প্রেমিকাকে বিরল দুধরাজনাগ সাপের খেলা দেখাতে গিয়ে সাপ-পাগল এক যুবার সর্পদংশনে মৃত্যু স্থানীয় হাসপাতালে অ্যান্টিভেনাম সিরাম না থাকায়। কল্পধন্বন্তরির আশায় মৃতদেহ মঞ্জুষে শুইয়ে মনসার ভাসান গাইতে গাইতে গ্রামবাসীর নদীপথে যাত্রা। আশাভঙ্গে অবশেষে মৃতকে গঙ্গায় অর্পণ। তিন দশক আগের মালদা-সন্নিহিত নদীবহুল উত্তরবঙ্গের পটভূমিতে রচিত আখ্যান। অভিজিৎ সেনের নতুন উপন্যাস নাগমঙ্গল। পাঠ করলেন শিক্ষাবিদ ও লেখক অমিয় দেব
অভিজিৎ সেনের ‘নাগমঙ্গল’ কোনো নতুন ‘মনসামঙ্গল’ নয়। কোনো চাঁদ বেনে এখানে নেই, নেই মনসাদেবীও, যদিও তাঁর পূজা আছে—বেশ বড়ো করেই আছে। তবে তিনি যে নাগমণ্ডলের অধীশ্বরী তার কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞান নেই, কিন্তু তা নিয়ে বিশ্বাস আছে। লৌকিক স্তরে। আর এ-বিশ্বাসও আছে যে কারও সর্পদংশনে মৃত্যু হলে তাকে বাঁচিয়ে তুলতে কলার মান্দাসে শুইয়ে নিয়ে মনসার ভাসান গাইতে গাইতে নদীবক্ষে ভেসে যাওয়াই শ্রেয়। বেহুলা-লখিন্দরের উপমান আজও জাগ্রত। এ-গল্পে এক লখিন্দর-তুল্য নবযুবা আছে বটে এবং সর্পদংশনে তার শেষ পর্যন্ত মৃত্যুও হয়েছিল, কিন্তু দংশনের কারণ সে নিজেই। সে সাপ-পাগল, যখন কোনো বড়ো গোখরো ফণা তুলে দাঁড়ায় তখন তার মুগ্ধতার অন্ত থাকে না—তার গ্রামের বাৎসরিক বিষহরি মেলায় সে প্রায় সাপুড়েদের সঙ্গেই থাকে। এবার তার নবার্জিত বেহুলাপ্রতিম প্রেমিকাকে এক বিরল দুধরাজনাগ দেখাবে বলে নেশাগ্রস্ত সাপুড়েকে দিয়ে সেই সাপ ঝাঁপি থেকে বার করিয়ে, তাকে নিজেই একটু খেলাতে গিয়ে শেষরক্ষা করতে পারেনি। আর, কাছাকাছি দুই হাসপাতালে গিয়েও যখন অ্যান্টিভেনাম সিরাম পাওয়া গেল না, এবং শহরগামী ট্রেনের খালি দেরিই হতে লাগল, আর ফলে একসময় যুবক মারাই গেল, তখন তাকে গ্রামে ফিরিয়ে এনে এক মঞ্জুষে শুইয়ে নিয়ে মনসার ভাসান গাইতে গাইতে নদীপথে যাত্রা শুরু হল। এক নদী থেকে আর-এক নদী করে গঙ্গায়। অবশেষে কোনো কল্পধন্বন্তরিরও আশা ছেড়ে দিয়ে এই নব-লখিন্দরকে গঙ্গায়ই অর্পণ করে দেওয়া হল।
এ-গল্পের ঘটনাস্থল মালদা-সন্নিহিত নদীবহুল উত্তরবঙ্গ। কথকের জবানে একত্রিশ বছর আগের ঘটনা, তিনি ও তাঁর এক তর্কপ্রিয় বন্ধু—দুজনেই অধ্যাপক—এর সাক্ষী। যুবকটি তাঁদের ছাত্র। তারই আগ্রহে এবং তার বাবার আমন্ত্রণে তাঁরা করন্ডি গ্রামের বিষহরি মেলায় আসেন। ছাত্রকে সাপে কাটার পরে তাঁরা তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় সঙ্গী হয়েছিলেন, এবং বিশ্বাস না থাকা সত্ত্বেও অবস্থাবিপাকে তার মঞ্জুষ-ভাসানেও সঙ্গী ছিলেন। তবে তাঁদের দুজনের স্বভাবে খানিক বৈষম্য ছিল: কথক কিঞ্চিৎ আবেগপ্রবণ, বন্ধুটি তা নন। ছাত্রের ঈদৃশ মৃত্যুর পর কথক যখন ভেঙে পড়ছেন, তখন হাল ধরছেন বন্ধুটিই। এবং শেষাবধি ছাত্রের সঙ্গে তাঁদের দুজনের থাকার সিদ্ধান্তও তাঁরই।
