানিয়ার ওপর প্রতিবেশি রাশিয়ার আগ্রাসন, ঔপনিবেশিক শাসন, ত্রাসের রাজত্ব আর গণহত্যার কথা। বাংলাভাষী পাঠকদের বেশির ভাগের কাছে ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলো অজানা।
হাঙ্গেরি ভ্রমণ নিয়ে একটি অধ্যায় ‘বুদাপেস্টে বিমোহিত’। এটিতে হাঙ্গেরির পুরোনো ইতিহাসের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের খবরদারির আমলের কথা উঠে এসেছে। সময়ের স্বল্পতায় হাঙ্গেরি ভ্রমণের গল্প শুধু রাজধানী নগরীতে সীমাবদ্ধ হয়েছে।
লাটভিয়া ভ্রমণ নিয়ে একটি অধ্যায় ‘দুগাভা নদীর তীরে’। ভ্রমণটি লাটভিয়ার রাজধানী রিগাতে সীমাবদ্ধ। এই শহরে লেখকের ত্রিশ বছর আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এসেছিলেন। স্বাভাবিকভাবে দুগাভা নদীর তীরের বাসিন্দাদের গল্পের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রসঙ্গও এসেছে।
বসনিয়া ভ্রমণ নিয়ে দুটি অধ্যায় ‘মোস্তারের প্রস্তর সেতু’, ‘সারায়েভোর স্নাইপার’। প্রথমটি ছোটো শহর মোস্তারের আর দ্বিতীয়টি রাজধানী শহর সারায়েভোর গল্প। অবধারিতভাবে এখানে বর্ণিত হয়েছে সার্বিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের নির্মম শিকার বসনিয়ানদের কথা। সেই সঙ্গে এসেছে বলকান অঞ্চলের জটিল জাতিগত বিদ্বেষ ও যুদ্ধের দীর্ঘ ইতিহাসের কথা। এসেছে বসনিয়ার স্থাপত্য ও সংস্কৃতিতে তুর্কি প্রভাবের কথা এবং জনপ্রিয় বসনীয় খাবারের কথা। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে যুদ্ধের নামে বসনিয়ায় চালানো নৃশংস গণহত্যাগুলোর কথা।
সার্বিয়া ভ্রমণ নিয়ে একটি অধ্যায় ‘মার্শাল টিটোর সমাধিতে’। রাজধানী বেলগ্রেডে সীমাবদ্ধ এই অধ্যায় এবং এর বড়ো অংশ জুড়ে আছে যুগোশ্লাভিয়ার অবিসংবাদিত নেতা জোসিপ ব্রোজ টিটোর কথা।
ক্রোয়েশিয়া ভ্রমণ নিয়ে একটি অধ্যায় ‘দুব্রভনিকে মুগ্ধতায় দ্রবীভূত’। দুব্রভনিক ক্রোয়েশিয়ার প্রধান কোনো শহর নয়, বরং মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন মন্টানেগ্রো সংলগ্ন ছিটমহলের একটি শহর। দুব্রভনিকের চোখ-ধাঁধানো বিচিত্র প্রকৃতির বর্ণনার সঙ্গে এর জটিল ইতিহাস প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণিত হয়েছে।
শেষে বুলগেরিয়া ভ্রমণ নিয়ে দুটি অধ্যায় ‘ভিতুশা পাহাড়ের নিমন্ত্রণে’, আর ‘সোফিয়া থেকে দূরে কোথাও’। রাজধানী সোফিয়া আর তার সংলগ্ন কিছু প্রাচীন শহর, গ্রাম, আশ্রম, গির্জা ইত্যাদি ভ্রমণ নিয়ে এই দুই অধ্যায়। সঙ্গে আছে সাম্প্রতিক বুলগেরিয়ার ইতিহাস, প্রকৃতি আর এখনকার নাগরিকদের জীবনের কথা।
লেখকের ভ্রমণের বেশিরভাগ অংশ সড়ক বা রেলপথে হওয়ায় পথের বর্ণনাগুলো বাড়তি পাওনা। বইটিতে কাহিনির সঙ্গে উপযুক্ত ছবিও আছে। তবে খরচ কমানোর উদ্দ্যেশ্যে ছবিগুলো সাদা-কালো আর আকারে ছোটো হওয়ায় তাতে পাঠকের আশ মিটবে না। তা ছাড়া ছবিগুলোর মান যথেষ্ট উন্নত নয়। বোধকরি লেখক নিজেই ছবিগুলো তোলায় এমনটা হয়েছে। এর পরেও বিষয়ের বৈচিত্র্যে, উপস্থাপনের দক্ষতায়, ভাষার সাবলীলতায় সর্বোপরি ভ্রমণকাহিনিকে ভিন্ন আঙ্গিকে পাঠকের সামনে হাজির করার বৈশিষ্ট্যে সঞ্জয় দে-র ‘রিগা থেকে সারায়েভো’ বাংলা ভাষায় সাম্প্রতিক ভ্রমণকাহিনি-ভিত্তিক প্রকাশনাগুলোর মধ্যে অনন্য।
