বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১-এর পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর হল ১৯৭৫। ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫-এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান খুন হন এক সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে। ক্ষমতা দখল করেন খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ। ঠিক তিরাশি দিন পর ৬ নভেম্বর ১৯৭৫, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে পুনরায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, পদচ্যুত হন মোস্তাক আহমেদ। ক্যান্টনমেন্টে গুজব রটে খালেদ মোশারফ এবং এ টি এম হায়দার আসলে ভারতের এজেন্ট, বাংলাদেশকে ভারত সরকারের হাতে তুলে দেবেন এঁরা। ৭ নভেম্বর আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থান কর্নেল আবু তাহের এবং মেজর জেনারেল জিয়ায়ুর রহমানের নেতৃত্বে, নিহত হন ৬ নভেম্বরের দুই নায়ক। আমরা জানি বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সকলেই নিরাপদে দেশের বাইরে পালাতে সক্ষম হয়েছিল। গোটা নভেম্বর মাস জুড়ে বাংলাদেশে ঘটে চলে অভূতপূর্ব সব ঘটনা। এরপর বাংলাদেশ দীর্ঘকালের জন্য ঢুকে যাবে এক অন্ধকারে, ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও অর্জন মুছে দেবার চেষ্টা শুরু হবে, শুরু হবে রাজাকারদের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ। পাকিস্তান সরকার প্রথমেই বঙ্গবন্ধুর খুনকে স্বাগত জানিয়েছিল, ১৯৭৫-এর নভেম্বরে ও পরবর্তীতে সৌদি আরব ও চিন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। আসলে ঠিক কী কী ঘটেছিল ১৫ আগস্টের রাতে? ৬ ও ৭ নভেম্বরে? কারা ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, কারা বিপক্ষে আর কারাই বা সময় ও জায়গা বিশেষে চুপ থেকে সুবিধে করে দিয়েছে আততায়ীদের? এই সব নিয়েই সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে নানা কাহিনি ছড়িয়ে আছে বঙ্গভবন আর ক্যান্টনমেন্টের ছাউনির আনাচেকানাচে। নজরুল সৈয়দ তাঁর ‘নভেম্বর ১৯৭৫’ বইতে চেষ্টা করেছেন মিথ ও মিথ্যার জাল ছাড়িয়ে সত্যটুকু তুলে আনতে। বিভিন্ন সহায়ক গ্রন্থের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের ইতিহাসের সমীহ জাগানো কিছু চরিত্রের দিকে সরাসরি শক্তপোক্ত অভিযোগের আঙুল তুলেছেন নজরুল। আজকালকার প্রতিবেদনের ভাষায় যাকে বলে ‘কানেক্টিং দ্য ডট্স’ সেই কাজটি বিভিন্ন তথ্যের সমাবেশে করেছেন লেখক।
শঙ্খ ঘোষ জন্মেছিলেন ১৯৩২সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। অধুনা বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায়। সেখানেই ছিল কবির মামাবাড়ি। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। প্রাণচঞ্চল পদ্মাপারে কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো। দেশভাগের নিয়তি মাথায় নিয়ে তাঁকে আবাস গড়তে হয় পশ্চিমবঙ্গে। বাংলাদেশের সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে তাঁর লেখালেখিরও গভীর সম্পর্ক। এই বইয়ে তেমনই একগুচ্ছ লেখা একত্রে সংকলন করেছেন কবি পিয়াস মজিদ। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সামরিক শাসন, বাংলাদেশের কবিতা এসবই তাঁর এই লেখাগুলির মধ্যে ঘুরেফিরে এসেছে। ১৯৫০-এর দশকে লেখা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একটি কবিতায় লিখেছিলেন, “ওপারে যে বাংলাদেশ/ এপারেও সেই বাংলা।” এই কথাটিকে ঘুরিয়ে শঙ্খ ঘোষ অমর একুশের গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে বলেছিলেন, “এপারে যে বাংলা, ওপারেও সেই বাংলা।” সূচিপত্র দেখলেই গ্রন্থটির সম্পর্কে আগ্রহ জন্মাবে। একুশ, একাত্তর ও নববর্ষ নিয়ে কয়েকটি ভাগ রয়েছে এই গ্রন্থে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, গানের ভিতর দিয়ে, শিক্ষা আন্দোলন, স্মৃতি ও ভ্রমণ বিষয়ে মোট ২৩টি লেখা এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে শঙ্খ ঘোষের অন্তরঙ্গ রচনার সংকলন ‘সন্ধ্যানদীর জলে: বাংলাদেশ’।
পৃথিবীতে কার্ল মার্কসের অর্থনীতি তত্ত্ব ও সমাজতন্ত্রের চিন্তাভাবনা আজও প্রাসঙ্গিক। রাশিয়ার সমাজতন্ত্র একসময় বহু দেশের মানুষকে মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শ্রমিকশ্রেণির উন্নতি, ব্যক্তিমালিকানার উচ্ছেদ, কৃষিতে যৌথ উদ্যোগ, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সমাজতন্ত্রের প্রধান লক্ষ্য। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করে। তারই সূত্র ধরে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের তুলনামূলক আলোচনা এই গ্রন্থে দেখা যায়। সমাজতন্ত্র, সামাজিক গণতন্ত্র, কলকারখানা রাষ্ট্রীয়করণ, সর্ব স্তরে অবৈতনিক শিক্ষা ছিল ব্রিটেনের সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ। প্রতিবেশী ভারত তখন জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে এক ধরনের ‘সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পর সংবিধানে জাতীয় চার নীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা-র সমন্বয়ে সংবিধান রচিত হয়।
কিন্তু, সমাজতন্ত্র শুধুমাত্র কাগজের পাতাতেই লিপিবদ্ধ থেকে গেছে। ৫০ বছরে তার বাস্তবায়ন হয়নি। তৃতীয় বিশ্বের বহু মানুষের দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল সমাজের নীচু তলার শ্রমিকেরা একতাবদ্ধ হবে। যারা অপরের শ্রমের ফল আত্মসাৎ করে, শ্রমিকশ্রেণি তাদের উৎখাত করবেই। সমাজতন্ত্র ব্যবস্থাটির প্রবর্তনে লেনিন ও তার অনুসারীদের ক্রিয়াকাণ্ড এবং মার্কসের তত্ত্ব ও মতাদর্শের মধ্যে কতটা সামঞ্জস্য ছিল তা বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। বাস্তবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থাটি কতটা যুক্তিযুক্ত, এর বিকল্প কিছু আছে কি না, গ্রন্থটিতে এই প্রশ্নগুলিরও উত্তর অনুসন্ধান করা হয়েছে।