উপন্যাস যে এক আখ্যানমাত্রই নয়, আরও অনেক কিছু—আনুষঙ্গিক বা পুরোপুরি আনুষঙ্গিক হয়তো নয়ও—তার এক উদাহরণ এই ‘নাগমঙ্গল’। এর অনেকটা জুড়ে আছে নাগ বা সর্পকথা। তার মুখ্য উৎস মহাভারতের আদিপর্ব—বিশেষত তক্ষকের পরীক্ষিৎ-দংশন ও জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞসহ তার বিবিধ কার্যকারণ, রুরু-প্রমদ্বরা প্রমুখ নানান কাহিনি—ও বিস্তর অনুপুঙ্খ সহযোগে মধ্যযুগীয় বাংলার মনসামঙ্গল। লোককথাও আছে, আছে সেই নৃতাত্ত্বিক বয়ানও যে সাপ নানা সভ্যতায়ই উর্বরতার প্রতীক। সেইসঙ্গে আছে এক প্রিয় গ্রন্থ আমাদের কথকের, তারাশঙ্করের ‘নাগিনীকন্যার কাহিনী’। তাঁর ছাত্রের ধরনে না হলেও তাঁর সাপ নিয়ে কৌতূহল অপার। তাঁর বন্ধুটির অবশ্য তা নয়। তাঁদের বৈষম্যেই, বস্তুত, তাঁরা এই উপন্যাসের অন্তর্বর্তী আখ্যানের যুগ্ম অভিভাবকতুল্য হয়ে উঠেছেন। আবার এই আখ্যানের নেপথ্যে যে-মনোভাণ্ডার তারও তাঁরা দ্বৈত কাণ্ডারী। লেখক অভিজিৎ সেন এক আখ্যানের অবতারণা করে তৎসম্পর্কিত সকল ভাবনার দায় তাঁর পাঠকের উপরে চাপিয়ে দিচ্ছেন না। কিছু সুতো ছেড়ে রাখছেন। প্রসঙ্গত, প্রকৃতির সঙ্গে কতটা দ্বন্দ্ব শোভন মানুষের তা নিয়ে কি এক এঙ্গেলসীয় তত্ত্বেরও তিনি শরণ নিচ্ছেন?
এক গল্প কী করে আর-এক গল্প টেনে আনে তাও বোধকরি উপন্যাসেরই আওতায় থাকে। এই লখিন্দরের যে-বেহুলা, নাম মৈথিলী, তার অপরাধবোধ তো গোড়ায় খুব তীব্র হবারই কথা (বিমল তো তার প্রেমেই সাপ নাচাতে গিয়েছিল)। হয়েওছিল। উন্মাদপ্রায় তাকে আটকে না রাখলে সে বিমলের মঞ্জুষে গিয়েই উঠত—মনসামঙ্গলের অবভাস উচ্ছ্রিত হত। বড়ো হয়ে সে আমাদের কথকের কাছে গবেষণা করতে এল। থিসিসের বিষয় বাছল সে নিজেই: ‘মনসামঙ্গলের বিবর্তন: আখ্যানের ভাঙাগড়া’। ভালো কাজ করল, পরীক্ষকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেল। তার সন্দর্ভ যে অন্তঃস্তরে তারই বোধ থেকে জাত তাতে সন্দেহ নেই। একত্রিশ বছর পর সে আজ পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, কিন্তু বিয়ে করেনি। অভিজিৎ সেনের নাগমঙ্গলে কি মনসামঙ্গলের** এক ছোপ লেগে রইল?
পটচিত্রে মনসামঙ্গল। শিল্পী ময়না চিত্রকর
তবে মনসামঙ্গল তাঁর অভীষ্ট না হলেও মনসামঙ্গলের কোনো কোনো উপকরণ তাঁর আখ্যানের কাঠামো জুড়ে আছে। বিমল-লখাইয়ের মঞ্জুষে যে-জিয়নগীতি গায়েনদের গলায় ঘুরে ঘুরে ধ্বনিত হয়ে উঠছে তা জগজ্জীবন ঘোষালের ‘মনসামঙ্গল’-খ্যাত ‘চিয়াও চিয়াও, চান্দোর পুত্ররে ডংক চিয়াও চিয়াও!’ (চাঁদ তো এখানে নিতান্ত উপমান!) কথক হিসেবে লেখকের বেশি প্রিয় অবশ্য কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ। কেতকাদাস কী করে মঙ্গলে অনুপ্রাণিত হলেন তা নিয়েও তাঁর কিঞ্চিৎ ভণিতা আছে, মুখ্যত তাঁর তর্কপ্রিয় বন্ধুর সকাশে। বন্ধু নিজে ধার্মিক না হলেও ধর্ম বোঝেন, কিন্তু সংস্কার তথা অবোধ বিশ্বাস? তাতে কি তাঁর মন স্বতই সায় দেয়? আর, সাপে আমাদের কথকের অগাধ আকর্ষণ বলেই কি তিনি মনসায় মন দিতে চান? অবশ্য, মহাভারতের সর্পযজ্ঞ-নিবারক আস্তিকের মাতা সর্পিণী জরৎকারুতে মনসার পূর্বাভাস কতটা আছে? যে কালনাগ লখিন্দরকে দংশন করেছিল তার সঙ্গে যদি জনমেজয়-দংশী তক্ষকের সাদৃশ্য দেখি, তাহলে তো বলতে হয় তেমন নেই, কারণ জরৎকারু তক্ষকের ভগ্নী। তবে পুরাণের পূর্বাপর নির্ণয় খুব সহজ নয়। বিশ্বাসের উদ্ভব তো যুক্তিতর্ক মেনে হয় না, লৌকিক জীবনযাত্রা থেকে হয়। (কোথাও কোথাও তো শুনেছি সাপের মুখে পড়লে ‘আস্তিক আস্তিক’ বলতে হয়। আর অবশ্যই এই সংস্কার নিয়ে কথক হাসিঠাট্টা করবেন না। লেখক কি করবেন?)