বাংলা সাহিত্যের বর্তমানকালের পাঠকদের কাছে মুহম্মদ জাফর ইকবাল সুপরিচিত নাম। তাঁর লেখা বিজ্ঞান ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই, বৈজ্ঞানিক কল্প উপন্যাস, ছোটোগল্প, ভ্রমণকাহিনি, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে বিশ্লেষণ পাঠকমহলে ব্যাপক জনপ্রিয়। পাঠককুল ফেব্রুয়ারি মাস আসলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন এবছর তাঁর কী কী বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। ‘গ্রামের নাম কাঁকনডুবি’ মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এই উপন্যাসের মূল পাত্রপাত্রী কিশোর বয়সী এবং এর উপস্থাপন কিশোরদের উপযুক্ত হলেও কাহিনির ব্যাপকতা ও গভীরতায়, বিষয়ের বৈচিত্র্যে উপন্যাসটি সববয়সী পাঠকের জন্য উপযুক্ত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যেসব পাঠকের ধারণা স্পষ্ট বা সম্পূর্ণ নয় এই উপন্যাসটি পাঠে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ এবং তাঁদের যুদ্ধকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সেসব পাঠকের ধারণা হয়ে যাবে।
কাঁকনডুবি নামের বাংলাদেশের এক গ্রামের কিশোর রঞ্জুর জবানিতে উপন্যাসটির কাহিনি শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার কয়েক মাস আগে থেকে ডিসেম্বরে বিজয়ের পরের সময় পর্যন্ত। রঞ্জুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধের প্রথম অভিঘাতে পিতা-হারানো কিশোরী ডোরা, যে ভয়ে নুয়ে পড়ে না বরং দুর্বীনিত সাহসে জ্বলে ওঠে চুল কেটে ছোটো করে বালক সেজে নিজেই প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাঁকনডুবি গ্রামটি বাংলাদেশের আর দশটি গ্রামের মতো, যেখানে নানা রকমের মানুষ আছে, ফসলের খেত আছে, নদী আর ছোটো জঙ্গল আছে, স্কুল আছে, চায়ের দোকান আছে। সেখানে হিন্দু-মুসলিমরা একসঙ্গে থাকেন, চায়ের দোকানে রাজনৈতিক আলাপ করেন, সবাই সবার খবর রাখেন। গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবন মুক্তিযুদ্ধের প্রচণ্ড অভিঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ থেকে কেউ কেউ যেমন মুক্তিযোদ্ধা হন, মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হন, তেমন কেউ কেউ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হয়। দেশের মাটি-মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা মানুষগুলো পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে মিলে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ চালায়। এমন ঘটনাগুলো কেবল বড়োদের মনেই পরিবর্তন আনে না, সেই সঙ্গে কিশোরদের মনেও ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করে। একসময় তারাও মুক্তিযুদ্ধের অংশ হয়ে যায়, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে।
উপন্যাসটির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে কাঁকনডুবির পরিপার্শ্বের ও এর মানুষদের বর্ণনা। এতে পাঠক বলাইয়ের চায়ের দোকান, কাজিদের ফুলের বাগান, রঞ্জু বা ডোরাদের বাড়ি, স্কুলঘর, কালীগাং নদীর সব কিছু কেমন তা আপনা থেকে বুঝে যাবেন। কোনো মানচিত্র ছাড়াই পাঠক বুঝতে পারবেন হানাদারেরা কোন্ দিক থেকে আক্রমণ করতে পারে আর মুক্তিযোদ্ধারা কোন্ দিক থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন। আরাফাত করিমের করা ভেতরের অলংকরণ পাঠকদের কল্পনাকে ছুটিয়ে নিতে বাড়তি সহযোগিতা জোগাবে। কলেজপড়ুয়া ছাত্র মাসুদ কী করে সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হয় আর ফালতু মতি কী করে রাজাকার হয় সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ না দেখা পাঠক বুঝে যাবেন অতি অল্প সময়ে কী করে মানুষের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধে মানুষের প্রাণ হারানো, সর্বস্ব হারানো, নির্যাতিত হওয়া—এমন বিষয়গুলো উপন্যাসের কাহিনিতে এমনভাবে আনা এবং বর্ণনা করা হয়েছে যে তাতে পাঠক মুক্তিযুদ্ধকালে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলোর ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়ে যাবেন।
উপন্যাসটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের নাম দেওয়া হয়েছে কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক রাজাকার-আল বদর নেতাদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে—যেমন, মতি বা কাদের। এতে গল্পের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের ওই নামগুলোরও পরিচয় হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা ভয়াবহ মাত্রার ধর্ষণের বিষয়টি স্পর্শকাতর একটি অধ্যায়। উপন্যাসটি কিশোরদের জন্য হলেও এখানে সেই ব্যাপারটিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। ধর্ষণের বর্ণনা না দিয়েও তা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে পাঠকের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠতে বাধ্য। উদ্ধৃতি দিলে ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে।
‘মেয়েগুলো আমাদের দিকে তাকাল, চোখের দৃষ্টি এত আশ্চর্য যে আমার বুকটা ধক করে উঠল। এত তীব্র দৃষ্টি আমি কখনও দেখিনি, সেখানে কোনো ভয় বা আতঙ্ক নেই, দৃষ্টিটা আশ্চর্য রকম তীক্ষ্ম। আমি কী বলব, বুঝতে পারলাম না। ঢোঁক গিলে বললাম, “আপনাদের আর কোনো ভয় নাই। যুদ্ধ শেষ। খোদার কসম। যুদ্ধ শেষ।”
লালচে চুলের একটা মেয়ে, যার চোখের দৃষ্টি সবচেয়ে ভয়ংকর, সে আস্তে আস্তে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “তোমাদের যুদ্ধ শেষ। আমাদের যুদ্ধ শুরু”।’
এই উদ্ধৃতির কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। এমনসব অনেকগুলো কারণে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ডজন ডজন উপন্যাসের মধ্যেও ‘গ্রামের নাম কাঁকনডুবি’ ব্যতিক্রমী এবং অবশ্যপাঠ্য।