এই উপন্যাসে লেখক নিজেকে দ্বিধাবিভক্ত করেছেন। একদিকে তিনি কথক, নাম বিনয়, অন্যদিকে তিনি কথকের বন্ধু, নাম অরুণাংশু, বুদ্ধির আভায় উজ্জ্বল। নামদুটো বোধ করি আপতিক নয়। বিনয় ছাড়া কি অপর মানুষের সন্নিধানে যাওয়া যায়, আর বুদ্ধি না থাকলে কি তাকে বুঝে ওঠা সম্ভব? একত্রিশ বছর আগের ওই সর্পদংশনের ঘটনা নিয়ে দুই বন্ধুর স্মৃতিচারণ এই উপন্যাসের এক মোড়ক, তা খুলতে খুলতে আমরা আখ্যানে ঢুকি। ওই পারস্পরিকতা বাদ দিয়ে ঠিক উপন্যস্ত হয় না এই উপন্যাস। কথককে লেখা তাঁর বন্ধুর এক চিঠি আছে এখানে, যাকে এর এক দাঁড়া-ও বলা যেতে পারে। মানুষজীবন নিয়ে লেখকের আস্থায়ীই হয়তো এখানে বেজে ওঠে। আর আভোগ বোধ করি গ্রন্থশেষে, যখন মৈথিলীর থিসিস-শেষের আত্মকথন আমরা শুনি ও বন্ধুটি বলে ওঠেন, ‘ধর্ম এবং সংস্কৃতির আধিপত্যের লড়াই বোধহয় পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত থাকবে। যারা জোর করে ধর্মকে দমাতে গিয়েছিল, তারা নিজেরাই দমে গেল।’
অভিজিৎ সেনের ‘নাগমঙ্গল’ বেরিয়েছে ২০১৯-এর ডিসেম্বরে। এ-বছর মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে তো আমরা কোভিড-১৯ হেতু লকডাউনে আছি। মাঝখানে আমফানে বইপাড়া বিপর্যস্ত হয়েছে। এখন খুললেও সেই বিপর্যয়ের চিহ্ন পুরো মুছে যায়নি। তা ছাড়া পরিবহনের অপ্রতুলতায় যারা বইপাড়া সচল রাখে তারাও তেমন এসে উঠতে পারছে না। টিমটিম বাতি জ্বলছে মাত্র। জানি না এ-বই পাঠকের কাছে কতটা পৌঁছেছে। বছর তিনেক আগে অবশ্য ‘স্বরান্তর’ পত্রিকায় এ-লেখাটা বেরিয়েছিল। তা-ই বা কতটা দৃষ্টিগোচর হয়েছিল জানি না। আমি কি রিভিউ লিখে ঘোড়ার আগে গাড়িটা বসিয়ে দিলাম? রিভিউ-ধর্মের অনর্থ ঘটিয়ে থাকলে, রিভিউ-পাঠক আমাকে মার্জনা করবেন।
‘নাগমঙ্গল’। অভিজিৎ সেন। অক্ষর প্রকাশন। ডিসেম্বর ২০১৯। মূল্য ২০০ টাকা। প্রাপ্তিস্থান — দে’জ পাবলিশিং। শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট। কলকাতা। অক্ষর প্রকাশন। ৭৩ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট (দোতলা)। কলকাতা ফোন নং: ৯৩৩০৩১১৩০৮
বাড়িতে বসে বইটি পেতে হোয়াটসঅ্যাপে বা ফোনে অর্ডার করুন +919330308043 নম্বরে।
**পদ্মাপুরাণ বা মনসামঙ্গল। বিজয় গুপ্ত। সম্পাদক: বসন্তকুমার ভট্টাচার্য্য। নিখরচায় পড়তে বা ডাউনলোড করতে এই লিঙ্কে যান —মনসামঙ্গল
ভারি তথ্যপ্রদ ও সরস আলোচনা।
বইটি সংগ্রহ করতে হবে।