গত পনেরো বছরে বাংলা সাহিত্যের জগতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনটি এসেছে, সেটি হচ্ছে অনলাইন মিডিয়ার আবির্ভাব। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং ইন্টারনেটে বাংলা ভাষা চর্চার সুযোগ এই সিংহদ্বারটি খুলে দিয়েছে। ফলে অনলাইন মিডিয়াসমূহে ব্যাপক সাহিত্য চর্চার প্রসার ঘটেছে এবং নতুন নতুন লেখক জন্ম নিয়েছেন। অনলাইনে যাদের বাংলা লেখা পাঠককুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে মাহবুব আজাদ তাঁদের অন্যতম। এই পর্যন্ত পাঠককুল তাঁর পাঁচটি ছোটোগল্প সংকলন ও একটি কমিক বই পেয়েছেন। অপেক্ষাকৃত নবীন লেখক হলেও ভাষার দক্ষতায়, বিষয়ের বিচিত্রতায়, কাহিনি নির্মাণশৈলীতে তাঁর মুন্সিয়ানা প্রশংসনীয়। এ ছাড়া কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয় শ্রেণির পাঠকদের জন্য সাবলীল ভাষায় লেখার ক্ষমতার জন্য মাহবুব আজাদ আগামী দিনে বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।
হাবুলের জলদস্যু জাহাজ, বুলুদের বারান্দায় চড়ুইগুলি, আলোদাদুর গল্প, শিলাবৃষ্টির গল্প, মিতুন যেদিন ডাল রাঁধলো, দাদিভাইয়ের বাগান, বইদাদু, বড়বুর কাছে লেখা চিঠি, গুড্ডুর সাইকেল শেখা আর অন্য রকম গন্ধ—এই দশটি গল্প নিয়ে মাহবুব আজাদের ‘হাবুলের জলদস্যু জাহাজ’ একটি কিশোর গল্প সংকলন।
এই গল্প সংকলনের সবচেয়ে সেরা গল্প ‘মিতুন যেদিন ডাল রাঁধলো’। শহুরে পরিবারে গ্রাম থেকে নিয়ে আসা কিশোরী গৃহকর্মী আর তার সমবয়সি গৃহকর্তার কন্যাকে নিয়ে গড়ে ওঠা এই গল্পের কাহিনিটা হয়তো একটু সিনেমাটিক, কিন্তু তা একেবারেই বেমানান নয়। গল্পের অন্তিম অংশ যে ধাক্কা দেয়, যে পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় তা পাঠককে গভীরভাবে ভাবাবে। কিশোর মননের জন্য এটি যথোপযুক্ত গল্প। গল্পের মান বিবেচনায় এই সংকলনে এরপরে রাখা যায় ‘গুড্ডুর সাইকেল শেখা’-কে। বড়োরা শিশু-কিশোরদেরকে ঠিকঠাক বুঝতে পারেন না—কখনও বয়সের তুলনায় তাদের ওপর বেশি গুরুভার চাপিয়ে দেন আর কখনও নিতান্ত দুগ্ধপোষ্য ভাবেন। এই গল্পটিতে কিশোরদের ভাবনা ও সক্রিয়তা যথাযথভাবে পরিমাপ করে চিত্রায়িত করা হয়েছে। ‘দাদিভাইয়ের বাগান’ গল্পটি এই ধারাতে পড়লেও সেটির মান এই গল্পটির পর্যায়ের নয়; বরং ‘হাবুলের জলদস্যু জাহাজ’, ‘বড়বুর কাছে লেখা চিঠি’ আর ‘অনেক রকম গন্ধ’ বালক মননকে আরও ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে।
‘হাবুলের জলদস্যু জাহাজ’ একেবারে ভিন্ন মেজাজের গল্প। ছোটোবেলার বেয়াড়া ইচ্ছেকে কল্পনার সঙ্গে বাড়তে দেবার এক চমৎকার গল্প। হাবুলের বেয়াড়া ইচ্ছেকে কেউ ধমক দিয়ে থামিয়ে দিচ্ছে না, কেউ ব্যঙ্গ করে খাটো করছে না। বরং তার সামনে একটার পর একটা সমস্যা দেওয়া হচ্ছে যা সমাধান করার জন্য সে মাথা খাটাবে, পরিকল্পনা করবে। আজকের এক/দুই সন্তান-বিশিষ্ট নিউক্লিয়াস পরিবারের কিশোরদের কাছে ‘বড়বুর কাছে লেখা চিঠি’র মতো গল্প হয়তো খুব বেশি আবেদন রাখবে না, তবু এমন বড়ো বোন থাকার ব্যাপারটি তাদের তন্ত্রীতে আঘাত করবে। যেসব পাঠকের বয়স ত্রিশের ওপরে তাদের কাউকে গল্পটি স্মৃতিমেদুর করতে পারে। বেশি ভাইবোন থাকুক বা না থাকুক, ভাইবোনদের মধ্যকার দুর্নিবার ভালোবাসা, মিষ্টি দ্বন্দ্ব এখনকার কিশোরদের কাছেও অবোধ্য নয়, এই মায়াটি সবাই টের পান। তাই গল্পটি সবার কাছে আবেদনময় হওয়ার মতো।
‘অনেক রকম গন্ধ’ একটা চিরায়ত গল্প। প্রতিটি শিশু জ্ঞান অবধি এই অভিজ্ঞতা আর ভালোলাগার ভেতর দিয়ে গেছে। তাই এই গল্পটিকে তাদের অনেক আপন মনে হবার কথা। ‘বইদাদু’ গল্পটি শিশু/কিশোরদের গল্প হিসেবে না ভেবে সাধারণ গল্প হিসেবে ভাবাটা ঠিক হয়। কারণ, জমানো বইয়ের ভবিষ্যত নিয়ে এখানে যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে সেটা হয়তো কিশোরদের পুরোপুরি বোধে আসবে না। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যারা বই কিনতে, বই জমাতে ভালোবাসেন, তাদের প্রত্যেকের মনে এই ভাবনা হয়—আমার অবর্তমানে আমার বইগুলোর কী হবে? প্রত্যেকটি বইয়ের সঙ্গে যে এক-একটি গল্প জড়িয়ে থাকে সেটি বইয়ের মালিকদের উত্তরসূরীদের পক্ষে বোঝা কঠিন। এমন গল্প এখনকার কিশোরদের মনে সেই ভাবনাটি হয়তো জাগাতে সাহায্য করবে।
‘বুলুদের বারান্দায় চড়ুইগুলি’, ‘আলোদাদুর গল্প’ আর ‘শিলাবৃষ্টির গল্প’ এই সংকলনের দুর্বল সংযোজন। কারণ এগুলো পুরোপুরি গল্প হয়ে উঠতে পারেনি। এগুলোর কাহিনি আরও বিকাশের দাবি রাখে। শিশু-কিশোর পাঠকরা এতটুকুতে সন্তুষ্ট হয় না। বইয়ের ছবিগুলো সাদা-কালো এবং কয়েকটি ছবি আড়াআড়িভাবে (ল্যান্ডস্কেপ) দেওয়াতে একেবারে বেমানান লেগেছে। তা ছাড়া ছবিগুলো ঠিক পাতা-ভরাও নয়। পাতা-ভরা ছবি না হলে শিশু-কিশোর পাঠকদের মন ভরে না।
গদ্যসাহিত্যের মধ্যে ছোটোদের জন্য লেখা সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন। বেশিরভাগ লেখক কিছু ন্যাকা ন্যাকা গল্প লিখে ভাবেন—ছোটোদের জন্য বেশ গল্প লিখে ফেললাম। বাস্তবে ছোটোরা ওসব গল্প গ্রহণ করে না। শিশুরা আগামী দিনের মানুষ, তাই তাদের জন্য গল্প লিখতে গেলে নিজেকে আরও আধুনিক, আরও অগ্রসর চিন্তার করে তুলতে হয়। ছোটোদের মন, মনন না বুঝলে তাদের উপযুক্ত, তাদের পছন্দের গল্প লেখা যায় না। তাদের গল্পে পৃথিবীটাকে তাদের চোখে দেখতে হয়, ঘটনাগুলোকে তাদের মতো করে বিশ্লেষণ করতে হয়। আর ছোটোদের জন্য লেখার বেশির ভাগ মাঠে মারা যায় সেগুলোকে ‘উপদেশমূলক’ আর ‘শিক্ষামূলক’ করার অর্বাচীন চেষ্টায়। চিনির প্রলেপ দিলেও ওষুধের বড়ি যে ওষুধই থেকে যায় এটা ছোটোরা খুব ভালো করে জানে। এসব বিবেচনায় এই গল্প সংকলনের গল্পগুলো সর্বাংশে শুধু উতরেই যায়নি বরং উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে গেছে। যারা ছোটোদের জন্য লিখতে চান ‘হাবুলের জলদস্যু জাহাজ’ তাদের জন্য একটি ভালো উদাহরণ।
গত এক দশকে বাংলা সাহিত্যে যেসব শক্তিমান লেখকের আবির্ভাব ঘটেছে তাঁদের মধ্যে হরিশংকর জলদাস অন্যতম। উপন্যাস, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণকাহিনি প্রভৃতি গদ্যসাহিত্যের ধারায় তাঁর অনায়াস বিচরণ আছে। নিম্নবর্গের মানুষদেরকে খুব কাছ থেকে দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকায় তাঁর লেখায় সেসব মানুষদের জীবন ও স্বপ্নের প্রকৃত রূপ ফুটে ওঠে। সেটি তাঁর উপন্যাস ‘জলপুত্র’ বা ‘দহনকাল’ অথবা তাঁর আত্মজীবনী ‘কৈবর্তকথা’ পড়লে স্পষ্ট হয়। ‘কসবি’ উপন্যাসটি বারাঙ্গনাপল্লির বাসিন্দাদের কাহিনির সঙ্গে এর অতীত ইতিহাস ও মানুষগুলোর অন্য জীবনের গল্প নিয়ে লেখা।
বারাঙ্গনাদের জীবন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে রচনা খুব কম নয়। সেই বিবেচনায় হরিশংকর জলদাসের এই উপন্যাসটি কেন বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে, সেটি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। চট্টগ্রাম মহানগরের বারাঙ্গনাপল্লীকে কেন্দ্র করে রচিত এই উপন্যাসে ঔপনিবেশিক আমলে কী করে এর গোড়াপত্তন হয় সেখান থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত এর বিকাশের ইতিহাস অনেকটা ফুটে উঠেছে। একটি বিশেষ বারাঙ্গনাপল্লীকে কেন্দ্র করে তার ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারণাটি উল্লেখযোগ্য। একজন নারী কী কী উপায়ে বারাঙ্গনাতে পরিণত হন ঔপন্যাসিক তার বিশদ এবং বাস্তব বর্ণনা দিয়েছেন। তাতে গল্প বারাঙ্গনাপল্লির বাইরেও বিস্তৃত হয়েছে। সেখানে নিম্নবর্গের মানুষের জীবনসংগ্রামের ছবিটিও খুঁটিনাটিসহ উঠে এসেছে–-বিশেষত চট্টগ্রাম ও নরসিংদী অঞ্চলের মানুষের। এই উপন্যাসের একটা বড়ো দিক হচ্ছে বারাঙ্গনাপল্লির ভেতরের নিখুঁত চিত্র, যা বেশিরভাগ পাঠকের অভিজ্ঞতার বাইরে। এই চিত্র আঁকতে গিয়ে তিনি বারাঙ্গনাপল্লি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গণের মানুষের জীবনচিত্রও নিখুঁত এঁকেছেন।
বারাঙ্গনাপল্লি সংশ্লিষ্ট মানুষদের বিস্তারিত জীবনচিত্র আঁকতে গিয়ে ঔপন্যাসিক অনেকগুলো গল্প, অনেকগুলো চরিত্র আর বহুমাত্রিক ক্যানভাস নির্মাণ করেছেন। ছোটো পরিসরে এত বড়ো কাজ করতে গিয়ে বিষয়টা কিছুটা ঘেঁটে গিয়েছে। তাতে কিছু গল্প জোরজার করে শেষ করতে হয়েছে, কিছু বিষয় আরোপিত ভাবে এসেছে। উপন্যাসের ক্যানভাসে গল্পের সংখ্যা বেশি বলে প্রত্যেকটা গল্প দ্রুত শেষ করার একটা প্রবণতা এখানে লক্ষ করা যায়, এতে বিশেষ কোনো চরিত্র বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। এই কারণে উপন্যাসটি যখন শেষ হয় তখনও পাঠকের মনে হতে পারে এটা এখনও শেষ হয়নি। বারাঙ্গনাপল্লির সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট থাকে সমাজের ক্ষমতাকাঠামো ও কর্তৃত্বকাঠামো সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি গণের মানুষ। ঔপন্যাসিক এই উপন্যাসে বারাঙ্গানাপল্লির ভৌগোলিক চৌহদ্দির বাইরের সেই গণগুলোর মানুষগুলোকে প্রায় বিবেচনার বাইরে রেখে দিয়েছেন। ফলে কোনো কোনো পাঠকের কাছে এমন একটা আপাতধারণা সৃষ্টি হতে পারে যে এই আদিম ব্যাবসায় বুঝি আর কারও সংশ্লিষ্টতা নেই। বারাঙ্গনাপল্লিগুলোর আসল মালিক, চালিকাশক্তি ও নিরাপত্তাদাতারাও গোটা উপন্যাসে অনুপস্থিত। এগুলো উপন্যাসটির অপূর্ণাঙ্গতা।
এর পরেও উপন্যাসটি জীবনঘনিষ্ঠতা, সাবলীল ভাষা, আকর্ষণীয় বর্ণনা এবং ঘটনার ঘনঘটার জন্য পাঠকদের মনোযোগ দাবি করে। যারা এই বিষয়ে গবেষণা করতে ইচ্ছুক তাদেরকেও এই উপন্যাসটি অনেক পথের শুরুর সন্ধান দিতে পারবে। এসব বিবেচনায় বাংলা ভাষায় সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘কসবি’ বাড়তি মনোযোগ দাবি করে।
সঞ্জয় দে’র ’রিগা থেকে সারায়েভো’ পড়া নেই। পড়ার আগ্রহ হলো।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘গ্রামের নাম কাঁকনডুবি’ কিশোরদের জন্য সত্যিই চমৎকার একটি উপন্যাস। রিভিউটিও খুবই ভালো লাগলো। এ বইটি মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে, কিন্তু মনে হয় সব কিশোরেরই পড়া উচিত। মানুষকে জীবনে অসংখ্যবার ‘চয়েস’ এর সঙ্কটে পড়তে হয়। জীবনের কোন প্রান্তে দাঁড়িয়ে কোন পথটায় এগিয়ে যেতে হবে, আর কোন পথটা বর্জন করতে হবে তা বুঝে ওঠা মুশকিল হয়। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়। অনেক সময়ই ভুল পথ নির্বাচন করা হয়, আর তাতেই জীবনের আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। মানুষের বোধের জায়গাটা ঠিকঠাক থাকলে, পথ নির্বাচনে ভুলটা কম হয়। আর সেজন্যই কিশোর কিশোরীদেরকে এই বইগুলো পড়ানো খুব জরুর।
মাহবুব আজাদের ‘হাবুলের জলদস্যু জাহাজ’ চমৎকার একটি বই। কিশোরদের জন্য দারুণ। প্রায় প্রতিটি গল্পই সুন্দর।
হরিশঙ্কর জলদাসের ‘কসবি’ যদিও অতোটা ভালো মানের মনে হয়নি। চমৎকার ডকুমেন্টেশন হয়তো বলা যাবে। কিন্তু উপন্যাস হিসেবে এটা তৈরি হয়ে ওঠেনি। বিশেষ করে তাঁর ‘জলপুত্র’ বা ‘দহনকাল’ এর মানের ধারেকাছেও যেতে পারেনি। মনে হয়েছে অসংখ্য জীবনের গল্প দুই মলাটের ঠাঁস বুনোটে আঁটানোর তড়িঘড়িতে পেয়েছিলো লেখককে, তাঁর কেবলই মনে হয়েছিলো জানা সবগুলো দুঃসহ গল্প পাঠকের সামনে উপচিয়ে দিতে হবে। তবেই পাঠক বুঝতে পারবে ব্যাপারটা। আর সেই তাগিদে একগাদা গল্প গছিয়ে দেওয়া হয়েছে পাঠকের সমীপে। পড়তে পড়তে একটা সময় ক্লান্তি হয়। জাহাঙ্গির মোহাম্মদ আরিফ বলেছেন বইটি পাঠকের বাড়তি মনোযোগ দাবি করে, আর আমি বলতে চাই ’কসবি’তে মনোযোগ ধরে রাখাটা সত্যিই একটা বড় সমস্যা। আমার নিজের অনেকটা যুদ্ধ করতে হয়েছে পুরোটা পড়তে। জলপুত্র বা দহনকাল বা কৈবর্তকথা বা রামগোলামে অতটুকু হয়নি। আমি বরঞ্চ বলতে পারি পান্ডুলিপি যখন তৈরি হচ্ছিলো, তখন লেখকেরই আরেকটু মনোযোগের প্রয়োজন ছিলো...’
সবশেষে বাংলাদেশের হৃদয় হতেই জাহাঙ্গির মোহাম্মদ আরিফকে ধন্যবাদ জানাই। চমৎকার চারটে বই নিয়ে আলোচনা করায়। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
সঞ্জয় দে বেশ অনেক কাল ধরে সচলায়তনে 'জীবনযুদ্ধ' নিকে লিখছেন। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও নিয়মিতভাবে ভ্রমণ বিষয়ক লেখা লিখে যাচ্ছেন।